ছিলেন নাপিত, কাজ করতেন লাহোরের সেলুনে, সেখান থেকে যেভাবে গায়ক হয়ে উঠলেন মুহাম্মদ রফি
১৯২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর এই পৃথিবীতে এসেছিলেন কিংবদন্তি শিল্পী মুহাম্মদ রফি। আজ এই শিল্পীর জন্মশতবার্ষিকী।
রফি যখন জন্মেছিলেন, তখন তার জন্মস্থান পাঞ্জাবের মাঝা অঞ্চলের অমৃতসর জেলার কোটলা সুলতান সিং অন্যান্য গ্রামের মতোই ছিল। এখানকার বাসিন্দারা গবাদিপশু পালন করতেন। সম্ববয়সি অন্যান্য শিশুদের মতো ফিকোও (রফির ডাকনাম ফিকো) স্কুলের পর প্রতিবেশীর গবাদিপশু চরাতে নিয়ে যেত, আর গুনগুন করে গাইত লোকগীতি।
পরবর্তী সময়ে ১৯৪২ সালে ফিকো (রফি) তার বাবা হাজী মুহাম্মদ আলির সঙ্গে কাজে যোগ দেন। তার বাবা লাহোরে একটা ধাবা চালাতেন। এরপর রফি একটা সেলুনে নাপিতের কাজ নেন। সেখানে খদ্দেরদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে ওয়ারিস শাহের 'হীর' ও পিল্লুর 'মির্জা' গাওয়ার লোভ সামলাতে পারতেন না রফি। তার মিষ্টি কণ্ঠ নতুন গ্রাহকদের টানত।
এক স্থানীয় বাসিন্দা একদিন লাহোরের অল ইন্ডিয়া রেডিওর স্টুডিওতে ঘুরতে গিয়ে রফির সুরেলা কণ্ঠের গল্প করেন আকাশবাণী প্রধান জীবনলাল মাট্টুর কাছে। এরপর একদিন মাট্টু ওই নাপিতের দোকানে গিয়ে নিজের কানে ওই যুবকের গলা শুনতে পেলেন। এরপর তিনিই মুগ্ধ হয়ে রফিকে ডেকে পাঠান অডিশনের জন্য।
অডিশনের পর রফি পাঞ্জাবের লোকগায়ক হিসেবে অনুমোদন পেলেন। সে সময় তাকে মাট্টুর সেকেন্ড-ইন-কমান্ড বুধ সিং তানের কাছে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছিল।
অল্প সময়ের মধ্যেই রফির কণ্ঠ লাহোরের ফিল্ম স্টুডিওতে পৌঁছে যায়। নতুন সংগীত পরিচালক শ্যামসুন্দর গুল বালুচ নিজের ছবির জন্য তাকে দিয়ে একটা পাঞ্জাবি গান রেকর্ড করান। যদিও সেই ছবি ফ্লপ হয়েছিল।
গানের প্রতি রফির ভালোবাসা তাকে লাহোরে কিংবদন্তি ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খানের ভাই বরকত গুলাম আলি খানের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে রফি 'খেয়াল' ও 'ঠুমরি'র সূক্ষ্মতা আয়ত্ত করেন। পরে মুম্বাইয়ে গিয়ে প্লেব্যাক করে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করার কথা ভাবেন।
এরপর ১৯৪৪ সালের শেষের দিকে ট্রেনে করে স্বপ্নের শহর মুম্বাইয়ে পৌঁছে যান রফি। তবে এরপরও তার সামনে ছিল দীর্ঘ লড়াই। ১৯৪৯ সালে রফি প্রথম উল্লেখযোগ্য সুযোগ পান। সংগীত পরিচালক সাজ্জাদ হুসেন তাকে দিয়ে হীর ওয়ারিস শাহ গাওয়ান। গানটি সে সময় হিট হয়েছিল।
প্লেব্যাক গাওয়ার ক্ষেত্রে মুহাম্মদ রফির ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের পরামর্শদাতা ছিলেন পণ্ডিত হুসান লাল, যিনি নিজে একজন পাঞ্জাবি। তিনিই রফিকে ভোর ৪টায় তার তানপুরা নিয়ে নিজের বাড়িতে ডেকে আনতেন। রেকর্ডিংয়ের আগে কয়েক ঘণ্টা অনুশীলন চলত। 'বাজার' (১৯৪৯) ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের সাথে ডুয়েট গাওয়ার জন্য রফিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন শ্যাম সুন্দর।
সংগীত পরিচালক ফিরোজ নিজামী 'জুগনু' ছবির জন্য 'নূরজাহান' গানটি ডুয়েট গাওয়ার জন্য রফিকে বারবার অনুশীলন করিয়েছিলেন। রফির গাওয়া ডুয়েট 'ইয়াহান বদলা ওয়াফা কা বেওয়াফাই কে সিওয়া কেয়া হ্যায়' গানটি সুপারহিট হয়।
এরপর ১৯৪৭ দেশভাগ হওয়ার প্রাক্কা পা পঞ্জাবের ভাগ হয়ে যায়। সে সময় মুহাম্মদ রফি একটা আবেগঘন গান গেয়েছিলেন: 'ইক দিল কে টুকড়ে হাজার হুয়ে কোই ইয়াহাঁ গিরা কোই ওহাঁ গিরা'। মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডে তিনি আরও একটা আবেগঘন গান গেয়েছিলেন—'সুনো সুনো অ্যায় দুনিয়া ওয়ালো বাপু কি ইয়ে আমার কাহানি'। এই দুটি গানেরই সুর দিয়েছিলেন হুসান লাল এবং ভগত রাম জুটি।
রফির কণ্ঠকে আরও উচ্চতায় পৌঁছে দেন উত্তরপ্রদেশের সুরকার নওশাদ আলি। রফির কণ্ঠে নওশাদের কিছু কালজয়ী সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে 'ইয়ে জিন্দেগি কে মেলে দুনিয়া মে কাম না হোঙ্গে আফসোস হাম না হোঙ্গে' (মেলা, ১৯৪৮), 'সুহানি রাত ঢল চুকি না জানে তুম কাব আওগে' (দুলারি, ১৯৪৯); 'হিউ হাম জিনকে লিয়ে বরবাদ' এবং 'মেরি কাহানি ভুলনে ওয়ালে' (দিদার, ১৯৫১); 'ও দুনিয়া কে রাখওয়ালে' (বৈজু বাওরা, ১৯৫২); এবং 'ইনসাফ কা মন্দির হ্যায় ইয়ে ভগবান কা ঘর হ্যায়' (অমর, ১৯৫৪)।
মদন মোহন, হংস রাজ বেহল, শ্যাম সুন্দর, আল্লা রাখা কুরেশি, খৈয়াম, ওপি নায়ার, এস মহিন্দর এবং শার্দুল সিং কোয়াত্রাসহ সমস্ত পাঞ্জাবি সংগীত পরিচালকদের পছন্দের গায়ক হয়ে ওঠেন রফি।
১৯৮০ সালে না ফেরার দেশে যাত্রা করেন এই অমর শিল্পী। তার মৃত্যুর পর পার হয়েছে ৪৪ বছর। তবু রফির গাওয়া গানগুলি সমান জনপ্রিয় রয়ে গিয়েছে। আকাশবাণী মুম্বাইয়ের বিবিধ ভারতীয় পরিষেবা এবং নয়াদিল্লি থেকে অল ইন্ডিয়া রেডিওর উর্দু পরিষেবাতে প্রায়শই শোনা যায় তার জনপ্রিয় সেইসব গান। মুম্বই ও অমৃতসরে তার অনুরাগীরা এই রুপালি পর্দার সোনালি কণ্ঠের সম্মানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা করছেন।