বুড়িগঙ্গার একাল-সেকাল
স্বচ্ছ জলরাশি ও উত্তাল ঢেউয়ের প্রশস্ত এক নদী। সারাদিন ধরে নৌকোয় চড়ে সে নদীর বুকে চলতো মানুষের অবাধ পারাপার। সকাল হলেই শুরু হতো নদী পাড়ের মানুষদের সমস্ত কর্মযজ্ঞ। নদী থেকে একটু দূরে নৌকা মেরামতের কাজে ব্যস্ত থাকতেন মাঝিরা। কাজের ফাঁকে ফাঁকে গলা ছেড়ে গান গাইতেন কেউ কেউ। সে গানে সুর মেলাতেন অন্যরাও। নৌকোয় করে ওপারে যাওয়ার লক্ষ্যে শতশত মানুষের ভীড় জমতো চারপাশে। সেসব যাত্রী নিয়ে এপার-ওপার ছুটে বেড়াতেন কর্মব্যস্ত মাঝিরা। এই ছুটে বেড়ানো চলতো রাত অবধি। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতেই দেখা যেতো নৌকা ভর্তি মাছ নিয়ে ক্লান্ত জেলেদের তীরে ফেরার দৃশ্য।
সকাল-সন্ধ্যা এমন প্রাণচঞ্চল জীবন দেখা যেতো যে নদীর বুকে, তার সাথে 'বুড়ি' নামটি যেন বড্ড বেমানান। তবুও কালক্রমে এই নদীর নাম হয়ে যায় বুড়িগঙ্গা। অবশ্য এ নিয়েও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের শেষ নেই!
যেভাবে হলো 'বুড়িগঙ্গা' নাম
ঢাকার দক্ষিণ ও পশ্চিম পাশ দিয়েই বুড়িগঙ্গার বয়ে যাওয়া। ধলেশ্বরী নদী থেকে উদ্ভূত এই নদী। কিন্তু কথিত আছে, গঙ্গা নদীর একটি ধারা ধলেশ্বরী হয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে মিশেছিল। যখন গঙ্গার সেই ধারাটির গতিপথ পরিবর্তন হয়, তখন গঙ্গার সাথে তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে প্রাচীন গঙ্গা এই পথে প্রবাহিত হতো বলেই এমন নামকরণ।
অনেক গবেষক বা লেখকদের লেখায়ও সেটিই উঠে এসেছে। নীহাররঞ্জন রায় তার 'বাঙ্গালীর ইতিহাস' (আদি পর্ব) বইয়ে বুড়িগঙ্গার উৎপত্তি নিয়ে লিখেছেন, 'পদ্মার প্রাচীনতম প্রবাহপথের নিশানা সম্বন্ধে নিঃসংশয়ে কিছু বলা যায় না। ফান ডেন ব্রোকের নকশায় দেখা যাইতেছে পদ্মার প্রশস্ততর প্রবাহের গতি ফরিদপুর-বাখরাগঞ্জের ভিতর দিয়া দক্ষিণ শাহবাজপুরের দিকে। কিন্তু ঐ নকশাতে আরেকটি প্রাচীন পথেরও ইঙ্গিত আছে। এই পথটি রাজশাহীর রামপুর-বোয়ালিয়ার পাশ দিয়ে চলনবিলের ভিতর দিয়া ধলেশ্বরীর খাত দিয়ে ঢাকার পাশ ঘেঁষে মেঘনা খাঁড়িতে গিয়ে সমুদ্রে মিশিত। ঢাকার পাশের নদীটিকে যে বুড়িগঙ্গা বলা হয়, তাহা এই কারণেই। ঐ বুড়িগঙ্গাই প্রাচীন পদ্মা-গঙ্গার খাত।'
মোগলদের আগমন
১৬১০ সালের কথা। বঙ্গে তখন আগমন ঘটে মোগলদের। সে সময়ে সর্বপ্রথম তাদের নজর কাড়ে বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্য। প্রমত্তা এই নদীর নানা রূপে মুগ্ধ হয়ে যান তারা। তা এতটাই তীব্র ছিল যে, বুড়িগঙ্গার তীরেই স্থাপন করে বসেন ঢাকা নগরী। নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা এমন একটি নগরীই চেয়েছিলেন তারা। কিন্তু এইটুকুতেই মোগলরা সন্তুষ্ট থাকবেন তা কী করে সম্ভব! সিদ্ধান্ত হয় আরও আকর্ষণীয় রূপে সজ্জিত হবে নদীর আশপাশ। হলোও তাই।
পরিকল্পনা মাফিক রাঙ্গিয়ে তোলা হলো নদীর তীরবর্তী নগরীকে। এরপর আলোকিত নগরীর নদীর ধারে হতো মোগলদের জমজমাট আড্ডার আসর। সাথে গান বাজনার আয়োজন তো ছিলোই। রাতের সময়টাকে আরও উপভোগ্য করে তুলতে নদীর তীরে অবস্থিত শহরের আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করেছিলেন মোগল সুবেদার মুকাররম খাঁ। বলা হয়, এই নদীর জোয়ার-ভাটার রূপ দেখেই নাকি প্রেমে পড়েছিলেন মোগলরা।
শুধু তারাই এই নদীর রূপে মন্ত্রমুগ্ধ ছিলেন তা নয়; অনেক ইউরোপীয় বণিকদের কাছে পুরো নগরীজুড়ে এটিই ছিল একমাত্র প্রশান্তির জায়গা। তাদের দেখাদেখিতে অষ্টাদশ শতকে ঢাকায় আগমন ঘটে আরও অনেক ইউরোপীয়দের। নদীর তীরঘেঁষে নানারকম ব্যবসাকেন্দ্রও গড়ে তোলেন তারা। সেকালের বুড়িগঙ্গা ছিল অবাধ সৌন্দর্য্যের আধার। তাই নদী ভ্রমণের উদ্দেশ্যে নানান প্রান্ত থেকে মানুষের আসা-যাওয়া ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার।
অনেক জমিদার তাদের বড় বড় বজরা ভিড়াতেন বুড়িগঙ্গার তীরে। কিছুদিন এভাবে ভ্রমণ শেষে ফিরে যেতেন আস্তানায়। নদীর রূপ দেখে প্রেমে পড়েননি এমন মানুষের দেখা মেলা ভার! শরতের নীল আকাশে ভেসে থাকা শুভ্র মেঘের ভেলা, বর্ষায় নদীর বুকে স্বচ্ছ জলরাশি, শীতে শান্ত নদীর বুকে জেগে ওঠা চর, গ্রীষ্মের দুপুরে প্রমত্তা নদীর বুকে উত্তাল ঢেউ- বুড়িগঙ্গায় এমন সব দৃশ্যপটই ছিল নিত্য নৈমিত্তিক।
নৌকোয় জ্বলতো ফানুস-বাতি
উত্তাল এই নদীর দু'পাশজুড়ে ছিল ঘন গাছগাছালি। সেখান থেকে শোনা যেতো পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ। নদীর উপরে ঝাঁক বেধে শঙ্খচিলের উড়োউড়ি। দিনের সূর্যের সোনালী কিরণ বা চাঁদের স্নিগ্ধ আলো মিলিয়ে গিয়ে ঝিলমিলিয়ে উঠতো নদীর পানি। রাতের বেলায় নদীর বুকে ভাসতে থাকা নৌকোয় জ্বলতো ফানুস-বাতি। পানিতে সেসব বাতির প্রতিচ্ছায়া নদীর সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিতো। অমাবস্যার রাতে নদীর তীরে মানুষের চলাচল কম হলেও চাঁদনী রাতে দেখা যেতো বিপরীত চিত্র।
ঘর থেকে বেরিয়ে প্রায় সবাই ভিড় জমাতেন তীরে। তারপর রাতভর আড্ডা দিতেন তারা। সবাই মিলে খেলে-গেয়ে আসর জমিয়ে রাখতেন। কেউ গান ধরলে সে গানে সুর মেলাতেন অন্যরাও। এভাবেই চাঁদের আলোয় নদীর তীরে কাটিয়ে দিতেন পুরো রাত।
দিন হোক বা রাত— সদা প্রাণচঞ্চল পরিবেশ বিরাজ করতো নদীর চারিদিকে। সেই মোগল আমল থেকেই মানুষের পদচারণায় মুখর ছিল এই নদীর আশপাশ। উনিশ শতকের দিকে তা আরও বেড়ে যায়। তখন বুড়িগঙ্গা হয়ে ওঠে মানুষের ঘুরে বেড়ানোর অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
জানা যায়, ১৮৬৪ সালে নাকি ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট ঢাকাবাসীদের সকাল ৯টার আগে ও বিকেল ৩টার পর নদীর ঘাটে স্নান করা নিষেধ করে আইন জারি করেছিলেন। মানুষের অবাধ যাতায়াত কমিয়ে আনতেই নেওয়া হয়েছিল এমন উদ্যোগ।
কিন্তু সেভাবে হয়তো সফল হতে পারেনি তা। নদীর ওপর বাকল্যান্ড বাঁধের কাজ শেষ হতেই আগের চেয়ে বেড়ে যায় মানুষের আনাগোনা। এমনকি বাঁধটি নির্মাণের পরবর্তী প্রায় একশো বছর পরেও ঢাকাবাসীদের কাছে পছন্দের বেড়ানোর স্থান ছিল এটি। কারণ বাঁধ থেকে বুড়িগঙ্গার মনোরম সৌন্দর্য দ্বিগুণ হয়ে ধরা দিতো তাদের চোখে। নদীর বুকে ভাসমান বজরা নৌকার বহর ছিল তৎকালীন ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্যতম আকর্ষণ। তাছাড়া, নদীর ধারে দেখা যেতো পানসি, কোষা, ডিঙ্গি, নায়রী, গয়না সহ হরেক রকম নৌকা।
ছিল বিশাল জেলে পল্লী
এসব নৌকা নিয়ে পূর্ণিমা রাতে জেলেরা বেরিয়ে পড়তেন মাছ ধরার উদ্দেশ্যে। নদীর দক্ষিণের তীর ঘেঁষে ছিল বিশাল জেলে পল্লী। প্রায় সময় নদীতে দেখা যেতো ব্যস্ত জেলেদের। জাল পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন। অপেক্ষা করতেন কখন মাছ এসে ধরা দেবে জালে। রাত অবধি চলতো সে কাজ। যত মাছ পাওয়া যেতো, ভোরে বিক্রি হতো বাজারে। আবার দুপুর থেকে পুনরায় শুরু হতো মাছ ধরার কাজ। সে সময়ে বিক্রি করার পরেও নিজেদের জন্য ঝুড়ি ভর্তি মাছ নিয়ে ঘরে ফিরতেন জেলেরা। এতে খেয়ে ও বিক্রি করে আরামেই কেটে যেতো দিন।
আবার সকাল থেকে নদীর ধারে শুরু হতো ধোপাদের কাজ। ভোর হতেই কাপড় ধোলাইয়ের কাজে লেগে যেতেন তারা। বুড়িগঙ্গার পানি পরিষ্কার ছিল বলে বুড়িগঙ্গায় সে কাজ হতো। এখনো এই পেশা বহাল রেখেছেন ধোপা ইকবালরা। কাজ করছেন ৪০ বছর হলো। বাবা-দাদাদের সময় থেকেই বুড়িগঙ্গার তীরে বসবাস তার।
ফেলে আসা দিনের কথা জানতে চাইতেই হাসি ফোটে তার মুখে। উচ্ছ্বসিত হয়ে ইকবাল বলেন, "এই নদীতে ছোডবেলায় কত সাঁতার যে কাটসি হিসাব নাই। সারাদিন নদীর পানিতেই থাকতাম। মাঝেমধ্যে দলবল নিইয়্যা বড়শি লইয়্যা মাছ ধরতাম। কেউ বেড়াইতে আইলে আমাদের লগে মাছ ধরতো।"
'মাল্লাই দোমাল্লাই নৌকা এসে ভিড়তো নারিন্দার পুলের আশেপাশে'
শুধু ধোপা ইকবাল নন। খ্যাতনামা অনেক লেখকই তাদের লেখায় ব্যক্ত করে গেছেন পুরোনো বুড়িগঙ্গার অনেক অজানা গল্প। এই যেমন 'ঢাকা পুরাণ' গ্রন্থে মীজানুর রহমান তার ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে লেখেন, 'দূর-দুরান্ত থেকে মাল্লাই দোমাল্লাই নৌকা এসে ভিড়তো নারিন্দার পুলের আশেপাশে। এসব নৌকায় বেদেরা নিয়ে আসতো মাটির হাঁড়ি, কলসি ও অন্যান্য তৈজসপত্র থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক কিছু। তখন ঘাটজুড়ে চোখে পড়তো বেদেদের নৌকার বহর।'
ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে নদীর বুকে দেখা যেতো ভিন্ন ভিন্ন রূপ। বর্ষার দিনে বৃষ্টি হলেই পানি বেড়ে কানায় কানায় পূর্ণ থাকতো নদীর দু-ধার। নগরীর অনেক জায়গাও ডুবে থাকতো জলে। জলমগ্ন নদীকে তখন দ্বীপের মতই মনে হতো। এই সময়ে জল থৈ থৈ নদীতে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়তো দুরন্ত বালকেরা। আবুল ফজল তার 'রেখাচিত্র' গ্রন্থে এমনই এক বর্ষার দিনে বুড়িগঙ্গার রূপ বর্ণনা করে লেখেন, 'বর্ষাকালে যখন বুড়িগঙ্গা কানায় কানায় ভরে উঠতো তখন কী আনন্দেই না আমরা তাতে ঝাঁপিয়ে পড়তাম আর এপার-ওপার সাঁতরাবার প্রতিযোগিতায় নামতাম।'
লেখক আবুল ফজলই নন, নদীর আশেপাশে বড় হওয়া সবারই এই নদীকে ঘিরে আছে সহস্রাধিক গল্প। এই যেমন মাঝি মো. হোসেন। বয়স সত্তরের কোঠায়। তার দাদা, বাবা, চাচা সবাই নৌকা চালাতেন। বংশ পরম্পরায় তিনিও সে পেশায় জড়িয়েছেন নিজেকে। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মাঝির কাজ করছেন হোসেন। শুধু পেটের দায়ে করেন তা নয়। এই কাজে মায়াও তৈরি হয়েছে তার। নদীর প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসার আভাস পাওয়া যায় তার ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে। প্রিয় কোনো জিনিসের নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার তীব্র যে যন্ত্রণা, তা তার চোখে স্পষ্ট।
'শীতকালে চর হইতো'
'মুক্তিযুদ্ধেরও অনেক আগের কথা। আমার বয়স ১৩ বা ১৪ হইবো। তহন কী সুন্দর পানি ছিল এইহানে। দুই-তিন হাত উঁচু উঁচু ঢেউও ছিল। নদীতে মাছ আর মাছ। বড়শি দিয়া কত মাছ ধরসি। সারাদিন নদীতে ঝাঁপাঝাপি কইরা চোখ লাল হইয়া যাইতো। আমি থাকতাম নদীর অই পারে, কেরানীগঞ্জে। শীতকালে অইহানে চর হইতো। কাশফুলে দুই ধার সাদা হইয়া থাকতো,' বলছিলেন মো. হোসেন।
যখন মাঝি হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি তখন নদী পার হতে লাগতো আট আনা। বর্তমানে জনপ্রতি ১০ টাকা করেই পান। কিন্তু তার নিকট এখনো সেই আট আনার দিনই অপেক্ষাকৃত মধুর।
হোসেন আরও বলেন, কেরানীগঞ্জ, কালিগঞ্জ ইত্যাদি জায়গায় রাত হলেই শুরু হতো শিয়ালের হাঁকডাক। এমনকি ২০ বছর আগেও নদীর দুধারে অবাধ আনাগোনা ছিলো শিয়ালের। সে সময় নদীতে বইতো নির্মল শীতল বাতাস। সে বাতাসে পাল তোলা নৌকা বাইতেন মাঝিরা।
শীতের দিনে যে চর জাগতো নদীর দুপাশে, তা ঘিরে সৃষ্টি হয়েছিল আরও একটি পেশার। চরের মাটি উর্বর ছিল বলে কেউ কেউ শুরু করেন সবজির চাষ। বেশ ফলনও হতো তাতে। নানা রকম সবজিতে ভরে যেতো নদীর দুপাশ। পরিপক্ক হতেই তা বাজারে আনা হতো বিক্রির উদ্দেশ্যে। এখন সে পেশাও বিলুপ্ত। এদের কেউ কেউ এখন করেন মালামাল বহনের কাজ। আবার কেউ কেউ মুদির দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন কোনোভাবে।
অবাধ বিচরণ ছিল শুশুকের
সারেং আবদুল মতিন। এই বুড়িগঙ্গার বুকে দীর্ঘ ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তার আনাগোনা। নদীর বর্তমান বা অতীত দুটোই দেখেছেন নিজ চোখে। আগের স্মৃতি মনে করতে গিয়ে তিনি বলেন, "আশেপাশে বসবাসরত সবার খাবার পানির একমাত্র উৎস ছিল এই বুড়িগঙ্গার পানি। সকাল- সন্ধ্যা কলসী কাঁকে পানি ভর্তি করে নিতেন নদী পারের নারীরা। খাওয়ার পাশাপাশি গোসল বা অন্যান্য ধোয়াপালার কাজ তো ছিলই। এমনকি, লঞ্চ বা জাহাজের যাত্রীদের খাবার পানির যোগান আসতো এই নদী থেকেই।"
সুপেয় বলেই এক সময় এই পানিতে অবাধ বিচরণ ছিল শুশুকের। প্রায়ই তাদের দেখা যেতো নদীতে। জেলেদের জালেও ধরা দিতো তারা। দেশের অনেক নদীতে বসবাসকৃত বিভিন্ন প্রজাতির ডলফিনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— শুশুক, ইরাবতী, ফিনলেস, গোলাপি, বোতলনাক, চিত্রা ও ঘূর্ণি। এরমধ্যে শুশুকের বসবাস সেসব নদীতে যেসব নদীর পানি হলো মিষ্টি। সাধারণত পরিষ্কার মিঠাপানি এই প্রাণির বেঁচে থাকার অন্যতম প্রধান শর্ত বলে পরিচিত।
স্থানীয় অনেকের মতে, আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগেও বুড়িগঙ্গায় দেখা মিলতো শুশুকের। শুধু তাই নয়, পাশাপাশি ছিল ঘড়িয়ালের বিচরণও। মিঠা পানিতে অভিযোজিত এসব জলজ প্রাণী নদী দূষণের ফলে আজ বিপন্ন প্রায়। এখন নদীপাড়ের অনেকের কাছে শুশুক কেবলই গল্প।
নদীর পানির বর্তমান অবস্থায় হতাশ আবদুল মতিনও। এমন স্বচ্ছ, সুপেয় পানির যে বিশ্রি হাল মানুষ করেছে, তা বেশ ভাবায় তাকে। তিনি বলেন, "একটা সময় মানুষের কাছে এটাই গল্প বলে মনে হবে যে এই নদীর পানি সাদা ছিল বা এই পানি খাওয়া হতো। যারাই এমন সুন্দর পানিটাকে নষ্ট করলো, একটা সময় তারাই পানির জন্য হাহাকার করবে।"
উত্তাল নদী বুড়িগঙ্গা
তখনের বুড়িগঙ্গা ছিল উত্তাল এক নদী। নদীর গভীরতাও ছিল বেশ। বিশাল প্রস্থের এই নদীর তীরে উঁচু উঁচু ডেউ এসে আছড়ে পড়তো। ফলে নদীপথে নানারকম দুর্ঘটনার শিকার হতো মানুষ।
অনেক ঐতিহাসিকের লেখায় বুড়িগঙ্গায় ঘটে যাওয়া অনেক দুর্ঘটনার উল্লেখও পাওয়া যায়। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তাঁর 'ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী' গ্রন্থে এমনই এক ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে ১৬৭৮ সালের পরে কেল্লা আওরঙ্গাবাদের দক্ষিণ ফটক বুড়িগঙ্গা কতৃক গ্রাস করে নেওয়ার কথা উল্লেখ করেন। এক সুবেদারের পালতোলা বজরা তলিয়ে যাওয়ার কথাও এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করেন তিনি। সেসময় এমন আরও অনেক ঘটনার সম্মুখীন হতো বলে নদীর রোষানল থেকে বাঁচতে লোকেরা চিনি-বাতাসা-পান দিয়ে নাকি ভ্যাটও দিতো। অবশ্য এর পেছনের কারণও বেশ শক্তিশালী।
আজ থেকে ৪০০ বছরেরও বেশি সময় আগে এই বুড়িগঙ্গাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল ঢাকা নগরী। কিন্তু যাকে কেন্দ্র করে এই শহরের গোড়াপত্তন হয়, সেই নদীই আজ ধ্বংসের মুখে। আগের মত স্রোত নেই। উত্তাল ঢেউ এসে আঁচড়ে পড়ে না তীরে। নদীর বুক ছুঁয়ে ঠান্ডা বাতাসেরও দেখা মেলে না আর। সময়ের সাথে সাথে এই নদীর তীরে গড়ে ওঠে নানা শিল্প কারখানা। সেসব কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য এসে পতিত হতে থাকে বুড়িগঙ্গায়।
ট্যানারি বর্জ্যের কারণে এই নদী এখন মাছশূন্য। কোনো জলজ প্রাণির বেঁচে থাকাই যেন দায়। নদীতে মাছ নেই বলে বিলুপ্ত জেলে পেশা। নেই জেলে পল্লীও। নদীর তীরে চর জাগতেই চলতে থাকে জমি দখল। কেটে ফেলা হয় চারপাশের গাছপালা। তারপর শুরু হয় দালান তৈরির কাজ। উচ্ছেদ করা হয় সেখানে বসবাসরত জেলেসহ নানা পেশার মানুষদের। এভাবে করে নদীর পরিধিও কমতে থাকে ধীরে ধীরে। এমন সব কারণে বুড়িগঙ্গার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা অনেক মানুষই হয়ে পড়েন কর্মহীন। অথচ তারাই ছিলেন এই প্রাণচঞ্চল নদীর মধ্যমণি।
'মুন্সিগঞ্জ ব্রিজ পার হয়েই দেখবেন কী সুন্দর স্বচ্ছপানি। কালো পানির কোনো চিহ্ন নাই। চারপাশের পরিবেশও সেই আগের মত। অথচ বুড়িগঙ্গা এর চেয়ে সুন্দর ছিলো এককালে। এখন তো নদীর পানির গন্ধেও কেউ লঞ্চের ছাদে যেতে চায় না। আগে প্রায় মানুষই ছাদে গিয়ে নদী দেখতো। চারপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতো। এখনো সেসব দৃশ্য চোখের সামনে ভাসে আমার,' বলছিলেন যাত্রি নুরুল ইসলাম।
ষাটোর্ধ্ব এই বৃদ্ধ ছোটবেলা থেকেই যাত্রা করেন নদীপথে। বাড়ি বরিশাল হওয়ায় লঞ্চই তার একমাত্র বাহন। তাই বুড়িগঙ্গার বুকে প্রায়ই যাতায়াত থাকে তার। নদীর এমন করুণ দশায় ব্যথিত তিনিও। এর পেছনে দায়ী করেন দূষণ এবং অবাধে জমি দখলকে। তিনি মনে করেন, এই দুটো জিনিসই পুরো নদীটাকে ঠেলে দিয়েছে ধ্বংসের দিকে।
'আজীবন নদীর খাইলো, পরলো, অথচ তারাই নদীটারে নষ্ট কইরা দিলো'
বর্তমানে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই এই নদীতে। নেই আগের সেই জৌলুশও। শখের বশেও কেউ আর বেড়ানোর উদ্দেশ্যে ভীড় করে না। মধ্যরাতে দূর থেকে ভেসে আসে না শিয়ালের হাঁকডাক। নদীর বুকে চর জাগে না বলে কাশফুলের দেখা নেই দীর্ঘবছর। গাছপালার কোনো চিহ্ন নেই। বুড়িগঙ্গা এখন কেবলই এক দূষিত নদী। যে নদীর জল পান করে জীবন ধারণ করতো হাজার হাজার মানুষ, সে পানিই সবচেয়ে বিষাক্ত আজ। একটা সময় ঢাকার মানুষ হয়তো বলবে, নগরায়ন এবং আধুনিকায়নে সবচেয়ে বড় ক্ষতির শিকার এই বুড়িগঙ্গাই।
সদরঘাটের মালামাল বহনকারী আব্বাস বুড়িগঙ্গার পারে কাজ করেন ২০ বছর ধরে। এই নদীর তীরেই তার বেড়ে ওঠা। নদীর রূপ-বৈচিত্র্য কিছুটা নিজের চোখে দেখেছেন তিনি। চোখের সামনে নদীর পানি নষ্ট হয়ে এভাবে দূষিত ও কালো হয়ে যাওয়ায় একরাশ অভিযোগ তার।
আব্বাসের মতে, "কিছু কিছু লোক আছে, মায়ের কাছে বড় হইয়্যা মায়েরে ভুইল্যা যায়। উপকার করলে সেইটা মনে রাখে না। এমন লোক এইহানেও আছে। আজীবন নদীর খাইলো, পরলো, অথচ তারাই নদীটারে নষ্ট কইরা দিলো।"