আমি কি এক কাপ কফিও খাব না?
আমাদের মধ্যে অনেকেই জীবনের একটি পর্যায়ে এসে নিজেদের প্রশ্ন করেন—"আমি কি এক কাপ কফিও খাব না? আমি কি একটা ব্র্যান্ডেড শার্ট কিনতে পারব না? মাসে কয়েকদিন পরিবার নিয়ে বাইরে খেতে যেতে পারবো না?"
এ প্রশ্নগুলো আসলে অনেক গভীর ভাবনার জন্ম দেয়। আমরা সবাই চাই আমাদের প্রয়োজনীয়তা ও চাহিদাগুলো পূরণ করতে, কিন্তু সেটি করতে গিয়ে কখনো কখনো ভুল আর্থিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। এ আর্থিক সিদ্ধান্তগুলোর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব কী হতে পারে, তা আমাদের সবারই বুঝে নেওয়া জরুরি।
আমরা যত বেশি পার্সোনাল ফাইন্যান্স সম্পর্কে সচেতন হব, তত ভালোভাবে আমাদের অর্জিত অর্থ ব্যবহারের উপায়গুলো জানতে পারব। মূল বিষয় হল, বর্তমানে যে জীবন যাপন করছি, সেটাকে কীভাবে ভবিষ্যতেও একই মানে ধরে রাখা যাবে।
কিন্তু অনেকেই কর্মজীবনে যে জীবনযাত্রার মান ধরে রাখেন, রিটায়ারমেন্টের পর তা আর ধরে রাখতে পারেন না। এর প্রধান কারণ, কর্মজীবনে তারা সঠিকভাবে আর্থিক পরিকল্পনা করতে ব্যর্থ হন। পরিকল্পনার অভাবে, রিটায়ারমেন্টের পর হঠাৎ করেই জীবনযাত্রার মান কমে যায়।
পার্সোনাল ফাইন্যান্স ম্যানেজমেন্টের গুরুত্ব স্কুল বা কলেজে সেভাবে শেখানো হয় না। অথচ এটি এমন একটি দক্ষতা যা আমাদের সবার জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারে। যখন আমরা সঠিকভাবে টাকা খরচ করতে শিখি এবং ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করি, তখন আর্থিক সংকট আমাদের জীবনে হানা দিতে পারে না।
হাভার্ড বিজনেস রিভিউ-এর একটি গবেষণায় (২০২০) বলা হয়েছে, "যাদের একটি সুনির্দিষ্ট আর্থিক পরিকল্পনা থাকে, তারা প্রায় ৩০% বেশি সফল হয় তাদের আর্থিক লক্ষ্য অর্জনে।" এ থেকেই বোঝা যায়, পার্সোনাল ফাইন্যান্সের জ্ঞান আমাদের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
অবশ্যই আমরা ব্র্যান্ডেড শার্ট পরতে পারি, ব্র্যান্ডের ঘড়ি কিনতে পারি, কিংবা পরিবার নিয়ে বাইরে খেতে যেতে পারি। তবে আমাদের সেই খরচগুলো সুনির্দিষ্ট চিন্তাভাবনার মাধ্যমে করতে হবে। প্রথমেই ভাবতে হবে, আমরা আসলে কী অর্জন করতে চাই—আধুনিক জীবনের চাকচিক্য, নাকি ভবিষ্যতের নিরাপত্তা।
একটি সাধারণ উদাহরণ দেয়া যাক। ধরুন আপনি প্রতিদিন সকালে ব্র্যান্ডেড কফি শপ থেকে কফি কিনছেন। এটি অবশ্যই একটি উপভোগ্য অভ্যাস, কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ অভ্যাস কি আপনার সারাজীবনের জন্য অর্থনৈতিকভাবে টেকসই হবে? যদি না হয়, তবে এর বিকল্প কী হতে পারে?
এ ধরনের ছোট ছোট খরচগুলো দীর্ঘমেয়াদে বিশাল হয়ে দাঁড়াতে পারে এবং রিটায়ারমেন্টের পর আমাদের জীবনযাত্রার মানকে প্রভাবিত করতে পারে।
অনেকেই কর্মজীবনের সময় অর্থ সঞ্চয় করেন না এবং ভবিষ্যতের জন্য কোনো পরিকল্পনা করেন না। কিন্তু রিটায়ারমেন্টের পর জীবনের মান হঠাৎ কমে গেলে তারা হতাশায় ডুবে যান।
আমরা দেখেছি, অনেক মানুষ কর্মজীবনে সফল হওয়ার পরেও রিটায়ারমেন্টের পর কষ্টে দিন কাটান, কারণ তারা কখনো নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করেননি। অথচ পার্সোনাল ফাইন্যান্সের জ্ঞান থাকলে তারা সেই সমস্যাগুলো থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারতেন।
আমাদের জীবনকে পরিচালিত করা উচিত মিতব্যয়ীভাবে, অপ্রয়োজনীয় খরচ থেকে বিরত থেকে।
অবশ্যই আমরা ব্র্যান্ডের শার্ট, ঘড়ি বা অন্যান্য বিলাসবহুল পণ্য কিনতে পারি, কিন্তু সেটা তখনই করা উচিত, যখন আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং ভবিষ্যতের সঞ্চয় সঠিকভাবে বজায় থাকে।
অধিকাংশ সময় আমরা আবেগতাড়িত হয়ে অনেক কিছু কিনে ফেলি, যা আসলে আমাদের দরকার নেই। এ অভ্যাসগুলো থেকে বেরিয়ে আসা খুবই জরুরি। কেননা প্রতিটি খরচের পেছনে একটি উদ্দেশ্য থাকা উচিত। কফি খাওয়া বা ব্র্যান্ডেড শার্ট কেনার মধ্যে কোনটা আমাদের মূল লক্ষ্য, সেটা ঠিক করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনা দরকার, যখন আমরা বুঝি যে আমাদের আর্থিক সিদ্ধান্তগুলো দীর্ঘমেয়াদে আমাদের সুখের ওপর প্রভাব ফেলবে। ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো-এর একটি গবেষণায় (২০১৯) বলা হয়েছে, "ইম্পালসিভ কেনাকাটা এবং বিলাসিতার পেছনে অতিরিক্ত খরচ করা ব্যক্তিদের মধ্যে আর্থিক হতাশা বেশি দেখা যায়।"
আমরা কখনও কখনও নিজেদের আনন্দের জন্য বিভিন্ন খরচ করি। কিন্তু সেই আনন্দ উপভোগ করতে হবে বুঝে-শুনে, যাতে তা দীর্ঘমেয়াদী সুখ দেয়। মুহূর্তের আনন্দ যদি আমাদের ভবিষ্যতকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তবে তা কোনোভাবেই একটি সঠিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। আমাদের খরচের প্রতিটি সিদ্ধান্তই এমন হওয়া উচিত, যাতে তা আমাদের জীবনের সব ধাপেই উপকারে আসে।
আমাদের অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত এমনভাবে, যাতে সেই অভ্যাসগুলো আমরা সারা জীবনের জন্য ধরে রাখতে পারি। শুধু বর্তমানের আয় নয়, আমাদের ভবিষ্যতের নিরাপত্তার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। কারণ রিটায়ারমেন্টের পরেও আমাদের জীবনযাত্রার মান ধরে রাখা জরুরি। আমরা প্রায়ই দেখি যে, অনেক প্রবীণ মানুষ তাদের জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে আর্থিক সংকটে পড়েন, যা তাদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতাকেও প্রভাবিত করে।
আমাদের জীবনে প্রতিটি সিদ্ধান্তই চিন্তা-ভাবনা করে নেওয়া উচিত, কারণ শেষ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্তগুলোই আমাদের ভবিষ্যত নির্ধারণ করবে। সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে আমাদের জীবন ভালোভাবে চলবে, কিন্তু ভুল সিদ্ধান্ত আমাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে। তাই আমাদের উচিত এখন থেকেই সচেতন হওয়া এবং আমাদের আর্থিক সিদ্ধান্তগুলোকে সঠিকভাবে নেওয়া।
সাইফুল হোসেন: দি আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট বইয়ের লেখক, কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।