জামাল দ্য ফলি ম্যান: যেভাবে ফলি সাউন্ড এফডিসি থেকে ওয়েবসিরিজে
চলচ্চিত্রে পাঁচ রকম শব্দ থাকে। এগুলোর মধ্যে দর্শক বেশি খেয়াল করেন সংলাপ বা ডায়ালগ। তারপর আসে গান। আবহসংগীত আর অ্যাম্বিয়েন্সও অল্পস্বল্প নজর কাড়ে। কিন্তু আড়ালে থেকে যায় ফলি বা ইফেক্ট সাউন্ড। অথচ এটি ছাড়া ছবি স্বাদহীন, কখনো কখনো আলুনি।
ধরুন— ঘোড়া ছুটছে, কিন্তু খুরের কোনো শব্দ নেই; তলোয়ার চলছে, কিন্তু ঝনঝনানি নেই বা গ্লাস পড়ে গেল, কিন্তু ভাঙার শব্দ নেই; তখন ছবি চলে যাবে কিন্তু কোনো দাগ রেখে যাবে না।
একটি পত্রিকা অফিসের কথাই ধরা যাক। এখানে যে শব্দগুলো নিত্য তৈরি হয় তার মধ্যে কিবোর্ড চালানো, চেয়ার নড়াচড়া, ফোন করা, চায়ের কাপে চামচ নাড়া, এক বা একাধিক জনের হেঁটে যাওয়া, কথাবার্তা, পাখা ঘোরা, পত্রিকার পাতা ওল্টানো অন্যতম। এই অফিসে কর্মরত নায়ক-নায়িকার দৃশ্য ধারণের সময় সবগুলো শব্দ ধারণ করা কঠিন। তখন স্টুডিওতে শব্দগুলো তৈরি করে নেওয়ার প্রসঙ্গ আসে, আর ডাক পড়ে ফলি আর্টিস্টের। পত্রিকা অফিসের মতো পানশালা, রান্নাঘর বা লাইব্রেরিরও কিছু সাধারণ শব্দ থাকে, ফলি আর্টিস্টরা সেগুলো স্টুডিওতে তৈরি করে দিয়ে ছবিতে প্রাণ সঞ্চার করেন।
ফলির যাত্রা শুরু
সবাক চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু হয় ১৯২৭ সালে হলিউডের 'জ্যাজ সিঙ্গার' দিয়ে। দুই বছর পরে ১৯২৯ সালে মুক্তি পায় 'শো বোট'। এই ছবির জন্য ইউনিভার্সাল স্টুডিওর জ্যাক ডনোভান ফলি বেশ কিছু ইফেক্ট সাউন্ড তৈরি করেন— যা ফলি ইফেক্টস নামে পরিচিতি লাভ করে।
এরপর ১৯৩১ সালে নির্মিত ড্রাকুলা থেকে ১৯৬০ সালের স্পার্টাকাস পর্যন্ত অনেক ছবিতে জ্যাক ডনোভান ইফেক্ট বা ফলি সাউন্ড তৈরি করেন। দরজায় খট খট , হাড় ও চুইংগাম চিবানো এবং হাঁটাহাঁটির শব্দ সৃষ্টির নতুন নতুন উপায় বের করেন। সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটিয়েছিলেন স্পার্টাকাস ছবির জন্য। ছবিতে শিকল পরে দাসদের হাঁটার দৃশ্য ঠিকঠাক নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু শব্দ বাদ পড়ে যায়। পরিচালক স্ট্যানলি কুব্রিক এটি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না, তিনি আবার দলবল নিয়ে ইতালি যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিলেন। এই সময়েই জ্যাক মঞ্চে আবির্ভুত হন এবং শিকল পরা পায়ের শব্দ সৃষ্টি করে তাক লাগিয়ে দেন।
সময়, অর্থ সব বেঁচে যায় পরিচালকের। সঙ্গীদের জ্যাক বলতেন, অভিনয়ের মুহূর্তটায় যে আবেদন তৈরি হয়েছিল, তা ধরার চেষ্টা করো— তবেই ভালো ইফেক্ট সাউন্ড তৈরি করতে পারবে।
এফডিসির অ্যানালগ আমল
অ্যানালগ আমলে ছবি ও শব্দ আলাদাভাবে ফিল্ম ও ম্যাগনেটিক টেপে ধারণ করা হতো। ছবি তোলার জন্য যেমন বিরাট আয়োজন লাগত, শব্দ ধরার জন্য তার চেয়ে কম লাগত না।
১৯৭৮ সাল পর্যন্ত আমাদের এফডিসিতে ডিরেক্ট সাউন্ড (ছবি, সংলাপ একসঙ্গে) নেওয়া হতো। গান ও আবহসংগীত স্টুডিওতে ধারণ করে পরে একসঙ্গে জোড়া দেওয়া হতো। শব্দগ্রাহক হিসাবে লিয়াকত আলীর ততদিনে এফডিসিতে ছয় বছর হয়ে গেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই চাষী নজরুল ইসলাম নির্মাণ করেন 'ওরা ১১ জন ' ছবিটি। ওই ছবির শব্দগ্রাহক দলের একজন ছিলেন লিয়াকত।
এফডিসির তখনকার সাউন্ড রেকর্ডিং মেশিনের ওজন ছিল ৪৫ কেজি। যখন যেখানে শুটিং, তখন সেখানে এটিকে বয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। তখন অবশ্য এফডিসির বাইরে শুটিং হতো যৎসামান্য। লাইলি মজনু ছবির মরুদৃশ্যের শুটিংও হয়েছিল ২ নম্বর ফ্লোরে।
সে আমলে ইফেক্ট সাউন্ড খুব কম তৈরি করা হতো, অন্য অনেক কাজের সঙ্গে সহকারী পরিচালকই তা সেরে দিতেন।
ভারত বা আমেরিকা থেকে আনানো কিছু সাউন্ড স্পুলের সংগ্রহ ছিল লিয়াকত আলীদের। অ্যাম্বিয়েন্স বা পারিপার্শ্বিক সাউন্ড সংগ্রহের জন্য তারা ক্যাসেট প্লেয়ার নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে যেতেন ও রেকর্ড করে নিয়ে আসতেন।
লিয়াকত আলী বিমান ওঠা-নামার শব্দ, ট্রেন চলার শব্দ, ঝিঝি পোকার শব্দ, নৌকা বাওয়ার শব্দ, সমুদ্রের গর্জন সনি ক্যাসেট প্লেয়ারে রেকর্ড করেছিলেন। নির্জন প্রান্তরে, শহরের মাঝখানে এবং ব্রিজের ওপর দিয়ে যখন ট্রেন চলে, প্রত্যেকবার ভিন্ন ভিন্নরকম আওয়াজ হয়। লিয়াকত সবখানেই ট্রেনের শব্দ ধারণ করেছিলেন।
জামাল দ্য ফলি ম্যান
আশির দশকের শুরুতে ট্র্যাক সাউন্ডের প্রচলন ঘটে। চার ও ছয় ট্র্যাকে শব্দ ধারণের প্রযুক্তি পায় এফডিসি। এর ফলে ফলি আলাদা ট্র্যাকে ধারণের সুযোগ তৈরি হয়, ফলি করার সুযোগ বেড়ে যায়। কিন্তু তখনো পেশাদার ফলি আর্টিস্ট দেখেননি লিয়াকত। সহকারীরাই ঠেকার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল।
দশকের শেষ দিকে শেখ মো. জামালকে দেখেন, সে ফলি ছাড়া অন্য কিছু করতো না। শুরুতে জামাল ছিলেন দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর সহকারী। এক পর্যায়ে ফলি করাতেই তিনি মনোযোগী হন এবং এতটাই পারদর্শী হয়ে ওঠেন যে তার বিকল্প এফডিসিতে ছিল না।
জামাল ফলি শিখেছেন ঝন্টুর কাছ থেকে। পরিচালক হিসাবে নাম করেছিলেন দেলোয়ার জাহান ঝন্টু, তার ফলি পরিচয় খুব বেশি জন জানে না। তিনি সিগারেটের প্যাকেট ও লজেন্সের মোড়ক দিয়ে অগণিত শব্দ তৈরি করতে জানেন। ঘোড়ার খুড়ের আওয়াজ তৈরি করতেন পায়ের ওপরে হাত চাপড়ে। ঝন্টুর এই গুণের কথা জামালের সহকারী শম্ভুর কাছ থেকে যেমন সহকর্মী আনোয়ার শাহীর কাছ থেকেও তেমন নিশ্চিত হওয়া গেছে।
জামালের শিষ্য শম্ভু
শম্ভু সরকার ওরফে সঞ্জয়ের (৬০) বাড়ি কিশোরগঞ্জ। অমিতাভ বচ্চন, আমজাদ খান, হুমায়ুন ফরিদীর তিনি ভক্ত ছিলেন। অভিনেতা হওয়ার ইচ্ছা নিয়ে পচানব্বই সালে এফডিসিতে আসেন। সহকারী পরিচালকদের ফাই-ফরমাশ খেটে দিতেন আর ছোটখাটো রোল চাইতেন।
বাজারের দোকানদার, পুলিশদলের একজন বা নায়িকা উত্যক্তকারীর রোল পেয়েছিলেন কিছু। এক পর্যায়ে সিনিয়র ক্যামেরাম্যান অরুন রায়ের ঘনিষ্ঠ হন। নায়ক-নায়িকারা অরুন রায়কে সম্মান করতেন।
একদিন তিনি নায়ক জসীমকে ডেকে বললেন, 'ছেলেটাকে (শম্ভু) তোর সঙ্গে সঙ্গে রাখিস।' সে থেকে শম্ভু জসীমের ব্যাগ বহন করতেন। জসীম ছিলেন ফাইটিং মাস্টার, ফাইট ডিরেক্টররা তাকে খুব মান্য করতেন। সেই সুবাদে শম্ভু পাহাড় থেকে লাফ দেওয়া, কাঁচের দেওয়াল ভেঙে গড়িয়ে পড়ার মতো স্টান্টের কাজ করতে থাকেন।
আটানব্বই সালের দিকে শম্ভু ভাবলেন, শরীরে তো শক্তি সবসময় থাকবে না, তখন পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়তে পারব না, তাই এমন কাজ শিখতে হবে– যার জন্য শক্তি লাগে না। জামালকে তিনি ফ্লোরে ফলি করতে দেখেছেন অনেকদিন। কাজটিতে বুদ্ধি লাগে আর হাত-পা, চোখ ভালো থাকলেই হয়। জামালের ছিল পান খাওয়ার অভ্যাস। শম্ভু পান মারফত তার সঙ্গে খাতির জমাতে থাকলেন। মাঝে মধ্যেই জামালকে তিনি পান এনে দিতেন, সুপারি-চুন-জর্দা সঙ্গে সঙ্গে রাখতেন।
জামালও দেখলেন ছেলেটার আগ্রহ আছে, সহকারী দরকারও ছিল, তার কারণ কাজের চাপ ছিল বেশি। একই সঙ্গে দুই তিনটি ছবির কাজ পড়ে যেত। জামাল তাই এক ফ্লোরে শম্ভুকে পাঠিয়ে নিজে অন্যটায় যেতেন। বলে দিতেন, ঠেকে গেলে যেন তাকে ডাক দেয়। সে আমলে মারপিটের দৃশ্যগুলোয় মুখে মুখে ঢিশুম, ইয়াক, ঢুশ-ঢাশ, ধুরুম-ধারুম শব্দও করতেন ফলি আর্টিস্টরা। ড্রাম ফেলে দেওয়া, একসঙ্গে কয়েকজনের দৌড়ে যাওয়ার শব্দও তৈরি করতেন তারা।
ফলি বাক্সের ওজন ১৪০ কেজি
জামালের ফলি বাক্স আগলে রাখতেন শম্ভু। যেখানে যা পেতেন কুড়িয়ে এনে বাক্সে রাখতেন। একসময় বাক্সটির ওজন দাঁড়িয়েছিল ১৪০ কেজি।
তাতে ছেড়া জুতা, রিকশার ঘণ্টা, সিরিশ কাগজ, বাটখারা, ইটের টুকরা, কার্পেট, পর্দা, পানির খালি প্লাস্টিক বোতল, ক্যাসেটের ফিতা, গাছের পাতা, শেকড় ও বাকল, দরজার ছিটকিনি, লেখার খাতা ইত্যাদি নানান কিছু ছিল। আরো ছিল চিনামাটির থালা-বাসন, কাসার গ্লাস, খণ্ড টিন ও কাঠের তলোয়ার। বাক্সটি শম্ভুর কাছে এখনো আছে, তবে ওজন কমে ৪০ কেজিতে দাঁড়িয়েছে।
শম্ভু বলেছেন, "ডিজিটাল আমল (২০১১ সাল) আসার আগ পর্যন্ত আমাদের অনেক কাজ ছিল। মালেক আফসারির বোমা হামলা ছবির ফলি করতে আমাদের ১৮ শিফট লেগেছিল। শিল্পী চক্রবর্তীর একটি ছবিতে লেগেছিল ২৮ শিফট। দিন রাত কোন দিকে পার হতো, টের পেতাম না। তারপর জামাল ভাইও মারা গেলেন।"
"আমি বলতে গেলে বেকার হয়ে গেলাম। এখন ফলি সাউন্ড সিডিতে পাওয়া যায়, ইউটিউব থেকে নামানো যায়, তাই আমাদের কথা পরিচালকরা ভুলে গেছেন। শেষ ফলি করেছি পরিচালক জি সরকারের একটি ছবির, সাত-আট মাস আগে," বললেন শম্ভু।
'কী কী শব্দ তৈরি করতেন আপনারা?'— জানতে চাইলে শম্ভু বললেন, "গরুর গাড়ি চলার, দরজায় খিল লাগানোর, পানশালায় মদের বোতল ভেঙে যাওয়ার, সড়কে দুই গাড়ির সংঘর্ষ, চেয়ারের ক্যাচ ক্যাচ, নৌকার গুন টানা, চুলায় ডাল পুড়ে যাওয়া, দরজায় খট খট, পা ঘষটে চলাসহ অসংখ্য শব্দ তৈরি করতে পারতাম আমরা। সামাজিক ছবিতে ফলি বেশি লাগে। শুধু রান্না করার দৃশ্যেই অনেক ইফেক্ট সাউন্ড লাগে যেমন আগুন জ্বালানো, লাকড়ি গুজে দেওয়া, ফু দিয়ে আগুন উস্কে দেওয়া, পাতিল চড়ানো, পানি ঢালা ইত্যাদি।"
আনোয়ার শাহী যখন রুস্তম
'জামাল কতটা দক্ষ ছিলেন?'— শম্ভু বললেন, "আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল জামাল ভাইয়ের। শুধু দুই হাত দিয়ে এতো শব্দ তৈরি করতে পারতেন, যা আমি আজও পারি না। চোখ কান সবসময় খোলা রাখতেন।"
"একবার তেলের ঘানির ক্যাচ ক্যাচ শব্দ কীভাবে তৈরি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। একদিন ডাবিং ফ্লোরের কন্ট্রোল রুমে রিভলভিং চেয়ার ঘোরার শব্দে তার মাথা খুলে গেল, শেষে ওই শব্দ দিয়েই তিনি ঘানির ক্যাচ ক্যাচ শব্দ সৃষ্টি করেছিলেন।"
"গরুর গাড়ি চলার, গর্তে পড়ে যাওয়ার শব্দ তিনি পানির বোতল দিয়ে তৈরি করতেন। দুটি কাগজ হাতে নিয়ে এমনভাবে ঘষতেন, মনে হতো পুরোনো জমিদার বাড়ির কবুতর উড়ে যাচ্ছে।"
"জামাল ভাই বলতেন, গরীবের হাঁটায় আর বড়লোকের হাঁটায় পার্থক্য আছে। বড়লোকের হাঁটায় ক্ষমতার দাপট থাকে আর গরীব হাটলে মাটিও টের পায় না। মানুষটা বেঁচে থাকলে আরো অনেক কিছু শিখতে পারতাম," বললেন শম্ভু।
মো. আনোয়ার হোসেনের বাড়ি রাজশাহীতে। অভিনেতা হওয়ার আশা নিয়ে ঢাকায় আসেন তিরানব্বই সালে। থিয়েটার করেছেন, উচ্চারণ ভালো, দেখতেও তিনি সুন্দর। আনোয়ার শাহী নাম নিয়ে আজমল হুদা মিঠুর 'অপরাধ জগতের রাজা' ছবির মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন। কণ্ঠ নকলে তিনি বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। আহমেদ শরীফ, আনোয়ার হোসেন, অমল বোস, প্রবীর মিত্রসহ অনেক শিল্পীর কণ্ঠ তিনি হুবহু নকল করতে জানতেন। তাই ডাবিংয়ে কারুর শিডিউল না পাওয়া গেলে আনোয়ারের খোঁজ পড়ত, আনোয়ার এসে পরিচালককে উদ্ধার করতেন। তার নামই হয়ে গিয়েছিল হামজা-রুস্তম (উদ্ধারকারী জাহাজের নাম থেকে)।
ডাবিং ফ্লোরেই যেহেতু কাজ করতেন বেশি, আনোয়ার তাই ফলি তৈরিতেও মনোযোগী হন। জামালের সঙ্গে ছিল তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। জামাল প্রতিদিনই তার দক্ষতা বাড়িয়ে চলতেন। অসমাপ্ত কাজ পরের দিন কীভাবে করবেন তা ভাবতে ভাবতে রাত পার করে ফেলতেন।
তখন ইউটিউব ছিল না, যা করার সব নিজেকেই করতে হতো। জামাল হাতের কাছে যা পেতেন, তা দিয়েই প্রাকটিস করে যেতেন।
ফলি দিয়ে কী হয়
আনোয়ারের মতে, ফলি হলো ছবির সৌন্দর্য। ছবির গভীরতা তৈরি করে ফলি। আবহসংগীত বা সংলাপের দাপটে অনেকসময় ফলি বোঝা যায় না, তবে এটি না থাকলে ঠিকই খালি খালি লাগে।
কিছু দৃশ্যে আবার ফলি ছাড়া আর কোনো শব্দই থাকে না। যেমন— টেবিলের ওপর আঙুল ঠোকা। এর মাধ্যমে খুশি, তাচ্ছিল্য এমনকি মগ্নতাও প্রকাশ করা সম্ভব। একইভাবে একই হাঁটার দৃশ্যে কেবল শব্দের হেরফের ঘটিয়ে অভিসারে যাওয়া এবং মারামারি করতে যাওয়া উভয়ই বোঝানো সম্ভব।
শম্ভু, জামাল, আনোয়ার এবং আরো যারা ফলি সাউন্ড করত, এফডিসিতে তারা পরিচিত ছিল ভাঙা-ভাঙির দল বলে। গ্লাস ভাঙা, কাঁচ ভাঙা, টুল ভাঙার কাজ তাদের প্রায়ই করতে হতো। ভাঙারি মালের বাক্সটাও তাদের সঙ্গে থাকত সর্বক্ষণ।
রতন পালের হাত ধরে
সজীব রঞ্জন বিশ্বাস এবং রাজেশ সাহা এখনকার ব্যস্ত ফলি আর্টিস্ট। দুজনেই গিটার বাজাতে ভালোবাসেন, শব্দের সঙ্গে তাদের ওঠাবসা ছোটবেলা থেকেই। সজীব ভারতের পুনেতে ওষুধবিজ্ঞান পড়েছেন যদিও তার বন্ধুরা ছিল চলচ্চিত্রের ছাত্র।
বন্ধুদের প্র্যাক্টিস ফিল্মে ফলি করার অভিজ্ঞতা তার আছে। পরে মুম্বাই ও চেন্নাইয়ের সাউন্ড স্টুডিওগুলোতে শিক্ষানবিশীও করেছেন। রাজেশ মুম্বাইয়ে শব্দ বিষয়ে ডিপ্লোমা করেছেন। দুজনে এখন ঢাকার নিকেতনের কাউবেল স্টুডিওর শব্দশিল্পী।
সজীব বলছিলেন, "আমাদের চলচ্চিত্রে ডিজিটাল সাউন্ডের সূচনা রতন পালের হাত ধরে। তিনি ভারতের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট থেকে শব্দ প্রকৌশলে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে আসেন নব্বই সালের মাঝামাঝিতে। সময়টা ছিল বেশ কঠিন। কারণ তখনো এফডিসিতে ডিজিটাল প্রযুক্তি আসেনি আর এফডিসি ছাড়া কাজের ভিন্ন জায়গাও ছিল না।"
"যে নতুন কলা-কৌশল তিনি শিখে এসেছিলেন তা প্রয়োগের সুযোগ পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে," বললেন তিনি।
ঘটনাটা ঘটেছিল আকস্মিকভাবে। সেটা ছিল ছিয়ানব্বই সাল। গণ সাহায্য সংস্থা বা জিএসএস তখন দেশের অন্যতম একটি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা। মিডিয়া সেন্টার নামে তারা একটি ডিজিটাল প্রোডাকশন হাউজ প্রতিষ্ঠা করে, যেখানে একটি আধুনিক সাউন্ড স্টুডিও ছিল। রতন পালকে সেটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
দেশের মূলধারা ও বিকল্পধারার সব প্রযোজক ও পরিচালককে চিঠি দিয়ে ডিজিটাল প্রযুক্তির সুবিধা নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু অনভ্যস্ততা ও অপরিচিত হওয়ার কারণে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রতি নির্মাতাদের সংকোচ ও সংস্কার ছিল বেশি, ফলে কাজ পেতে সময় লেগেছে।
রতন পাল বলছিলেন, "যারা নতুন কিছুতে উৎসাহ বোধ করতেন এবং তার সম্ভাবনাগুলোকে যাচাই করতে চাইতেন, তেমন হাতেগোনা কয়েকজন মাঝে মধ্যে মিডিয়া সেন্টারে এসেছেন। একজন যেমন সূর্য দীঘল বাড়ির সহ-পরিচালক মসিহউদ্দিন শাকের। তবে তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদের বরাবরই উৎসাহ ছিল এবং তারা আগে থেকেই এ প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন।"
"শুরুর দিকে আমরা প্রযুক্তিটি পরিচিত করতেই সময় বেশি ব্যয় করেছি। এর মধ্যে বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম দুটি কর্মশালাভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি নির্মাণে হাত দিল। একটির নাম ছিল হাজারিবাগ ইন শটস, অন্যটি পোস্টার। ছবিগুলোর সাউন্ড ডিজিটালি তৈরি করতে উৎসাহিত করেছিলাম আমরা। সে মতো ছবি দুটির শব্দ সৃষ্টি ও সংযোজন করা হয়। এসময় আব্দুস সাত্তার রীপন নামের একজন আমার সঙ্গী ছিলেন, তিনি মেধাবী ও সৃজনশীল ছিলেন। আমরা দুজনে মিলে ছবি দুটির কিছু ফলি বা ইফেক্ট সাউন্ড তৈরি করেছিলাম। যতদূর মনে পড়ছে, তানভীর মোকাম্মেলের 'চিত্রা নদীর পারে' ছিল প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি— যেটিতে ডিজিটালি শব্দ সংযোজন ও সম্পাদনা করা হয়।"
"এই ছবিতে গায়ে পানি ঢালার, পাখির উড়ে যাওয়ার, চুল ছাটার, চায়ে চুমুক দেওয়ার মতো অনেক ফলি সাউন্ড করার সুযোগ পেয়েছিলাম। সম্ভবত আমাদের দেশে এই ছবিতেই প্রথমবারের মতো ফলি আর্টিস্টকে ক্রেডিট লাইনে যুক্ত করা হয়," বললেন তিনি।
সত্যজিতের তার সানাই
ইফেক্ট সাউন্ড যে স্বতন্ত্র একটি বিভাগ এবং ফলি আর্টিস্টেরও স্বীকৃতির প্রয়োজন, তা আমাদের এখানে কম অনুভূত হয়েছে। সে কারণে তারা উপযুক্ত সম্মানী পাননি।
শম্ভু যেমন বলছিলেন, "শিফটপ্রতি যে টাকা পেতাম, তাতে থাকা-খাওয়ার খরচটাই উঠতো। তবু করে যেতাম, কারণ কাজটা করে আনন্দ পেতাম; কাজ করতে নামলে আর কোনোদিকে চাইতাম না; না টাকার দিকে, না শরীরের দিকে।"
অথচ হলিউডে ফলি আর্টিস্টদের আলাদা দল আছে, এমনও স্টুডিও আছে যারা কেবল ফলি তৈরি করে; যেমন— স্কাইওয়াকার, ইউনিভার্সাল। ইউক্রেনের ফলিওয়াকার সাউন্ড এবং নেদারল্যান্ডসের ফলি টেলসও বিখ্যাত।
রাজেশ বলছিলেন, "ফলি ছাড়া ছবি শেষ করার কথা অনেক নির্মাতাই ভাবতে পারেন না। কারণ কোনো কোনো দৃশ্যে ফলিই একমাত্র হাতিয়ার যা দিয়ে ইমোশন ডেভেলপ করা যায়। যেমন— দরাম করে দরজা বন্ধ করেও বোঝানো যায় পরিবারে অশান্তি চলছে। সেকারণেই গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডে সেরা ফলির জন্যও পুরস্কার থাকে।"
ফলি কখনো কখনো সংলাপকেও অতিক্রম করে যায়। এ দিয়ে যা বোঝানো যায়, তা সংলাপ দিয়ে সম্ভব হয় না। রতন পাল সত্যজিৎ রায়ের 'পথের পাঁচালি' এবং ঋত্বিক ঘটকের 'তিতাস একটি নদীর নাম' এর প্রসঙ্গ তুললেন। পথের পাঁচালিতে দুর্গার মৃত্যু ঘোষণা করা হয় তারসানাইয়ে সুর তুলে। বেদনা ও বিষণ্নতা তৈরিতে এর জুড়ি ছিল না।
অন্যদিকে, তিতাস একটি নদীর নাম ছবিতে যখন বাসন্তীর (রোজী সামাদ ) নাড়িছেড়া ধন দূরে চলে যায়, তখন কাছেই কাপড় কাচার ধুপ ধুপ শব্দ হতে থাকে, যা বস্তুত বাসন্তীর ভিতরের কষ্টকেই প্রকাশ করে।
এখনকার ফলিম্যান
সজীব রঞ্জন বিশ্বাস বললেন, "আমাদের দেশে এখনো শব্দের প্রতি খুব বেশি নজর দেওয়া হয় না। অথচ চলচ্চিত্র অডিও-ভিজ্যুয়াল মাধ্যম। ছবি ঝিরঝির করলেও আপনি দেখা চালিয়ে যেতে পারবেন, কিন্তু শব্দ না থাকলে ছবি বেশিক্ষণ দেখতে পারবেন না। অ্যানালগ পিরিয়ডে এফডিসি ক্যামেরা সামলাতেই হিমশিম খেয়েছে। ঠিকঠাক ছবি তোলাটাই বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।"
"সে কারণে জামাল ভাই বা শম্ভুদা প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও তার স্বীকৃতি দেওয়ার মতো মনন ছিল না কারো। তার ওপর চলচ্চিত্রের যে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল মানে বাজেট, শিডিউল এবং কোয়ালিটি, তার ভারসাম্য বজায় রাখাও ছিল কঠিন। এটি এখনো কঠিন। আমরা যখন কাউকে বলি এ কাজে দেড় মাস সময় লাগবে, তখন তিনি খোঁজেন এক মাসে কোথায় শেষ করা যাবে।"
"বাজারে টিকে থাকতে আমরাও তখন এক মাসে কম্প্রোমাইজ করি। আজকের এই ওটিটির যুগে এসেও আমরা খুব বেশি আগাইনি। একটা সুবিধা হয়েছে যে, লোকেশন সাউন্ড নেওয়া হচ্ছে আগের তুলনায় বেশি। ফলে সাউন্ড ন্যাচারাল করার সুযোগ বেড়ে গেছে," যোগ করেন তিনি।
চার-পাঁচ বছর আগে রাজেশ সাহা দেশে ফেরার পর সাউন্ডবক্স স্টুডিওতে যোগ দিয়েছিলেন। বর্তমানে দেশের ব্যস্ততম শব্দশিল্পী রীপন নাথ এর প্রতিষ্ঠাতা; তিনি দেবী, ডুব, আয়নাবাজি, ডুবসাঁতারসহ আরো অনেক প্রশংসিত ও জনপ্রিয় ছবিতে শব্দ সংযোজন করেছেন।
রীপন নাথেরও যাত্রা শুরু হয়েছিল রতন পালের সঙ্গী হিসাবে ধ্বনিচিত্রে।
শাটিকাপের কাউবেল
এনজিও হওয়ায় মিডিয়া সেন্টারের খুব বেশি উন্মুক্ত বা বাণিজ্যিক হওয়ার সুযোগ ছিল না। এরমধ্যে একবার বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিকের কর্ণধার আলী যাকের 'লাল সালু' ছবির ডাবিংয়ে মিডিয়া সেন্টারে আসেন। তিনি ডিজিটাল প্রযুক্তির সুবিধা দেখে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন এবং বুঝতে পারেন ভবিষ্যতে এটিই প্রাধান্য বিস্তার করবে।
ফলাফলে এশিয়াটিকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিসাবে ধ্বনিচিত্র লিমিটেড আত্মপ্রকাশ করে। রতন পালকে তার দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব দেন আলী যাকের। রতন পাল সম্মত হন এবং ধ্বনিচিত্রকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
আব্দুস সাত্তার রীপন জার্মানি চলে যাওয়ার পর রীপন নাথ ধ্বনিচিত্রে যোগ দেন, তারপর শৈব তালুকদার। শৈব তালুকদার রেহানা মারিয়াম নূরের শব্দশিল্পী হিসাবে সুনাম অর্জন করেছেন। নিজের স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করেছেন, যার নাম অডিওপিপল।
সজীব ও রাজেশ প্রায় একই সময়ে স্টুডিও কাউবেলে যোগ দিয়েছিলেন।
স্টুডিওটি দেখে দুজনেরই ভালো লেগে গিয়েছিল, মনে হয়েছিল এটি আন্তর্জাতিক মানের একটি স্টুডিও। মেঘদল ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট রাশিদ শরীফ শোয়েব এর প্রতিষ্ঠাতা। মেজবাউর রহমান সুমনের হাওয়া চলচ্চিত্রের শব্দ সংযোজনা ও সম্পাদনা করেছেন শোয়েব এই কাউবেল স্টুডিওতেই।
রাজেশ আর সজীবও সাউন্ড এডিটর, একই সঙ্গে ফলি আর্টিস্টও। ওটিটি প্লাটফর্ম চরকির আলোচিত ওয়েব সিরিজ শাটিকাপ এবং উনলৌকিকের ফলি করেছেন দুজনে মিলে। শাটিকাপের দৌড়াদৌড়ি এবং উনলৌকিকের ধ্বস্তাধ্বস্তিসহ আরো অনেক শব্দ তৈরি করেছেন তারা।
সজীব আর রাজেশেরও ফলি বাক্স আছে। সেখানে আরো অনেক কিছুর সঙ্গে নুড়ি পাথর, শঙ্খ, গাছের পাতা ও শিকড়, মখমল কাপড় আছে। ইফেক্ট সাউন্ড তৈরি করে অনেক সময় আবিস্কারের আনন্দ পাওয়া যায়। শেখ মো. জামালকে নতুন নতুন অনেক ইফেক্ট সাউন্ড তৈরির কৃতিত্ব দেওয়া যায়। সাউন্ড ছাড়া অন্য কিছু তিনি ভাবতেন না। তিনি যেন আমাদের তারক!
ফলিওয়ালা তারক
তারক চরিত্রটির (ঋত্বিক চক্রবর্তী অভিনীত) কথা অনেকেরই মনে থাকবার কথা। সে এক ফলি শিল্পী। তাকে নিয়ে কৌশিক গাঙ্গুলি ২০১৩ সালে নির্মাণ করেছিলেন শব্দ নামের এক ছবি।
ছবিতে দেখা যায়, শব্দ তৈরি করতে করতে তারক একসময় শব্দপূর্ণ এক জগতে বন্দি হয়ে যান। তার স্ত্রী এতে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে তাকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যান। ডাক্তার দেখেশুনে বুঝতে পারেন, তারক পারিপার্শ্বিক শব্দগুলিতে এতই মগ্ন থাকে যে আড্ডা বা গল্পে কোনো মনোযোগ রাখতে পারে না। শেষে তারককে একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠাতে হয়।
এই ছবি একজন ফলি আর্টিস্টের জীবন ও ভাবনা বোঝার এক দারুন উপায়। বিশ্বখ্যাত জার্মান চলচ্চিত্র নির্মাতা ভিম ভেন্ডারসও ফলি আর্ট নিয়ে ১৯৯৩ সালে লিসবন স্টোরি নামে একটি ছবি নির্মাণ করেছেন। হলিউডের এমন আরেকটি ছবির নাম বেরবেরিয়ান সাউন্ড স্টুডিও।
দেশে এখন কোটি টাকা বাজেটের ছবি হচ্ছে। টিভি চ্যানেলের সংখ্যাও অনেক। বৃদ্ধি পাচ্ছে ওটিটি প্লাটফর্মের সংখ্যা। চলচ্চিত্র, নাটক, ওয়েব সিরিজ ছাড়াও বিজ্ঞাপনচিত্র, কার্টুন, মিউজিক ভিডিওতে ফলি সাউন্ডের ব্যবহার বাড়ছে। শব্দ শিল্পে যুক্ত হচ্ছেন নতুন প্রজন্মের প্রশিক্ষিত তরুণ যুবা। তাই রতন পাল আশা করেন— আগামী দিনে শব্দশিল্পের মানসম্মত বিকাশ ঘটবে, ফলি সাউন্ডের গুরুত্বও বৃদ্ধি পাবে।