নীলক্ষেতের কপিবইয়ের ব্যবসার জটিল জগতে
নীলক্ষেত এলাকা দিয়ে হেঁটে গেলে আপনার চোখ পড়বে চেনা-অচেনা লেখকদের অসংখ্য ইংরেজি উপন্যাস ও আত্মোন্নয়নমূলক বইয়ের ওপর। কখনো সেগুলো দেখা যায় কাঠের চেয়ারের ওপর জড়ো করা অবস্থায়। আবার কখনো দেখা যায় ছোট ছোট দোকানের তাকগুলোতে ঠাসা অবস্থায়।
এছাড়াও অনেক আন্তর্জাতিক বেস্টসেলার এবং জনপ্রিয় বই রয়েছে যা থেকে পরবর্তীতে সিনেমা বানানো হয়েছে। সারা বিশ্বে প্রতি বছর হাজার হাজার বই প্রকাশিত ও বিক্রি হয়। নীলক্ষেতে এই বইগুলোর কপি পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
এই বইগুলো অবশ্য হার্ডবাউন্ড বা আসল চকচকে সংস্করণ নয়। এগুলো মূল প্রকাশনার পাইরেটেড কপি। তাই নীলক্ষেতের বইবিক্রেতারা এগুলো বেশ কম দামে বিক্রি করেন।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এখানকার বই ব্যবসায়ীরা কীভাবে বোঝেন কোন বইটি ছাপা যাবে আর কোনটি বাদ দেবেন? বাংলাদেশি পাঠকরা কোন বইটি বেশি পছন্দ করবে, তা বইবিক্রেতারা বোঝেন কী করে?
নীলক্ষেত ও সারা দেশে প্রতি বছর প্রকাশিত ও বিক্রি হওয়া এসব বইয়ের বিক্রির পরিমাণের সঠিক তথ্য নেই। তবে সংশ্লিষ্টদের ধারণা অনুযায়ী, বছরে অন্তত ৪ লাখ পাইরেটেড বই বিক্রি হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বইবিক্রেতা বলেন, 'এখানে প্রায় ৫০০টি বই রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটির ২০ হাজার কপি, আবার কোনোটির ৫০০ কপি আছে।'
কপিবই প্রকাশকরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রিভিউ ও হাইপের ওপর ভিত্তি করে এসব বই প্রকাশনার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। সেইসাথে যেসব বইপ্রেমী নিয়মিত বই কেনেন, তাদের পরামর্শের ভিত্তিতেও তারা বই প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন।
কিছু বই হিট হয় এবং রমরমা ব্যবসা করে। আবার ভুল বই বাছাইয়ের কারণে কিছু বই বিক্রি হয় না, তখন লোকসানে পড়েন বিক্রেতারা।
ব্যবসাসংশ্লিষ্টদের তথ্যানুসারে, কপিবইয়ের প্রকাশকরা খরচ বাঁচাতে অন্তত ১ হাজার কপি বই মুদ্রণ করেন।
আন্তর্জাতিক বাজারে একটি বই প্রকাশিত হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে এর পিডিএফ সংস্করণ ডার্ক ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়। কপিবই বিক্রেতারা সেগুলো ডাউনলোড করে প্রিন্ট করে নেন। কখনও কোনো বই ডার্ক ওয়েবসাইটে পাওয়া না গেলে আসল বই কিনে এর বেশ কয়েকটি প্রিন্ট বের করেন।
এই ব্যবসার বড় তিন প্রকাশক
শিল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, নীলক্ষেতে কপি ও প্রকাশনা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বড় তিন 'কপিবুক প্রকাশক' হলো তাজিন বইঘর, মলি প্রকাশনী ও ওরিয়ান পাবলিকেশন্স।
মোহাম্মদ ফয়েজ তাজিন বই ঘরের অন্যতম মালিক। দোকানটি নীলক্ষেতের বাবুপুরা মার্কেটের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। গত আট বছর ধরে বই ব্যবসার সাথে জড়িত আছেন ফয়েজ। তিনি জানান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা মূলত পাঠকদের সুপারিশের ভিত্তিতেই বই ছাপান। তিনি বলেন, 'ইন্টারনেটে বই দেখে তারা আমাদের বলে দেন তারা কোন বইগুলো চান এবং কোনগুলো সবচেয়ে বেশি বিক্রি হবে।'
ফয়েজ আরও বলেন, অনেকসময় তারা ফেসবুক ও ইউটিউবের রিভিউ দেখেও বই ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেন।
প্রথমে তারা বইয়ের একটি ফটোকপি সংস্করণ বাজারে ছাড়েন। যদি বিক্রি যথেষ্ট হয়, তখন তারা প্রেস থেকে আরও কপি মুদ্রণ করেন।
কিছু অনলাইন বই বিক্রেতা আছে, যারা কোনো বিশেষ বই জনপ্রিয় হলে সেই বইয়ের চাহিদা সম্পর্কে এই প্রকাশকদের জানায়। ওই অনলাইন বিক্রেতারাই বইগুলো অনলাইনে বিক্রি করার দায়িত্ব নেয়।
নীলক্ষেতে যেকোনো দোকানমালিক যেকোনো বই ছাপতে পারেন। এতে কোনো বিধিনিষেধ নেই। কিন্তু কোনো বই প্রকাশের জন্য প্রকাশকদের অবশ্যই ছাপাখানার সাথে চুক্তিতে থাকতে হবে।
তবে মূল লেখক ও প্রকাশকদের কাছ থেকে স্বত্ব না নিয়ে বই ছাপানো সারা বিস্বের—এমনকি বাংলাদেশেও—একটি গুরুতর অপরাধ। তা সত্ত্বেও কিছু সিন্ডিকেট এবং প্রভাবশালী দোকানমালিক দীর্ঘদিন ধরে মেধাস্বত্ব লঙ্ঘন করে এই বই পাইরেসির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ।
পাইরেটেড বই ব্যবসার সাথে জড়িত দোকান মালিকদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কখনও কোনো অভিযান পরিচালনা করেছে কি না জানতে চাইলে ফয়েজ বলেন, তার জানামতে তেমন কোনো অভিযান হয়নি।
তিনি দাবি করেন, 'বিদেশি বই ছাপানো বেআইনি বলে আমার জানা নেই।'
পাইরেটেড বইয়ের বাজারের আরেক বড় ব্যবসায়ী মলি প্রকাশনীর মালিক মজিবর রহমানও একই কথা বলেন।
তবে এই ব্যবসাসংশ্লিষ্ট একজনের তথ্যমতে, এসব ব্যবসায়ী দীর্ঘদিন ধরেই এই ব্যবসায় রয়েছেন। কাজেই এই কাজটি যে অবৈধ, সেটি তাদের অবশ্যই জানার কথা। তবু তারা আইনের তোয়াক্কা না করে এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
অনেক দল রয়েছে যারা ফিকশন এবং নন-ফিকশন বই ছাড়াও বিদেশি অ্যাকাডেমিক বই ছাপার সাথে জড়িত। এর মধ্যে রয়েছে ব্যবসায় প্রশাসন, চিকিৎসা, প্রকৌশল ও আইনের বই।
আমরা যখন ফয়েজের সাথে কথা বলছিলাম, তখন তিনি জেমস ক্লিয়ারের আত্মোন্নয়নমূলক বই 'অটোমিক হ্যাবিট', রবার্ট কিয়োসাকি ও শ্যারন লেখটারের 'রিচ ড্যাড অ্যান্ড পুওর ড্যাড' বিক্রি করছিলেন। ড্যান ব্রাউনের 'ইনফার্নো' এবং কলিন হুভারের 'ইট স্টার্টস উইথ আস'সহ অন্যান্য জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোও বিক্রি করছিলেন তিনি।
মলি প্রকাশনীর মজিবর রহমান আরও জানান, বই ছাপানোর জন্য বিশেষ করে গ্রাহকরা তাদের ধারণা ও পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, 'আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমরা যখন জানতে পারি যে একজন জনপ্রিয় লেখকের বই প্রকাশিত হয়েছে, প্রথমে প্রায় ৫০০ কপি প্রকাশ করি। ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেলে আমরা আরও ৫০০ কপি প্রকাশ করি।' মজিবর জানান, আজকাল তিনি কমিকও ছাপাচ্ছেন, বিশেষ করে মাঙ্গা (জাপান থেকে উদ্ভূত গ্রাফিক উপন্যাস)।
সব সিদ্ধান্ত ঠিক হয় না
ড্যান ব্রাউন 'দ্য দা ভিঞ্চি কোড'সহ বেশ কয়েকটি বেস্টসেলিং উপন্যাসের লেখক। বাংলাদেশেও তার উপন্যাসগুলো দারুণ জনপ্রিয়। আর নীলক্ষেতে এ লেখকের বইয়ের প্রচুর কপি পাওয়া যায়। তার শেষ বইটি ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।
মজিবর রহমান বলেন, 'আমরা ড্যান ব্রাউনের "অরিজিন" এবং "ইনফার্নো" প্রকাশ করেছি। এখন আমরা তার নতুন বইয়ের জন্য অপেক্ষা করছি।'
বেস্টসেলিং লেখক জে কে রোওলিংয়ের হ্যারি পটার সিরিজ বাংলাদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। কপিবুক প্রকাশকরা এ বই নিয়ে ভালো ব্যবসা করেছেন।
তাজিন বইঘর এবং মলি প্রকাশনীও হ্যারি পটার সিরিজ প্রকাশ করেছে।
কপিবুক প্রকাশক ফয়েজ বলেন, 'কিছু বই আছে যেগুলোর ১৫-২০ কপি আমরা বিক্রি করতে পারি। এমনও সময় গেছে যখন আমাদের অবিক্রীত বইগুলো কেজি দরে বিক্রি করতে হয়েছে। কিছু বই বিক্রি হতে প্রায় পাঁচ বছর লাগে।'
সাদিকুজ্জামান স্বপ্নীল নীলক্ষেতের ইসলামিয়া মার্কেটে 'শপনীল বুকস্টোর' নামে একটি বইয়ের দোকান চালান। এছাড়াও তিনি 'নীলক্ষেত বইয়ের বাজার' ফেসবুক পেইজে অনলাইনে বই বিক্রি করেন।
তিনি জানান, হ্যারি পটার সিরিজের বইয়ের চাহিদা কয়েক বছর আগের তুলনায় কমে গেছে। এর কারণ নতুন কোনো সিরিজ বের হয়নি বলে জানান তিনি। হ্যারি পটার সিরিজের সপ্তম বই 'হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ডেথলি হ্যালোস' ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।
স্বপ্নীল বলেন, 'সিরিজের পরের বইটি যখন প্রকাশিত হবে, তখন চাহিদা আবার বাড়বে।' তিনি জানান, বর্তমানে কপিবইয়ের বাজারে অনুপ্রেরণামূলক বই আধিপত্য বিস্তার করছে।
আমাদের সাথে শেয়ার করে তিনি বলেন, 'এখন অ্যাটমিক হ্যাবিট, দ্য পাওয়ার অভ নাউ, হান্ড্রেড ডলার স্টার্ট-আপ এবং দ্য সাইকোলজি অভ মানি সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে।'
মেধাস্বত্ব সংরক্ষণকর্মী এবং প্রকাশনা শিল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নীলক্ষেত এলাকায় মেধাস্বত্ব লঙ্ঘনের জোরালো সমালোচনা করেন।
দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বই প্রকাশক দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের (ইউপিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহরুখ মহিউদ্দিন বলেন, তারা সৃজনশীল এবং জ্ঞানভিত্তিক বিষয়বস্তুকে উৎসাহিত করার স্বার্থে মেধাস্বত্ব রক্ষার প্রয়োজনীয়তায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন।
তিনি আরও বলেন, 'আমি মনে করি স্থানীয় প্রকাশক ও লেখক/কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের স্বার্থ রক্ষা এবং তাদের কপিরাইট অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অপরিহার্য দায়িত্ব। স্থানীয় বাজারে পাইরেটেড বইয়ের বিষয়টি আমি দেখব, কারণ এমন কাজ কোনোভাবেই চালিয়ে যেতে দেওয়া চলে না।'
মহিউদ্দিন বলেন, 'দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি বড় অংশ পাইরেসির বাজারের ওপর নির্ভরশীল। এমনকি স্থানীয় প্রকাশকরাও এর শিকার হয়েছেন।'
তিনি আরও বলেন, সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারের মধ্যে (যেমন ছাত্র, শিক্ষক এবং সাধারণ পাঠকদের) সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। এর দেশের কপিরাইট অফিস ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার প্রয়োজন।