শামসুদ্দিন অ্যান্ড সন্স: ১১২ বছর পর ঢাকার প্রথম বন্দুকের দোকান যেমন আছে…
যুবা বয়স শামসুদ্দিনের। কলকাতায় গেলেন। আঠারশ আশির দশক। বন্দুক তৈরির প্রতিষ্ঠান ম্যান্টন অ্যান্ড কোম্পানিতে কাজ নিলেন। ১৮২৫ সালে ফ্রেডরিক ম্যান্টন এটি প্রতিষ্ঠা করেন, ১৮৪৭ সালে চলে যায় উইলিয়াম রবার্ট ওয়ালিসের মালিকানায়, ওয়ালিস ১৮৭৮ সালে অবসরে গেলে তার ছেলেরা দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তারা এতোটাই নাম করেছিলেন যে ভারতে ব্রিটিশ রাজের নিযুক্ত সব ভাইসরয় তাদেরকেই গানমেকার হিসাবে নিয়োগ দিত।
শামসুদ্দিন এমন একটা জটিল ও বিরল কাজে যুক্ত হতে পারলেন কীভাবে? প্রশ্নটি করেছিলাম শামসুদ্দিনের নাতি ড. মোমতাজউদ্দিন আহম্মদকে।
মোমতাজউদ্দিন বলেছিলেন, "এটি তার রক্তে ছিল। আমাদের শেকড় মধ্য এশিয়ায়। আগ্রা ও দিল্লীর মুঘল দরবারে আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রভাবশালী ছিলেন। ঢাকায় ইসলাম খানের সঙ্গে আমাদের ঊর্ধ্বতন দশম পূর্বপুরুষ এসেছিলেন অস্ত্রবিশারদ হিসাবে। মুর্শীদকুলি খাঁ রাজধানী ঢাকা থেকে সরিয়ে নিলে আমাদের দাদা-পরদাদারাও মুর্শিদাবাদ চলে যান। পরে নায়েবে নাজিম জেসারত খাঁর (১৭৬৫-১৭৭৮) আমলে আমাদের ঊর্ধ্বতন পঞ্চম পূর্বপুরুষ মুন্সী তুরকানকে সরকারি কাগজপত্র লেখার কাজে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। তিনি পাহলোয়ান ছিলেন, তার আখড়া ছিল, তিনি মারা যাওয়ার পর ছেলে উমরাও আখড়া পরিচালনা করতেন বলে খলিফা পদবি পান। ১৮৫৭ সালের ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তারা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন বলে তাদের আগা মাসিহ লেনের বাড়িঘর ইংরেজরা দখল করে নিয়েছিল। তাই ধারণা করা অসংগত নয় যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আগ্রহ দাদা শামসুদ্দিনের তৈরি হয়েছিল বংশপরম্পরায়। যেটি পরে তার ৭ ছেলের মধ্যেই বিস্তৃত হয়েছিল।"
১৯৪৭ সালে আশি বছর বয়সে শামসুদ্দিন আহাম্মদ মারা যান। খাজে দেওয়ানের বাড়িতেও তিনি বন্দুক ও যন্ত্রাংশ তৈরির ওয়ার্কশপ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ছেলেদের সবারই ততদিনে হাতেখড়ি হয়ে গেছে। বড় দুই ছেলে রীতিমতো যন্ত্রাংশ সংযোজন ও সারাইয়ে হাত পাকিয়ে ফেলেছেন।
১৯১২ সালে শামসুদ্দিন অ্যান্ড সন্স
ম্যান্টন কোম্পানির লাহোর, বোম্বে, হায়দ্রাবাদ, দিল্লীতে ডিলার ছিল। কলকাতায় ছিল প্রধান অফিস। শামসুদ্দিন ইংরেজ ওস্তাদের কাছ থেকে অস্ত্রবিদ্যার শিক্ষা পেয়েছেন। তিনি ফ্লিন্ট লক, ম্যাচ লক, গাদা বন্দুক, মাজললোডার, পিস্তল, রিভলভার, রাইফেল সারাইয়ের কাজ জানতেন। এটা তখন ছিল একটা উঁচু মানের বিদ্যা। গানস্মিথ বলে পরিচিত ছিলেন। অভিজাত ও ধনী লোকদের সঙ্গে তার চলাফেরা ছিল। অস্ত্র ব্যবসা যেমন লাভজনক ছিল, বন্দুক সারিয়েও ভালো উপার্জন করতেন।
বন্দুক তিন কারণে রাখত তখন লোকে: শিকারের শখে, ডাকাতের ভয়ে আর আভিজাত্য বোঝাতে। তাই পূর্ববঙ্গে বন্দুকধারীর সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। অথচ ভালো গানস্মিথ ছিল না একজনও। তাই বন্দুক সারাতে কলকাতায় না গিয়ে উপায় ছিল না। বন্দুক আদুরে যন্ত্র, ঝাড়পোঁছ করা লাগে নিয়মিত, তেল-পানি দিতে হয় নইলে বোল্ট খুলে যায়, ঘোড়া আলগা হয় বা বাট ক্ষয়ে যায়। আগ্নেয়াস্ত্রে আরো থাকে ট্রিগার, ম্যাগাজিন, সিলিন্ডার, ফ্রন্ট স্ট্র্যাপ, সেফটি ক্যাচ, স্লাইড স্টপ, ব্যারেল, মাজল, এক্সট্রাক্টর, ইজেক্টর বা বাটস্টক। বিজ্ঞান ভালো না বুঝলে গানস্মিথিং কঠিন, আরো লাগে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা। তাই শামসুদ্দিনকে নবাব সলিমুল্লাহ, ঢাকার জিওসি ডালস্মিথ এবং আরো সব জমিদার, তালুকদারেরা একরকম মিনতি করেই ঢাকায় ফিরিয়ে আনলেন।
১৯১২ সাল। চকবাজারে শামসুদ্দিন আহাম্মদ অ্যান্ড সন্স নামে একটি বন্দুকের দোকান বসল। এর আগে ঢাকাবাসী বন্দুকের দোকান দেখেনি। শাহী মসজিদের পাশের গলিতে, একটু ভিতর দিকে দোকানটি। লম্বা, গৌরবর্ণ বলিষ্ঠ দেহধারী শামসুদ্দিন মেহগনি কাঠের পাল্লা দিয়ে ভিতরের খোপে সার ধরে বন্দুক রাখলেন। একটা লোহার লকারে রাখলেন পিস্তল, রিভলভার বা শটগান। সদর দরজা বানালেন শক্তপোক্ত লোহা কাঠ দিয়ে। পাকা দালান ছাড়া বন্দুকের দোকান বসানো নিষেধ, লাইসেন্স না থাকলে অচেনা কাউকে ঢুকতে দেওয়ারও অনুমতি নেই-নিয়মনীতি মেনে দোকান চালাতে লাগলেন শামসুদ্দিন।
নবাব অবাক হয়ে গিয়েছিলেন
নবাব সলিমুল্লাহর সঙ্গে শামসুদ্দিনের প্রথম পরিচয়ের ঘটনাটা মজার। কলকাতা থেকে ছুটিতে এসেছেন ঢাকায়। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন একটি ম্যাচলক বন্দুক। একদিন চললেন বেগুনবাড়ি, নবাবদের উন্মুক্ত চিড়িয়াখানা ছিল সেখানে। ঘোরাঘুরি করতে করতে একটি হরিণ পেয়ে নিশানা ছুড়লেন শামসুদ্দিন । খবর পেয়ে নবাবের পেয়াদারা হাজির হলেন। শামসুদ্দিনকে নিয়ে গেলেন নবাবের কাছে, একের পর এক প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করলেন, কেন হরিণ মারলেন? কেমন শিকারি আপনি? কোথায় গুলি করেছেন?
সরেজমিনে দেখা গেল বুকের যেখানে পাকা শিকারি গুলি বেঁধায়, শামসুদ্দিনও তাই করেছেন। নবাব পুলকিত, বললেন, আমার সঙ্গে শিকারে চলুন। আপনার পরীক্ষা হয়ে যাবে। সেবার টানা দশটি গুলি টার্গেটে লাগিয়ে শামসুদ্দিন অবাক করে দিয়েছিলেন নবাব ও তার সঙ্গীদের। তারপর থেকে হেকিম হাবিবুর রহমান, নবাব সলিমুল্লাহ, ডালস্মিথদের শিকার সঙ্গী হয়ে গিয়েছিলেন শামসুদ্দিন। ছুটি শেষ হলে শামসুদ্দিন ফিরে গিয়েছিলেন তার কলকাতার কর্মস্থলে।
এদিকে নতুন নতুন বন্দুক আসে, পুরানো বন্দুকের এটা ওটা নষ্ট হয়, ঢাকার শিকারিরা হায় হায় করে। শিকার তখন নিষিদ্ধ ছিল না বরং শৌখিন ও মর্যাদাপূর্ণ এক খেলা ছিল। ওই আমলে ঢাকার আশপাশের বনজঙ্গলে বিশেষ করে শীত মৌসুমে শিকারিরা নৌকা, বজরা বা লঞ্চে চেপে শিকারে বের হতেন। চর ও বিলে পাখির অভাব ছিল না তবে দক্ষ শিকারিদের টার্গেট থাকত হরিণ, বাঘ বা বুনো শূকর। দুর্গম এলাকার লোকজন অনেকসময় বাঘ বা শূকরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সাহায্য চাইত। বাঘ, হরিণ, শূকর, গন্ডার শিকারের বন্দুক ছিল আলাদা আলাদা। হাতি মারার বন্দুকও কিন্তু ভিন্ন। কোন এলাকায় কী ধরনের প্রাণীর উপদ্রব, তা জেনে তেমন বন্দুক নিয়ে যেতেন শিকারি। ঢাকায় শামসুদ্দিন দোকান দিয়ে বসায় শিকারিরা তাই হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন।
সাত ছেলের হাতেখড়ি
শামসুদ্দিনের সাত ছেলের মধ্যে সবার বড় সামিরুদ্দিন, তারপর ফকরুদ্দিন, দলিলউদ্দিন, ইসলামউদ্দিন প্রমুখ। ছেলেদের শামসুদ্দিন কেবল কারিগর বানাননি, নিয়মকানুনও রপ্ত করিয়েছেন। যেমন বন্দুক ধরে আঙুল ট্রিগারে নয় রাখতে হয় ট্রিগার গার্ডে, ব্যারেলের মুখ রাখতে হয় নিচে। আবার পিস্তল হাতে নিয়ে প্রথমেই খুলে ফেলতে হয় ম্যাগাজিন, নইলে ঘটে যেতে পারে দুর্ঘটনা। ব্রিটিশ আমলে অস্ত্র আসত ইউরোপের দেশগুলো থেকে, আনত ম্যান্টন ও অন্যরা। শামসুদ্দিন তাদের কাছ থেকে এনে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করতেন ঢাকায়। পরে ঢাকায় যে গুটিকয় বন্দুকের দোকান হয় তারা শামসুদ্দিনের কাছ থেকেই বন্দুক নিয়ে বিক্রি করতেন।
রাজা, নবাব, জমিদার, খান বাহাদুর, রায় বাহাদুর, তালুকদার, চোকদার, চৌধুরীরাই সাধারণত বন্দুকের লাইসেন্স পেতেন। লাইসেন্স দেওয়ার আগে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট খতিয়ে দেখতেন বংশ পরিচয়, ক্রিমিনাল রেকর্ড ইত্যাদি। ডাকাতের উৎপাতের মতো উপযুক্ত কারণ দর্শিয়ে সাধারণ গিরস্ত একনলা (সিঙ্গেল ব্যারেল) বন্দুকের লাইসেন্স পেতে পারত, দোনলা (ডাবল ব্যারেল) কালেভদ্রে। বন্দুকের গুলির ক্ষেত্রে সীমারেখা ছিল না কিন্তু পিস্তল,রিভলভার ও রাইফেলের গুলি লাইসেন্সভেদে পাওয়া যেত ২৫, ৫০ বা ১০০টি। সময়টা ছিল স্বদেশিদের, তাই দোকানীদের বার বার হুঁশিয়ারি দিত ব্রিটিশ প্রশাসন। একবার যেমন ফরমান জারি করেছিল এই বলে যে, শক্ত আলমারি বা সিন্দুকে আগ্নেয়াস্ত্র রাখুন যেন বেহাত না হয়ে যায়।
পাকিস্তান আমলের রেজিস্ট্রার খাতা
দেশভাগের ফলাফলে নতুন দেশ হলো পাকিস্তান। নতুন দেশের সীমান্ত ছিল অরক্ষিত। সরকারের কোষাগারে অনেক অস্ত্রও ছিল না। সীমান্তবর্তী মানুষদের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল হিসাব না করে। তখন বন্দুকের দাম ছিল ১২৫ রুপির মতো। গ্রামের মাতব্বররা দলেবলে এসে ১০-১২টি করে বন্দুক কিনত। আখ যেমন আঁটি বেঁধে কাঁধে বয়ে নিতে দেখা যায় তেমনভাবে নিয়ে যাওয়া হতো বন্দুক। শামসুদ্দিন মারা যাওয়ার পর তার ছেলেরা চালাতেন দোকান বিশেষ করে ফকরুদ্দিন ও দলিলউদ্দিন। বন্দুক ও গুলি বিক্রি হলে একটা মোটা রেজিস্ট্রার খাতায় নিয়মমতো ক্রেতার নাম, ঠিকানা, লাইসেন্স নম্বর, বন্দুকের সংখ্যা, গুলির সংখ্যা ইত্যাদি লিখে রাখা হতো। খাতাটি এখনো যত্নে রেখেছেন ফকরুদ্দিনের তৃতীয় ছেলে আবরারউদ্দিন। ফকরুদ্দিনের ইংরেজিতে প্যাঁচানো হাতের লেখা বেশ সুন্দর ও সুশৃঙ্খল। খাতা খুলে দেখালেন আবরারউদ্দিন, ১৯৫১ সালের একদিনে বন্দুক বিক্রি হয়েছে ১৬০টি, মোট দাম ২১০০০ টাকা। বন্দুকের লাইসেন্স নম্বর হয়ে থাকে এমন ১/৭৮৮৯, এখানে ১ হলো থানার কোড। বস্তুতই ১ নম্বর দিয়ে কোতোয়ালি থানাকে বোঝাতো, ২ নম্বর দিয়ে কেরানীগঞ্জ, ৩ নম্বর দিয়ে সাভার থানা বোঝানো হতো। এভাবে দেশের সব থানারই নম্বর ছিল।
শৈশব থেকেই আবরারউদ্দিন বন্দুকের সঙ্গে মিতালি পাতিয়ে ফেলেছিলেন। লোহা কাটা, কাঠ জোড়া দেওয়া, ড্রিল করার কাজে তার মন বসে গিয়েছিল। বাবার সঙ্গে বন্দুক ব্যবসায় যুক্ত হয়েছিলেন ১৯৭১ সালে, বয়স তখন তার ১৬। দিনে বেচা-বিক্রি করতেন আর গভীর রাত পর্যন্ত দোকানের ওপরতলার ওয়ার্কশপে বন্দুক সারাই করতেন বা যন্ত্রাংশ তৈরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি এক সময়ে এক পাকিস্তানি মিলিশিয়া একটি রিভলভার এনে ফকরুদ্দিনকে বলে মেমো তৈরি করে দিতে। ফকরুউদ্দিন বলেন, আপনি তো এটা আমার দোকান থেকে কেনেননি, আমি কেন আপনাকে মেমো দিব? মিলিশিয়া তখন স্টেনগান তাক করে মৃত্যুভয় দেখিয়েছিল। সমিরউদ্দিন টলে যাননি। পিছু হটেছিল হাবিলদার। দীর্ঘদিন ধরে নীতি মেনে ব্যবসা করছিলেন বলে শামসুদ্দিন ও তার বংশধরদের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল দেশজুড়ে।
দলিলউদ্দিনের ছেলে মোমতাজউদ্দিন
আবরারউদ্দিনের চাচাতো ভাই ঢাকা ফোরামের সভাপতি ড. মোমতাজউদ্দিন আহাম্মদের সঙ্গে শামসুদ্দিন অ্যান্ড সন্স দোকানটিতে যাই বিকালবেলা। মোমতাজউদ্দিনও একজন গানস্মিথ। তার পিতা দলিলউদ্দিন ছিলেন শামসুদ্দিনের পঞ্চম সন্তান। দলিলউদ্দিন ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী ও ভাষাসৈনিক। অসাধারণ গানস্মিথ ছিলেন, সেসঙ্গে পাকা শিকারি। আবরারউদ্দিন বলছিলেন, 'চাচার কাজ এতো নিখুঁত ছিল যে আসল-নকল ফারাক করার উপায় ছিল না। তিনি বন্দুক মডিফাই করতে পারতেন যেমন হ্যামার গানকে তিনি হ্যামারলেস করে ফেলতে পারতেন। ' মোমতাজউদ্দিন বলছিলেন, আব্বা ১৯৪৬ সালে ইংরেজদের পলাশী ব্যারাক পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। অরফানেজ রোডে একজন ইংরেজ সার্জেন্টকেও তিনি গুলি করে হত্যা করেন। তিনি ছিলেন ইংরেজদের আতঙ্ক, হুলিয়া জারি হয়েছিল তার নামে কিন্তু তিনি ছিলেন অকুতোভয়। আখড়ায় যেতেন, কুস্তি লড়তেন, সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেন। ভালুকার জমিদার সানোয়ারউদ্দিন তালুকদারের শিকারসঙ্গী ছিলেন তিনি। গারো পাহাড়ে শিকারে যেতেন। তিনি ময়মনসিংহে একটি অস্ত্রের দোকান দিয়েছিলেন পাকিস্তান আমলে। মুক্তাগাছার জমিদার, গৌরিপুরের জমিদার, আঠারোবাড়ির জমিদার ছিলেন তার কাস্টমার। ওই দোকান থেকে ভালো রোজগার হতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আব্বা চকবাজারের জাহাজ বিল্ডিংয়ে ডি. আহাম্মদ এন্ড সন্স নামে আলাদা দোকান দিয়েছিলেন।'
পঞ্চাশের দশকে, ষাটের দশকেও বন্দুকের দোকানগুলো ভালো ব্যবসা করত। প্রায় প্রতিদিনই বন্দুক নয়তো গুলি অথবা গান পাউডার বিক্রি হতো। আবরারউদ্দিনের কাছে সংরক্ষিত রেজিস্ট্রার খাতা থেকে জানা গেল, ২৫টি গুলির দাম ছিল তখন ১১ রুপি। সে আমলে কোনো কোনো দিনে বিক্রির পরিমাণ ২০ হাজার টাকাও ছাড়িয়ে যেত, রেজিস্ট্রার খাতায় তার নজির আছে। মোমতাজউদ্দিন মনে করিয়ে দিলেন পঞ্চাশের দশকে ২০ হাজার টাকা মানে অনেক টাকা। পরিমাণ বোঝাতে ইমামগঞ্জের রংমহলের কথা তুললেন। নায়েবে নাজিমদের বংশধরেরা ১৯৫০ সালের দিকে ইমামগঞ্জ রংমহল তেল ব্যবসায়ী দুলিচাঁদের কাছে বিক্রি করেছিলেন ১৮ হাজার টাকায়।
মোমতাজউদ্দিন আরো জানালেন, বন্দুক সারাই করেও ভালো টাকা উপার্জন হতো বিশেষ করে শামসুদ্দিন পরিবারের কোনো গানস্মিথ যে সার্ভিস চার্জ নিতেন তা অন্যরা চাইতেও সাহস করত না। নতুন অস্ত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তার মান নির্ণয়ের জন্য প্রশাসন থেকেও ডাক পড়ত শামসুদ্দিন পরিবারের সদস্যদের।
ড. মোমতাজউদ্দিন আহাম্মদ বলেছেন, "আশির দশকের একটা ঘটনা বেশ আলোড়ন তুলেছিল। নানান জায়গায় অবৈধ অস্ত্র পাওয়া যেতে থাকল, খোঁজ খবর করে গোয়েন্দারা বুয়েটের এক ছাত্রকে বমাল ধরে ফেলল। জানা গেল, অস্ত্রগুলো সে নিজে তৈরি করে মাস্তানদের কাছে বিক্রি করে। অস্ত্রগুলো কোন মানের জানার জন্য আমার বাবা-চাচাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। দলিলউদ্দিন বলেছিলেন, ছাত্রটি যদি চর্চা চালিয়ে যায় তবে একদিন ভালো কারিগর হয়ে উঠবে সন্দেহ নেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের পরিবারের চারটি দোকান ছিল ঢাকায়। আব্বা মারা গেলেন ২০০৮ সালে, তারপর আমি জাহাজ বিল্ডিংয়ের দোকান চালিয়েছি ২০১৬ সাল পর্যন্ত। এ ব্যবসায় ঝুঁকি অনেক বেশি, সতর্ক না থাকলে বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে। আমি বিভিন্ন পেশায় ও সামাজিক-সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে বেশি জড়িয়ে পড়ায় দোকান বন্ধ করে দিই।"
ড. মোমতাজউদ্দিন আহাম্মদ তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব এবং মানবাধিকার বিষয়ে পিএইচডি করেছেন।
বাবরের ফ্লিন্টলক, শাহজাহানের ম্যাচলক
শামসুদ্দিন আহাম্মদ অ্যান্ড সন্স দোকানটি এখন দুইভাগ হয়ে গেছে। সামনের অংশে পোশাক-আশাকের দোকান আর পিছনদিকে বন্দুকের দোকানটি। আবরারউদ্দিন বসেছিলেন তিন সঙ্গীসহ। এ দোকানটি তার দাদার আমল থেকেই আড্ডাঘর। সন্ধ্যায় ঢাকার শিকারিরা এসে জড়ো হতো, কে কোথায় কবে কী শিকার করেছে, আবার কবে যাবে, কার কাছে কোন বন্দুক আছে, কোনোটায় কী অসুবিধা ইত্যাদি নিয়ে তুমুল আড্ডা হতো। মাঝখানে বসার জায়গা রেখে ডান ও বাম দেয়ালজুড়ে কাচের পাল্লা দেওয়া আলমারি। তাতে দুইনলা, একনলা বন্দুক ও রাইফেল সার ধরে সাজানো। পায়ের কাছে রাখা একটি সিন্দুকে রেখেছেন শটগান, পিস্তল ও রিভলভার।
মোমতাজউদ্দিনের কাছে জানা গেল, গান পাউডার ও আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ভাবনের কৃতিত্ব চীনাদের। মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে চীনারা যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে সেটি ছিল একটি চোঙা যার ভিতরে বারুদ পোরা থাকত। চোঙার মাঝখানে একটি ফুটো থাকত, সেখান দিয়ে আগুন দিলে বারুদ বেড়িয়ে আসত তীব্রবেগে। ১৩৮০ সালে সিল্ক রুট ধরে ইউরোপে যায় হ্যান্ডগান। লক উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে ১৪০০ সালে ম্যাচলক বন্দুকের প্রচলন ঘটে যা বন্দুকের ব্যবহারকে সহজ, নিরাপদ ও কার্যকরী করে। ব্যারেল, ট্রিগারের সংযোজনও প্রথম ঘটে এতে, এটি আগের আগ্নেয়াস্ত্রের তুলনায় সহজে বহনযোগ্য ছিল, ম্যাচ বা দিয়াশলাই দিয়ে এতেও অগ্নিসংযোগ ঘটাতে হতো। ডাচ শিল্পী রেমব্রাঁর একটি ছবিতে মুঘল সম্রাট শাহজাহানকে ম্যাচলক বন্দুক দিয়ে শিকার করতে দেখা যায়। পনেরো শতকের শেষদিক থেকে ফ্লিন্টলকের উন্নয়ন ঘটতে থাকে, পানিপথের যুদ্ধে প্রথম মুঘল বাবর ফ্লিন্টলক ব্যবহার করেছিলেন। এই বন্দুকে অগ্নিসংযোগের বদলে ঘর্ষণ প্রযুক্তির সংযোজন ঘটে। এগুলোতে মাজল বা বন্দুকের সম্মুখভাগ দিয়ে বারুদ পোরা হয়, তাই বলা হয় মাজললোডার। ডুয়েল লড়ার পিস্তলের আবির্ভাব ঘটে ১৭৫০ সালে। সংঘর্ষজনিত বিস্ফোরণ (পারকাসন-ডিটোনেটিং) প্রযুক্তি সংযোজিত হয় ১৮০৭ সালে। ১৮৩৫ সালে স্যামুয়েল কোল্ট ধারাবাহিকভাবে একাধিক গুলি ছোড়া যায় এমন রিভলভার (কোল্ট নামে বেশি চেনা) উদ্ভাবন করেন। আধুনিক শটগান সাধারণের নাগালে আসে ১৮৫০ সালে। ১৮৬১ সালে পাই ব্রিচ লোডেড (ব্যারেলের শেষভাগ দিয়ে বারুদ বা গুলি ঢোকানোর প্রযুক্তি) বন্দুক।
তিনি আরো জানালেন, পিস্তলে একসঙ্গে অধিক গুলি পোরা যায় তাই বার বার রিলোড করতে হয় না তবে লোড হয়ে যাওয়ার পর কিন্তু রিভলবারের ব্যবহার সহজ। পিস্তল ওজনেও হালকা হয় তাই পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সদস্যরা পিস্তল বেশি ব্যবহার করে। বাড়ির নিরাপত্তা এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্যও পিস্তলের চাহিদা বেশি । অন্যদিকে রাইফেল দূরবর্তী টার্গেটের জন্য ভালো, শটগান ভালো উড়ন্ত পাখি শিকারের জন্য।
মাসুদ রানার ওয়ালথার
আবরারউদ্দিন তার সিন্দুক থেকে ওয়ালথার পিপিকে নামের পিস্তলটি বের করলেন। জেমস বন্ডের শন কনরি, রজার মুর, পিয়ার্স ব্রসনান একে জনপ্রিয় করেছেন, কাজী আনোয়ার হোসেন মাসুদ রানার হাতেও দিয়েছেন পিস্তলটি। মেপে দেখা গেল এর ওজন ৫৩৬ গ্রাম (ম্যাগাজিন ছাড়া)। এর দাম এই বাজারে সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকা। ম্যাগাজিনে ৭টি গুলি ভরা যায়, একটি গুলির দাম সাড়ে তিনশত টাকা।
তারপর তিনি স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসনের রিভলভার দেখালেন, পকেট পিস্তলও দেখালেন যেটি তালুর মধ্যে লুকিয়ে ফেলা যায়। আবরারউদ্দিন বললেন, 'নারী গোয়েন্দারা পকেট পিস্তল বেশি ব্যবহার করে। জার্মান পিস্তল খুব ভালো, তবে আমার বেশি ভালো লাগে ইংল্যান্ডের বন্দুক। হল্যান্ড অ্যান্ড হল্যান্ড বা পার্ডি কোম্পানির বন্দুক এতটা নিখুঁত যে দেখলে চোখ ফেরাতে পারি না।'
এরপর আবরারউদ্দিন ওয়ার্কশপে নিয়ে গেলেন। শত বছরের পুরোনো কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। ছোট্ট জায়গাটাকে মনে হলো মিনি ধোলাইখাল। গ্রাইন্ডিং মেশিন, নানান মাপের নাট-বল্টু, মিলিং মেশিন, সিরিশ কাগজ, পালিশ করার যন্ত্র, স্ক্রু গেজ, প্লাস মিলিয়ে দেখার মতো এক জায়গা। ছোট্ট একটা কাঠের খণ্ড দেখিয়ে আবরারউদ্দিন বললেন, 'এটি শিশু গাছের কাঠ, উসমানি উদ্যান থেকে নিলামে কিনেছিলাম। বন্দুকের বাট তৈরিতে শিশু কাঠের জুড়ি নেই। তবে সবচেয়ে ভালো ওয়ালনাট বা আখরোটের কাঠ।'
তবে আর কেন
শামসুদ্দিন আহমেদ অ্যান্ড সন্সে এখন ৭২টি বন্দুক আছে। থানায় প্রতি মাসে রেজিস্ট্রার জমা দিতে হয় বলে হিসাব থাকে পরিষ্কার। দোকানে শেষ বিক্রি হয়েছে গেল বছরের আগস্ট মাসে। বন্দুক বিক্রি হয় এখন কালেভদ্রে। আগের প্রয়োজনও সব ফুরিয়েছে যেমন ডাকাতির খবর পাওয়া যায় কালেভদ্রে, শিকার নিষিদ্ধ, আভিজাত্য দেখানোর জন্য আছে গাড়ি, আসবাব, আইপ্যাড এবং আরো অনেক কিছু। শামসুদ্দিনের অন্য নাতিরা গানস্মিথিং ছেড়েছেন অনেকদিন হয়, আবরারউদ্দিনই কেবল ধরে রেখেছেন গানস্মিথিং। বংশপরম্পরায় তিনিই এখন দেশের একমাত্র গানস্মিথ। ইংল্যান্ডের এক বন্দুক কোম্পানি তাকে নিয়োগ দিতে চেয়েছিল, কিন্তু তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ধরে রাখবেন বলে। আবরারউদ্দিনের এক মেয়ে এক ছেলে। কেউ আর গানস্মিথ হতে চায় না। তিন প্রজন্মেই শেষ হয়ে যাচ্ছে শামসুদ্দিনের দক্ষতা ও কারিগরি জ্ঞান। অথচ কলকাতায় পাঁচ প্রজন্ম ধরে চলছে এমন দোকানও আছে। ছেলেকে আবরারউদ্দিন বলেছিলেন, তুমি কাজটা শিখে নিলে চার প্রজন্ম ছুঁয়ে যেতে পারে ঢাকার গানস্মিথিং, কিন্তু ছেলে রাজী হয়নি। বন্দুক ব্যবসার সুদিন আর নেই, সম্মানও নেই, তাই কেন আর শুধু শুধু সময়ক্ষেপণ?