যেভাবে তিমি দর্শন সম্ভব!
২০২১ সালের ৯ এপ্রিল বিকেলবেলা, মৃত তিমি ভেসে আসার খবর আবু সাঈদ মুহাম্মদ শরীফ প্রথম জানতে পারেন সাংবাদিক গিয়াসউদ্দিনের কাছে। বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিটের (বোরি) বায়োলজিক্যাল ওশানোগ্রাফি বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুহাম্মদ শরীফ। কক্সবাজারের রামুর প্যাঁচার দ্বীপে বোরির ক্যাম্পাস।
খবর পেয়ে মুহাম্মদ শরীফ সঙ্গী বিজ্ঞানীদের নিয়ে হিমছড়ির ঘটনাস্থলে যান। ততক্ষণে সেখানে পরিবেশ ও বন বিভাগের, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা উপস্থিত হয়েছেন। কক্সবাজার জেলা প্রশাসন প্রতিনিধি এবং রামুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রণয় চাকমাও উপস্থিত। সেইসঙ্গে আছে স্থানীয় লোকজন এবং পর্যটকরা। অনেক মিডিয়া কর্মী এবং বেসরকারি পরিবেশকর্মীরাও হাজির হয়েছেন। নানান প্রশ্ন ও কৌতূহল সবার মধ্যে—কোথা থেকে এসেছে তিমিটি? কি প্রজাতির তিমি এটি? এর লিঙ্গ কি? কীভাবে মৃত্যু হলো? ইত্যাদি, ইত্যাদি।
তিমিটির মাংস ও চর্বিতে ইতিমধ্যে পচন ধরেছে, ব্যাপক দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো ৭-৮ দিন আগে মারা গেছে তিমিটি। যেহেতু এটি বন্যপ্রাণী, তাই বন ও পরিবেশ দপ্তরের সম্পদ। বোরির বিজ্ঞানীরা পরিবেশ দপ্তরের অনুমতি নিয়ে মাপজোখ শুরু করলেন। মেপে দেখা গেল, ৪২ ফুট দীর্ঘ এ তিমি প্রস্থে ১৩ ফুট। তবে এর মুখ ও চোয়ালের অনেকখানি অংশ ক্ষয়ে গেছে।
এর মধ্যে অনেকেই একমত হয়েছেন, এটি বলিনোপেট্রা ব্রাইড তিমি। কিন্তু শরীফের ধন্ধ লাগল। তিনি দ্বিমত করলেন না, তবে সন্তুষ্টও হলেন না। তার মনে হলো ব্রাইডের সঙ্গে এর সাদৃশ্য থাকলেও কিছুটা ভিন্নতাও আছে। ডিএনএ টেস্ট হওয়ার আগে প্রশ্ন তুললে বিতর্ক তৈরি হতে পারে। তাই চুপ থাকাই সংগত ভাবলেন শরীফ।
এবার মিডিয়াকর্মীরা তিমিটির মৃত্যুর কারণ জানতে আগ্রহী হলেন। কেউ কেউ ভাবল ফিশিং ট্রলারের সঙ্গে সংঘর্ষ এর মৃত্যুর কারণ হতে পারে। বোরির বিজ্ঞানীরা অবশ্য আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা যাওয়ার কোনো চিহ্ন দেখতে পেলেন না।
এবার ফরেনসিক তদন্ত করার প্রসঙ্গ সামনে চলে এলো। কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেল তিমির ফরেনসিক দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা কারুরই নেই। অথচ ফরেনসিক তদন্ত ছাড়া এর মৃত্যুর কারণ নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়, তাই বিষয়টি রহস্যময় থেকে গেল।
ইতিমধ্যে প্রাণীটিকে কোথায় নিয়ে রাখা হবে সে প্রশ্নও উঠল। কিন্তু এত বড় প্রাণীটিকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া অসম্ভব, তাই সবাই মিলে বালিচাপা দেওয়াই সাব্যস্ত করলেন। এজন্য এক্সকাভেটর দিয়ে টেনে কিছুটা ওপরে তুলে আনা হলো। রাত তখন মধ্যরাত পেরিয়েছে। বালিচাপা দেওয়ার আগে বোরির বিজ্ঞানীরা মাংসের নমুনা সংগ্রহ করে রাখলেন। তারা এর কংকাল সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের আগ্রহ জানিয়ে রাখলেন পরিবেশ ও বন দপ্তরকে। পরে এ ব্যাপারে দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ সম্পন্ন হয়।
পরেরদিন আবার হিমছড়ি সৈকতের ১ কিলোমিটার দক্ষিণে আরেকটি মৃত তিমি ভেসে এলো। সেটির দশাও আগেরটির মতোই। এই তিমিটিরও নমুনা সংগ্রহ করলেন বোরির বিজ্ঞানীরা। শেষে আগেরটির মতোই বালি চাপা দেওয়া হলো। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় এটির কংকাল সংরক্ষণের ও অধ্যয়নের কাজে ব্যবহার করার আগ্রহ জানিয়েছে।
অল্পকাল পরে দুটি তিমিরই নমুনা পাঠানো হলো ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি বা এনআইবিতে। এনআইবির বিজ্ঞানীরা গুরুত্বের সঙ্গে নমুনা পরীক্ষা (ডিএনএ টেস্ট) করে দেখেন। মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কেশব চন্দ্র দাশ ও সিনিয়র বিজ্ঞানী ড. ছলিমউল্লাহর নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল এ পরীক্ষা কার্যক্রম চালান। নিবিড় পরীক্ষা শেষে তারা দুটি তিমিকেই ব্রাইড শ্রেণীর বলিনোপেট্রা ইডেনি (Balaenoptera edeni) বলে নিশ্চিত করলেন।
মুহাম্মদ শরীফ জানালেন, বলিনোপেট্রা ইডেনির বিচরণক্ষেত্র ইন্দো-প্যাসিফিক (ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর ঘিরে যেসব দেশ রয়েছে) অঞ্চল যেমন শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া বা চীনের উপকূলে। আমাদের সমুদ্র সীমার মধ্যে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড এলাকায় এদের মাঝে মাঝে দেখা গেছে বলেও জানান। তিনি ধারণা করেন তিমিটি শ্রীলংকা বা মধ্য ভারত থেকে ভেসে আমাদের সৈকতে আটকা পড়েছে। কাছাকাছি কোথাও মারা গেলে সৈকতে আসতে ৭-৮ দিন লাগত না। তিমিটি অ্যাডাল্ট (প্রাপ্ত বয়স্ক) নয় এবং বয়স হবে ১০ এর নিচে।
এই তিমিগুলির দাঁত থাকে না, বদলে ছাঁকনির মতো একটা অংশ থাকে যাকে বেলিন বলা হয়। এরা ছোট মাছ ও চিংড়িজাতীয় প্রাণী খেয়ে বেঁচে থাকে। লম্বায় ৪০-৫০ ফুট হয়ে থাকে। ওজন হতে পারে ২৫ টন পর্যন্ত।
বালিচাপা দেওয়ার পর বোরির বিজ্ঞানীরা অপেক্ষা করতে থাকেন। ২০২২ সালের অক্টোবরে হিমছড়িতে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে দেখেন, তিমিটি বালির আরো গভীরে চলে গেছে।
এর মধ্যে চাপা দেয়া প্রাণীর হাড় উত্তোলন ও সংরক্ষণে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনা করতে থাকেন মুহাম্মদ শরীফ। ২০২৩ সালের শেষ দিকে, প্রায় আড়াই বছর পরে বোরির সঙ্গী বিজ্ঞানীদের বিয়ে তিমিটি উত্তোলনের প্রস্তুতি নেন মুহাম্মদ শরীফ। এজন্য জানা দরকার তিমিটি বালির ঠিক কত গভীরে আছে। স্ক্রুর মতো অগার নামের একটি যন্ত্রও এ কাজে তারা ব্যবহার করেন। ততদিনে তিমিটি বালির ২০ ফুট গভীরে চলে গিয়েছিল। শেষে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক্সকাভেটর নিয়ে বালি খোঁড়া হয় ২০২৪ সালের ২৪-২৬ জানুয়ারি।
বোরির বিজ্ঞানীরা আগেই অন্তর্জাল ঢুঁড়ে তিমির কংকালচিত্র খুঁজে নিয়েছিলেন। প্রিন্ট করিয়ে হাতে রেখেছেন। উদ্দেশ্য, উত্তোলিত হাড়গুলো মিলিয়ে নেওয়া। কিছুদূর খোঁড়ার পর থেকেই পানি উঠতে শুরু করল। তাই পানি নিষ্কাশনের জন্য পাম্প ব্যবহার করতে হচ্ছিল। ১০ ফুট পর্যন্ত খোঁড়া হতেই বালিতে কালো কালো বালি দেখা যেতে থাকল, যার অর্থ হাড় থেকে মাংস খুলে পচে বালির সঙ্গে মিশে গেছে।
শেষে ২০ ফুট গভীরে গিয়ে হাড় পাওয়া শুরু হলো। কিছু হাড় ভাঙা অবস্থায় পাওয়া গেলেও দ্বিতীয় দিন ২৫ জানুয়ারি মাঝবেলা পর্যন্ত খননকাজ চালিয়ে ১৫০টি হাড় উদ্ধার করা হলো যা আস্ত কংকালের প্রায় ৮০ ভাগ।
হাড়গুলোকে নাম্বারিং করে তাতে ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হলো ও পলিথিন বিছিয়ে ধারাবাহিকভাবে বসানোও হলো। শেষে যখন নিশ্চিত হওয়া গেল আর কোনো হাড় অবশিষ্ট নেই, তখন আগের দুদিনে তৈরি হওয়া বিশাল সে গর্ত আবার বালি দিয়ে ভরাট করে দেওয়া হলো।
এরপর বোরি ক্যাম্পাসে নিয়ে গিয়ে হাড়গুলো ভিজিয়ে রাখা হলো যেন হাড়ের ভিতরে থাকা লবণাক্ত পানি বের হয়ে আসে। সেইসঙ্গে অবশিষ্ট মাংস অপসারণের কাজও চলল। বোরির পক্ষ থেকে এর মধ্যে দেশের তিন বিশিষ্ট বোন এক্সপার্ট বা হাড় বিশেষজ্ঞ নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তাদের একজন ঢাকা জাতীয় জাদুঘরের, একজন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং তৃতীয়জন চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার। কমিটির সঙ্গে দফায় দফায় সভা করে বোরির বিজ্ঞানী কর্মীরা হাড় প্রক্রিয়াজাত করার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেন।
গত প্রায় তিন মাসে বোরির ১০-১২ জন কর্মী নিয়মিতভাবে তিমির কংকাল প্রস্তুত করার কাজ করে চলেছেন। আরো প্রায় ১ বছর পর কংকালটি পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে যাবে বলে আশা করছেন মুহাম্মদ শরীফ। এ সময়টা লাগবে সিজনিং ও টেম্পারিংয়ের জন্য। কীভাবে প্রদর্শন করা যায়, তা নিয়েও বিশেষজ্ঞ সভায় আলোচনা হয়েছে। ওপর থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া কিংবা একটি ঢাল (স্লোপ) তৈরি তাতে কংকালটি রাখার ব্যাপারে মত এসেছিল। তবে এভাবে বাস্তবায়নে অসুবিধার সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ প্রদর্শনও মুশকিল। শেষে ঢাকা জাতীয় জাদুঘরে যেভাবে স্ট্যান্ডের ওপর রেখে তিমির কংকাল প্রদর্শিত হচ্ছে সেভাবেই প্রদর্শন করা হবে বলে স্থির করা হয়েছে। বড় একটি কাজ এখনো বাকি, তা হলো মিসিং হাড়গুলো তৈরি করা।
মুহাম্মদ শরীফ বললেন, 'বস্তুত শিক্ষার্থীদের কথা ভেবেই আমরা তিমির কংকাল প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বোরির মহাপরিচালক ড. তৌহিদা রশীদ আন্তঃদপ্তর যোগাযোগ স্থাপন, সংরক্ষণ প্রক্রিয়াসহ সব কিছুতেই সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। তাতে আমরা বিজ্ঞানী ও কর্মী যারা আছি, সবাই উৎসাহ বোধ করছি।
'আমাদের ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অংশ নিতে সারা দেশ থেকেই শিক্ষার্থীরা আসেন। আরো আসেন পর্যটকরা। তাদের প্রত্যেককেই আকর্ষণ করবে তিমির কংকালটি।'
তিনি যোগ করলেন, 'সমুদ্রবিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহ তৈরি করবে এই কার্যক্রম।'