হাতিরপুলের নাম কেন হাতিরপুল?
১৯৬৯ থেকে ৭৪ পর্যন্ত আমার ভূতের গলি ও নর্থ সারকুলার রোডে কেটেছে। সে সময়টাতে আব্বা হাতিরপুল বাজারে বাজার করতে যেতো। আমি মাঝেমাঝে আব্বার হাত ধরে হাতিরপুল বাজারে যেতাম। বাজারে যাওয়ার ব্যাপারে আমার উৎসাহটা ছিল অন্য কারণে। সেখানে গিয়ে হাতিরপুলে উঠতে আমি খুব পছন্দ করতাম। পুলে ওঠার জন্য টাকা দিয়ে রিকশা ঠেলা দেয়ার লোক পাওয়া যেতো। এভাবে রিকশায় চেপে পুল পার হতে আমার খুব ভাল লাগতো।
বাসা থেকে বাজারে হেঁটে যাওয়ার পথেই ছিল শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীদের পৈতৃক বাড়িটা। হালকা হলুদ রঙের বাংলো প্যাটার্নের বাড়িটা ছিল খুব সুন্দর। সামনে গোল বারান্দা ঘেরা দোতলা এই বাড়িটির নাম ছিল দারুল আফিয়া। শহীদ মুনীর চৌধুরীর ভাগনি সাংবাদিক কুররাতুল আইন তাহমিনা তার নানাবাড়ি নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন, "আমি বড় হয়েছি পুকুরপাড়ে। তিন বছর বয়স থেকে ১৮/১৯ বছর পর্যন্ত। হাতিরপুল পার হয়ে যাতায়াত ছিল দারুল আফিয়ায়, আমার নানুবাসাতে। পুকুর পাড় থেকে ভূতের গলি হয়ে দৌঁড়ে নানুবাসায় যেতাম আমরা। ১৯৭১ সালে মুনীরমামা কিছুদিন আমাদের পুকুরপাড়ের বাসায় ছিল। তারপর নানুবাসায় চলে যায়। সেখান থেকেই মামাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল রাজাকাররা।"
সেই হাতিরপুল দিয়ে কিন্তু একসময় ঠিকই হাতি পারাপার হতো। পুলের নীচে ছিল একটি রেললাইন। শোনা যায় হাতিরা রেললাইনের উপরের পুল দিয়ে পিলখানা থেকে হাতিরঝিলে যেতো গোসল করতে। নুড়ি পাথর ও রেললাইনের উপর দিয়ে হাতিরা নাকি হাঁটতে পারতোনা পায়ের নীচের নরম মাংশের কারণে। তাই তারা যেতো উপর দিয়ে। আর সেই থেকেই এর নাম হলো হাতিরপুল।
ইতিহাস আছে একসময় মোগল ও ইংরেজ আমলে ঢাকায় অনেক হাতি ছিল। যাতায়াত করা ছাড়াও এই হাতিগুলো নানাধরণের কাজে ব্যবহৃত হতো। পিল মানে হাতি, আর খানা মানে আশ্রম। সরকারের এই হাতিগুলো থাকতো পিলখানায়। পিলখানা নামটা এখনো আছে। তবে এখন সীমান্ত স্কয়ার নামেই বেশি পরিচিত। এই পিলখানা থেকে রমনা পার্ক-এ হাতি চারণের জন্য নেয়া হতো। যে রাস্তা দিয়ে নেয়া হতো সেটাই আজকের এলিফ্যান্ট রোড। রমনার চারপাশে বেশ কিছু খাল ছিল। হাতিগুলোকে নেওয়ার জন্য খালের উপর নির্মিত হয় সেতু। পিলখানা থেকে বর্তমান হাতিরপুল এলাকায় হাতি চলাচলের জন্য ইস্টার্ন প্লাজা ও পরিবাগ বরাবর যে সেতু বা পাকা পুল নির্মাণ করা হয়েছিল হাতি পারাপারের জন্য, যা পরবর্তীতে হাতিরপুল নামে পরিচিতি লাভ করে।
হাতিরপুল এলাকার আদি বাসিন্দা কবি সাদেকুর রহমান পরাগ জানালেন, "ঢাকা শহরের অনেক খাল এখন বক্সের ভেতর বন্দি আছে। এগুলোকে আনবক্সিং করে খালগুলোকে মুক্ত করে নগর পরিকল্পনা করলে শহরটি অনেক সুন্দর হয়ে উঠতে পারে। যেমনটা হয়েছে হাতিরঝিলের ক্ষেত্রে। সীমান্ত স্কয়ার থেকে হাতিরঝিল হয়ে একদিকে গুলশান পর্যন্ত অন্যদিকে ডেমরা পর্যন্ত নৌ চলাচল পথ তৈরি করা এখনো সম্ভব। গাওছিয়া মার্কেটের পাশ দিয়ে বাটা সিগনাল ক্রস করে হাতিরপুল দিয়ে পরিবাগ হয়ে রমনা থানার পাশ দিয়ে মগবাজার ওয়্যারলেস মোড় পেরিয়ে মধুবাগের দিকে যে রাস্তাটি গেছে - এই পুরো রাস্তাটির নাম ছিল এলিফ্যান্ট রোড। পরবর্তীতে সায়েন্স ল্যাব থেকে শাহবাগ পর্যন্ত নিউ এলিফেন্ট রোডের দাপটে আসল এলিফেন্ট রোডের পরিচয়টি হারিয়ে গেছে।"
হাতিরপুল ভেঙ্গে নীচের লাইন বরাবর যে রাস্তাটি নির্মাণ করা হয়, ছোটবেলায় দেখেছিলাম সেই রাস্তার নাম লিখা ছিল পেনিট্রেটর রোড। কেনইবা এমন একটা অদ্ভুত নাম রাখা হয়েছিল, আর কীভাবেই-বা এলাকাটা হাতিরপুল বাজার হয়ে গেল কে জানে?
আমার ছোটবেলায় হাতিরপুলের পাশের এই সুইপার কলোনিটা তখনও ছিল। এখন যেখানে মোতালেব প্লাজা গড়ে উঠেছে, সেখানে ছিল একটি কলোনি। নাম ছিল মোতালেব কলোনি। মোতালেব কলোনির মধ্যে সম্ভবত পাঁচটি দোতলা বাড়ি ছিল। কাঁঠালবাগানের ঢালে পরিত্যক্ত রেললাইন ছিল। ঢাকার নবাবরাও হাতি পার করার জন্য খাল ভরাট না করে বানিয়েছিলো হাতির পুল, আমরা তো আরো বড় নবাব, তাই খালটাই ভরাট করে ফেললাম।"
ওপাশে ছিল পরীবাগ মসজিদ, ছিল পাওয়ার হাউসটাও। আবছা মনেপড়ে একটি চিমনীও ছিল এর উপর। সেসময় হাতিরপুল সংলগ্ন পরিবাগ এলাকায় অনেক গাছগাছালি ও খাল ছিলো। হাতিরপুলের একটি ছবি একজন শিল্পী নিজের স্মৃতি থেকে এঁকেছেন আর তা পোষ্ট করেছেন সৈয়দ নাগিব মাহমুদ তার ফেইসবুক পেইজে। খান বাশার নামে একজন স্মৃতি থেকে বলেছেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীরা নাকি এই পুলের উপর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে গুলিবর্ষণ করেছিল। আমার বন্ধু আশরাফুল আমিন বলেছে, "হাতিরপুলটি ছিল অনেক খাড়া, যার ফলে প্রতিদিন দুর্ঘটনা লেগেই থাকতো। আমার মা দুবার মারাত্মক দুর্ঘটনার মুখে পড়েছিলেন। ২৫ মার্চ আমাদের বাসার ছাদ থেকে রেললাইনের বস্তির আগুন দেখেছিলাম।"
আব্বার কাছে শুনেছি এই পুল পারাপারের জন্য যে ছোট ছোট ছেলেপেলেরা ছিল, তাদেরকে দিতে হতো ২/৩ আনা। এরা ৪/৫ জনে দলবেঁধে রিকশা ঠেলতো। আব্বা ১৯৫৯ সালের দিকে ইত্তেফাকে কাজ করতো আর এই এলাকায় থাকতো। তখন নাকি মানুষে এই পুল আর ট্রেন দেখতে এখানে আসতো। এর নীচে ছোট ছোট কয়েকটি খাবার দাবারের হোটেল ছিল।
আমার ফুপাতো ভাই সিনিয়র সাংবাদিক শফিকুল করিম সাবু ভাই বললেন, "১৯৫৯ সালে মোতালেব কলোনির কাছে একটি দোতলা কাঠের বাড়িতে থাকতেন তারা। এরপর চলে আসেন একেবারে হাতিরপুলের পাশে। আমি তখন স্কুলে পড়ি। ট্রেন এলেই আমরা ট্রেন দেখতে যেতাম। ট্রেনগুলো ছিল অনেক বড় বড় এবং সুন্দর। এখন মনেহয় সময়টা ছিল স্বর্ণযুগ।"
বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত শাহিদ ভাই স্মৃতি হাতড়ে বলেন, "রিকশায় হাতিরপুল পার হওয়ার অভিজ্ঞতা আমার আছে। রিকশা ঠেলার জন্য চার আনা দিতে হতো। আমার নানার বাসা হাতিরপুলের কাছে। একদিন নানী আমাকে এক টাকা দিয়ে বাজারে পাঠালেন মাছ আর পান-সুপারি কেনার জন্য। বাজার বলতে তখন রেল লাইনের উপর কয়েকটা অস্থায়ী দোকান। আমি চার আনা দিয়ে এক ভাগা পুঁটি মাছ আর কিছু পান-সুপারি কিনে আরো কিছু পয়সা ফেরত এনেছিলাম।"
বন্ধু মনজুরা আক্তার, যার জন্ম, শৈশব এবং বড় হয়ে ওঠা এই হাতিরপুলে, জানালো, "পঞ্চাশ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন সেখানে বসতি গড়ে উঠতে শুরু করে তখনই আব্বা সেখানে এক টুকরো জমি কিনেন। সম্ভবত আটান্ন সালের দিকে আব্বা নিজের বাসায় উঠেন। বাড়ি তৈরির উপকরণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নামানো হত, সেখান থেকে শ্রমিকরা মাথায় করে আমাদের বাসায় আনতো। এগুলো সবই আব্বার কাছে শোনা।
হাতিরপুল বাজার কিন্তু তখনো হয়নি। নূতন বাসিন্দারা নিজেদের প্রয়োজনে পুঁজি বিনিয়োগ করে কিছু লোককে এখানে বেচাকেনা করতে বলেন, সেখান থেকেই এ বাজারের গোড়াপত্তন। এ বাজার এবং কাটাবন মসজিদটি স্থাপনে আমার আব্বা অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। হাতিরপুল বাজারের সেই ব্যবসায়ীরা এখন কোটিপতি, কিন্তু আমার আব্বাকে তারা মনে রেখেছেন। এখনো আব্বার বাসায় প্রয়োজন অনুযায়ী বাজারের সেরা মাংস, মাছ এবং অন্যান্য জিনিষ লোক মারফত পৌঁছে দিয়ে যায়। বংশ পরম্পরায় তারা এটা করছে। বাসা থেকে আমরা ট্রেন যেতে দেখতাম। এখন যেটা সুবাস্তু টাওয়ার সেটা ছিল আমাদের খেলার মাঠ। আজিজ সুপার মার্কেটে আমরা বড় ভাইএর সাথে সাঁতার শিখতে যেতাম। এলিফ্যান্ট রোডকে আমরা বলতাম নূতন রাস্তা। আমার কাছে এই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় এক টুকরো জায়গার নাম হাতিরপুল।"
এই পুলটি যখন ভাঙা হয় ৭০ এর দশকে, তখন ইত্তেফাকে একটি সচিত্র প্র্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল এই হাতিরপুল ভাঙা নিয়ে। রিপোর্টে উল্লেখ আছে, ৫০ বছরের পুরোনো এই পুলটি ভাঙা হবে নগরে নতুন রাস্তা তৈরি করার জন্য। পৌরসভা এই পুল ভাঙ্গার কাজটি করছে। নতুন রাস্তা তৈরির জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে দেড় লক্ষ টাকা।
ফুলবাড়িয়া-তেজগাঁও রেললাইনের উপর দিয়ে পরিবাগ ও ধানমন্ডি এলাকার মধ্যে যান চলাচলের সহজ উপায় ছিল এই হাতিরপুল বা রেলওয়ে ওভার ব্রিজটি। নগর সংস্কারের জোয়ারে ও আকাশচুম্বি অট্টালিকা তৈরির জন্য এই পুলটি ভাঙ্গা হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যদিও এই পুলটি ঐতিহাসিক এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ছিল, কিন্তু সেসময়ের নগর পরিকল্পনাবিদরা বলেছিলেন রেলওয়ে স্টেশন কমলাপুরে সরিয়ে নেয়ার পর এই পুলের আর দরকার নাই ।
এই ঐতিহাসিক হাতিরপুলটি কি রেখে দেয়ার কোন দরকার ছিল না? তৎকালীন বৃটিশ সরকারের শেষ সময়ে ঐ স্থানে রেললাইন তৈরি করা হয়। এলিফ্যান্ট রোড দিয়ে শত শত হাতির পাল চড়িয়ে বেড়াতেন মাহুতরা। হাতিগুলোকে চারণভূমিতে নিয়ে যাবার জন্য যে রাস্তা ব্যবহার করা হতো, পরবর্তীতে এই রাস্তার নামকরণ করা হয় এলিফ্যান্ট রোড। ঢাকার উপরে লেখা ইতিহাস বই থেকে জানা যায়, আজকের জনবহুল এলিফ্যান্ট রোড এলাকাটি ১৮০০ সালে ছিল বিশাল আকৃতির গাছ-গাছালিতে ঘেরা ছোটখাট বনাঞ্চল। পরবর্তীতে গাছ-পালা কেটে হাতি চলাচলের জন্য রাস্তা তৈরি করা হয়।
প্রয়োজনের খাতিরে না হোক, ইতিহাসের খাতিরেই হাতিরপুলটিকে সংস্কার করে কি আমরা রেখে দিতে পারতাম? আমরা কেন যেন কোন ইতিহাসকেই ধরে রাখতে পারিনা। ছবিতে ঢাকার ৪০০ বছরের ইতিহাস পাতায় 'বিদায় হাতীরপুল' শিরোনামে ইত্তেফাকের সংবাদটি পড়ে আর যাদের শৈশব, কৈশোর, যৌবনের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই হাতিরপুল, ভুতের গলির সাথে, সবার স্মৃতি হাতড়ে আজকের এই লেখা।
- লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন