ঢাকার শেষ কয়েকটি ফ্যাক্সমেশিন
২০১৮ সালে আমার সহকর্মী নুসমিলা লোহানি যখন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপের জন্য আবেদন করছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি তখন তার ভ্যাকসিনেশনের কাগজপত্র বাধ্যতামূলকভাবে ফ্যাক্স করার কথা বলেছিল। তারা বলেছিল ই-মেইল করলে হবে না।
ই-মেইল আর ভুরি ভুরি অনলাইন অ্যাপ্লিকেশনের যুগে কাগজপত্র ফ্যাক্স করার বিষয়টি একেবারে অদ্ভূত লাগছিল।কিন্তু তখন সবে আসল লড়াইটা শুরু। ভিসা প্রসেসিংয়ের অন্য সব কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় সে তার বাবাকে এ ব্যাপারে কিছু একটা করতে বলে।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর তার বাবা ধানমন্ডি ২৭ এর কাছে সোবহানবাগে একটি দোকান খুঁজে পান। সেখান থেকে অবশেষে তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়ের কাগজপত্র ফ্যাক্স করতে পারেন।
এই ঘটনা ছয় বছর আগের।
এখন ঢাকায় ফ্যাক্স মেশিন খুঁজে পেতে আপনার রীতিমতো ঘাম ছুটে যাবে। তবে একেবারে যে নেই তা নয়। রাজধানীর এখানে সেখানে এখনও কিছু ফ্যাক্স মেশিনের অস্তিত্ব রয়েছে।
ঢাকার কিছু থানা, সরকারি অফিস এবং এনজিও অফিসে এখনও ফ্যাক্স মেশিন রয়েছে এবং তাদের ওয়েবসাইটেও এগুলোর নম্বর দেওয়া থাকে। তবে তারা নিজেরাও কদাচিৎ বিলুপ্ত প্রায় এই মেশিনগুলো ব্যবহার করে।
স্মার্টফোন, ই-মেইল এবং ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের যুগে, কেনই বা কেউ এই প্রাচীন হার্ডওয়্যারগুলোতে আটকে আছে? এটা কি কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা? নাকি ফ্যাক্স মেশিনের কোনো গোপন সুপারপাওয়ার আছে, যা নীতি নির্ধারণের জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ?
ফ্যাক্স মেশিন থাকা সর্বশেষ দোকান
রাজধানীর দৈনিক বাংলার মোড়ের ছোট্ট একটি অফিসে হেলানো চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায় আলী আকবর নামের এক ব্যক্তিকে। 'মিজান অনুবাদ কেন্দ্র' নামের এই দোকানটি টয়েনবি রোডের একটি কোণায় অবস্থিত। পুরো দোকানটি ফটোকপি মেশিন, ডেস্কটপ কম্পিউটার, প্রিন্টার এবং তরুণ অনুবাদকদের ভিড়ে ঠাসা।
তার পুরনো টেবিলের ওপর পড়ে আছে কালো রঙের প্যানাসনিক কেএক্স এফটি ৯৮৩ ফ্যাক্স মেশিন। বহু বছর ব্যবহারের ফলে বোতামগুলোর উপরে লেখা সংখ্যা এবং শব্দগুলো প্রায় মুছে গেছে।
নিউমার্কেট থেকে ধানমন্ডি, খিলগাঁও, বনশ্রী, কলাবাগান, মোহাম্মদপুর পর্যন্ত প্রায় অর্ধেক ঢাকা শহর ঘুরে আমি এই একটিমাত্র দোকানে ফ্যাক্স মেশিন পেয়েছিলাম।
মেশিনটি এখনও কাজ করে, তবে ছোট ডিজিটাল ডায়ালিং স্ক্রিনটিতে দিনের ভুল সময় উঠে থাকে।
ষাটোর্ধ্ব আলী আকবর বলেন, 'সর্বশেষ এক মাসেরও বেশি সময় আগে আমরা মেশিনটি ব্যবহার করেছি। সেসময় এটি চালাতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়েছিল।'
তবে একটা সময় ছিল যখন মেশিনটি নিয়মিত ব্যবহার করা হতো।
তিনি বলেন, 'মতিঝিল ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত স্থান। সবাই এখানে কাজের জন্য আসে। এমন দিনও গেছে যখন আমরা দিনে ৩০ থেকে ৪০টিরও বেশি ফ্যাক্স পাঠিয়েছি।'
একটি পেজ বাংলাদেশের ভেতরে পাঠালে ১৫-২০ টাকা এবং আন্তর্জাতিক ফ্যাক্সে ৫০ টাকা ফ্যাক্স করতে খরচ হতো বলেও জানান তিনি।
আকবর সম্ভবত শিগগিরই মেশিনটির হাত থেকে মুক্তি পেতে চলেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, 'এখন কেউ আর ফ্যাক্স পাঠাতে চায় না।'
বহু বছর ব্যবহার হয়না মতিঝিল থানার ফ্যাক্স মেশিনটি
ফ্যাক্স মেশিনটি মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কক্ষের একটি টেবিলে রাখা আছে। দেখে মনে হচ্ছিল এটা একেবারে পালিশ করা, গায়ে এক ফোঁটা ধুলো পর্যন্ত নেই।
মতিঝিল থানার অন্যতম কেরানি জাহাঙ্গীর মুন্সী বলেন, 'দুই বছরেরও বেশি সময় আগে আমরা সর্বশেষ ফ্যাক্স পাঠিয়েছি বা পেয়েছি। আমরা এখন ই-মেইল ব্যবহার করি। মেশিনটি ওখানে পড়ে আছে, কেউ হাতও দেয় না।'
কথা বলা সময় জাহাঙ্গীর ও তার সহকর্মীরা তাদের কম্পিউটারে কাজ করছিলেন।
আমাদের ফ্যাক্স মেশিন খুঁজতে দেখে নিউমার্কেট থানার ডিউটি অফিসার অবাক হয়ে যান।
তিনি বলেন, 'এখনও কি ফ্যাক্স মেশিন তৈরি হয়? ই-মেলের যুগে এখনও কারা এগুলো ব্যবহার করছে?'
বাংলাদেশ পুলিশের আইসিটি ডিভিশনের এআইজি ইশতিয়াক-উর-রশিদ বলেন, 'সরকার থানাগুলোতে ফ্যাক্স মেশিন দিয়েছিল যাতে তারা গুরুত্বপূর্ণ নথি, কাগজপত্র এবং ছবি শেয়ার করে নিতে পারে। পুলিশ পরিষেবার জন্য এটি একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র।'
তিনি জানান, সরকারি কর্মকর্তা, সচিব ও পরিচালকদের অফিসে এখনও ফ্যাক্স মেশিন রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অন্যতম মহাপরিচালক নাফিউল হাসানের অফিসে একটি ফ্যাক্স মেশিন রয়েছে।
তার সচিব জুলেখা আক্তার জানান, তার ফ্যাক্স মেশিনে প্রতিদিন একাধিক ডকুমেন্টস আসে।
তিনি বলেন, 'কিন্তু স্যার সাধারণত ফ্যাক্স করা ডকুমেন্ট চেক করেন না, কারণ আমরা এখন অনেক বেশি ই-মেইল ব্যবহার করি। আপনার যদি আপনার কোনো গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টস পাঠানোর দরকার হয়, আমি এটি ফ্যাক্স না করে ই-মেইল করার পরামর্শ দেবো।'
ইশতিয়াক-উর-রশিদ বলেন, 'যতক্ষণ না সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো যন্ত্র ব্যবহার করা হবে বা এটি ব্যবহার বন্ধ করতে হবে সে সম্পর্কে অবহিত না করছে, আমরা বলতে পারি না যে এটি (ফ্যাক্স) অকেজো।'
সম্প্রতি অবশ্য দেশব্যাপী শাটডাউন ও ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের সময় ফ্যাক্স মেশিন পুলিশের কাজে লেগেছে।
বাংলাদেশ পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের এআইজি এনামুল হক সাগর বলেন, 'আমাদের তথ্যের প্রবাহ অব্যাহত রাখতে হয়েছিল। প্রতিটি থানায় না হলেও পুলিশ সার্কেলে মেশিন আছে বলে আমরা ফ্যাক্স মেশিন ব্যবহার করেছি।'
কেন মানুষ এখনও ফ্যাক্স ব্যবহার করে
এখনও মানুষ ইন্টারনেটে 'হাউ টু ইউজ আ ফ্যাক্স মেশিন' (কীভাবে ফ্যাক্স মেশিন ব্যবহার করব) তা অনুসন্ধান করে।
ইউটিউবে সর্বশেষ ফ্যাক্স মেশিন টিউটোরিয়ালটি ছয় মাসের পুরনো।
বর্তমানে পিআইআই এবং এইচআইপিএএ ডেটা পাঠাতে ফ্যাক্স ব্যবহৃত হয়, কারণ এটি ই-মেইলের চেয়ে বেশি নিরাপদ। ই-মেইল হ্যাক করা যায়। সাধারণত একই কারণে নিরাপত্তা সংক্রান্ত তথ্য এবং ব্যাকগ্রাউন্ড তদন্ত সংক্রান্ত তথ্যাবলী ফ্যাক্স করা হয়।
এআইজি ইশতিয়াক-উর-রশিদ বলেন, 'ফ্যাক্স মেশিনগুলো এখনও ব্যবহার করা হয় কারণ এগুলো নিরাপদ এবং স্প্যামে হারিয়ে যাওয়ার বা সংরক্ষণের সম্ভাবনা কম। এছাড়াও এটি টেলিফোন লাইনের সাথে সংযুক্ত থাকায়, আমরা প্রাপককে কল করে জানাতে পারি যে আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ নথি পাঠিয়েছি। ফলে শত শত ই-মেইল বা নথির নিচে তা জমে যাওয়ার সম্ভাবনা কম।'
তবে ফ্যাক্সের একটি সমস্যা রয়েছে: কোনোভাবেই প্রাপক কে তা শনাক্ত করা যায় না। মানুষ এতে ফোন নম্বর টাইপ করে এবং ফ্যাক্স করে দেয়। কিন্তু নম্বরটি ভুল হলে বা পরিবর্তন করা হয়ে গেলে ভুল ব্যক্তির কাছে এটি যাবে।
ই-মেইলের ক্ষেত্রে এই সমস্যা খুব কম। ডোমেনের নামটি সঠিক হলে এটি সঠিক জায়গায় পৌঁছে যায় এবং ডোমেনটির একটি ডিএনএস এমএক্স রেকর্ড থাকে। আজকাল অ্যানালগ ফোন কলের চেয়ে সুরক্ষিত 'এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপ্ট' করা ই-মেইল পাঠানো সম্ভবত বেশি সস্তা।
ফ্যাক্স মেশিন ছাড়া ফ্যাক্সিং
আজকাল ফ্যাক্সজিরো, ফ্রি ফ্যাক্স অনলাইন, আইএফএক্স ইত্যাদির মতো একাধিক বিকল্প রয়েছে, যারা অনলাইন ফ্যাক্সিং পরিষেবা দিয়ে থাকে। এটি ই-মেইল পাঠানোর মতোই। আপনি যা পাঠাতে চান আপনাকে প্রথমে সেই ডকুমেন্ট বা ইমেজটি স্ক্যান করতে হবে এবং আপনার কম্পিউটারে আপলোড করতে হবে। এরপর এসব ওয়েবসাইট ব্যবহার করে আপনি একটি ফ্যাক্স নম্বর দিয়ে সেই স্ক্যান করা ফাইলটি পাঠাতে পারবেন।
এছাড়া বাজারে অনেক কপি মেশিন এবং প্রিন্টিং মেশিন রয়েছে, এগুলোর মাধ্যমেও ফ্যাক্স করা যায়।
বাজারে পাওয়া কিছু জনপ্রিয় মেশিন হলো- এইচপি অফিসজেট প্রো ৮১৩৯ই, ক্যানন জি৭০২০, ব্রাদার এমএফসি-জে৬৫৪০ডিডব্লিউ,ক্যানন ইমেজ রানার ২৭৩০আই ইত্যাদি।
এই মেশিনগুলোতে টেলিফোন লাইনের সঙ্গে সংযোগ করার জন্য একটি ফোন জ্যাক পয়েন্ট রয়েছে, যার মাধ্যমে আপনি ফ্যাক্স পাঠাতে পারেন।
তবে বাংলাদেশের মুদ্রণ এবং কপি করার দোকানগুলো সাধারণত এই উপায়টি ব্যবহার করে না।
এমনকি বেশিরভাগ দোকান অপারেটর তাদের ফটোকপি মেশিনের ফোন জ্যাক সম্পর্কেও জানে না।
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি