ব্যস্ত জনজীবনে কেনাকাটায় যে কারণে স্বস্তির নাম মতিঝিলের ‘হলিডে মার্কেট’
বিক্রেতা মাহবুব আলম নিজের ছোট ভ্যানগাড়িটি নিয়ে মার্কেটে এসেছেন সকাল ৭টারও কিছু সময় আগে। এসেই পছন্দমতো জায়গা বাছাই করে ভ্যানভর্তি কাপড় নিয়ে বসে পড়েছেন রাস্তার এক ধারে। এবার আস্তেধীরে গামছা, তোয়ালে, রুমাল, শীতের জামা কাপড় সাজিয়ে রাখছেন একে একে। মিনিট কুড়ির মধ্যে ভ্যানের ওপরে রাখা মালামাল গুছিয়ে নিলেন পুরোপুরি। আবার অতিরিক্ত কিছু বস্তাবন্দী করে রেখেছেন ভ্যানের নিচে।
এবার তার অপেক্ষা ক্রেতাদের জন্য। অবশ্য সময় গড়ানোর সাথে সাথে ক্রেতাদের ভিড়ও বাড়ছে।
এরই মাঝে কথা হলো মাহবুবের সাথে। শান্ত মেজাজের লোক। বিরক্তির কোনো রেশ নেই চোখেমুখে। কথা প্রসঙ্গে জানালেন, প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই মার্কেটে ব্যবসা তার। থাকেন মতিঝিলের আশেপাশেই। এতে বেশ ভালোভাবে তার সংসার চলে। এক ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে চার সদস্যের ছোট পরিবার মাহবুবের।
অবশ্য তার হাসিখুশি মুখখানিই বলে দেয় মোটামুটি শান্তিতেই দিন কাটাচ্ছেন তিনি। বেচাকেনাও ভালো। তার সহজ সরল ভাষ্যে, "এইখানে কিনতে আসলে ক্রেতারাও খুশি, আমরাও খুশি। তারাও তাদের মনমতো দামে জিনিস কিনতে পারে, আমরাও আমাদের মনমতো দাম পাই। লস বলতে কোনো ব্যাপার নাই এখানে।"
ছুটির দিনের মার্কেট
মূলত মাহবুব বলছিলেন, মতিঝিলের অস্থায়ী মার্কেট 'হলিডে মার্কেট' এর কথা। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনেই এই মার্কেটের অবস্থান। সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবারে এই মার্কেট বসে বলে লোকমুখে নাম হয়েছে হলিডে মার্কেট। আবার কেউ কেউ ছুটির দিনের মার্কেটও বলে থাকেন।
অস্থায়ী এই মার্কেটে শুক্রবারে রাস্তার দুইধারে শত শত দোকানের দেখা মেলে। সেসবও অস্থায়ী। কোনো কোনো দোকানী ভ্যান নিয়ে বসেন, কেউ জমিতে পলিথিন বিছিয়ে, আর কেউ কেউ হাতে জিনিস নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন।
বুড়ো থেকে শিশু, নারী থেকে পুরুষ প্রায় সব বয়সী মানুষের প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী কিনতে পাওয়া যায় এই বাজারে। নিত্যপ্রয়োজনীয় চামড়াজাত পণ্য, পাটজাত পণ্য, হস্তশিল্প, ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল পণ্য, হোম ডেকর পণ্য, চুড়ি-গয়নাসহ হরেক রকম জিনিসপত্র বিক্রি হয় এই মার্কেটে।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হতেই বাড়তে থাকে ক্রেতা সমাগম। এর কারণ অনায়াসে একই স্থানে সকল প্রকার জিনিস কিনতে পাওয়া যায়, আবার দামও আছে হাতের নাগালে। ফলে পছন্দসই পণ্য কিনতে এই মার্কেটে ভিড় জমাতে ভুল করেন না ক্রেতারা। ক্রেতাদের ভাষ্যে, অন্যান্য মার্কেটের তুলনায় এখানে সস্তায় মেলে সকল পণ্য।
কথা হলো এক নারী ক্রেতার সাথে। ঘরের জন্য পর্দা এবং বিছানার চাদর কিনতে এসেছেন তিনি। নাম ফেরদৌসি আক্তার (৫৫)। বাসা শাপলাচত্বর থেকে মিনিট পাচেঁক দূরত্বে। প্রায়ই তার আসা হয় এখানে। টুকটাক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে ঘরে ফেরেন। এই মার্কেটে আসার মূল কারণ কম দামে ভালো জিনিস কিনতে পারা।
তিনি বলেন, "দরদাম করে যদি আপনি ভালো জিনিসটা কিনে নিতে পারেন, তবে আপনি অবশ্যই জিতবেন।"
কম দামে ভালো পণ্য
যেমনটা মাহবুব জানালেন, ক্রেতাদের যেমন দরদাম করে নেওয়ার সুযোগ আছে— তেমনি বেশি লাভে জেতার সুযোগ আছে বিক্রেতাদেরও। অবশ্য মাঝেমধ্যে অল্প লাভেও মালামাল বিক্রি করে দেন তারা। এর কারণও জানালেন তিনি।
যত মালামাল আনা হয়, দেখা যায় তার সবটাই বিক্রি হয়ে যায় একদিনে। সপ্তাহের অন্যান্য দিন এমনটা লাভ হয় না তাদের। এমনকি, কেনাবেচাও তেমন একটা হয়না বললে চলে। হলিডে মার্কেট শুক্রবার বা ছুটির দিনে বসে বলে মানুষের ভিড় থাকে পিপড়ার মতো। ফলে লাভ একটু কম হলেও বিক্রি হয় ভালো। তাই বেশি লাভের চিন্তা ছেড়েও বেশ সন্তুষ্ট থাকেন দোকানীরা।
প্রতি শুক্রবার সকাল ৭টা থেকেই মেলা বসে মতিঝিলের এই মার্কেটে। এত ভোরে রাজধানীর নানান প্রান্তের মানুষ এসে ভিড় জমান নিয়ম করে। সকাল থেকে শুরু হয়ে মার্কেটের কর্মযজ্ঞ, চলে রাত ৭টা-৮টা অব্দি। এত ভোরেও ক্রেতাদের ভিড় থাকে চোখে পড়ার মতো।
এত ভিড় ঠিক কী কারণে? এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন আরেক দোকানী মো. জব্বার। গেঞ্জি, শার্ট, প্যান্টের ব্যবসা তার। মোটামুটি ছয় বছর ধরে এই কাজ করে পরিবারের ভার টানছেন।
জানালেন, "আপনে যেখানে কম দামে জিনিস পাইবেন সেখানে যাইবেন, না? অগোর আসার ব্যাপারও তাই।"
আবার মিনিট কয়েক ধরে মার্কেট ভেদে দামের পার্থক্যের বিষয়টিও তুলে ধরলেন জোরালোভাবে। তার মতে, শহরের অন্যান্য মার্কেটে যেসব চুড়ির দাম ২৫০-৩০০ টাকা দরে বিক্রি হয়, এই বাজারে নাকি তা পাওয়া যায় ১০০ টাকায়। আবার ১৫০-২০০ টাকা দামের কানের দুল এই মার্কেটে কিনতে পাওয়া যায় মাত্র ৫০ টাকায়।
"ধরেন, নিউ মার্কেটের দোকানদার যদি ৫০ টাকা লাভ করেন, আমরা করি ২০ টাকা," বললেন জব্বার।
অর্থাৎ কম লাভে, কম দামে পণ্য বিক্রিই এই বাজারের অনন্য বৈশিষ্ট্য বলে মত ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের।
একই কথা জানালেন, ব্যাগ বিক্রেতা মো. ইমনও। বছর তিনেক ধরে এই মার্কেটে কাজ করার অভিজ্ঞতা তার। পাইকারি হিসেবে মালামাল রাখার ব্যাগ কিনে আনেন গুলিস্তান থেকে। ব্যাগ প্রতি লাভ করেন ২০ টাকা। যদি ১০০ টাকায় ব্যাগ কিনে নেন, তবে বিক্রি করেন ১২০ টাকায়।
জানতে চাইলাম, এত অল্প লাভে সংসার চলে? ইমনের সরল স্বীকারোক্তি, "না চললে কি আর ৩ বছর ধইরা ব্যবসা চালাই? বিনা লাভে কেউ কাম করে?"
ইমনের ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নে বুঝতে বাকি রইলো না এই মার্কেটে বিক্রেতারা বেশ খুশি মনেই বিকিকিনি করেন। তাই ১০ টাকা বাড়তি লাভের দুঃখ চেপে ধরেনা তাদের।
এসব মালামাল তারা নিয়ে আসেন শহরের বিভিন্ন পাইপারি মার্কেট থেকে। বিশেষ করে, যেখানে সস্তায় কিনতে পারেন দোকানীরা। যেমন মাহবুব জানালেন, গুলিস্তান হল মার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট, পীর ইয়ামেনি মার্কেট, ফার্মগেট মার্কেট– এসব জায়গা থেকে কম দামে নিয়ে আসা হয় যাবতীয় মালামাল।
হাজার টাকার শাড়ি ২০০-৩০০ টাকায়
এই মার্কেটে ঘরের ছোট আসবাব থেকে শুরু করে সাজসজ্জা, কাপড়, ছোটদের খেলনা, বাদ্যযন্ত্র, গাছ, হরেক রকম খাবার এমনকি মাছ-সবজিও বিক্রি হয় সমানভাবে। তবে নারীদের কাছে এর পরিচিতি একটু বিশেষভাবে। এই মার্কেটে কম দামে কিনতে পাওয়া যায় হাজার টাকার শাড়ি। এই যেমন– ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ৩০০ টাকায় ভালো মানের শাড়ি পাওয়া যায়। ফলে নারী ক্রেতাদের ভিড় থাকে দেখার মতো। সব ধরনের ক্রেতাই আসেন মার্কেটে। তবে নারী ক্রেতাদের সংখ্যা সর্বোচ্চ বলে জানান দোকানীরা।
কথা হলো আরেক নারী ক্রেতা রুকসানার সাথে। ১৫০ টাকা করে দুটো সুতির শাড়ি এবং ২০০ টাকায় একটি জরজেট শাড়ি কিনে নেন তিনি। ৩টি শাড়ি কিনতে তার খরচ হয়েছে মাত্র ৫০০ টাকা!
তিনি বললেন, "দেখেন, এই শাড়ি আমিও একবারের বেশি পরবো না হয়তো। কিন্তু এত কমে শাড়ি পেলে তো কিনতে ইচ্ছে হয়ই। দেখা যাবে একবার পরে এই শাড়িগুলো দিয়ে কাঁথা সেলাই করে ফেলবো।"
"এখানে দেখবেন, অনেক শাড়ির দাম একেবারেই কম। অথচ শাড়িগুলো কিন্তু অনেক দাম দিয়ে কেনা। বাজারে কিনতে গেলে এসব শাড়ির দাম পড়বে ৪-৫ হাজার টাকা। এই মার্কেটে সেগুলো পাওয়া যায় ৫০০-৬০০ টাকার মধ্যে। আমরা এসব ১০০-১৫০ টাকা লাভে এখানে বিক্রি করি," বলেন শাড়ি বিক্রেতা রুবেল।
এসব শাড়ি কারো ব্যবহৃত। এক-দুবার পরেছেন হয়তো, পরে মার্কেটে কম দামে বিক্রি করে দিয়েছেন। পরে এসব শাড়ি পরিষ্কার করে বিক্রি হচ্ছে মার্কেটে। এতে ক্রেতারা কম দামে পেয়ে যাচ্ছেন পছন্দের পোশাকটিকে, অন্যদিকে বিক্রেতারাও ভালো লাভে বিক্রি করতে পারছেন।
আবার এমন কিছু গেঞ্জি আছে, যা আসে বিদেশ থেকে। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে অল্প দামে। এত কম দামে এমন দামি পোশাক বিক্রি করার রহস্য কী তবে? জানতে চাইলাম গেঞ্জি বিক্রেতা মো. রাকিবের কাছে।
তিনি জানালেন, "এইসব গেঞ্জি ধরেন কেউ গিফট পাইসে, তার পছন্দ হয় নাই বা সাইজে মিলে নাই। তখন তারা সেগুলো জমায়ে কম দামে আমাদের কাছে বিক্রি করে দেয়। এই গেঞ্জিগুলো বেশিরভাগ হয় বিদেশি। যারা কিনতে আসে, তারা বোঝে এইগুলা দামি গেঞ্জি। তারা বেশি করে কিনে নিয়ে যায়।"
কর্মব্যস্ত মানুষের সুবিধার্থে ২০০৭ সালে রাজধানীতে গড়ে তোলা হয় হলিডে মার্কেট। তবে মাঝে তা বন্ধ ছিল কয়েক মাস। আবার পুনরায় চালু হয় এটি। এখন আগের মতই প্রাণচঞ্চল ব্যাপারখানা রয়ে গেছে।
তবে মাহবুব জানালেন, বেচাকেনা সারাবছরই সমান থাকে এই মার্কেটে। ফলে মাঝেসাঝে তাদেরও সমস্যায় পড়ে যেতে হয়।
মাহবুব বলেন, "দেশে সমস্যা-সংকট চললে আমরা কষ্টে পড়ে যাই। তখন আবার চলতে বেশ কষ্ট হয়। কারণ আন্দোলন মারামারি হলে তো আমরা এখানে আর বসতে পারি না। আবার আমাদের কোনো স্থায়ী দোকানও নাই। এভাবে ভাসমান অবস্থায় আসি, বিক্রি করে চলে যাই।"