ফিলিস্তিনের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন যেসব বাংলাদেশি স্বেচ্ছাসেবক
৬৭ বছর বয়সী জিয়াউল কবির দুলু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তবে এটি তার একমাত্র যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নয়। পরবর্তীতে তিনি ফিলিস্তিনের পক্ষে একটি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
সম্প্রতি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দুলু বলেন, "মেজর এম এ জলিল আমাকে পাঠিয়েছিলেন। আমি তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে লড়েছি। আমার সাথে যুদ্ধ করা আরও অনেক সহযোদ্ধাও ফিলিস্তিনের জন্য যুদ্ধে গিয়েছিল।"
যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেস-এর ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৮০ এর দশকে প্রায় ৮ হাজার বাংলাদেশি যুবক প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-এর পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। জিয়াউল কবির দুলু ছিলেন তাদের মধ্যেই একজন।
লেবাননের পত্রিকা আল-আখবার ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেস-এর তথ্য উল্লেখ করে এক প্রতিবেদনে জানায়, কয়েকজন ফিলিস্তিনি সামরিক ব্যক্তিত্বকেও প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল।
পরবর্তীতে, বাংলাদেশি যুবকেরা প্রায় ৫ হাজার ৫০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে ফিলিস্তিনের যুদ্ধে অংশ নেন। এদের মধ্যে কমপক্ষে ৪৭৬ জনকে ইসরায়েলি বাহিনী আটক করে এবং তারা কারাগারে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হন।
দুলু বলেন, "কেউ কেউ গিয়েছিলেন ইসরায়েলি দখল থেকে পবিত্র আল-আকসা মসজিদকে মুক্ত করতে, কেউ ইসলামি ভ্রাতৃত্বের অনুভূতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। আর কেউ গিয়েছিলেন সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতে কারণ যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সমর্থন দেয়।"
তিনি আরও বলেন, "অনেকেই চেয়েছিলেন ফিলিস্তিনকে মুক্ত করতে এবং জেরুজালেমকে রাজধানী হিসেবে গড়ে তুলতে। সবার একটি সাধারণ লক্ষ্য ছিল, ইসরায়েলের পরাজয়।"
উল্লেখযোগ্যভাবে, যুদ্ধে অংশ নেওয়া সবাই শুধু ইসলামী অনুভূতি থেকেই অনুপ্রাণিত ছিলেন না। দুলু জানান, তার দলে দুইজন হিন্দুও ছিলেন। তিনি বলেন, "তবে দেশে ফিরে আসার পর তাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।"
যেসব স্বেচ্ছাসেবক ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তারা প্রধানত ছিলেন মেজর এম এ জলিলের অনুসারী। মেজর জলিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর ৯ এর কমান্ডার ছিলেন।
সেক্টর ১১-এর নেতৃত্ব দেওয়া কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিকরা এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক ও আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আবদুর রাজ্জাকের অনুসারীরাও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
দেশে ফিরে আসার পর এই স্বেচ্ছাসেবকরা "ফিলিস্তিন ফেরত মুক্তিযোদ্ধা সমিতি" নামে একটি কমিটি গঠন করেন।
সমিতির সভাপতি দুলু বলেন, "১৯৮২ সালের ৭ জুলাই, আমরা দেশে ফেরত আসা ১০২ জন যোদ্ধাকে নিয়ে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করি। আরও অনেকেই দেশে ফেরার পর আমাদের সংগঠন শক্তিশালী হয়। পরে আমাদের নেটওয়ার্ক অন্তত দুই থেকে তিন হাজার মানুষ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।"
যুদ্ধে অংশ নেওয়া অনেকেই আর বেঁচে নেই। ফিলিস্তিনের জন্য জীবন বাজি রেখে লড়াই করার সময় তারা ছিলেন তরুণ। কিন্তু এখন বেঁচে থাকা প্রায় সবারই বয়স সত্তর বা তার বেশী। তবুও তাদের সাহস ও উৎসাহ কমেনি। ফিলিস্তিনের প্রতি তাদের ভালোবাসা এখনও প্রবল।
ফিলিস্তিন থেকে ফিরে আসা আরেক যোদ্ধা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের সরকার বলেন, "আমি সত্যিই চেয়েছিলাম ফিলিস্তিনকে মুক্ত করতে এবং আল-আকসা মসজিদে নামাজ পড়তে। কিন্তু সেটি আমাদের নিয়তিতে ছিল না। তবে, যদি সরকার আমাকে পাঠায়, ইনশাআল্লাহ আমি ইসলামের জন্য আবার যেতে প্রস্তুত।" ।
তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, "আমি আমার ফিলিস্তিনি ভাইদের পাশে থাকতে চাই। এখন ৭০ বছর বয়সে এসেও আমার মনোবল অটুট। তাই, সরকার আবার ডাক দিলে আমি যেতে প্রস্তুত।"
বাংলাদেশ থেকে বৈরুত পর্যন্ত নাটকীয় যাত্রা
বাংলাদেশিরা ১৯৮০ সালে ফিলিস্তিনের যুদ্ধে যোগ দিতে যাত্রা শুরু করেন।
১৯৮১ সালের শুরুর দিকে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল কবির দুলুসহ ৪৭ জন বাংলাদেশি লেবাননের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এই দলে ছিলেন ছাত্র, অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য, জাসদ-এর সদস্য (জলিল-রব) এবং কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংগঠনের সদস্যরা।
তৎকালীন বাংলাদেশি সরকার ভেবেছিল, তারা হয়ত বিমানবন্দরে ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করছেন। তাই, তাদের যাত্রা বিলম্বিত হয়। তখন তারা ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত আহমেদ আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তার হস্তক্ষেপে দু'ঘণ্টা পর তারা বিমানযাত্রা শুরু করেন। দূতাবাসের পক্ষ থেকে তাদের পকেট খরচ হিসেবে ১০০ ডলার দেওয়া হয়েছিল।
যাত্রাপথে তাদের পাকিস্তান, ব্যাংকক, দুবাই এবং সিরিয়ায় বিরতি নেওয়ার কথা ছিল। সিরিয়ায় পিএলওর একটি ক্যাম্পে ৬ থেকে ৭ দিন অবস্থান করার পর তারা সড়কপথে লেবাননে পৌঁছান।
অন্যদিকে, আবু তাহের সরকার ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে আরও নাটকীয়ভাবে দেশ ছাড়েন।
প্রথমে তিনি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে মুন সিনেমা হলে কাজ করছিলেন। তিনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। তবে, তিনি যুদ্ধের জন্য যাচ্ছেন, তা তিনি জানতেন না।
তার এক চাচাতো ভাই তাকে পাসপোর্ট করার পরামর্শ দেন এবং খলিল নামে এক বন্ধু তাকে বিদেশ যাওয়ার সম্ভাবনার কথা বলেন। কিন্তু যুদ্ধের বিষয়টি তাকে দু'জনের কেউই জানায়নি।
দেশ ছাড়ার আগে আবু তাহের তার পরিবারের কাউকে কিছু জানাননি, শুধু এক বন্ধুকে জানান। তার সেই বন্ধুই পরবর্তীতে তার পরিবারকে বিষয়টি জানান।
তাহের বলেন, "আমি পরিবারকে জানাইনি কারণ তখন আমার ছেলের বয়স মাত্র সাত দিন ছিল। আর আমার স্ত্রী ও সন্তান তখন ঢাকায় ছিল। পরে তারা আমার প্রস্থান সম্পর্কে জানতে পেরে গ্রামে চলে যান।"
বিমানবন্দরে পৌঁছে আবু তাহের বুঝতে পারেন, তিনি পিএলও-তে যোগ দিতে যাচ্ছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে মুক্ত করার পর তিনি জেরুজালেমের নির্যাতনের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে আল-আকসা মসজিদের জন্য লড়াই করার তীব্র আগ্রহ অনুভব করেন। এটিই তাকে এক নতুন লক্ষ্য দেয়।
তিনি সহ তার দলের ২১ জন সদস্য প্রথমে থাই এয়ারের মাধ্যমে ব্যাংকক এবং পরে পাকিস্তান ও সিরিয়া হয়ে বৈরুত পৌঁছায়। সিরিয়ার হাম্বুরিয়া ক্যাম্পে দশ দিনের অস্ত্র প্রশিক্ষণের পর বৈরুতের বীর হাসান ক্যাম্পে আরও বিস্তৃত প্রশিক্ষণ নেয় দলটি। সেখান থেকে তাদের বিভিন্ন অভিযানে পাঠানো হয়।
লেবাননে কঠোর প্রশিক্ষণ
বৈরুতে পৌঁছানোর পর জিয়াউল কবির দুলুর ৪৭ সদস্যের দলটি ভাগ করে দক্ষিণ লেবাননের সাইদনের আরনাম পাহাড়ে কঠোর প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়।
সাইদন যা ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে অবস্থিত এবং এটি লেবাননের তৃতীয় বৃহত্তম শহর। এই শহরটিতেই প্রায় ১০০ জন প্রশিক্ষণার্থী একত্রিত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন, ৩০ থেকে ৩৫ জন বাংলাদেশি। পাশাপাশি, পাকিস্তান, ইয়েমেন ও শ্রীলঙ্কার স্বেচ্ছাসেবকরাও ছিলেন।
দুলু বলেন, "কিছু স্বেচ্ছাসেবককে গোয়েন্দা প্রশিক্ষণ শেষে ইসরায়েলের ভেতরে পাঠানো হয়েছিল। তারা ভিতর থেকে আমাদের কাছে তথ্য পাঠাত। প্রশিক্ষণের পর অনেকের নাম পরিবর্তন করা হয়। আমার নাম ছিল আবদুর রহমান।"
দুলু আরও জানান, তাদের মধ্যে অনেকেই ইতোমধ্যে সেনা প্রশিক্ষণ এবং মুক্তিযোদ্ধার প্রশিক্ষণ নিয়ে গিয়েছিলেন।
দুলু বলেন, "প্রশিক্ষণে আমাদের সতর্ক করে বলা হতো, যেকোনো সময় আকাশ থেকে এফ-১৬ বিমান হামলা হতে পারে। আবার, ভূমধ্যসাগর থেকে নৌ হামলা হতে পারে। আমাদের ট্যাংক এবং বিমান ধ্বংসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আমাদের মধ্যে যারা যোদ্ধা ছিলেন, তাদের ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ধ্বংসের অভিজ্ঞতাও ছিল।"
এরকম একজন বিশিষ্ট যোদ্ধা ছিলেন বৈমানিক সাইফুল আজ। তিনি ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে তার ভূমিকার জন্য স্মরণীয়। জর্দানের পক্ষে লড়াই করে তিনি প্রথম ৭২ ঘণ্টায় তিনটি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেন। এর জন্য তিনি ইরাক ও জর্দানের বিশেষ সম্মাননা লাভ করেন।
ফ্রন্টলাইনের তুমুল যুদ্ধ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর ১১-এ যুদ্ধ করার সময় পায়ে গুলি খাওয়া আবু তাহের সরকার লেবাননে সম্মুখ যুদ্ধের তীব্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। এমনকি তিনি পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে পরিচালিত এক অভিযানে অংশগ্রহণ করেন।
একটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, "ক্যাম্পের কাছে একটি চেকপয়েন্টে ডিউটি করার সময় দেখি, আমাদের ১২ জন সদস্যের কোনো চিহ্নই নেই। হঠাৎ করে আমাদের দিকে গুলি চালানো হয়।"
তাহের এবং আরও ছয়জন নিরাপদ আশ্রয় নিয়ে রকেট লঞ্চার দিয়ে পালটা আক্রমণ করেন এবং ইসরায়েলি সেনাদের দখলকৃত একটি ভবন ধ্বংস করেন।
ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে আরেকটি অভিযানের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, "আরাফাত বিদেশি সৈন্যদের নিয়ে, যার মধ্যে বাংলাদেশিরাও ছিল, একটি অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি ট্যাংকের ভেতরে ছিলেন। আমরা বিজয় অর্জন করি এবং কয়েকজন ইসরায়েলি নিহত হয়।"
১৯৮২ সালের ৫ জুন ইসরায়েল লেবাননের ওপর বড় ধরনের আক্রমণ চালায়। এর পর পিএলও বাংলাদেশিদের সরে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। আবু তাহের স্মরণ করে বলেন, "১৯৮৩ সালের দিকে পিএলও কমান্ডাররা আমাদের বলেছিলেন, তারা এখানে টিকতে পারবে না। 'তোমাদেরও চলে যাওয়া উচিত,' তারা বলেছিলেন।"
পিছু হটবার সময় তারা তীব্র ইসরায়েলি আক্রমণের সম্মুখীন হন। তাহের বলেন, "আমাদের ক্যাম্প ভূমধ্যসাগরের কাছে ছিল। হঠাৎ দেখি, একটি সাবমেরিন ভেসে উঠেছে। আমরা গুলি চালাই এবং প্রায় ২৫ জন ইসরায়েলি বন্দী নিহত হয়। এরপর বোমা উড়ে এসে ক্যাম্পে পড়ে এবং আমরা সৈকতের দিকে সরে যাই।"
এ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে আহত এক সহযোদ্ধাকে ৩০ কিলোমিটার পাহাড় পাড়ি দিয়ে বৈরুতে নিয়ে যেতে হয়। সেখানে পৌঁছানোর পর পিএলও তাদের যেকোনো উপায়ে লেবানন ত্যাগ করার পরামর্শ দেয়।
ইসরায়েলি বন্দি শিবিরে ছয় মাস
মুক্তিযোদ্ধা আবু সিদ্দিক ১৯৮১ সালের শেষের দিকে ১০৫ জন স্বেচ্ছাসেবকের একটি দলের সঙ্গে পিএলওতে যোগ দেন। তিনি সেই ৪৭৬ জন বাংলাদেশির একজন, যারা ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে বন্দিত্বের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার শিকার হন।
তিনি বলেন, "১৯৮২ সালের ৬ জুন যুদ্ধ শুরু হয়। ইসরায়েলি সেনারা ট্যাংক ছাড়াও স্থল, সমুদ্র ও আকাশ থেকে আক্রমণ চালায়। আমরা পালটা আক্রমণ করি এবং এই যুদ্ধে ২৯টি ইসরায়েলি বিমান ভূপাতিত করতে সক্ষম হই।"
কিন্তু একপর্যায়ে গোলাবারুদ ফুরিয়ে গেলে তারা বন্দি হন। তাদের বৈরুত বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরে জাতীয়তার ভিত্তিতে আলাদা করে ইসরায়েলের একটি ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়।
ক্যাম্পের ভয়াবহ পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে আবু সিদ্দিক বলেন, "৫০ জন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি তাঁবুতে ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে রাখা হতো। প্রতিদিন সকালে আমাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে হাজিরা নেওয়া হতো। আর দেখা হতো, কেউ অসুস্থ কি-না। যাঁদের বিপজ্জনক মনে করা হতো, তাদের একটি নির্যাতন কক্ষে নিয়ে যাওয়া হতো।"
নির্যাতন কক্ষের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, "সেখানে তিনজন ছেলে ও তিনজন মেয়ে ছিল। তারা মূলত শিক্ষার্থী ছিলেন। একজন প্রতিবেদন লিখত, একজন ভিডিও করত এবং অন্যজন জিজ্ঞাসাবাদ করত। আমি তাদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলতাম।"
তারা তাকে জিজ্ঞাসা করেন, "বাংলাদেশ থেকে কেন এসেছেন? সত্যি বললে নির্যাতন কম হবে।" তখন তিনি সোজাসুজি জানান, তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধা এবং ফিলিস্তিনের জন্য লড়াই করতে এসেছেন।
তার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় জানার পর তারা বলেন, "আমরা তোমাদের নেতা শেখ মুজিবকে স্বীকৃতি দিয়েছিলাম। কিন্তু তোমরা আমাদের সেই স্বীকৃতি গ্রহণ করোনি। কেন?" জবাবে আবু সিদ্দিক বলেন, "আমার নেতা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত বলতে পারবেন।"
এরপর তাকে লাঠি এবং হাত দিয়ে আঘাত করা হয়। এতে তিনি তার ডান কানের শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেন। নিয়মিত ব্যথার কারণে তার পক্ষে ঘুমানোও অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।
তবে তিনি এটাও যোগ করেন, "তারা শিক্ষার্থী ছিল এবং তাদের ফিলিস্তিন বিরোধী অবস্থানে কোনো সমর্থন ছিল না। তারা শান্তি চাইত, যেমনটা আমরাও চেয়েছিলাম।"
বন্দি শিবির থেকে পালানো
আবু সিদ্দিকের মতে, ১৯৮২ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস তাদের সাথে যোগাযোগ করে এবং তাদের নিবন্ধন করে।
এক মাসের মধ্যে তাদের লেবাননে স্থানান্তর করা হয়। সেখান থেকে বৈরুত বিমানবন্দরে আনা হয় এবং ৩ ডিসেম্বর তারা বাংলাদেশে পৌঁছান।
তিনি বলেন, "আমরা রেড ক্রসের তত্ত্বাবধানে ছিলাম। কিন্তু ফেরার আগে আমাদের একজন ক্যান্সারে মারা যান। ২২ থেকে ২৫ জন বিভিন্ন দেশে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন রেড ক্রসকে। তারা রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে ওই দেশগুলোতে থেকে যান, আর দেশে ফেরেননি। তাদের মধ্যে কেউ কেউ জাসদ-এর আন্ডারগ্রাউন্ডের সদস্য ছিলেন। আবার কারও নামে মামলা ছিল।"
স্বেচ্ছাসেবক আবু তাহের সরকারের দেশে ফেরার গল্পটিও ছিল উত্তেজনাপূর্ণ। ইসরায়েলি আক্রমণ থেকে পালিয়ে বৈরুতে পৌঁছালে তারা শোনেন, লেবাননের ব্রিটিশ দূতাবাস সাধারণ প্রবাসীদের সাহায্য করছে। সেখান থেকে তারা ব্রিটিশ দূতাবাসে যান।
আবু তাহের বলেন, "আমরা ব্রিটিশদের কাছে নিজেদের মাদানি (সাধারণ মানুষ) হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলাম, ফাতাহ'স খেদা'ই (সৈনিক) হিসেবে নয়। পরিস্থিতি বদলে যাওয়ায় আমরা পরিচয় গোপন রাখি। তারা আমাদের চিনে ফেললে আমাদের ইহুদিদের হাতে তুলে দিতে পারত।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা বলেছিলাম, আমরা সেখানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলাম। তারা আমাদের দূতাবাসের সিলযুক্ত পাসপোর্ট (সিস্টেম থেকে) দিয়েছিল।"
তিনি উল্লেখ করেন, তখন পূর্ব ও পশ্চিম বৈরুত খ্রিষ্টান এবং ইহুদিদের দখলে ছিল। তারা পশ্চিম বৈরুতে ছিলেন। সেখান থেকে তাদের পূর্ব বৈরুতের একটি শরণার্থী শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ১৫ দিন থাকার পর রেড ক্রসের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের সঙ্গে একটি জাহাজে সাইপ্রাসে পাঠানো হয়।
সমুদ্রে থাকা অবস্থায় ইসরায়েলি বাহিনী তাদের জাহাজ আটকে দেয়। তাদের দল থেকে ১৫ জনকে একটি সাবমেরিনে নিয়ে গিয়ে অস্ত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
প্রথমে তারা মনে করেছিলেন, তাদের কোনো বিশেষ দক্ষতা নেই। কিন্তু পরে বুঝতে পারেন, তারা রকেট লঞ্চার, মেশিনগানসহ বিভিন্ন অস্ত্র পরিচালনা করতে সক্ষম। প্রায় তিন ঘণ্টা পর, তাদের একটি রাবারের নৌকায় করে জাহাজে ফিরিয়ে আনা হয়।
তিনি বলেন, "পরে আমরা সাইপ্রাসের একটি দ্বীপে পৌঁছাই। সেখান থেকে রেড ক্রসের বিমানে করে আমাদের দুবাই পাঠানো হয়। এরপর করাচি হয়ে কলকাতা এবং সেখান থেকে ঢাকার বিমানবন্দরে পৌঁছাই। আমাদের ফ্লাইটে প্রায় ১০০ জন বাঙালি ছিলাম।"
কামাল মুস্তফা আলী: 'বীর শহীদ'
লেবানিজ সংবাদপত্র আল-আখবার ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে "অতীতকে স্মরণ: ১৯৮০ দশকের প্যালেস্টাইনের জন্য বাংলাদেশি যোদ্ধারা" শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে কামাল মুস্তফা আলীর কাহিনি তুলে ধরা হয়।
দক্ষিণ বৈরুতের শাতিলা শরণার্থী শিবিরের বাইরে ফিলিস্তিনি শহীদ কবরস্থানে তার সমাধি অবস্থিত। সেখানে ফিলিস্তিনের হয়ে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করা অনেক যোদ্ধার কবর রয়েছে।
ফিলিস্তিনিদের কবরগুলোর মধ্যে কিছু বিদেশিদেরও কবর রয়েছে, যার মধ্যে আলী মুস্তফার কবরও রয়েছে। তার কবরের ওপর কোরআনের সূরা আল-ইমরানের একটি আয়াত লেখা আছে। আয়াতটি হলো: "এবং আল্লাহর পথে নিহতদেরকে মৃত মনে করো না। বরং তারা তাদের প্রভুর কাছে জীবিত, তাঁর কাছ থেকে রিজিক পাচ্ছে।"
কবরের ফলকে তার নাম এবং জাতীয়তা উল্লেখ করা হয়েছে। তাকে "বীর শহীদ" হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আলি মুস্তফা ১৯৮২ সালের ২২ জুলাই লেবাননের নাবাতিহ-এ 'ক্যাসল অব দ্য হাই রক'-এর যুদ্ধে নিহত হন।
১৯৮২ সালের ৬ জুন শুরু হওয়া ইসরায়েলি আগ্রাসনের সময় এই দুর্গটি একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র ছিল। পিএলওর দ্রুত নিয়ন্ত্রণ হারানোর পরও, ইসরায়েলি বাহিনী ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী এবং পরে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে নিরলস প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। ২০০০ সালে হিজবুল্লাহকে পিছু হটানোর আগে পর্যন্ত এই প্রতিরোধ চলমান ছিল। দুর্গটি পুনরুদ্ধারের প্রাথমিক প্রচেষ্টার সময় মুস্তফা আলীর মৃত্যু হয়েছিল।
তার দেহাবশেষ ২০০৪ সালে জার্মান মধ্যস্থতায় হিজবুল্লাহ এবং ইসরায়েলের মধ্যে বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে উদ্ধার করা হয়। কবরস্থানের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা জানান, তার দেহাবশেষ বাংলাদেশে পাঠানো হয়। দেশে তার ত্যাগের প্রতি সম্মানে জানিয়ে একটি কবর তৈরি করা হয়।
এখনও ফিলিস্তিনের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ
ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি সংঘাতের সূচনা ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বালফোর ঘোষণার মধ্য দিয়ে। এই ঘোষণা অনুযায়ী, ব্রিটেন ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়।
উল্লেখযোগ্য ইহুদি অভিবাসনের পর উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে, ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের বিভাজন পরিকল্পনা নেওয়া হয়, যেটি আলাদা আরব এবং ইহুদি রাষ্ট্রের প্রস্তাব দেয়। এর ফলে ১৯৪৮ সালের নাকবা ঘটে এবং এর ফলে, ৭ লাখ ৫০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে জাতিগতভাবে নির্মূল করা হয়। এভাবেই ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির মাধ্যমে ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইতজাক রাবিনের মধ্যে ঐতিহাসিক স্বীকৃতির সূচনা হয়। কিন্তু পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি সম্প্রসারিত হতে থাকলে, শান্তি প্রক্রিয়া খারাপ হতে শুরু করে। ১৯৯৩ সালের ২ লাখ ৫০ হাজার বসতি থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ অঞ্চলে বসতির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭ লাখে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে সাম্প্রতিক সহিংসতা শুরু হওয়ার পর থেকে আল জাজিরার তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে অন্তত ৪১ হাজার ৮৭০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এই দুঃখজনক পরিস্থিতি একসময় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া বাংলাদেশি স্বেচ্ছাসেবকদের মনেও গভীরভাবে দাগ ফেলেছে।
মুক্তিযোদ্ধা দুলুর মতে, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি।
তিনি বলেন, "যেখানে আরব ঐক্য নেই, সেখানে ৭০ থেকে ৮০ বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের টিকে থাকাটা একটি বড় বিষয়। বাংলাদেশে এমনটা ঘটলে আমরা নয় মাসে স্বাধীন হতে পারতাম না। ফিলিস্তিন স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের যুদ্ধ চলতে থাকবে।"
ইংরেজী থেকে অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়