ধার দেবেন ধার? শিলনোড়া ধার, দা-বটি ধার…
'কচুর ডাঁই পড়ে আছে। সেগুলো কখন কাটা হবে, বাটা হবে কে জানে। ঝন্টু তার ব্যাগ থেকে কৃষ্ণনগরের সরভাজা বার করে দেয়। ইন্দুবালা সবাইকে বসতে বলেন। কচি কচুকে ভালো করে ধুয়ে, কুরে, নারকেল, সর্ষে আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মিহি করে বেটে ওপরে ছড়িয়ে দেন কাঁচা সরষের তেল। গরম ভাতে এই কচুবাটা নিমেষে শেষ হয়। সবাই হাপুস হুপুস শব্দ তোলে। কচি দেশি টমেটোর চাটনি সবাই চেটেপুটে খায়' — ইন্দুবালা ভাতের হোটেল-এর এই মানকচু বাটা ভর্তা নিয়ে সেবার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল রন্ধনপ্রেমীদের মধ্যে।
বলা বাহুল্য, প্রায় সব ঘরে ঘরে এভাবেই বাটা মশলায় শুরু হতো মানুষের আগেকার দিন। দিন কি রাতের বালাই ছিল না — যখনের মশলা, তখনই খাওয়া হতো বেটে। রেফ্রিজারেটরের সুবিধা তখন ছিল না। তা বলে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া আর থেমে থাকত কই! কষ্ট হলে হোক, রান্নার স্বাদ হওয়া চাই-ই চাই। তাই রাতদুপুরেও বাড়ি বাড়ি শোনা যেত শিলনোড়ার খটখট শব্দ।
'যত বাটা, তত স্বাদ'
তবে এখন চিত্র অন্য। প্যাকেট মসলা আর ব্লেন্ডারে বদলেছে দিন। মানুষও হয়েছে প্রযুক্তিমুখী। আজকের দিনে কতজনের ঘরে শিলনোড়া আছে বা কতজনই তা চেনে, এ নিয়ে কিছুটা সন্দেহ আছে বৈকি। তবে একটা সময় পর্যন্ত এ জিনিসই ছিল আধুনিক ব্লেন্ডারের আদিম ভার্সন।
ব্যক্তিগতভাবে শিলনোড়ার সঙ্গে পরিচিতি সে ছোটবেলা থেকেই। বিশেষ কিছু দিনের কথা আলাদা করেই গেঁথে আছে মনে। ক্লাস নাইন-কি-টেনে পড়ি। ছুটির দিন এলেই হানা পড়ত নানুবাড়িতে। সারাদিন এদিক-সেদিক ছুটোছুটি। বাড়ির দক্ষিণ পাশেই ছিল ইয়া বড় এক পুকুর। বাড়ির পুরুষেরা জাল নিয়ে নেমে পড়তেন সেখানে। সঙ্গে হাঁস-মুরগির বন্দোবস্ত তো থাকতই। ঘণ্টা ধরে হতো মাছ-মাংস কাটাকুটি। অন্যদিকে চলত মসলার বাটাবাটি। এক-দুজন নয়, করতেন ৩-৪ জন মিলে। মসলাভর্তি রঙিন সব বাটি সাজিয়ে রাখা হতো আলাদা করে।
আজকের মতো প্যাকেট মশলার চল ছিল না। বাটা মসলাতেই হতো যাবতীয় রান্না। এইতো ২০-৩০ বছর আগেও মরিচ, হলুদ, পিঁয়াজ, রসুন, আদা, জিরা, ধনিয়াসহ যত মশলা আছে, তা বাটার জন্য পাটায় হাত পড়েনি এমন গৃহবধূ খুঁজে পাওয়াই হবে দুষ্কর।
আবার উৎসবের দিনগুলোতে এ দৃশ্য ছিল দেখার মতো। কারো বাড়িতে কুটুম এলে রাত-দিন পার হতো বাটাবাটি করেই। ঈদ বা কোরবানের কথা তো আলাদা করে উল্লেখ না করলেই নয়। চাঁদরাত থেকেই শুরু হতো এসব কর্মযজ্ঞ। চলত সকাল অব্দি। থামাথামির ফুরসতই পেতেন না নারীরা। বাড়ি বাড়ি কথাই ছিল এই: 'যত বাটা, তত স্বাদ'। গ্রামের দিকে প্রায় বাড়িতেই একাধিক পাটার বন্দোবস্ত থাকত।
'শিলপাটা ধারকাটা কারিগর' তারা
গ্রাম বা শহর — একসময় প্রতিটি বাড়ির রান্নাঘরের অন্যতম সরঞ্জাম ছিল পাটা। পাটা ভোঁতা হয়ে এলেই প্রয়োজন হতো ধার দেওয়ার। আর এ বিশেষ কাজটি করতেন এক শ্রেণির মানুষ। বলতে গেলে এটিই ছিল তাদের একমাত্র পেশা। বছরজুড়ে এ কাজই করতেন তারা।
নুরুল আবসার পাটা ধার দেওয়ার কাজ করেন ৪০ বছরেরও বেশি। বাবার কাছ থেকেই এ কাজ শেখা। পাটায় ছেনি দিয়ে খোদাই করে সুন্দর নকশা ফুটিয়ে তোলায় খ্যাতি আছে তার। তাই ডাক আসে এ বাড়ি, ও পাড়া থেকে। ভালোই রোজগার ছিল একসময়। সংসারের খরচ জুগিয়ে দুই ছেলে-মেয়েকে পড়িয়েছেনও। পাটায় নিখুঁত নকশা করতেন বলে বেশ কদরও ছিল তার। এখন আর সে দিন নেই। তাই কিছুটা বাধ্য হয়েই চাষি হিসেবে কাজ করেন অন্যের জমিতে।
প্রায়ই শহুরে বাড়ির অলিগলি বা গ্রামে-গঞ্জের রাস্তাঘাটে দেখা মিলত আবসারদের। 'শিলপাটা ধারকাটা কারিগর' তারা। হাঁক-ডাক ছাড়তে-ছাড়তে এ গ্রাম, ও গ্রাম চষে বেড়াতেন প্রতিদিন। বাড়ি-বাড়ি ঘুরে 'শিলের ধার কাটাবেন, নোড়ার ধার কাটাবেন, দা-বটি ধার দেবেন' বলে চিৎকার করতেন। বাড়ির নারীরা দা-পাটা বের করে আনতেন।
ধার দেওয়ার জন্য সাইকেলের ফ্রেম আর ক্র্যাংকসেট দিয়ে তৈরি একটি যন্ত্র ব্যবহার করতেন কারিগরেরা। শিলের ক্ষেত্রে হাতুড়ি, ছেনির ব্যবহার হতো। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে নকশা তুলে খোদাই করা হতো পাটা। পাটায় কারিগরেরা ফুটিয়ে তুলতেন ফুল-পাখি, লতা পাতা।
এখনো আছেন তারা, তবে…
বছর দশেক আগেও এই কারিগরদের আনাগোনা ছিল শহরজুড়ে। কোথাও না কোথাও দেখা মিলত তাদের। এখন তাদের দেখা যায় মৌসুমবিশেষে।
সময় পালটেছে। তবে এখনো কোনো কোনো রাঁধুনি টিকিয়ে রেখেছেন এটির ব্যবহার। সবকিছু থাকলেও পাটায় বাটা মশলার অকৃত্রিম স্বাদে স্বস্তি আর ভরসা তাদের।
প্রতি বছর কোরবানির ঈদের সময় শহরের অলিতে গলিতে কারিগরদের হাঁকডাকের শোর শোনা যায়। বছরের এ সময়টাই এখন তাদের আয়ের একমাত্র পথ। সারাদিন ডাকাডাকির পরে বেশি হলে ২-৩ জনের কাছ থেকে মেলে সাড়া।
আগে শিলনোড়া ধার করে দিনে ২-৩ হাজারও আয় করতেন কোনো কোনো কারিগর। কিন্ত এখন সারাদিন ঘুরে গড়ে ৬০০-৮০০ টাকা আয় হয় বলে জানান আবসার। ঈদের আগ পর্যন্ত তারা শহরগুলোতে কাজ করেন। তারপর বাড়ি ফিরবেন। এ কারিগরদের কেউই ঢাকার স্থানীয় নন।
কৃষক-দিনমজুর বা শিলপাটা কারিগর
মানিক মিয়া এ কাজে আছেন দেড় দশক। থাকেন সিলেটের হবিগঞ্জে। ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় এসেছেন কিছু বাড়তি আয়ের উদ্দেশ্যে। এটাই তাদের একমাত্র পেশা কি না জানতে চাইলে তার সরল উত্তর: 'আগে এডাই করতাম। এহন ধানের ক্ষেতে কাম করি। অহন সে কামও নাই। কুরবানে এইহানে আইলে কিছু বাড়তি ইনকাম করোন যায়।'
তিনি জানান, প্রতি ঈদুল আজহায় তিনি ঢাকা আসেন শিলনোড়া ধারের কারিগর হিসেবে। এক সপ্তাহ কাজ পাওয়া যায়। 'তারপর আবার বাড়ি চইল্লা যাই।'
সারাদিন খাটনি করে সেদিন তার আয় হলো মাত্র ২০০ টাকা। কিন্তু তাতেও খুশি এ কারিগর। পাটা ধারে টাকা বেশি। কিন্তু খুব কম লোকই তা করায়। পাটার আকার বিবেচনায় তা ৬০ থেকে ১২০ টাকা হয়। দা-বটির ক্ষেত্রে পারিশ্রমিক অতি সামান্য। একটি দা-বটি-ছুরি ধার করে পান ২০-৩০ টাকা। বেশি হলে ৫০ টাকা।
রাজধানীর আরেক কারিগর জুলফিকার রংপুর থেকে এসেছেন। রাজশাহী, বগুড়ায়ও তার সমান আনাগোনা। অন্যের ক্ষেতে শ্রম দেন তিনি। কিন্তু দিনমজুরির কাজ না থাকলে পাটা ধারের কাজে নেমে পড়েন। 'শুধু পাটা-বটি ধারের কাজ করলে দিন চলবো না। তয় এই কাজের পাশাপাশি অন্য কাজে কামলা দিলে সংসার চলে। সব কারিগর এহন এইডাই করে।'
অর্থাৎ বংশপরম্পরায় এ কাজ আয়ত্ত্ব করলেও কেউই আর পুরোপুরি এটির ওপর নির্ভরশীল নন। শিলনোড়ার ব্যবহার কমে যাওয়ার দরুন এ কারিগরদের জীবিকার পথও সংকুচিত হয়ে এসেছে।
আরও কিছু বছর পরে হয়তো 'শিল পাটা ধার, বটি ধার' হাঁকডাকে সরব হবে না শহুরে অলিগলি। হয়তো তাদের দেখাই মিলবে না আর। কে জানে, পাটাই তখন হয়ে উঠতে পারে অত্যাশ্চর্য এক বস্তু!