আদার ব্যাপারী কেন জাহাজের খোঁজ নেয়!
বাংলা ভাষায় একটি বাগধারা প্রচলিত আছে— 'আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর রাখা'; বাগধারাটি মূলত 'বড় বিষয়ে নগণ্য লোকের মাথা ঘামানো' বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। তবে, আদার ব্যাপারীদের একসময় নগণ্য মনে করা হলেও তারা এখন আর মোটেও নগণ্য বা তুচ্ছ নন। দিন দিন ফুলেফেঁপে বড় হচ্ছে আদার বাজার।
আন্তর্জাতিক আমদানি-রপ্তানি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ভোলজা'র তথ্য মতে, বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আদা আমদানিকারক দেশ। প্রতি বছর দেড় লাখ টনেরও বেশি আদা আমদানি করে বাংলাদেশ। আদা আমদানিতে প্রথমস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তৃতীয় স্থানে আছে ভারত।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, বাঙালি রান্নার অন্যতম এই মসলার চাহিদা দেশে বছরে ৩ লাখ টনের বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আদার উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৯২ হাজার টন। মোট চাহিদার প্রায় ৪২ থেকে ৪৫ শতাংশই আমদানি করতে হয়েছে।
চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড থেকে বছরে এক থেকে দেড় লাখ টন আদা আমদানি করে মেটানো হয় স্থানীয় চাহিদা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের আদার বাজার তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার মত।
দ্রুত পচনশীল পণ্য হওয়ায় একবারে বেশি পরিমাণে আমদানিও করা যায় না এই মসলা। অল্প অল্প করে সারাবছর ধরে জাহাজে বিশেষ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কন্টেইনারের করে আমদানি করতে হয় আদা।
তাই জাহাজের খবর না নিলে কীভাবে চলবে আদার ব্যাপারীদের! আমদানিকারকদের পাশাপাশি আদার ব্যাপারীদের প্রতিনিয়ত খবর রাখতে হয় কখন কোন জাহাজে করে কী পরিমাণ আদা আসছে দেশে। কারণ সরবরাহের ওপরেই নির্ভর করে ওঠানামা করে বাজার দর। এছাড়াও তাদের রাখতে হয় আন্তর্জাতিক বাজার ও ডলারের বাজারদরের খোঁজখবর।
আদার ব্যাপারীরা যখন থেকে জাহাজের খবর নেওয়া শুরু করে
দেশে ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তম পাইকারী বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে আদার ব্যাপারীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আশির দশক পর্যন্ত আদা উৎপাদনে মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল বাংলাদেশ। সারাদেশ থেকে আদার চালান আসতো খাতুনগঞ্জে। দেশের চাহিদা মেটানোর পর অল্প কিছু আদা রপ্তানিও করতেন ব্যবসায়ীরা।
তবে, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি এসে দ্রুত চাহিদা বাড়তে থাকলেও উল্টো কমতে থাকে আদার উৎপাদন। এতে ঘাটতি দেখা দেয় বাজারে। সেই ঘাটতি মেটাতে খাতুনগঞ্জ ভিত্তিক আমদানিকারকরা প্রথমে চীন থেকে আদা আমদানি শুরু করেন। এরপর উৎপাদনের সাথে পাল্লা দিয়ে চাহিদা বাড়তে থাকায় দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকেও আদা আমদানি শুরু করেন ঢাকার শ্যামবাজার-কেন্দ্রিক আমদানিকারকরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক হিসাবে দেখা যায়, ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে ৭০২০ হেক্টর জমিতে ৪২,৬৮০ টন আদা উৎপাদন হয়। পরের বছর আবাদ বাড়লেও কমে যায় উৎপাদন। এ সময় ৭০৫৯ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয় ৪১,৫৩৫ টন আদা। এরপর প্রতিবছরই আবাদ ও উৎপাদন কমতে কমতে ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে ৩৮,২৬৫ টনে এসে ঠেকে।
খাতুনগঞ্জের আদা-রসুনের ব্যাপারী মাহিন এন্টারপ্রাইজের মফিজুল ইসলাম বলেন, দেশের অর্থনীতির আকার বাড়ার সাথে সাথে বেড়েছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা।
তিনি বলেন, "আগে যেখানে মানুষ সপ্তাহে একদিন বা দুইদিন মাংস খেত, বর্তমানে সেখান প্রায় প্রতিদিনই মাংস খায় মানুষ। বিশেষ করে, ব্রয়লার মুরগীর উৎপাদন বাড়ায় ও দাম মোটামুটি কম হওয়ায় মাংস খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে অনেকখানি। যা আদার চাহিদা বাড়ার অন্যতম কারণ।"
চট্টগ্রামের সবচাইতে বড় আদা আমদানিকারক ফুলকলী গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ জহির উদ্দিন বলেন, "দেশে আদার চাহিদা কয়েকগুণ বাড়লেও সেই অনুপাতে বাড়েনি উৎপাদন। তাই চাহিদা মেটাতে বেড়েছে আদার আমদানি। আমরা ২০০৩ সাল থেকে আদা আমদানি শুরু করি।"
তিনি বলেন, "আমরা প্রতিমাসে ২৫-৩০ কন্টেইনার আদা আমদানি করে থাকি। প্রতি কন্টেইনারে ২৭ টন আদা ধরে। বছরে ৩০০-৩৫০ কন্টেইনারে করে ৮ থেকে ১০ হাজর টন আমদানি করে সারাদেশে সরবরাহ করি আমরা।"
আদা-রসুনের আরেক আমদানিকারক আবুল কালাম আজাদ বলেন, আগে শুধু চীন, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড থেকে আদা আমদানি হতো। তখন আদার বাজার ছিল খাতুনগঞ্জ কেন্দ্রিক।
"ভারত ও মিয়ানমার থেকে আমদানি শুরু হওয়ার পর থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ীরা আদা আমদানি শুরু করেন। এতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় আদার বাজার," যোগ করেন তিনি।
আদার দেশীয় বাজার
বাংলাদেশে গত তিন বছর আদার দাম ৬০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করলেও বছরের বেশির ভাগ সময় ছিল ১০০-১৫০ টাকার মধ্যে। সেই হিসেবে তিন লাখ টন চাহিদা ধরে দেশে মোট আদার বাজার দাঁড়ায় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার মতো। তার মধ্যে দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকাই খরচ হয় আমদানিতে।
বাংলাদেশে আদা আমদানির বড় উৎস ছিল চীন। ২০১৯ সালের মোট আমদানি ১ লাখ ৩৯ হাজার টনের এর মধ্যে চীন থেকে আমদানি হয়েছিল ৪৫ শতাংশ। ২০২০ সালে করোনার কারণে চীন থেকে আমদানি কমতে থাকে। এরপর দুই বছর ২০২০ ও ২০২১ সালে আদা আমদানিতে শীর্ষে ওঠে আসে ভারত।
২০২২ সালে বাংলাদেশে আদা রপ্তানিতে শীর্ষে চলে আসে মিয়ানমার। মোট ১ লাখ ৬৫ হাজার টন আদা আমদানির ৪০ শতাংশই এসেছে মিয়ানমার থেকে।
তবে, ২০২৩ সালে এসে আবারও চীন থেকে আমদানি বাড়তে থাকে বলে জানিয়েছেন আমদানিকারকরা।
আমদানিকারক জহির উদ্দিন বলেন, "চীন বিশ্বের বৃহত্তম আদা রপ্তানিকারক দেশ। তাদের আদা মানেও সেরা।"
চীনে কোনো কারণে চাহিদা বাড়লে বা উৎপাদন কমলে বিশ্ববাজারে বাড়ে আদার দাম। সম্প্রতি চীনে আদার বুকিং রেট চলছে ১,৬৫০ মার্কিন ডলার। শুল্ক ও অন্যান্য ব্যয় মিলে প্রতি কেজি আদা আমদানিতে খরচ পড়ছে ২২০ থেকে ২৩০ টাকা। কয়েক হাত ঘুরে সে আদা বাজারে ২৬০-২৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানান তিনি।
আমদানি নির্ভরতায় বাড়ে আদার দাম
আদার মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি করা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে আদার দাম বাড়ার জন্য আমদানি নির্ভরতা ও সীমিত উৎপাদনকে দায়ী করা হয়েছে।
এছাড়াও, উৎপাদন মৌসুমে দেশি আদার সংরক্ষণ ব্যবস্থার অভাব, ভালো মানের বীজের অভাব ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্মকেও কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
খাতুনগঞ্জের আদা ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দুই ঈদকে ঘিরে প্রতিবছরই চড়া হয় বাজার। এছাড়াও, বছরে দুই একবার সরবরাহে ঘটতি হলে বা চীনের বাজারে আদার বুকিং রেট বেড়ে গেলেও বাড়ে আদার দাম। এতে ভোগান্তি পোহাতে হয় সাধারণ ক্রেতাদের।
রোজার ঈদে পুরো মাসজুড়ে স্বাভাবিকের চাইতে দ্বিগুণ থাকে আদার চাহিদা। আদা কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষণ করা যায় বিধায় চাইলেও সরবরাহ দ্বিগুণ করা যায় না। এতে রোজার সময় দাম বেড়ে যায় আদার।
অন্যদিকে, ঈদুল আজহার সময় দেশজুড়ে কোরবানি দেওয়া পশুর মাংস রান্না করতে প্রচুর পরিমাণে আদার প্রয়োজন পড়ে। এতে আদার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দাম বাড়ে আরেক দফা।
এছাড়াও, মধ্যস্বত্বভোগী কিছু কমিশন এজেন্টকে দায়ী করেছেন ব্যবসায়ীরা। খাতুনগঞ্জের আদা-রসুনের পাইকারী দোকান এ এইচ ট্রেডার্সের পরিচালক শাহাদাৎ হোশেন টিবিএসকে বলেন, "বন্দরে আসার পর আমদানিকারক কাছ থেকে কিনে নিয়ে তিন-চার হাত ঘোরার পর খাতুনগঞ্জে আসে আদা। এতে ১০-২০ টাকা দাম বেড়ে যায়।"
তিনি বলেন, "আদা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কন্টেইনার থেকে বের করে গুদামে আনার পর সর্বোচ্চ এক সপ্তাহ রাখা যায়। এরপরে পঁচন ধরে যায়। এছাড়াও প্রতি ২২ কেজির বস্তায় ওজন কমে ২-৩ কেজি। এতে লোকসান গুনতে হয় আমাদের মত ব্যাপারীদের।"
গত শুক্রবার ও শনিবার (১৪ ও ১৫ জুন) খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন দোকান ঘুরে দেখা গেছে, চীনা আদা বিক্রি হচ্ছে ২৬৫ টাকায়। ইন্দোনেশিয়া থেকে আসা ছোট আকারের আদা বিক্রি হচ্ছে ১৮০-৯০ টাকায়।
অথচ, মাত্র এক সপ্তাহ আগে চীনা আদার দাম ছিল ২৩০ থেকে ২৪০ টাকা এবং ইন্দোনেশিয়ার আদার দাম ছিল ১৫০-১৬০ টাকা। কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে পাইকারী বাজারে প্রতি কেজিতে ৩০-৪০ টাকা দাম বেড়েছে আদার দাম।
আদার চাহিদা ও উৎপাদনের হিসাবে গড়মিল
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব বলছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত দেশে আদার উৎপাদন থমকে রয়েছে। এই এক দশকজুড়ে মাত্র ৮০ হাজার টনের সামান্য এদিক-সেদিক হয়েছে মসলাটির উৎপাদন।
২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে ৭৭ হাজার টন আদা উৎপাদন হয়েছিল, যা ২০১৯-২০ সালে এসে সর্বোচ্চ ৮৪ হাজারে উঠে। ২০২১-২২ এ কমে আবার ৮২ হাজার টনে নেমেছে।
বিবিএস যে হিসাব দেয়, তার সঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবের বড় ফারাক রয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় উৎপাদনের তথ্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেশব্যাপী নিযুক্ত কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সংগ্রহ করে। সেখান থেকে দেওয়া মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেখা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে আদার উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ৯১ হাজার টন। অর্থাৎ, দুই সংস্থার (বিবিএস ও কৃষি মন্ত্রণালয়) উৎপাদনের হিসাবের মধ্যে ফারাক ১ লাখ ৯ হাজার টন।
আশা জাগাচ্ছে বিকল্প চাষ পদ্ধতি
বাংলাদেশের জলবায়ু আদা চাষের জন্য বেশ অনুকূল। উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া আদা চাষের উপযোগী। সামান্য ছায়াযুক্ত স্থানে এর ফলন ভালো হয়। সমুদ্র সমতলবর্তী অঞ্চল থেকে শুরু করে ১,৫০০ মিটার উঁচু পার্বত্য অঞ্চলেও আদার চাষ করা যায়। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা সম্পন্ন উঁচু জমি আদা চাষের উপযোগী। বেলে দো-আঁশ, বেলে ও এঁটেল দো-আঁশ মাটিতে এর ফলন ভালো হয়।
বাংলাদেশের সর্বত্র আদার চাষ হয়ে থাকে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলায় ব্যাপকভাবে আদার চাষ করা হয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর ৭ হাজার হেক্টর জমিতে আদার চাষ করা হয়, যার হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ৫.৫ টন।
তারপরও, ফলন পেতে ৯-১০ মাস লাগার কারণে আদা চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন দেশের কৃষকরা।
তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বস্তায় আদা চাষে সাফল্য পাওয়ায় অনেকেই আবার ফিরছেন বাণিজ্যিক চাষাবাদে।
মাটিতে আদা চাষ করলে মাটির আদ্রতা রক্ষা করা যায় না। এতে ঘাসের যন্ত্রণায় মাটি শক্ত হয়ে যায়। ফলে আদার বিস্তারে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে ফলন কমে যায়। আর বর্ষাকালে মাটিতে পানি জমে আদা পঁচে যায়। কিন্তু বস্তা পদ্ধতিতে আদা চাষ করলে এ ধরনের কোনো ঝুঁকি থাকে না। বস্তায় মাটি নরম থাকে ঘাস কম হয়।
অন্যদিকে, বস্তায় ছিদ্র থাকায় বর্ষাকালে পানি জমে না। ফলে জমিতে চাষাবাদের চেয়ে বস্তায় আদার ফলন অনেক বেশি হয়।
বিকল্প এই পদ্ধতি ব্যবহার করে দেশের বিভিন্ন জেলায় ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে আদার চাষাবাদ। বাড়ির আঙ্গিনা, ছাদ, পতিত জমি, আমের বাগানসহ বিভিন্ন জায়গায় এ পদ্ধতিতে আদা চাষ করা যায় বলে দ্রুত জনপ্রিয়তাও পাচ্ছে।
এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরে আদার উৎপাদন বেড়ে দাম কিছুটা হাতের নাগালে আসতে পারে বলে মনে করছেন ব্যাপারীরা।