৬ হাজার ব্যঙ্গের রঙ্গময় তরঙ্গমালা, হুদার কার্টুনে এরশাদ থেকে হাসিনা
সকালে বঙ্গভবনে গিয়ে এরশাদ সাহেব (সাবেক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ) প্রথম যে কাজটি করতেন, তা হলো দৈনিক জনতা খুলে হুদার কার্টুনে চোখ বুলানো এবং হো হো করে হাসা। তখন এরশাদ ক্ষমতায়। জনতা ছিল এরশাদ তথা জাতীয় পার্টির পত্রিকা। হুদা প্রতিদিন জনতায় পকেট কার্টুন (সিঙ্গেল কলামে ২ বা ৩ ইঞ্চি লম্বা) আঁকতেন। এরশাদ তার কার্টুন পছন্দ করতেন। কিন্তু হুদা কি তাকে পছন্দ করতেন?
আসিফুল হুদা বললেন, 'জীবিকার প্রয়োজনে জনতায় কাজ করতাম, কিন্তু এরশাদকে পছন্দ করতাম না। তিনি স্বৈরাচার ছিলেন। স্বৈরাচারের নীতি ও দর্শন আমার পছন্দ করার কোনো কারণ নেই। আমি গণতন্ত্রমনা মানুষ। গণতন্ত্রের পক্ষেই আমার সমর্থন।'
হুদার কার্টুন দেখে এরশাদ বা তার সেক্রেটারি জনতার সম্পাদককে (সানাউল্লাহ নূরী) ফোন করে ধন্যবাদ জানাতেন। পরে সম্পাদক তা হুদাকে জানাতেন। একদিন হুদাকে দেখে নূরী বললেন, 'প্রেসিডেন্ট তোমার আজকের কার্টুন দেখে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।'
কি ছিল সেই কার্টুনটি? হুদা বললেন, "তখন এয়ারপোর্ট দিয়ে সোনা চোরাচালানের খবর প্রায়শই পাওয়া যেত। চোরাকারবারিরা পেটে গিলে সোনা চালান করত। আমার কার্টুনটি ছিল, ইমিগ্রেশন অফিসার সন্দেহের চোখে এক গর্ভবতী মহিলার পেটের দিকে তাকিয়ে আছেন। মহিলা বুঝতে পেরে বললেন, 'সোনাদানা নয়, সোনামনি।'" হুদার কার্টুন দেখে এরশাদ আরও অনেকবারই প্রীত হয়েছিলেন। একবার বঙ্গভবনে চা খাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন।
চা খাওয়ার নিমন্ত্রণ
হুদা কি নিমন্ত্রণ রক্ষা করেছিলেন? না, তিনি রক্ষা করেননি। কারণ, স্বৈরাচারের সঙ্গে ওঠাবসায় তার আপত্তি ছিল। দৈনিক জনতায় যখন কাজ করতেন, তখন হুদা পেতেন আড়াই হাজার টাকা। তবে শুরুটা হয়েছিল মাত্র ৬০ টাকা দিয়ে। সেটা ছিল বিরাশি বা তিরাশি সালের কথা। মাস্টার্স শেষ করে বসে আছেন হুদা। বাড়ি থেকে বড় ভাই খবর পাঠালেন, 'চলে আসো, বিসিএসের প্রস্তুতি নাও। ঢাকায় থাকারও তো খরচ আছে।' কিন্তু হুদা ঠিক করে ফেলেছেন, তিনি কার্টুনিস্ট হবেন।
তখন রফিকুন্নবী আর নজরুল ছিলেন নামকরা কার্টুনিস্ট। আর খুব বেশি কেউ ছিলও না। পলিটিক্যাল কার্টুন তখন হতো না, প্রায় সবই ছিল সামাজিক বা ফান কার্টুন। পত্রিকায় কার্টুন পেলে খুব মন দিয়ে দেখতেন হুদা। এর মধ্যে কার্টুনিস্ট হিসেবে বন্ধুমহলে তার কিছু পরিচিতি তৈরি হয়েছে। সে গল্পে আসছি একটু পরেই।
তিরাশি সালের বইমেলায় একদিন দেখা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই, কবি মাহবুব হাসানের সঙ্গে। হাসান বললেন, 'কি করতেছ, হুদা?' হুদা বললেন, 'কিছুই করি না, ভাই, ঘুরি ফিরি।' হাসান ভাই আবার জিজ্ঞেস করলেন, 'তাহলে কীভাবে চলছে খাওয়া-দাওয়া, ঘোরা ফেরা?' হুদা বললেন, 'এই ধার-দেনা করে টুকটাক চলে যাচ্ছে।' হাসান ভাই বললেন, 'চলো, তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাই, সেখানে কার্টুন আঁকবা।'
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক পার করে সার্কিট হাউজ রোডে নিয়ে গেলেন হাসান। সেখানে ছিল সচিত্র স্বদেশ পত্রিকার অফিস। তখনো সাপ্তাহিক রোববার সম্ভবত বের হয়নি। তখনকার বিখ্যাত ম্যাগাজিন ছিল বিচিত্রা আর সচিত্র সন্ধানী। সচিত্র স্বদেশ-এর মালিক-সম্পাদক জাকি মোশাররফ কথাবার্তা ভালোই বললেন। প্রতি সপ্তাহে একটি করে কার্টুন দিতে হবে, আর প্রতি কার্টুনের জন্য সম্মানী পাওয়া যাবে ১৫ টাকা। ফলে মাসে সাকল্যে ৬০ টাকা। সে আমলের হিসাবে একেবারে খারাপ ছিল না।
টাকা-পয়সার এই বন্দোবস্ত হওয়ার পর হুদা নাটকে আরও বেশি সময় দিতে লাগলেন। নাট্যদল নাট্যচক্র-এর সদস্য তিনি আগে থেকেই। তার ধ্যান-জ্ঞান তখন মঞ্চনাটক আর কার্টুন। বাড়ি থেকে বড় ভাইয়ের তাগাদায় তিনি এখন আর ভড়কে যান না। কার্টুন যে খুবই শক্তিশালী মাধ্যম, তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন জহুরুল হক হলে থাকার সময়ই। তখন থেকেই বন্ধুদের মধ্যে তার আঁকিয়ে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
প্রভোস্ট জব্দ করেছিলেন
হলের খাবার ছিল খুবই খারাপ, বিশেষ করে ডাল। এত পাতলা ছিল যে, অনেকে ময়লা পানি ভেবে হাত ধুয়ে ফেলত। টয়লেট ছিল অপরিস্কার, আর সিটগুলো রাজনৈতিক বিচারে বরাদ্দ দেওয়া হতো। সব মিলিয়ে হলের অবস্থার কথা বলার মতো ছিল না। বন্ধুরা বলল, 'তুই কার্টুন এঁকে এর প্রতিবাদ কর।'
হলের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে হুদা একটি মাউন্টবোর্ডে ৭–৮টি আলাদা আলাদা কার্টুন আঁকলেন। একটি ছিল একজন ডুবুরি ডালের গামলায় ডুব দিয়ে ডাল খুঁজে বেড়াচ্ছে। পরে মাউন্টবোর্ডটি টাঙিয়ে দিয়েছিলেন হলের মেইন গেটের সামনে। সারাদিন ধরে হলের ছাত্ররা হুমড়ি খেয়ে কার্টুনগুলো দেখেছে, এমনকি অন্য হলের ছাত্ররাও ভিড় করেছিল। সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে খবর রটে যায়। হল প্রভোস্ট এতে বিব্রত হন।
পরের দিন আর মাউন্টবোর্ডটি খুঁজে পাওয়া গেল না। জানা গেল, প্রভোস্ট সেটি জব্দ করেছেন। প্রভোস্ট পরে ডেকে বললেন, 'তুমি এভাবে রাষ্ট্র না করলেও পারতে, আমাকে সরাসরি জানাতে পারতে, আমি ব্যবস্থা নিতাম।' হুদা অবশ্য কোনো জবাব দেননি। রুমে ফিরে এসে ভাবলেন, এবার পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের অব্যবস্থাপনা নিয়ে বেশ কিছু কার্টুন আঁকবেন।
একেকটা মাউন্টবোর্ড ছয় বা আট ভাগে কেটে প্রায় ৩০টি কার্টুন এঁকেছিলেন। কলাভবনে ঢোকার মুখে সেগুলো টাঙিয়ে দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দেখতে ভিড় করেছিল। এ দুই ঘটনার পর হুদা বুঝতে পেরেছিলেন, কার্টুন একটি শক্তিশালী মাধ্যম, এবং এর প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী। তখনই তিনি স্থির করেছিলেন, কার্টুনিস্ট হবেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে রাজনৈতিকভাবে সচেতন থাকারও চেষ্টা করতেন।
সচিত্র স্বদেশ-এ কাজ
সচিত্র স্বদেশ পত্রিকায় তিন মাস কাজ করার পর হুদা দেখলেন, টাকা পাচ্ছেন না। একদিন কবি মাহবুব হাসানকে পেয়ে জানতে চাইলেন, 'হাসান ভাই, আসলে ব্যাপারটা কী? আমি তো কিছু বুঝতেছি না।' হাসান ভাই বললেন, 'তোমার পিছনে শয়তান লাগছে। সে মালিককে বুঝাইছে, তোমার তো নাম হইতাছে, টাকার দরকার কী?'
এরপর হুদা সচিত্র স্বদেশ-এ কার্টুন আঁকা বন্ধ করে দেন। তিনি ভাবতেন, মেধা ও শ্রম দিয়ে যখন কাজ করেন, তখন পাঁচ টাকা হলেও পারিশ্রমিক নেবেন। পরে কাজ নিয়েছিলেন 'খবরের কাগজ-এ। সেখানে তিনি তিন ফ্রেমের একটি স্ট্রিপ কার্টুন আঁকেন। তাতে দেখা যায়, একজন ছাত্র বই নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করছে, সঙ্গে লেখা — 'এসো পড়ি।'
পরের ফ্রেমে দেখা যায়, কলমকে বন্দুকের মতো কাঁধে ঝুলিয়ে সেই ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সঙ্গে লেখা — 'এসো লড়ি।' শেষ ফ্রেমে দেখা যায়, তার লাশ পোস্টমর্টেমের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সঙ্গে লেখা — 'এসো মরি।' সাপ্তাহিক যায় যায় দিন এ কার্টুনটিকে বর্ষসেরা কার্টুন নির্বাচন করেছিল।
১ টাকা করে বিক্রি হয়েছিল
খবরের কাগজ-এ হুদা বেশি দিন কাজ করেননি। এরপর তিনি দৈনিক জনতায় যোগ দেন। সেখানে দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন। জনতায় কাজ করার সময় তিনি আড়াই হাজার টাকা সম্মানী পেতেন। এরশাদের পতন যখন নিশ্চিত, তখন তিনি একটি কার্টুন আঁকেন, যাতে এরশাদকে টিভির ফ্রেমে টাই পরা অবস্থায় দেখা যাচ্ছে, কিন্তু ফ্রেমের যেখানে শেষ, সেখান থেকে তিনি নগ্ন। একজন সে কার্টুনটি চেয়ে নিয়ে ফটোকপি করিয়ে ১ টাকা করে বিক্রি করেছিল।
হুদা বললেন, 'কার্টুনে একটি ঘটনার প্রকাশ থাকতে হয় বিদ্রুপাত্মক বা হাস্যরসাত্মকভাবে, শেষে একটি মেসেজ বা চিন্তা থাকে। পত্রিকায় পকেট কার্টুন ছাড়াও স্ট্রিপ কার্টুন (কয়েকটি ফ্রেম নিয়ে একটি কার্টুন), কমিক কার্টুন (হাস্যরসাত্মক), এডিটোরিয়াল কার্টুন এবং পলিটিক্যাল কার্টুন ছাপা হয়। তবে আশির দশকে পলিটিক্যাল কার্টুন বলতে কিছু ছিল না। তখন পত্রিকার ডিক্লারেশন দেওয়াও বন্ধ ছিল। কার্টুনিস্টরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে কার্টুন আঁকতেন। পত্রিকায় অনেক মজার বা উদ্ভট প্রতিবেদন ছাপা হতো, সেগুলো থেকেই আইডিয়া জোগাড় করতাম।'
মুণ্ডুহীন খাসির রোস্ট
১৯৯৪ সালের দিকে হুদা দৈনিক বাংলায় যোগ দেন। এখানে তিনি সম্মানী পেতেন সাড়ে তিন হাজার টাকা। হাসিনা সরকার প্রথমবার ক্ষমতায় আসার আগে বলেছিল, সরকারি কোনো সংবাদপত্র থাকবে না। সে অনুযায়ী ১৯৯৭ সালে দৈনিক বাংলা এবং বিচিত্রা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আসলে হাসিনা টের পেয়েছিলেন, এ পত্রিকাগুলো সরকারি পৃষ্ঠপোষণায় থাকলেও সরকারি দলের পক্ষে কাজ করে না। তাই কথার মারপ্যাচ ও ছলচাতুরির মাধ্যমে পত্রিকাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়।
পত্রিকা বন্ধ হওয়ার কিছুদিন আগে দৈনিক বাংলার সম্পাদক আহমেদ হুমায়ুন একদিন আলাপে হুদাকে বলেছিলেন, 'জানো হুদা, পাকিস্তান আমল থেকে আজ পর্যন্তও কার্টুনিস্ট ও সম্পাদক উভয়ের স্কেলই সমান, অর্থাৎ স্পেশাল গ্রেড।' হুদা অবাক হন এবং দুঃখও পান। কারণ খুঁজে পাননি — এভাবে ঠকানোর মানে কী? পরের ওয়েজ বোর্ডে অবশ্য এ নিয়ম বাতিল করা হয়। কার্টুনিস্টদের দেওয়া হয় সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটরের গ্রেড ওয়ান স্কেল।
ইনকিলাব-এ কাজ করতে যেয়ে এ বিষয়ে সম্পাদকের সঙ্গে তিন ঘণ্টার বৈঠক হয়। তারা হুদাকে স্টাফ হিসেবে নিয়ে কাজ করাতে চেয়েছিলেন। তবে হুদা ওই স্কেলে কাজ করতে রাজি হননি। তিনি কার্টুন আঁকবেন ঠিকই, তবে সম্মানী নেবেন চুক্তিভিত্তিতে।
১৯৯৮ সালের দিকে হুদা একসঙ্গে তিনটি পত্রিকায় — দৈনিক দিনকাল, ইনকিলাব এবং সাপ্তাহিক যায় যায় দিন — কার্টুন আঁকতেন।
তখন শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায়। যায় যায় দিন-এর জন্য হুদা একটি কার্টুন আঁকলেন, যেখানে মুণ্ডুহীন একটি আস্ত খাসির রোস্ট থালায় করে শেখ হাসিনার সামনে রাখা হচ্ছে। খাসির লেজটি ছোট্ট করে আঁকা। পত্রিকা ছাপা হওয়ার দিন দেখলেন, সে কার্টুনটি ছাপা হয়নি। তিনি সম্পাদক শফিক রেহমানের কাছে কারণ জানতে চান। শফিক রেহমান বললেন, 'এটাকে কেউ শূকর বলে ভুল করতে পারে, এতে জেলেও যেতে হতে পারে।'
হুদা তখন বললেন, 'লেজটুকু কম্পিউটারে মুছে দিলেই তো হতো।' জনাব রেহমান উত্তর দেন, 'কার্টুনিস্টের অনুমতি ছাড়া কেউ এ কাজ করতে পারে না। বিশ্বের কোনো উন্নত দেশেই এমনটা করা যায় না।' হুদা তখন মনে মনে ভাবলেন, এ না হলে সম্পাদক! সম্পাদকের তো এমনই হওয়া উচিত।
একসঙ্গে ৩ পত্রিকায়
দিনকালের সম্পাদক আখতারুল আলম হুদাকে কড়া বা হার্ড কার্টুন আঁকতে উৎসাহ দিতেন। এ প্রসঙ্গে হুদার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কখনো কি হুমকি-ধমকির শিকার হয়েছেন?
হুদা বললেন, 'আমি মিথ্যা বা ভুল কোনো বিষয়ে কার্টুন করিনি। কাউকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা আমার লক্ষ্য ছিল না। সত্য ঘটনাকেই আমি বিষয় করতাম।'
একবার আখতারুল আলম জানতে চাইলেন, 'তুমি কয়টা পত্রিকায় আঁকো?'
হুদা উত্তর দিলেন, 'দিনকালসহ তিনটা।'
আখতারুল আলম বললেন, 'সব কয়টাতেই আঁকা অব্যাহত রাখো। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সভায় তোমার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে যেন তিনটি পেপারই শাউট (লেখালেখি) করে। তাই বলছি, কোথাও আঁকা থামিও না।'
কোনো প্রলোভনেও হুদা নীতিবিচ্যুত হননি। অনেকেই বলত, ভালো-মন্দ কিছু না আঁকলে সমস্যা নেই, শুধু চুপচাপ থাকেন। হুদা জবাব দিতেন, 'আমার তো কাজই এটা। চুপ থাকব কীভাবে?'
ইনকিলাবে প্রথম রঙিন কার্টুন আঁকা শুরু করেন হুদা, সেটাও সম্পাদকের চাপাচাপিতে। সম্পাদকের মতে, পুরো পাতা রঙিন হলেও কার্টুনটি সাদাকালো হলে বেমানান দেখাত।
হুদার যুক্তি ছিল, কার্টুন সাদাকালোতেই বেশি আবেদন তৈরি করতে পারে, রঙিন কার্টুন ততটা পারে না। কিন্তু সম্পাদকের যুক্তিও ফেলে দেওয়ার মতো ছিল না। তাই হুদা রঙিন কার্টুন আঁকতে শুরু করেন।
ষোল আনা উসুল
সে সময় হুদা কার্টুন আঁকায় মগ্ন ছিলেন। খেতে খেতে, বাজারে যেতে যেতে, গোসল করতে করতে — সর্বত্রই তিনি কার্টুন নিয়ে ভাবতেন। এটি যেন তার নেশায় পরিণত হয়েছিল। তিনি প্রচুর চিঠি পেতেন, তার কার্টুনের প্রতিক্রিয়াও ছিল বিপুল।
ঈদ উপলক্ষে যায় যায় দিন তখন পুরো পাতাজুড়ে কার্টুন ছাপাত। একবার ঈদ কার্টুনের প্রতিক্রিয়ায় একটি চিরকুট পান, সঙ্গে ১ টাকা। চিরকুটে লেখা ছিল, 'আপনার কার্টুন দেখে ষোল আনা উসুল হয়েছে।'
দিনকালের পরে হুদা কাজ করতে শুরু করেন দৈনিক আমার দেশে। সেখানে তিনি কড়া বা হার্ড কার্টুন আঁকার অনেক সুযোগ পেয়েছিলেন।
এরপর হুদাকে একটি প্রশ্ন করলাম, যেটি করতে চাইছিলাম অনেকক্ষণ ধরেই, কিন্তু অস্বস্তির কারণে করতে পারছিলাম না। তবে প্রশ্ন করার পর দেখলাম তিনি বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করলেন। প্রশ্নটি ছিল — 'আপনি বিএনপিঘেঁষা পত্রিকাগুলোতেই কাজ করেছেন, কেন?'
হুদা বললেন, 'বিএনপিকে আমার অধিক গণতন্ত্রমণা মনে হয়। তাদের আমলে বাকস্বাধীনতার ওপর কমই হস্তক্ষেপ হয়েছে। তবে যে স্মৃতি আমাকে আজও তাড়িত করে তা হলো চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ। আমরা ভৈরবে থাকতাম। রাস্তায় হাড্ডিসার মানুষের মিছিল দেখেছি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে শুধু ভাতের মাড়ের জন্য মানুষগুলোর সে কী আকুতি! অথচ দলীয় মজুতদার, চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। দলের লোকের ব্যাপারে সরকার চোখে ঠুলি পরে থাকত।
'সে দুর্ভিক্ষ যতটা না প্রাকৃতিক ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল মনুষ্যসৃষ্ট। আমার ধারণা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মৃত্যুহার অনেকটাই ঠেকানো যেত। চুয়াত্তরের পর থেকে আমি আর আওয়ামী লীগকে সমর্থন করতে পারিনি।'
হুদা বলতে থাকলেন, 'আমার দেশ পত্রিকায় কাজ করে যেমন ভালো লাগছিল, সম্মানীও পাচ্ছিলাম যথেষ্ট। কিন্তু ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়। তারপর থেকে গুম-খুনের ঘটনা ঘটতে থাকল। আঁকাআঁকি সব বন্ধ করে দিতে হলো।
'গত ১০ বছর আমার কোনো আয়-রোজগার ছিল না। যা সঞ্চয় ছিল তা ভেঙে খেয়েছি, জমিজমাও কিছু বিক্রি করতে হয়েছে। বড় মেয়েটি নিজের যোগ্যতায় আমেরিকায় বৃত্তি নিয়ে পড়তে গেছে। টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কিছু রোজগার করে, সেখান থেকে আমাকেও কিছু দেয়। ছোট মেয়েটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজনেস স্টাডিজ পড়ছে আর আছেন আমার স্ত্রী। দেশে তিনজনের সংসার একরকম চলে যায়।'
'তবে এই সময়ের মধ্যে টুডি অ্যানিমেশন ফিল্ম বানিয়েছি, কোনো মিডিয়ার জন্য নয়, নিজের আনন্দের জন্যই,' বলেন তিনি।
আমাদের দেশে নতুনদের অনেকেই কার্টুন করছে। আপনার কেমন লাগে? হুদা বললেন, 'আমাদের এখানে কার্টুনের চেয়ে ক্যারিকেচারই বেশি হয়। আমি মনে করি শিশির ভট্টাচার্য দেশের এক নম্বর ক্যারিকেচারিস্ট। তার ড্রইংও অসাধারণ। ক্যারিকেচারে মুখ বা চেহারাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয় আর কার্টুনে ঘটনা।'
শেষ প্রশ্ন করলাম এবার, সারাজীবন কার্টুন আঁকলেন। কেমন লাগল?
হুদা উত্তর দিলেন, 'আমি পুরোপুরি সন্তুষ্ট। কার্টুন খুবই শক্তিশালী মাধ্যম। হাজার কথায় যতটা ঘা দেওয়া যায়, এক কার্টুন পারে তার চেয়ে অনেক বেশি। কার্টুন শিক্ষিত, অশিক্ষিত সব মানুষকে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা রাখে।
'গ্রামের হোটেলগুলোতে আমার কার্টুন লাগিয়ে রাখার খবর অনেকবারই পেয়েছি। তাই বলব, একটা বড় সময় ধরে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেছি। সবসময় গণমানুষের পক্ষে ছিলাম, চেয়েছি নীতিনির্ধারকরাও গণমানুষের কাতারে এসে দাঁড়ান। সফল হয়েছি কতটা তা সময় বলবে, তবে আমি সন্তুষ্ট।'
আজকে উনসত্তর বছর বয়সেও সচল আছেন আসিফুল হুদা। সবমিলিয়ে ছয় হাজার কার্টুন এঁকেছেন। 'আগামীতে সুযোগ পেলে আবার আঁকব,' প্রত্যয় জানালেন তিনি।
ছবি সৌজন্য: আসিফুল হুদা