ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডালের কথা কেন কেউ ভোলে না!
পাত পেড়ে ডাল-ভাত খেতে ভালোবাসে না এমন বাঙালি মিলবে না বঙ্গদেশে। এমন কথা দাবি করে বললে অন্তত ভুল প্রমাণিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই প্রচণ্ড গরমে রোদ্দুর ঠেঙিয়ে কর্তাটি অফিস থেকে ফিরে ডাল-ভাতের সাথে পাতিলেবু চটকে এমন তৃপ্তির সাথে খান, যে তৃপ্তি মেলে না ফাইভস্টার রেস্তোরাঁর খটমট নামের খাবারেও। কেবল কেবল জ্বর থেকে সেরে উঠছি, মুখে রুচিমাত্র নেই। এমন সময়ে এক বাটি মসুর ডাল, ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত আর একটা কাঁচা লঙ্কা জুটলে আবারো অনেক অনেক দিন বাঁচতে ইচ্ছে করে। ফুলকো লুচির সাথে নারকেল দিয়ে ছোলার ডাল, বিয়ে বাড়িতে মাছের মাথা দিয়ে সোনামুগ ডাল কিংবা ব্যাচেলর লাইফের শেষ ভরসা ডাল-ডিম ভাজা—ডাল সবখানে স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
বাঙালি যেখানেই যাক, আর কিছু খাক বা না খাক—প্রথম বা শেষ পাতে একটু ডাল থাকা চাই ই চাই। স্কুলে যাবার আগে কখনো মায়ের হাতের ডাল ভাত খেয়ে বেরোয়নি এমন ছেলেমেয়ে পাবেন না হ্যারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজলেও। একসময়ে বাড়ির মায়া ছেড়ে আমাদেরকে পাড়ি দিতে হয় অন্য কোনো শহরে, উচ্চশিক্ষার খোঁজে। তা বাঙালি সন্তান, হোস্টেলে গিয়েও হাপিত্যেশ করে বসে থাকে ডাল-ভাতের জন্যে। ওরা টাকার মোহ ছাড়তে পারলেও ছাড়তে পারে না ডাল-ভাত আর দুপুরবেলার ভাত ঘুমের মোহ। আর তাই বোধহয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে গিয়ে রীতিমত দেখা মেলে গামলা গামলা ডালের।
হয়তো দুপুরবেলা ক্লাস; হন্তদন্ত হয়ে বেরোচ্ছেন। খুব তাড়াহুড়োয় ঢুকলেন ক্যান্টিনে। ডালের গামলার দিকে মুখিয়ে প্লেটে ডাল নিতে যাবেন, এমন সময়ে ডালের গামলায় নিজের মুখখানা দেখে নিলেন একঝলকে। সুতরাং হলে ডাল থাকলে আয়না থাকবার প্রয়োজন পড়ে না। একেই খাচ্ছেন বিনে পয়সার ডাল, সাথে বেঁচে গেল আয়না কেনবার খরচ। এমন সাশ্রয় সম্ভব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আজকে গল্প বলবো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডালের। ডাল বলতে আপনি ঠিক কী বোঝেন—তা আমার জানা নেই। হলের বাসিন্দারা ডাল বলতে যে বস্তুটিকে বোঝে—তার বৈশিষ্ট্য শতভাগ মিলে যায় জলের সাথে।
হলের ডাল কিন্তু একেবারেই গুরুপাক নয় বরং হজমশক্তির জন্যে অতি উত্তম। একথা চরম শত্রুকেও স্বীকার করতে হবে। এই ডাল এতটাই পাতলা যে কোনটা ডাল আর কোনটা জল, তা বুঝে উঠতে সময় লেগে যায় ঢের। এইভাবেই পুরুষ মানুষ ডাল চিনতে শিখে সংসারী হওয়ার পাঠটা নেয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই।
প্রথম বর্ষের যে শিক্ষার্থীরা হলে উঠে প্রথম প্রথম ডাল নামক বস্তুটি চিনে উঠতে হিমশিম খান, তারাই পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন ডাল বিশারদ। ভাতের মাড়ে কতটুকু লবণ আর হলুদ দিলে সেটা ডাল হয়ে ওঠে, তা তাদেরকে কোনো রেসিপির বই পড়ে শিখতে হয় না। এই দেখলেন তো, আবারো রেসিপির বই কেনবার খরচাটা বেঁচে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাল যে কত হাজারো সাশ্রয়ের সাক্ষী, তা আপনি চিন্তাও করে উঠতে পারছেন না।
এতদিন শুনেছেন, মানুষ চেনা বড়ো দায়। আজকে নতুন করে শোনাচ্ছি, হলের ডাল চেনা বড়ো মুশকিল। হলের ডাল নিয়ে হাজারো গল্প জমে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আনাচে কানাচে। বের হলাম সেই সব গল্পের খোঁজে, গল্পকারদের খোঁজে।
শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র নাজমুল হাসান। প্রথম বর্ষ থেকেই হলের বাসিন্দা তিনি। অভিজ্ঞতার কারণে ডাল সম্পর্কে বেশ টনটনে জ্ঞান এই ছাত্রের। তবে মুশকিল এই যে, এখন পর্যন্ত চাকরির পরীক্ষাগুলোতে হলের ডাল খাওয়ার অভিজ্ঞতাকে আলাদা করে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। এ এক ঘোরতর অন্যায়। হলের প্রোটিন ফ্রি ডাল খেয়ে যে ছাত্ররা বছরের পর বছর টিকে থাকে, তাদেরকে জীবনীশক্তির দরুন কী চাকরিতে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত নয়? এমন কই মাছের প্রাণের চাকুরেই তো দিতে পারে সর্বোচ্চ সেবা। ঘাড়ের ওপর যতই ফাইল চাপান না কেন, ডাল খাওয়া চাকুরের কুছ পরোয়া নেহি।
এই হলবাসী ছাত্রকে ডাল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি যা বললেন, তা শুনে চোখ ছানাবড়া হবার যোগাড়। "একদিন হলের ক্যান্টিনে খেতে বসেছি, সামনে বসা এক ছোটো ভাই পাতলা ডালের বাটিতে অবলীলায় হাত ধুয়ে ফেললো। ঘটনার আকস্মিকতায় পুরো টেবিলের সবাই খাওয়া থামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। পরে জানা গেল, ছেলেটা বুঝেই উঠতে পারেনি ওটা খাওয়ার ডাল ছিল। ভেবেছে হাত ধোয়ার পানি।"
তাহলেই বুঝুন কাণ্ড! ডাল আর জলে তফাৎ করা যায় না—এমন পাতলা ডাল বানানো কী যে সে ব্যাপার? হলের রাঁধুনিদের এলেম আছে বটে। এমন রন্ধনকৌশল আয়ত্ত করতে হলে ডেডিকেশন থাকা চাই। থাকা চাই আত্মবিশ্বাস। এরপর আবার ডাল দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলবার কারণে পানির অপচয় রোধ হচ্ছে। বেসিনে যাবার সময়টাও সাশ্রয়। ফিরতে হবে সাশ্রয়েই।
শুধু তাই নয়, অনুসন্ধানে বোঝা গেল দেশের অন্যতম প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার অতীত গৌরবকে ধরে রাখায় বেশ সচেষ্ট। হ্যাঁ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের ডাল আজ থেকে ৪৫ বছর আগেও যেমন পাতলা ছিল এখনো তেমনি। ৪৫ বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়লেও বাড়েনি ডালের ঘনত্ব। তা এত বছর ধরে একইভাবে ঘনত্ব না বাড়ার ব্যাপারটাই কিন্তু অক্ষুণ্ন রেখেছে গৌরব।
তবে অনিরুদ্ধ বিশ্বাস নামের এক আবাসিক ছাত্র জানালেন, "ডাল ঘন করবার একটা গভীর ষড়যন্ত্র চলেছিল। আটার লেইচি দিয়ে ডাল ঘন করা হয়েছিল যাতে করে তলানিটা দেখা না যায়।" যে বিশ্ববিদ্যালয় স্বচ্ছতার প্রশ্নে সকলের থেকে এগিয়ে আর স্বচ্ছতার প্রতীক মনে করে ডালকে—তারা সেই ঘোলাটে ডালকে আবারো ফিরিয়ে এনেছে স্বচ্ছতায়। মেনে নেয় নি ষড়যন্ত্র।
এই স্বচ্ছ ডালের এমনই চাহিদা যে মেয়েদের হলগুলোতে অনাবাসিক ছাত্রীদেরকে হলের গেট ডিঙোতে দেওয়া হয় না। না জানি তারা আবার ডালের বাটি ফাঁকা করে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়ের হলের শুধু আবাসিক ছাত্রীরাই খেতে পারে এই মূল্যবান 'ফ্রি' ডাল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত গৌরব আর পাতলা ডালের ঐতিহাসিক পটভূমি খুঁজতে হাজির হলাম ১৯৭৬-৭৭ সেশনের এক প্রাক্তন ছাত্রের কাছে। আমি যেহেতু রোকেয়া হলের আবাসিক ছাত্রী, তাই বর্তমানের সাক্ষী হয়ে অতীতকে খোঁজবার এই অ্যাডভেঞ্চারে দারুণ আনন্দ পেলাম। হলের ডাল নিয়ে গল্প করতে করতে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই প্রাক্তন ছাত্র স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লেন। কী ডালের মহিমা একবার ভাবুন তবে! ইংরেজি বিভাগের এই ছাত্র খুবই আন্তরিকভাবে ডাল বৃত্তান্ত বলে যেতে লাগলেন। বলার ভঙ্গিমা আমাকে মনোযোগী শ্রোতা করে তুললো।
"জগন্নাথ হলের ডাইনিংয়ের টেবিলগুলোতে দুপুরে খাওয়া চলতো বারোটা থেকে দুটো পর্যন্ত। আমরা যারা অর্থের অভাবে সকালে তেমন কিছু জল খাবার খেতাম না, দুপুরবেলা স্বাভাবিকভাবে আগে খিদে পেয়ে যেত। তাই ডাইনিংয়ে আগেভাগে গিয়েই পাঁচ নয়া পয়সা বা ছোট্ট কাগজে নাম-রুম নম্বর লিখে জায়গা ব্লক করতাম। এভাবে জায়গা নিলে আগে খাওয়ার সুবিধা পাওয়া যেত। আর জুটতো কম পাতলা ডাল। সময় যতই গড়াতো ডালে মেশানো হতো লবণ মেশানো গরম জল। সেগুলো ঢালা হতো পরে খেতে বসা ছাত্রদের প্লেটে।"
"এই ডাল যদি কখনো বা অসাবধানে শার্ট-প্যান্টে পড়ে গেলেও তার জন্যে ছিল না আলাদা ডিটারজেন্ট খরচ। হাত দিয়ে মুছে ফেললেই কোন দাগ থাকত না আর। কারণ এই ডালের জলে ডাল থাকতোনা, ডালের রং ছাড়া। আর সেই রঙও খুব পাকা রঙ নয়।"
"ডাইনিং হলের ক্যাটারার এভাবেই ডালের অতিরিক্ত চাপ সামলাতে চেষ্টা করত। শেষে খেলে সবজি বা মাছ তেমন মিলতো না। তবে নিম্নমানের রেশনের চালের ভাত ও ডালের পরিমাণে কোনো কড়াকড়ি ছিল না। যত খুশি খাওয়া যেতো। খাবারের মান উন্নত করতে হবে এমন সব স্লোগান দিয়ে মিছিল হতো। তেমন কোন পার্থক্য হত না এতে। সুতরাং 'আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম' কথাটি পুরো সত্য নয়," পুরোনো দিনের এমন সব কথা জানাচ্ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রাক্তন ছাত্র।
প্রসঙ্গ যেহেতু ডালের, তাই নিজ থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছোনোটা অন্যায়। সিদ্ধান্ত নেয়া হোক তাদের থেকে যারা রোজ রোজ এই ডাল খাচ্ছেন। এবারে বর্তমানে ফিরে আসা যাক।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের একজন আবাসিক শিক্ষার্থী মেহেদী হাসানের সাথে কথা হলো ডাল নিয়ে। তিনি যা বললেন তার সারমর্ম অনেকটা এরকম—পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য ডাল বোধহয় তাদের হলে পাওয়া যায়। ডালের ঘনত্ব এতো বেশি যে ডালের দিকে তাকিয়ে নিজের ভবিষ্যৎ পর্যন্ত দেখা সম্ভব। লোকে বলে বাঙালি ফ্রি পেলে আলকাতরা পর্যন্ত ছাড়ে না। কিন্তু এখানের ডালের স্বাদ এতই ভালো যে ডালটা ফ্রি ছেড়ে দেওয়া হলেও শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে থাকে অনাদরে, অবহেলায়।
তাহলে বুঝতেই পারছেন, এই ডাল ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। আবার বাঙালি ফ্রি পেলে আলকাতরা অব্দি খায়, এই বদনামটা তো হলের ডালের বদৌলতেই ঘুচতে বসেছে।
রোকেয়া হলের শিক্ষার্থী সানজানা আফরিনের ভাষ্যমতে, "একটু দেরি করে ক্যান্টিনে খেতে গেলে পাতলা ডাল শেষ হয়ে যায়। যারা পাতলা ডাল খান, তাদেরকে দ্রুত যেতে হয়।"
এদিকে সুফিয়া কামাল হলের শিক্ষার্থী স্বর্ণা দাস জানালেন, তার হলের ডালের মান খুবই বাজে। জল দিয়ে ভাত খাওয়া যা, এই ডাল দিয়েও ভাত খাওয়াও তা। তবে ডালের রংটুকু থাকে। ওতেই মানসিক শান্তি যে ডাল-ভাত খেলাম। শিক্ষার্থীদের সময় জ্ঞান তৈরি থেকে শুরু করে মানসিক শান্তির ব্যাপারেও যে হলের ডাল এক নম্বরে আছে, তার প্রমাণ মিললো এভাবেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রথম প্রথম হলের ডাল দেখে হকচকিয়ে উঠলেও এই ডাল কিন্তু একেবারে অকাজের নয়। ডাল নিয়ে রম্য রচনা লিখতে লিখতেই কেউ কেউ যে 'শিবরাম চক্কোত্তি' বনে যায় না—এমন কথা কে বলতে পারে? যে ডাল সাহিত্যরস তৈরিতে সহায়ক, সে ডালকে হেলাফেলার পাত্র ভাবা অনুচিতই বটে।
অস্বচ্ছল ছাত্র-ছাত্রীরা দুবেলা দুমুঠো ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকে হলের এই বিনে পয়সার ডালের মহিমায়। তবে সে ডাল তাদেরকে ঠিক কতটুকু বাঁচিয়ে রাখে সে প্রশ্নের মীমাংসা করা কঠিন। কারণ আগে বহুবার বলেছি, এই ডালে প্রোটিনের ভাগ অল্প, জলের ভাগটা অধিকাংশ। আজ আর ডালের প্রোটিন নিয়ে প্রশ্ন তুলব না। কেননা সে ডাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবগাঁথার এক অধ্যায়। সবসময় নিন্দেমন্দ কেন? আজ নাহয় গৌরব নিয়েই কথা হোক। কথা হোক সাশ্রয় নিয়ে।