বুড়িগঙ্গার জলে কাপড় ধুয়ে এখনও টিকে আছেন যে ধোপারা
'অই যে বেড়িবাঁধ দেখা যায় না? অইহান পর্যন্ত নদী আছিলো। কত বড় যে আছিলো এই নদী তা না দেখলে বুঝান যাইবো না। সাথে আছিলো অনেক গাছগাছালি। তহন এই নদীর পানি কালা আছিলো না। একবারে সাদা সাদা পরিষ্কার পানি। একবার ধোলাই দিলেই কাপড় পরিষ্কার হইয়া যাইতো। কামের মাঝে চা-নাস্তা খাইবার পরে মাঝেমধ্যে হাতর মুঠোত পানি লইয়্যা এইহান থেইক্যা খাইতাম আমরা। অনেক ছুডো আছিলাম তহন। আব্বার লগে আইতাম, কাম দেখতাম আর নিজেও কিছু কইরা দিতাম'— উচ্ছ্বাস ভরা কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন ধোপা মো. ইকবাল হোসেন।
ষাটোর্ধ্ব ইকবাল কাপড় ধোলাইয়ের কাজ করছেন ৪০ বছর ধরে। ছোটবেলা থেকে এই কাজটিই শিখেছেন তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগের কথা। বাবার সাথে ছোট্ট ইকবাল বুড়িগঙ্গার পারে আসতেন প্রতিদিন। বাবা কাজ করলে একপাশে বসে সেসব দেখতেন মনোযোগের সাথে। ছোট হাতে এক-দুইটা করে কাপড়ও ধোলাই করতেন সে সময়। ১০-১২ বছর থেকেই এই কাজ করেন। বয়স ১৫-১৬ হতে হতে ভালোভাবে নিজেকে পাকাপোক্ত করে নেন এই কাজে। এটি তাদের আদি পেশা। নদীকেন্দ্রিক জীবন তাদের। তাই এখানেই গড়ে তোলেন নিজেদের বসবাসের স্থান।
আজ থেকে শত বছরেরও বেশি সময় আগের কথা। তখন বুড়িগঙ্গা ছিল বিশাল এক নদী। কালো নয়, স্বচ্ছ সাদা পানির ধারা প্রবাহিত হতো নদীজুড়ে। এই তো বছর বিশেক আগেও দেখা মিলতো পরিষ্কার পানির ধারা। সূর্যের সোনালী আভা পানিতে পড়লে ঝিলিমিলি করে মিলিয়ে যেতো পুরো নদীতে। নদীর চারপাশে ছিল গাছের সমাহার। কলসী হাতে পাড়ে এসে খাওয়ার পানি নিতেন আশেপাশের লোকজন। পাশাপাশি গোসল বা অন্যান্য কাজ তো ছিলোই!
'এই নদীর কাছে আমাদের অনেক ঋণ'— কর্মরত ধোপাদের অনেককেই বলতে শোনা যায় এমন কথা। অবশ্য কতটুকু অনুধাবন করে বলেন, তা নিয়ে সন্দেহ আছে বৈকি! তবে কেউ কেউ প্রকৃত অর্থেই আজীবন এই নদীর কাছে ঋণী। অনেক ধোপার চোখেমুখের অভিব্যক্তিতে তা স্পষ্ট।
নুরু মিয়া এমনই একজন। বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই। কিন্তু তাকে দেখে সেটি বোঝার উপায় নেই। ভোর ৬টা থেকেই লেগে পড়েছেন কাজে। আজ তার টার্গেট ১৫০টি কাপড় ধোলাই করবেন। কিছু অবশ্য ধোলাই করে শুকাতেও দিয়ে দিয়েছেন এরমধ্যে। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে মনোযোগের সাথে কাজও চালিয়ে যাচ্ছেন। ধোপার কাজ করছেন ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। ১৪ বছর বয়সে এই কাজে হাত পাকা করেন তিনি৷ কাজ বলতে এটিকেই চিনেছেন। এর বাইরে অন্য কোনো কাজে দক্ষতাও নেই তার। তাই জীবন ও জীবিকা বলতে এই পেশাকেই বোঝেন। এই নদীর পাড়েই কাজ, নদী পাড়েই বসবাস বলে নদীর প্রতি, নদীর পানির প্রতি তার আজীবনের কৃতজ্ঞতা।
এদের কারোরই নেই নিজস্ব জমি। থাকেন অন্যের ভাড়া দেওয়া বাড়িতে। নদীর আশেপাশেই সকলের বসবাস। ধোপা নুরু মিয়া ও তার তিন ভাই থাকেন কেরানীগঞ্জের নিউ গুলশান সিনেমা হলের পাশে। অন্যদিকে আমবাগিচা সরকারি খেলার মাঠে থাকেন ধোপা ইকবাল। অন্যদের বসবাসও নদীর এপার ওপার মিলিয়ে বিভিন্ন জায়গায়। অবশ্য তাদের বাবা-দাদাদেরও নিজেদের জমিজমা ছিল না। তারাও ভাড়া দিয়েই থাকতেন এই এলাকায়। এর সূত্র ধরে নুরু মিয়ারাও আর বদলাননি বসবাসের জায়গা।
এভাবেই বছরের পর বছর নদীর পাড়ে নিজেদের স্থায়ী ঠিকানা গড়ে তুলেছিলেন তারা। তবে সে সময়ে আজকের মত বেশি ভাড়া ছিল না। দেড়-দুইশ টাকা ভাড়া গুণতে হতো মাসে। বর্তমানে নুরু মিয়াদের দিতে হয় পাচ হাজারেরও বেশি টাকা। এর বাইরে বিদ্যুৎ বিল তো আছেই। তবুও এই জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার চিন্তা করেননা কেউই। থাকতে চান মৃত্যু অবধি।
এক কাপড়ে পেতেন এক টাকা
আজ থেকে শতবছর আগে নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠে নুরু মিয়াদের জীবিকা। পেটে ভাতের যোগান দিতে নদীর তীরে গড়ে তোলেন নিজেদের আবাসভূমি। পেশা হিসেনে বেছে নেন কাপড় ধোলাইয়ের কাজ। নদীর পানিতে সকাল সন্ধ্যা ধোলাই করে যে আয় করতেন তাতে দু'দণ্ড শান্তির ব্যবস্থা হয়ে যেতো তাদের। হেসেখেলে অন্য দশটি মানুষের মতই দিন পার করতেন তারা। যেটুকু আয় হতো তাতে বাঁচার জন্য দরকারী সব চাহিদাও মিটে যেতো ঠিকঠাক । তাই এখনো পর্যন্ত সে পেশাই বহাল রেখেছেন তারা।
পাকিস্তান আমলে একটি কাপড় ধোলাইয়ের জন্য পেতেন ১ টাকা করে। তাতে দিনে যদি ২০০ কাপড় ধোলাই হতো তবে ২০০ টাকা করে পারিশ্রমিকও পাওয়া যেতো। সে সময়ের এক টাকায় কিনতে পাওয়া যেতো নানান জিনিস। আজকের মত দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজার ছিল না। সাধ্যের মধ্যে সুখ কিনতে পারতেন তারা।
কিন্তু বর্তমানে সে চিত্র পুরোপুরি বিপরীত। এখন অবশ্য কাপড় প্রতি আর এক টাকা নয়, দেওয়া হয় ৬ টাকা করে! অর্থাৎ, দিনে ২০০ কাপড় ধোলাই করলে পাওয়া যাবে ১,২০০ টাকা। তবে টাকা বাড়লেও আগের সেই শান্তি আর নেই। বাঁচার তাগিদে প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করাই যেন কল্পনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের কাছে।
'এই কামে ভাত নাই'
নেই আগের মত কাজও। তাই আক্ষেপের সুর মেলে নুরু মিয়ার কন্ঠে। বয়সের ভারে কিছুটা শ্লথ হয়ে এসেছে কাজের গতি। আগে ৩০০-৩৫০ কাপড় একাই ধোলাই করতে পারতেন। এখন সে সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১২০-১৫০ এ। তবুও হার মানার পাত্র নন তিনি। খেটে খাওয়া লোক। তাই আগের অভ্যাস ছাড়তে পারেননি। এখন শারীরিক শক্তি কমে আসলেও মনোবল তার আগের মতোই তীব্র। তাই তো জীর্ণশীর্ণ শরীর নিয়েও কাজ করেন রোজ। কাজ পেলে তার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু কাজ না থাকলে রাজ্যের কষ্ট ভর করে বুকে।
কিছুটা অভিযোগের সুরে নুরু মিয়া বলেন, 'আগে মেলা কাম আছিলো। শরীরে বলও আছিলো। সারাবেলা কাম করতাম। অহন কাম নাই, ট্যাহাও নাই। এইডা কইরা কেউ কিচ্ছু করতে পারে নাই। এই কামে ভাত নাই।'
তবে রোজার মাস আসতেই কাজ বাড়ে কিছুটা। পুরাতন কাপড় ধোলাইয়ের অর্ডার আসে নানান জায়গা থেকে। লন্ড্রির জামা কাপড়ও আসে কিছুটা। কুরবানির আগেও বেড়ে যায় কাজের চাপ। কাজের পরিমাণ বাড়লে দু:খ নয়, বরং খুশিতে চোখ ঝলমল হয় তাদের। তাতে যে কয়েকটা টাকা বেশি আয় করা যায়!
বছরের এই সময় ছাড়া অন্যান্য দিনে এত কাজ থাকেনা। তখন ২-৩ দিন পরপরই কাপড় ধোলাইয়ের কাজে আসেন নদীতে।
'এই পানি দেখতে কালা, কিন্তু সাদা'
বুড়িগঙ্গার এই কালো পানিতেই করেন সমস্ত কাপড় ধোলাইয়ের কাজ। সাদা কাপড়ও আছে এই তালিকায়। নুরু মিয়াদের হাতে কালো পানিতে সাদা শার্টও হয়ে ওঠে একেবারে নতুনের মত। চকচকে সাদা শার্ট দেখে বোঝায় উপায় নেই কেমন পানিতে ধৌত করা হয়েছে এসব। অবশ্য এই পানিকে অপরিষ্কার বা কালো মানতে নারাজ ধোপা ইকবাল হোসেন।
পানিটা যে পরিষ্কার তা প্রমাণ করতে হাতের মুঠোয় করে পানি এনেও দেখালেন। তার ভাষ্যমতে, 'এই পানি দেখতে কালা, কিন্তু সাদা। কাছে গেলেই সেটা টের পাওয়া যায়। এই যে আপনারা গন্ধ পান, আমরা কিন্তু কোনো গন্ধ পাই না পানিতে। আমাদের কাছে এই পানি পরিষ্কার।'
সাধারণত সাবান, সোডা, ব্লিচিং পাউডার, রিন বা হুইল পাউডার ইত্যাদি জিনিস ব্যবহার করে গরম পানিতে সারারাত ভিজিয়ে রাখা হয় কাপড়। আগের দিন সন্ধ্যার দিকে ভিজিয়ে রেখে ধোয়া হয় পরের দিন সকালে। অর্থাৎ, ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখার পরে। তারপর ধোয়ার আগে সাবান মেখে প্রতিটি কাপড়ে ব্রাশ দিয়ে ঘষে বা সিমেন্ট দ্বারা বাঁধানো তক্তায় জোরে আছড়িয়ে বুড়িগঙ্গার পানিতে ধুয়ে নেওয়া হয়। কাপড়ের সাদা ও উজ্জ্বল রং নিশ্চিত করার জন্য ব্যবহার করা হয় নীল।
তবে বর্তমানে যেসব কাপড় ধোলাই হয়, প্রায় সবগুলোই পুরাতন কাপড়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত লন্ড্রির কাপড়ই আসতো এই ধোপাদের কাছে। ২০১৪-১৫ সাল পর্যন্ত সে ধারা অব্যাহত ছিল। বড় বড় অভিজাত পরিবারের সমস্ত জামা-কাপড় আসতো তাদের কাছে। সে সময়ে কাজও ছিল অনেক বেশি। আবার আয়ও ছিল ভালো। ধোপা হিসেবে কাপড় ধোলাইয়ে কাজ করে আরামেই কেটে যেত দিন।
লন্ড্রির কাপড় কারা ধোয় বা কোথায় ধোয়া হয় জানতে চাইলে নুরু মিয়া বলেন, 'বর্তমানে লন্ড্রির কাপড়গুলো ধোয়া হয় কারখানায়। মেশিনের সাহায্যে করা হয় এই কাজ।' যাত্রাবাড়ী, উত্তরা ও শনির আখড়ায় এসব কারখানার অবস্থান বলে জানান তিনি।
এরপর পুরাতন কাপড় ধোলাইয়ের কাজ করতে শুরু করেন। পুরাতান কাপড় আসা শুরু হয় দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে। এর আগ পর্যন্ত আসত লন্ডি থেকে। তাদের ধোলাই করা পুরনো কাপড়গুলো আবার বিক্রি হয় বিভিন্ন মার্কেটে। এসব পুরাতন কাপড় কোথায় কোথায় যায় জানতে চাইলে ধোপা নুরু মিয়া জানান ফার্মগেইট, মতিঝিল, টঙ্গি, বরিশাল, চরমোনাই ইত্যাদি জায়গার নাম। তবে প্রথমেই সব কাপড় যায় ওয়াজঘাটে। সেখান থেকে বিভিন্ন জায়গায়।
'হিন্দুরা আছিলো বেশি'
এক সময়ে মুসলমানদের এই পেশায় খুব একটা দেখা যেত না। হিন্দুরাই করতেন এই কাজ। প্রাচীন হিন্দু সমাজে রজক নামের এক শ্রেণির নিম্নবর্ণের হিন্দু এই পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। উচ্চ বর্ণ বা ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যদের পরিধেয় কাপড় পরিষ্কার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তারা। মুসলমানদের এই পেশায় আগমন ঘটে আরও পরে। ১৯৪৭ সালে যখন ভারত পাকিস্তান দুভাগে ভাগ হয়ে যায়, সে সময়ে অনেক হিন্দু ধোপা পূর্ব বাংলা ছেড়ে চলে যান। তাদের যাওয়ার পরে অনেক মুসলমান এই পেশায় ধীরে ধীরে প্রবেশ করতে শুরু করেন। ধোপা ইকবাল বলেন, 'আমাদের বাপ দাদারও আগে এই কাজ করতো হিন্দুরা। তাদের দেখে হয়তো বাপরা শিখসে। আমি ছোডকালেও দেখসি৷ হিন্দুরা আছিলো বেশি।'
এই সময়ে ধোপাদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। একসময়ে বকল্যাণ্ড ব্রীজে বুড়িগঙ্গার তীরে সারিবদ্ধভাবে ধোপাদের কাপড় ধোয়ার দৃশ্যের দেখা মিলতো। তবে অনেক মুসলমান ধোপার মতে, তাদের পূর্বপুরুষরা এই কাজ শুরু করেন দেশ ভাগেরও আগে, ব্রিটিশ আমল থেকে। অনেকের দাবি ৫ পুরুষ ধরেই তারা এই পেশায় নিয়োজিত আছেন। তার মানে, এই পেশায় মুসলমানদেরও অনেক আগে থেকেই আগমন ঘটে। হয়তো হিন্দুদের সংখ্যা ছিল পরিমাণে বেশি। তবে অনেক মুসলমান ধোপাও ছিলেন।
বর্তমানে পুরো বুড়িগঙ্গাজুড়ে আছেন ৮ জন ধোপা। কামরাঙ্গির চরে আছেন ২৫-৩০ জনের মতো, যারা মেডিকেলের চাদর পর্দা ইত্যাদি ধোলাই করেন। ঢাকার অন্যান্য জায়গায় আর অল্প স্বল্প থাকতে পারে বলে মত নুরু মিয়ার। তবে বুড়িগঙ্গার ধোপাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন কেবল এই ৮ জনই। আগে এই সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। কেউ কেউ পেশা পরিবর্তন করেন বলেও জানান তারা।
'বাপ দাদারে দেইখ্যা শিখসি'
তবে এই আটজন খুব শখের বশে এই কাজ করছেন তা কিন্তু নয়। কেবল এই কাজই শিখেছেন বাবা-দাদারের কাছে। পড়াশোনা করেননি কেউই। কাজ বলতে এটিই জানেন। এভাবে করে বাবা-দাদার পেশা অর্পিত হতে থাকে পরবর্তী প্রজন্মের ওপর। ফলে বুড়িগঙ্গার পানির রূপ, রঙের পরিবর্তন হলেও নদীকেন্দ্রিক এই মানুষগুলোর জীবিকা বদলায়নি।
নুরু মিয়া বলেন, 'বাপ দাদারে দেইখ্যা শিখসি এই কাম। এইডা ছাড়া কিছুই পারি না। এহন অনেক কষ্ট হয় শরীরে। নি:শ্বাস নিতেও কষ্ট লাগে। নিজে করসি কিন্তু আমার ছেলে-মেয়েরে এই কাম কোনোদিন করবার দিমু না।'
বুড়িগঙ্গার তীরে কর্মরত আট ধোপাই পরস্পরের আত্মীয়। প্রায় সবার ৩০-৩৫ বছরের কাপড় ধোলাইয়ের অভিজ্ঞতা। ফলে কোন কাপড়ের কী দাগ কীভাবে তুলতে হবে– সে বিষয়ে তাদের জানাশোনাও আছে ভালো। তবে দাগ তুলতে যে পরিমাণ ব্লিচিং পাউডার তারা ব্যবহার করেন এতে আছে প্রাণনাশের ঝুঁকিও। ধোপা ইকবালের মতে, অন্য মানুষ হলে ক্ষতি হবে, কিন্তু তাদের কিছু হয় না এতে। অভ্যস্ত হয়ে গেছেন এসবে।
এই বিষয়ে নুরু মিয়ার ভিন্ন মত। তিনি বলেন, 'এই কাম করার পরে হাত অনেক জ্বালাপোড়া করে। চামড়া উইঠ্যা যায়, ব্যথা হইয়া যায়। অনেক কষ্ট লাগে তহন।'
এরমধ্যে আছে জরিমানার চাপও। কোনো ভালো কাপড় ধুতে গিয়ে ছিড়ে গেলে জরিমানা হিসেবে বড় অংকের টাকা গুণতে হয় তাদের। প্রায় সারাদিনের আয়ের সমান টাকা দিতে হয় মালিকপক্ষকে। জরিমানার পরিমাণ জানতে চাইলে ধোপা ইকবাল বলেন, 'কিছু কিছু শার্টের জন্য ৪০০ ট্যাহা দিতে হয়। আবার ৫০০ টাকাও দেওন লাগে মাঝেমধ্যে।
'আগে মায়া আছিলো, অহন নাই'
'যে কাম কইরা ঠিকঠাক চলবার পারি না, অইডা কইরা কী লাভ! আগে মায়া আছিলো, অহন আর নাই। অন্য কাম জানলে অইডা করতাম। মেলা কষ্ট এইহানে,' বলছিলেন ধোপা নুরু মিয়া।
আগে ভালোবেসে এই কাজ করলে এখন শুধুমাত্র পেটের দায়ে করেন। প্রাপ্য মজুরি নাই। তার উপর বয়সও বেড়েছে। এত কম টাকায় এত কাজ করতে করতে ক্লান্ত তিনি। নিচু হয়ে কাপড় ধুতে গেলে দম বন্ধ হয়ে আসে তার। তবুও শেষ বয়স অব্দি এটিই করে যেতেন চান। বাঁচতে তো হবে।
কষ্ট উপলব্ধি করেই নিজের ছেলেকে করতে দেননি এই কাজ। নিজে পড়াশোনা না করলেও, ছেমেয়েকে করিয়েছেন। গর্বের সাথে বলেই বসলেন, 'আমি পড়ালেখা করি নাই, কিন্তু আমার মেয়ে একটা কলেজে পড়ে, একটা ম্যাট্রিক পাস। আমার ছেলেও।' তার ভাষ্যমতে হয়তো তারাই বুড়িগঙ্গার সর্বশেষ ধোপা। এই পেশায় নতুন কেউ আসতে চায় না। আবার তারাও নিজের কাউকে আনতে চান না এই পেশায়।
অবশ্য ড্রাই ক্লিনিং ও কাপড় পরিষ্কারের অটোমেটিক মেশিন আবিষ্কার সনাতনী ধোপাদের স্থান পূরণ করে চলছে। বর্তমানে শহরের অনেক বস্ত্র পরিষ্কারক প্রতিষ্ঠান অটোমেটিক ও সেমি অটোমেটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সনাতনী ধোপারাও সেদিকে কাজ করার দিকে ঝুঁকছেন। অনেকেই এসব প্রতিষ্ঠানে সাবকন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করে থাকেন।
একটা সময় হয়তো ধোপাদের পেশাই বিলুপ্তির পথে চলে যাবে। গ্রাম ও শহরতলিতে দেখা যাবে না সনাতনী ধোপাদের। সনাতনী পদ্ধতিতে ধোয়াও হবে না কোনো কাপড়। আধুনিকায়নের এই যুগে ধোপাদের পেশাও হয়তো হারিয়ে যাবে একেবারে– এমনটাই দাবি নুরু মিয়ার।