শেরেবাংলা নগর যেভাবে সত্যিকারের 'নগরে' রূপ নিলো
আমি যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি তখন প্রথম ঢাকায় আসি। ঢাকার প্রথম স্মৃতি আমার শেরেবাংলা নগরে। বন্ধুর ড্রয়িং রুমের ক্যালেন্ডারে থাকা ফ্লাইওভার আর ব্রিজের ছবি কিংবা সিনেমায় দেখা ডুপ্লেক্স বাড়ি, ঢাকা শহর বলতে এমন দৃশ্যই আমার কল্পনাতে আঁকতাম।
কিন্তু যখন জাতীয় সংসদে ঘুরতে যাওয়ার জন্য প্রথম ঢাকার রাস্তায় পা রাখলাম, তখন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের সুন্দর, মসৃণ রাস্তা দেখে খানিকটা অবাকই হয়েছিলাম। প্রশস্ত ও পরিষ্কার এ রাস্তা যেন চাঁদের আলোয় চকচক করছিল। ক্রিসেন্ট লেক, চন্দ্রিমা উদ্যানের সবুজের সমারোহ দেখে আমার মনে হচ্ছিল পুরো শহরটাই মনে হয় এরকম নির্মল আর সুন্দর।
প্রায় এক দশক পর ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে এইচএসসির ছাত্র থাকাকালে ভাগ্য আমাকে আবার শেরেবাংলা নগরের কাছাকাছি নিয়ে আসে। সেখানে আমি দুই বছর ছিলাম। তারপর কেটে গিয়েছে আরও প্রায় এক দশক।
সংসদ ভবন, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও লেক রোডের দুই পাশের রাস্তা এখনও বেশ সুন্দর। রাস্তাগুলো ফুটবল মাঠের মতো প্রশস্ত, ছোটবেলায় খেলতাম সেখানে। তবে এখন গাছের সংখ্যা কমে গেছে।
বলাই বাহুল্য, আমার চেনা শেরেবাংলা নগর আর বর্তমানে যে শেরেবাংলা নগর এ দুইয়ের মধ্যে আছে বিস্তর ফারাক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. আমানত উল্লাহ খানের কাছে এটি সম্পূর্ণ নতুন একটি শহর। তার ভাষ্যে, 'আমি ঠিকমতো কিছু চিনতে পারছি না।'
এভাবেই অবকাঠামোগত পরিবর্তন পুরো এলাকাকে বদলে দিয়েছে।
নান্দনিক অফিসপাড়া
ঢাকার নতুন সেনসেশন মেট্রোরেল, মাত্র ৩০ মিনিটেই পৌঁছে যাবেন মতিঝিল থেকে উত্তরা স্টেশনে। যাওয়ার পথে মেট্রোর জানালা দিয়ে ফার্মগেট, বিজয় সরণি এবং আগারগাঁও স্টেশন থেকে শেরেবাংলা নগরের দৃশ্য দেখা যাবে। যত এগোবেন, ততই চোখে পড়বে ঢাকার দুটো ভিন্ন দিক।
ফার্মগেট থেকে দেখা যায় সেই পুরোনো, জনাকীর্ণ ভবন। আগারগাঁওয়ের পরেও একই দৃশ্য। কিন্তু এই দুই স্টপেজের মাঝখানে দৃশ্যপট নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়।
শেরেবাংলা নগরের দিকে এগোলেই দেখা যাবে রাস্তাগুলো প্রশস্ত এবং মসৃণ, দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন নকশার সারিবদ্ধ ছোট-বড় দালান।
তুলনামূলকভাবে এই এলাকা খোলামেলা এবং প্রশস্ত, এর আগে বা পরে যে জনাকীর্ণ এলাকাগুলো দেখবেন তার থেকে বেশ আলাদা। গুগল ম্যাপে চোখ বুলিয়ে নিলে দেখা যাবে আশপাশের এলাকাজুড়ে সবুজের সমারোহ ও খোলা জায়গা।
শেরেবাংলা নগরের বুক দিয়ে যাওয়া মেট্রোরেল এই অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান আবেদনকে যেন আরও বাড়িয়ে তুলেছে। তবে মেট্রো থেকে সব উন্নয়ন উপভোগ করা সম্ভব না। তাই ঠিক করলাম সাইকেল চালিয়ে পুরো এলাকাটা ঘুরে দেখব।
সাইকেল দিয়ে বেগম রোকেয়া অ্যাভিনিউ থেকে মিরপুর রোডের সংযোগকারী সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ অ্যাভিনিউ দিয়ে যাওয়ার পথে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, পরিকল্পনা কমিশন, পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অধিদপ্তর, এলজিইডি ভবন, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি অফিসের দেখা পেলাম। শেরেবাংলা নগরের প্রধান সড়ক এটি।
পথিমধ্যে কথা হলো শেরেবাংলা নগরের বাসিন্দা চায়ের দোকানদার হাবিবুর রহমানের সাথে। তিনি বলেন, 'নতুন নতুন সরকারি অফিসগুলো এই অঞ্চলটিকে সম্পূর্ণ নতুন রুপ দিয়েছে। দুই দশক আগেও এই এলাকা এরকম ছিল না।'
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভবনে ঢুকেই চোখে পড়ল চারপাশে তিন ফুট চওড়া বাগান, পরিপাটি করে ছাঁটা ফুলের বাহার। নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম, প্রতিটি ভবন ও এর প্রাঙ্গণ নিখুঁতভাবে পরিচ্ছন্নতা ও নান্দনিক সূক্ষ্মতার সঙ্গে পরিচর্যা করা হয়েছে।
দেয়ালে কোনো পোস্টার ছিল না, রাস্তায় কোনো আবর্জনা ছিল না, কোনো ভবন ভাঙাচোরাও ছিল না। এই ছোট ছোট কিন্তু সম্মিলিত প্রচেষ্টা পুরো এলাকার সৌন্দর্য্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
শুধু সরকারি অফিস নয়, বিদেশি প্রতিষ্ঠান যেমন এডিবি, বিশ্বব্যাংক ও ইউনিসেফের ভবনগুলো ব্যতিক্রমীভাবে সাজানো। আছে বাগান, ফুল এবং সবুজের সমারোহ।
প্রতিটি ভবনের নকশা স্বতন্ত্র, একটি অন্যটির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক, নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খানও একমত যে প্রশস্ত রাস্তা এবং ভবনের নকশার বৈচিত্র্য এলাকার নান্দনিকতা বাড়িয়ে তুলেছে।
বিটিআরসি ভবনের ঢেউখেলানো সম্মুখভাগ সবার নজর কাড়ে, পোস্ট অফিসের ভবনটি দেখতে আবার বিশাল লাল পোস্টবক্সের মতো। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে সিইজিআইএস ভবনের সাদামাটা নকশা এবং সবুজ সম্মুখভাগ বিশেষভাবে আকর্ষণীয় মনে হয়েছে।
নির্বাচন অফিস থেকে আগারগাঁও মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত যে রাস্তাটি গেছে সেখানেই এলাকার কয়েকজন যুবককে আড্ডা দিতে দেখলাম।
মোটরবাইক রাইড শেষে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে থাকা মাহবুবুল পিয়াল বলেন, 'এই জায়গাটা সুন্দর, খুব বেশি ভিড় নেই। আমরা বিকেলে বন্ধুদের সাথে এখানে আড্ডা দিতে পারি। অন্যান্য এলাকার লোকজনও আমাদের এলাকায় আসেন।'
তিন বছর আগে উদ্বোধন হওয়া ডাক ভবনের পাশে কোস্টগার্ডের সদর দপ্তর অবস্থিত। আশেপাশে আরও অসংখ্য ভবন নির্মাণের কাজ চলছে, প্রতিটির নকশা আকর্ষণীয় ও জাঁকজমকপূর্ণ। সুন্দর ভবনগুলো, স্থাপত্যকলার শিক্ষার্থীদের অধ্যয়নের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
অবকাঠামো খাতে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ বাংলাদেশের অর্থনীতির শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির প্রমাণ দেয়। বিশ্বব্যাংকের মতে, গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রতি বছর গড়ে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হারে বাড়ছে। কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব সত্ত্বেও গত বছর দেশটি ৭ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।
বিএমপি নাকি বিএনপি
বিএনপি এবং বিএমপি, শব্দ দুটো যে কারও জন্য বিভ্রান্তিকর হতে পারে। বিএনপি (বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি) বলতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এবং বিএমপি (বাংলাদেশ মিটিওরোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট) বলতে আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরকে বোঝায়।
বিএমপি প্রকল্পকে ঘিরে যে বিশাল বস্তি গড়ে উঠেছে তা বিএনপির কোনো নেতা বা তাদের সমর্থকরা গড়ে তোলেননি।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই বস্তির ভেতরের বাস্তবতা ভয়াবহ। মাদক পাচার, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, চুরি, হামলা, ধর্ষণ এবং এমনকি হত্যা থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপরাধ যেন এখানকার নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। এখানে সংগঠিত নানা অপরাধের সংবাদ খবরের শিরোনামে ওঠে এসেছে, আতঙ্ক ছড়িয়েছে বাসিন্দাদের মধ্যে।
কালক্রমে ভুল উচ্চারণ বা ভুল বোঝাবুঝির কারণে বস্তিটিকে অনেকেই বিএনপি বাজার নামেই ডাকেন।
সংসদকে ঘিরে নির্মিত
জাতীয় সংসদ ভবন নির্মাণের পর শেরেবাংলা নগর আধুনিক এলাকায় পরিণত হয়। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে বাংলাদেশের প্রথম প্রাদেশিক সংসদ পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই অস্থায়ী সংসদ নিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা আছে।
১৯৫৫ সালে শাহেদ আলী পাটোয়ারী ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব পান। তবে ১৯৫৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পাটোয়ারী বিতর্কিতভাবে স্পিকার আবদুল হাকিমের মানসিক স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, যা গণপরিষদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।
অস্থায়ী সংসদে, সদস্যরা একে অপরের সাথে মারামারি, লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েন। দুঃখজনকভাবে, কেউ একটি পেপারওয়েট নিক্ষেপ করে যা শাহেদ আলীকে আঘাত করে এবং আঘাতের দুই দিন পরে তিনি মারা যান।
পরে সংসদ ভবন বিজয় সরণি (পুরাতন বিমানবন্দর) এলাকায় স্থানান্তরিত হয়।
১৯৬২ সালে, আইয়ুব খানের ইসলামাবাদকে পাকিস্তানের রাজধানী এবং ঢাকাকে 'দ্বিতীয় রাজধানী' হিসেবে ঘোষণা করেন। স্থপতি লুই কানকে শেরেবাংলা নগরে জাতীয় সংসদ কমপ্লেক্সের নকশা প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়, যা তখন আইয়ুব নগর নামে পরিচিত ছিল।
অধ্যাপক খানের মতে, 'এটি পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) জন্য একটি সান্ত্বনা পুরস্কার ছিল মাত্র।'
মূল পরিকল্পনায় জাতীয় সংসদ ভবন এবং সংসদ অধিবেশনে পশ্চিম পাকিস্তানের কর্মকর্তা ও প্রতিনিধিদের জন্য তিনটি অস্থায়ী আবাসন বা হোস্টেল অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এই আবাসনগুলো মন্ত্রী, সচিব এবং জাতীয় পরিষদের প্রতিনিধিদের জন্য ছিল এবং এটিকে 'সিটাডেল অফ দ্য অ্যাসেম্বলি' বা 'সংসদের দুর্গ' বলা হত।
প্রাথমিকভাবে, স্থপতি 'সিটাডেল অফ দ্য ইন্সটিটিউশন' বা 'প্রতিষ্ঠানের দুর্গ' নামে একটি বিকল্প ধারণা প্রস্তাব করেছিলেন, যার মধ্যে সংসদের নিকটবর্তী নাগরিক কার্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে প্রকল্পের এই অংশটি কখনও নির্মিত হয়নি। ১৯৭১ সালে এটি বাংলাদেশ জাতীয় সচিবালয় দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়।
১৯৭৫ সালের পর, প্রকল্পটি আবার জীবন পায়। কমপ্লেক্সটি তখন নতুন সরকারের স্থিতিশীলতা এবং অর্জনের প্রতীক হয়ে ওঠে।
অতীতে দেখতে যেমন ছিল
৩২ বছর বয়সী নাজমা আক্তার সারাটা জীবন কাটিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংলগ্ন বস্তিতে। 'আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন এই পুরো এলাকাটি কেবল একটি বড় বস্তি ছিল। আশেপাশে কোনো জাদুঘর বা অন্য কোনো ভবন ছিল না', বলেন নাজমা।
নাজমার এখনও মনে আছে, এখানে জাদুঘরের পাশে একটি বড় পুকুর ছিল, যেখানে তিনি এবং তার বন্ধুরা সাঁতার শিখেছিলেন।
তিনি বলেন, 'পুরো এলাকাজুড়ে আগে অনেক বস্তি ছিল। পূর্বদিকে একটি কবরস্থান, পশ্চিমে একটি বাজার এবং মাঝখানে ছিল একটি পুকুর। কিন্তু এখন এখানে সবই ভবন।'
গত পাঁচ বছরে নির্মিত আরও কয়েকটি ভবনের পাশাপাশি চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি উদ্বোধন হওয়া জাহাজ অধিদপ্তরের নতুন ভবনের কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
নতুন ভবনের সাথে পুরো এলাকা কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে তা বর্ণনা করতে নাজমা বলেন, 'গ্যাস অফিস ভবনটি দুই বছর ধরে নির্মাণাধীন। এর ডান দিকে, স্বাস্থ্য প্রকৌশলী বিভাগ ভবনের পাশাপাশি মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি অফিস এক বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছে।'
'এই বস্তি বেশিদিন বস্তি থাকবে না; নামের মতোই একদিন গোটা এলাকা সত্যিকারের নগরে পরিণত হবে', যোগ করেন নাজমা।
স্থপতি লুই আই কান বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ ভবন ও গণভবনের নকশা প্রণয়নের পর থেকে নগরায়ণের ফলে এই এলাকার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে।
ঢাকার নগরায়ণের ইতিহাস অনেক গভীরে। ১৮৩০-এর দশকের মধ্যে ঢাকা তার গৌরবান্বিত আভিজাত্য হারিয়ে আধুনিকায়নের দিকে ধাবিত হতে থাকে।
এক সময়ের জাঁকজমকপূর্ণ মুঘল প্রাসাদ, প্রবেশদ্বার, সেতু, সমাধি এবং মসজিদগুলো এখন জরাজীর্ণ ও অবহেলিত। এমনকি মোগল স্থাপত্যশৈলীর জন্য পরিচিত লালবাগ কেল্লায় বিবি পরীর সমাধির মতো বিখ্যাত নিদর্শনগুলোও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল।
শহরের অনেক বাসিন্দারা শহর ছেড়ে চলে যাওয়ায় অনেক বাড়িঘর পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। বাসযোগ্য বাড়ির সংখ্যা ১৮০১ সালে ৪৪ হাজার থেকে ১৮৩০ সালে ১৬ হাজার ২৭৯ এবং তারপরে ১৮৩৮ সালে ১০ হাজার ৮৩০-এ নেমে আসে।
তবে সময়ের সাথে সাথে শহরের কেন্দ্রীয় এলাকাগুলো আরও জনাকীর্ণ হয়ে ওঠে। বিশৃঙ্খল বিন্যাস এবং অধিবাসীদের অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসের কারণে ঢাকা হয়ে ওঠে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর।
ভারতের অনেক শহরের মতো ঢাকাও অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। এলোমেলো, সরু ও আঁকাবাঁকা রাস্তায় গাদাগাদি করে নির্মিত হয়েছে বাড়িঘর। নগরীতে মাত্র দুটি প্রধান সড়ক ছিল, একটি পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে এবং অন্যটি দক্ষিণ থেকে উত্তরে যা সদরঘাটের কাছে মিলিত হয়েছে।
তবে ১৮৪০ সালে ম্যাজিস্ট্রেট রাসেল মোরল্যান্ড স্কিনার উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ বাস্তবায়ন শুরু করলে ঢাকার নগর উন্নয়ন উল্লেখযোগ্য মোড় নেয়।
সময়ের সাথে সাথে ঢাকার প্রশাসনিক গুরুত্ব এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বাড়তে থাকে। সরকারি নানা উদ্যোগ এবং জনসাধারণের চাপ বৃদ্ধির কারণে শহরের অবস্থারও অবনতি হতে থাকে।
১৬৬০, ১৯০৫, ১৯৪৭ এবং ১৯৭১ সালে চারবার ঢাকা রাজধানী নির্বাচিত হয় এবং প্রত্যেকবারই এর কল্যাণে এখানে কিছু নগর উন্নয়ন হয়েছে। ১৯৪৭ সালে শেরেবাংলা নগরে সরকারি অফিসারদের জন্য একটি স্টাফ কোয়ার্টার নির্মাণ করা হয়।
জাতীয় সংসদ ভবন, জাতীয় সংসদ কমপ্লেক্সের একটি অংশ। পুরো কমপ্লেক্সের আয়তন ১০০০ একর এবং মূল সংসদ ভবন এলাকার আয়তন ২১৫ একর ।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত আটটি সংসদ নির্বাচনের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় নির্বাচনের পর গঠিত সংসদের অধিবেশনগুলো অনুষ্ঠিত হয় পুরোনো সংসদ ভবনে, যা বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তানের (বর্তমান পাকিস্তান) জন্য আইনসভার জন্য জাতীয় সংসদ ভবনের নির্মাণ শুরু হয় ১৯৬১ সালে। আমেরিকান স্থপতি লুই কান ১৯৬২ সালে এই প্রকল্পের জন্য কমিশন লাভ করেন এবং ১৯৭৪ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নকশায় কাজ করেন।
নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৮২ সালের ২৮ জানুয়ারিতে বিশ্ব স্থাপত্যকলার অনন্য এ নিদর্শনের উদ্বোধন করা হয়।
এতদিন পর্যন্ত মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও লেক রোড ছিল শেরেবাংলা নগরের একমাত্র দৃষ্টিনন্দন এলাকা। এখন পুরো এলাকা নান্দনিকভাবে রূপান্তরিত হয়েছে, সংসদের সৌন্দর্যের সাথে নির্বিঘ্নে মিশে গেছে।
৭৪ বছর বয়সী এন্তাজ হোসেন স্মৃতিচারণ করে বলেন, 'নির্বাচন কমিশন অফিসসহ এই অফিসগুলো কিছুদিন হলো নির্মিত হয়েছে। বিএনপির শাসনামলে হাজার হাজার কুকুর জবাই করে এখানে পুঁতে ফেলা হয়। এখান থেকে গাবতলী পর্যন্ত একটি খাল (কল্যাণপুর খাল) রয়েছে। খালের পাড়ে বস্তি ছিল এবং ওই সময় যাতায়াতের জন্য মানুষ নৌকা ব্যবহার করত।'
একতা ভিলার কেয়ারটেকার মোহাম্মদ শাহাজান বলেন, 'পশ্চিমে মিরপুরগামী রাস্তা ধরে গড়ে উঠেছে অনেক আবাসিক ভবন, বেড়েছে আবাসন ব্যয়। আট বছর আগে যে ফ্ল্যাটের ভাড়া ছিল ১৩ হাজার টাকা, এখন এটি ১৮ হাজার টাকা।'
স্থানীয় বিক্রেতা মোহাম্মদ বাদল বলেন, 'এখানকার প্রথম উঁচু ভবনটি ছিল আবহাওয়া অধিদপ্তরের। এখন আরও অনেকগুলো ভবন হয়েছে।'
দশ বছর আগে দুই কক্ষের ফ্ল্যাট ভাড়া ছিল পাঁচ হাজার টাকা, আর এখন তিন কক্ষের একটি ফ্ল্যাটের ভাড়া ২১ হাজার টাকা বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ঢাকার পর্যটন কেন্দ্র কি হতে পারবে?
কিছুদিন আগেই শেরে বাংলা নগরে গিয়েছিলেন অধ্যাপক আমানত উল্লাহ খান। পুরো এলাকার আমূল পরিবর্তন দেখে অবাকই হন তিনি। তিনি উৎসাহের সাথে তার ফোনটি আনলক করে আমাকে তার তোলা কিছু ছবি দেখালেন।
আমানত উল্লাহ বলেন, 'যদিও তাপপ্রবাহের কারণে প্রচণ্ড গরম ছিল, তবুও আমি গাড়ি থেকে নেমে কিছু ছবি তুললাম এবং আবার দ্রুত গাড়িতে ফিরে গেলাম।'
তিনি জোর দিয়ে বলেন, 'শহরের অনন্য পরিচয় ফুটিয়ে তুলতে এই জাতীয় সুন্দর স্পটের প্রয়োজন।'
আমানত উল্লাহ খান শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকার সবুজ মাঠ ও পুকুরের প্রশংসা করে বলেন, এগুলো পুরো এলাকায় প্রাণ সঞ্চার করে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী জাদুঘর, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর, জাতীয় সংসদ ভবন, চন্দ্রিমা উদ্যান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভো থিয়েটার এবং বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর থাকায় শেরেবাংলা নগরের পর্যটন কেন্দ্র হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, 'অবশ্যই, এটি পর্যটকদের জন্য একটি বিকল্প হতে পারে কারণ তারা পুরানো জায়গাগুলো ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।'
তবে পর্যটনের জন্য এর সৌন্দর্য ধরে রাখতে উচ্চতর রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
এদিকে অধ্যাপক আদিলের মতে, পর্যটকদের জন্য আরও আকর্ষণীয় ও টেকসই করতে আরও গাছ লাগাতে হবে।
যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে
বীর উত্তম খালেদ মোশারফ অ্যাভিনিউ দিয়ে যাওয়ার পথে চোখে পড়ল লাল কৃষ্ণচূড়া ফুল। আমার বাম পাশে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডান পাশে ছিল বাণিজ্য মেলার মাঠ।
যান্ত্রিক এ শহরের মাঝে যেন খানিকের জন্য শান্তি খুঁজে পেলাম। তবে সে শান্তি বেশিক্ষণ টিকল না। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা তিনটা সিএনজি এবং তাদের ড্রাইভারদের প্রস্রাব করতে দেখেই বিরক্তি চলে আসল।
মোহাম্মদ ভুট্টু নামে এক সিএনজি চালক বলেন, 'আশেপাশে কোনো পাবলিক টয়লেট আছে কিনা আমার জানা নেই।'
অধ্যাপক খান এই রুটে নিয়মিত যাতায়াত করেন, তিনিও লক্ষ্য করেছেন যে সিএনজি চালকরা নিয়মিত এই রাস্তায় প্রস্রাব করেন।
তবে অধ্যাপক খানের চিন্তার জায়গা অন্য জায়গায়। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের পাশে মাঠে তরুণদের খেলা দেখে তার বেশ দুশ্চিন্তা হয়। কর্তৃপক্ষ এই জায়গা দখল করে ভবন তৈরি করতে পারে, এ নিয়ে উদ্বিগ্ন তিনি।
তিনি বলেন, 'এখানে সচিবালয় স্থানান্তর নিয়ে আলোচনা চলছে। কিন্তু এখন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থাকায় সচিবালয় উত্তরা বা গাজীপুরে উত্তর দিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। এই এলাকা ঢাকার প্রাকৃতিক ফুসফুস হিসেবে কাজ করে। মানুষ এখানে স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারে। তাই এটিকে শুধু সংরক্ষণ করা নয়, বাড়ানোও উচিত। আমাদের অবশ্যই অতিরিক্ত যান্ত্রিক বিকাশ কমাতে হবে।'
অধ্যাপক খান আরও বলেন, 'এক সময়ের ধানমন্ডি ৮ নম্বর মাঠ সবার জন্য উন্মুক্ত থাকলেও অতি উন্নয়নের কারণে এখন অধিকাংশ সময় তালাবদ্ধ থাকে। এখানে একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করা উচিত নয়।'
অবকাঠামোগত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি টেকসই রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, 'সরকারি বিনিয়োগের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পরিবেশ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বরাদ্দ করতে হবে।'
রাস্তা এবং আশেপাশের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি নিবেদিত রক্ষণাবেক্ষণ দলও প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
অধ্যাপক আদিল অবশ্য এই অঞ্চলের পরিবেশ, পরিবহণ প্রভাব এবং জনসেবা নিয়ে আরও সামগ্রিক চিন্তাভাবনা করার পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, 'প্রথমত শিশুমেলা থেকে বাংলাদেশ বেতার পর্যন্ত সারি সারি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। তাই ক্ষতিপূরণ হিসেবে আরও বেশি করে গাছ লাগাতে হবে। ভরাট হওয়া জলাশয় এবং কল্যাণপুর খাল সংস্কার করে এর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।'
অধ্যাপক আদিল আরও বলেন, 'সব অফিস পুরোপুরি চালু হলে ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হবে। এই এলাকায় ট্র্যাফিক চাপ সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা হয়নি, তাই এ জিনিস মাথায় রেখে পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।'
অফিস কেন্দ্রিক এই এলাকায় বাণিজ্যিক জায়গার অভাব চোখে পড়ার মতো। তিনি বলেন, 'আমাদের রেস্টুরেন্ট, বইয়ের দোকান ও আসবাবপত্রের দোকানের মতো প্রতিষ্ঠান দরকার। তাই একটি শপিং সেন্টারের জন্যও নির্দিষ্ট জায়গা সংরক্ষণ করুন।'
এনবিআর ভবনের অভ্যন্তরে একটি টেস্টি ট্রিটের শাখা রয়েছে, তবে শুধু তাদের কর্মীদের জন্য। এক বিক্রয়কর্মী জানান, অন্য অফিসের কর্মীরা অনেক সময় ফোন কলের মাধ্যমে তাদের এখান থেকে খাবার অর্ডার করেন।
তাই এখানকার চাকুরিজীবিদের জন্য মানসম্মত খাবারের ব্যবস্থাও করার অতীব জরুরি।
অফিস এলাকায় বিভিন্ন সেবার ওপর গুরুত্বারোপ করে অধ্যাপক খান একমত পোষণ করেন। তিনি স্ট্রিট ফুড বিক্রির জন্য একটি কাঠামোগত পদ্ধতির পরামর্শ দিয়েছেন এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য অননুমোদিত দোকানগুলো স্থাপন করতে নিরুৎসাহিত করেছেন।
তিনি বলেন, 'একটি সঠিকভাবে পরিকল্পিত নির্ধারিত স্ট্রিট ফুড অঞ্চল, মানুষকে আকর্ষণ করবে এবং একটি প্রাণবন্ত পরিবেশকে উৎসাহিত করবে।'
অধ্যাপক খান এবং অধ্যাপক আদিল দুইজনই জোর দিয়েছেন সবুজায়নের ওপর।
যেহেতু এটি অফিসকেন্দ্রিক এলাকা, তাই অফিস সময়ের পর এখানে ভিড় কম হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ঢাকার মতো ব্যস্ত শহরে মানুষের ঘোরার জায়গাগুলো আরও সমানভাবে বণ্টন করা উচিত।
অফিস পরবর্তী সময়ের কথা বিবেচনা করে বিশেষজ্ঞরা অফিসের আশেপাশে রিলাক্সেশন স্পট ও পকেট পার্কিংয়ের পরামর্শ দেন। তাদের মতে, রেস্তোরাঁ এবং কফি শপগুলো এর পরিপূরক হতে পারে, ফলে অফিসের সময়ের পরেও এই এলাকা প্রাণবন্ত থাকবে।
এসব লক্ষ্য অর্জনে অধ্যাপক খান টেকসই ব্যবস্থার উন্নয়ন ও হস্তান্তরের জন্য আন্তর্জাতিক নগর পরিকল্পনাবিদদের কাছ থেকে এমনকি প্রয়োজনে স্বল্পমেয়াদি চুক্তিতেও বিশেষজ্ঞ নেয়ার প্রস্তাব করেন। অধ্যাপক আদিল পরিকল্পনার পুনর্মূল্যায়ন এবং সমস্যাগুলো ঠিক করার পরামর্শ দিয়েছেন। উভয় বিশেষজ্ঞই সরকারের কাছ থেকে প্রশাসনিক সহায়তার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন