‘এমন বাংলাদেশই আমরা চেয়েছিলাম’: টিএসসিতে ত্রাণ দিতে আসা মানুষের ঢল
বিকেল ৪টা। কিছু জামাকাপড় আর এক প্যাকেট বিস্কুট নিয়ে মালিবাগ থেকে এসেছেন হাসিবুর রহমান। রামপুরা থেকে এসেছেন জুয়েল। মাথায় চিড়ার বস্তা। সাব্বির-সৌরভদের দলটি এসেছে শ্যামলী থেকে। তাদের রিকশাভর্তি পানির বোতল। শেহরিন তার মাকে নিয়ে এসেছেন, কাজ করবেন সশরীরে।
শুক্রবারে টিএসসি থাকবে জমজমাট, এ আর নতুন কী। তবে এই শুক্রবার (২৩ আগস্ট) নতুন কিছুই দেখল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আড্ডা নয়, অবকাশ যাপন নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক কারণে টিএসসিতে ছুটে এলেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। একটিই উদ্দেশ্য সবার। বন্যাদুর্গত এলাকায় পাঠাতে হবে ত্রাণ। তাতে যার যেটুকু করার, করতে হবে পুরোটাই।
'দেশে একটা অঞ্চলে মানুষ জীবন মরণ লড়াই করতেছে, তখন তো আমরা ঘরে বসে থাকতে পারি না।' সৌরভের এই মন্তব্যই বুঝিয়ে দিলো সব। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আগেরদিন থেকেই শুরু হয়েছিলো 'গণত্রাণ' কার্যক্রম। তবে শুক্রবার যেন ত্রাণ দিতে আসা মানুষের ঢল নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। এদিন সকাল থেকেই শুরু হয়েছিল কার্যক্রম। শুরু থেকেই আসতে থাকে ত্রাণ।
দুপুরের পর রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে শুরু হয় পূর্বঘোষিত কনসার্ট 'জরুরী সংযোগ'। কনসার্টের চারপাশে বসানো হয় ডেস্ক। শ্রমিক থেকে ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী থেকে শিক্ষার্থী—সামর্থ্য অনুযায়ী যে যা পেরেছেন, তা নিয়ে হাজির হয়েছেন এসব ডেস্কে। এ সময় মানুষ অর্থসাহায্য যেমন করেছেন, তেমনি সঙ্গে করে নিয়ে এনেছেন বন্যাদুর্গত এলাকার জন্য জরুরি পণ্যসামগ্রীও।
ঢাবির সামাজিক বিজ্ঞান ভবনের সামনে একটু পরপরই এসে থামছে একের পর ট্রাক। ট্রাকে বোঝাই শুকনো খাবার, কাপড়, ওষুধ, পানি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য।
ঢাবি শিক্ষার্থী মাহাবুব খালাসি কাজ করছেন 'জরুরী সংযোগ'-এ স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে। জানালেন, রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশ থেকে আসা ট্রাক থেকে তারা পণ্য নামাচ্ছেন বিকেল থেকেই। অন্তত ২০ ট্রাক পণ্য তারা ইতিমধ্যে পেয়েছেন।
টিএসসির ভেতরে সারাদিনই চলেছে কর্মযজ্ঞ। এত অল্প সময়ে মানুষ সাড়া দিয়ে এত এত ত্রাণ নিয়ে আসবে, আয়োজকেরাও এমনটি আশা করেননি। তবে পুরো কার্যক্রম নিয়ে অভিভূত তারা।
'আজকে তো জনবিস্ফোরণ ঘটছে। আমরা তো ভাবতেই পারিনি এত ত্রাণসামগ্রী হবে। আমাদের চিন্তার বাইরে চলে গেছে। তাই এসব ম্যানেজমেন্টেও অনেক লোকের এবং সময়ের প্রয়োজন। আমরা সারাদিন সংগ্রহ করেছি, এখন চলবে প্যাকেজিং। সকালের মধ্যে আমরা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব জেলায় জেলায়,' কাল রাতে বললেন গণত্রাণ কার্যক্রমের অন্যতম সমন্বয়ক নয়ন আহাম্মেদ।
তিনি আরও জানান, বিকেল হতেই টিএসসি অডিটোরিয়াম, ক্যাফেটেরিয়া ভরে ওঠে ত্রাণে। টিএসসি ক্যাফেটেরিয়াকে মূলত স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এখান থেকে পণ্য নিয়ে গেম রুম এবং ডাকসুতে চলছে প্যাকেজিংয়ের কাজ।
সেখানে গিয়ে দেখা গেল, একেকদিকে একেক দল কাজ করছে। একদল ওষুধ ভাগ ভাগ করে রাখছেন, অন্য দল শুকনো খাবার ও শিশুখাদ্য আলাদা করছেন। জরুরি ওষুধের প্যাকেটে রাখা হচ্ছে খাবার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধ করার ট্যাবলেট, মোমবাতি, লাইটার, দেশলাই, সাবান ও প্যারাসিটামল-জাতীয় ওষুধ। শুকনো খাবার হিসেবে আছে চিড়া, মুড়ি, বিস্কুট, কেক। এছাড়া চাল, ডাল, তেল, লবণ, চিনি, গুড়ও যাচ্ছে প্রতিটি প্যাকেটে।
এদিকে টিএসসি মাঠের পাশে চলছে আরেক কর্মযজ্ঞ। এই বারান্দা আগেই ভরে গেছে জামাকাপড়ের ব্যাগে। গ্রিক সমাধিস্তম্ভের পাশে এখন সেগুলোই বেছে আলাদা করা হচ্ছে। এখানকার স্বেচ্ছাসেবী মোহাম্মদ নাসির জানালেন, বিতরণের সময় যাতে অসুবিধা না হয়, সেজন্য নারী, পুরুষ আর বাচ্চা—এই তিন ক্যাটাগরিতে আলাদা করা হচ্ছে জামাকাপড়।
সন্ধ্যা থেকেই টিএসসি অডিটোরিয়ামে চলছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মেডিকেল টিম গঠনের মিটিং। দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ের মোকাবিলা কীভাবে করতে হবে, তা নিয়েই চলছিল আলোচনা। নয়ন আহাম্মেদ জানালেন, আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পানি কমে গেলে দুর্যোগ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত হচ্ছেন তারা।
রাতেও চলতে থাকে ত্রাণ সংগ্রহ। সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি কর্মজীবী মানুষদেরও দেখা গেল স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন টিএসসির এদিক-ওদিক।
ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড-এর জিএম (এডমিন) জাহিদুল আলম এসেছিলেন খোঁজখবর নিতে। কী কী পণ্য জরুরি ভিত্তিতে দরকার জেনে নিলেন। কথা দিলেন, কালকে এসব ত্রাণ নিয়ে আসবেন তিনি।
মাঝরাতে একটি ভ্যান বোঝাই করে শুকনো খাবার নিয়ে এসেছেন মোহম্মাদ তামিম। অফিস শেষ করেই ত্রাণ নিয়ে রওনা দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষার্থী।
'আমি কোনো সংগঠন থেকে না। আমি এখানকার সাবেক ছাত্র। নিজের দায়িত্ববোধ থেকে এগুলো নিয়ে এসেছি। মানুষ কষ্ট পাচ্ছে, এ সময় আমরা এগিয়ে না আসলে তো অন্যায় হবে। আমরা যারা সুবিধাভোগী আছি, শান্তিতে আছি, আমাদের অবশ্যই তাদের জন্য কাজ করতে হবে,' বললেন তামিম।
রাত সাড়ে বারোটা। টিএসসি গেম রুম থেকে সর্বশেষ প্যাকেজিং হয়ে ব্যাগগুলো আসছে ক্যাফেটেরিয়ায়। এ সময় নানা স্লোগানে নিজেদের উজ্জীবিত করছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। এসময় শোনা যায়, 'ঢাকা না দিল্লি', 'মোদি না ইউনুস'-এর মতো স্লোগান।
রাত ১টার পরে সে দিনের মতো প্যাকেজিংয়ের কাজ সমাপ্তি ঘোষণা করেন দায়িত্বে থাকা সমন্বয়ক ফয়সাল আহম্মেদ। তিনি জানান, প্রতিটি ব্যাগে এক কেজি করে মুড়ি, চিড়া, চিনি, পর্যাপ্ত শুকনা খাবার, মেডিসিন, স্যালাইন থেকে শুরু করে নাপা, ফিটকিরি, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দেওয়া হয়েছে। বাচ্চাদের জন্য করা হয়েছে আলাদা প্যাকেট, তাতে কেক, চিপস, জুস, গুঁড়া দুধ, চকলেট রয়েছে।
ফয়সাল বললেন, 'আজকে সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ চার হাজার প্যাকেট ফাইনাল করা হয়েছিল। এখন পর্যন্ত আনুমানিক ৮ হাজারের বেশি প্যাকেট ত্রাণ রেডি করা হয়েছে।'
রাতে এক পোস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয় হাসনাত আব্দুল্লাহ জানান, টিএসসি গণত্রাণ সংগ্রহ কর্মসূচি থেকে শুক্রবার রাত ১০টা পর্যন্ত ১ কোটি ৮ লাখ ২৩ হাজার ৯৪৭ টাকা নগদ সংগ্রহ করা হয়েছে। শেষ ৫ ঘণ্টায় সংগ্রহ হয়েছে ৬৭ লাখ টাকা।
অন্যদিকে 'জরুরী সংযোগ'-এর অন্যতম আয়োজক কবি সৈকত আমীন জানালেন, আয়োজনটি ছিল সম্পূর্ণ শূন্য খরচের। তবুও পেয়েছেন অভূতপূর্ব সাফল্য। 'জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে ২০ লক্ষ টাকা নগদ সাহায্য এবং অন্তত দুই টনের ২০টি ট্রাক জরুরি সামগ্রী আমরা সংগ্রহ করতে পেরেছি, যেগুলো আমরা আশা করছি বন্যাদুর্গত অঞ্চলে পৌঁছে দিতে পারব।'
স্বেচ্ছাসেবীদের একটি বড় অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তারা বলছেন, আজ (শুক্রবার) এক নতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেখছেন তারা।
স্বেচ্ছাসেবী রিফাত তানজিম বললেন, 'এমন বাংলাদেশই আমরা চেয়েছিলাম। যেকোনো জাতীয় বিপর্যয়ে এক হবে পুরো জাতি, ঝাঁপিয়ে পড়বে কাজে। আজকের টিএসসি যারা দেখছে, তারা দেশ নিয়ে আশাহত হবে না।'
রাত আড়াইটা। টিএসসি মেট্রো স্টেশনের নিচে জড়ো হচ্ছে একের পর এক ট্রাক। বানভাসি মানুষের জন্য ত্রাণসামগ্রী নিয়ে সেগুলো চলে যাবে জেলায় জেলায়।
টিএসসির পেছন গেট দিয়ে যখন শুরু হয়ে গেছে ট্রাক বোঝাই করার কাজ, তখন কথা হলো স্বেচ্ছাসেবী শাহিনুর সুরাইয়ার সাথে। তিনি জানালেন, শনিবারও সকাল থেকে চলবে ত্রাণ সংগ্রহের কাজ। 'কিছু জরুরি পণ্য আমাদের বেশি বেশি দরকার, অথচ কম আসছে। সেগুলো যেন মানুষ নিয়ে আসে। ন্যাপকিন, বাচ্চাদের খাবার, লাইটার, দেশলাই, খেজুর, পানি, পলিথিন এবং বিভিন্ন ধরনের ওষুধ আমাদের জরুরি দরকার।'
'আমাদের ত্রাণ কোনো নির্দিষ্ট একটি জেলায় যাবে না। এখানে খাগড়াছড়ির জন্য আলাদা দল আছে; ফেনী, নোয়াখালী, হবিগঞ্জ—প্রতিটি বন্যাদুর্গত জেলার পৌছে যাবে। আমরা সামগ্রিকভাবে চিন্তা করছি,' মন্তব্য করলেন স্বেচ্ছাসেবী মাহাবুব খালাসি।
তিনি বললেন,'টিএসসি কিংবা রাজু, এখানে আয়োজকদের বাইরেও অচেনা অনেকেই কাজ করেছেন। যে যেখান থেকে পেরেছে, সম্মিলিত এবং সুশৃঙ্খলভাবে এই কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছে। এগুলো আমাদের অভিভূত করে এবং প্রেরণা দেয়। আমরা যে আপৎকালীন সময়ে সব ভেদাভেদ ভুলে এক হয়ে কাজ করতে পারি, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ আজকের সারাদিন।'