চার অর্থবছর ধরে বিএটি বাংলাদেশের ৩৮০ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকির সন্ধান পেয়েছে এনবিআর
দেশের একক সর্বোচ্চ করদাতা ও শীর্ষ তামাকপণ্য কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি) বাংলাদেশ লিমিটেডের গত চার অর্থবছর ধরে ৩৭৯ কোটি টাকা মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ফাঁকির তথ্য জানতে পেরেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
এনবিআরের এক অনুসন্ধান চলাকালে, বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ-ভ্যাট) উদঘাটন করে যে, রাজস্ব কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে উচ্চমূল্যে সিগারেট বিক্রি করে এবং সেই অনুযায়ী কর না দিয়ে আইন ভঙ্গ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
রাজস্ব কর্তৃপক্ষটির সূত্রগুলো জানায়, বিএটি পুরনো মূল্যে সরকারকে কর দিয়ে ওয়্যারহাউজে নিয়ে পরবর্তীতে নতুন বর্ধিত দামে বিক্রি করলেও ওই পরিমাণ ভ্যাটের অর্থ সরকারকে দেয়নি।
এনবিআর কোনো অর্থবছরে সিগারেটের যে দাম নির্ধারণ করে দেয়, পণ্য গুদামে নেওয়ার পূর্বে সেই হারে কর পরিশোধ করে বিএটি। তবে এক অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার আগে কর দেওয়া পণ্য মজুত করে আরেক অর্থবছরে (অর্থাৎ, বাজেট ঘোষণার পরে) ডিলার বা পরিবেশকদের কাছে উচ্চমূল্যে বিক্রি করেছে সে অনুযায়ী কর না দিয়েই।
রাজস্ব বোর্ডের এলটিইউ-ভ্যাট বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, অনুসন্ধানে শুরুতে জানা যায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কোম্পানিটি এই কৌশলে ১৬৯ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। পরবর্তীতে কোম্পানিটির আগের অর্থবছরগুলোর মজুত পণ্যের তথ্য নেন কর্মকর্তারা, তখন জানা যায় ২০২২-২৩ অর্থবছরেও কোম্পানিটি ৮৮ কোটি টাকা করফাঁকি দিয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে দিয়েছে ৫৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৫ কোটি ৯২ লাখ টাকা।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া ১৬৯ কোটি টাকা ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে পরিশোধ করতে গত ১২ ডিসেম্বর বিএটি'কে একটি নোটিশ দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন ওই কর্মকর্তা। তিনি আরও জানান, আগের তিন অর্থবছরের (২০২০-২১, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩) এর মোট ২১১ কোটি টাকা পরিশোধ করতে ১৯ ডিসেম্বর আলাদা তিনটি নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে একই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে তথ্য গোপনের মাধ্যমে ২ হাজার ৫৪ কোটি টাকার ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক ফাঁকির সন্ধান পায় এনবিআর, যা নিয়ে এনবিআরের সাথে বিএটির আইনি বিরোধ চলমান।
কেবল বিএটি নয়, বর্ধিত দামে সিগারেট বিক্রি করার মাধ্যমে ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে দেশের আরেক বহুজাতিক কোম্পানি জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনাল (জেটিআই) বাংলাদেশ-এর বিরুদ্ধেও। তবে তাদের ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ জানা যায়নি।
গত কয়েক বছর ধরেই বাজেটে সিগারেটসহ তামাকজাত পণ্যের দাম বাড়ছে। সংসদে বাজেট উত্থাপনের দিন থেকেই বর্ধিত দাম বিবেচনা করে করের হিসাব করা হয়। সর্বশেষ চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হয়েছিল গত ৬ জুন।
ভ্যাট অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএটি বাজেটের আগে থাকা মজুদ সিগারেটের উপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক-সহ অন্যান্য কর পরিশোধ করে বিপুল সংখ্যক সিগারেট ওয়্যারহাউজে স্থানান্তর করলেও বাজেট পেশ হওয়ার পর তা বর্ধিত দামে বিক্রি করেছে। বর্ধিত দামে বিক্রি করলে ওই অনুযায়ী, বাড়তি ভ্যাট পরিশোধের কথা থাকলেও, কোম্পানিটি কৌশলে তা ফাঁকি দিয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৬৯ কোটি টাকা ফাঁকি সংক্রান্ত এনবিআরের একটি নোটিশের কপি টিবিএস এর হাতে এসেছে। এতে বলা হয়, বিএটি ৫ জুন, ২০২৪ পর্যন্ত (বাজেটের আগের দিন) কার্যকর মূল্যের ভিত্তিতে সিগারেটের উপর মোট ডিউটি-ট্যাক্স ৩ হাজার ৪৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা পরিশোধ করে ওয়্যারহাউজে সিগারেট স্থানান্তর করেছে। অপরদিকে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ৬ জুন তারিখ থেকে ওয়্যারহাউজে মজুদকৃত ওই সিগারেট ক্রেতা অর্থাৎ ডিলার বা ডিস্ট্রিবিউটর, এর কাছে বর্ধিত মূল্যে বিক্রি করেছে, যার পরিমাণ ৩ হাজার ২১৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা।
"বর্ধিত মূল্যে সিগারেট বিক্রি করার মাধ্যমে ১৬৮ কোটি ৭৭ লাখ কোটি টাকা ডিউটি-ট্যাক্স পরিহার করা হয়েছে, যা আদায়যোগ্য"—বলা হয় ওই ডিমান্ড নোটিশে।
এসব বিষয়ে জানতে বিএটি'র সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পক্ষ থেকে লিখিত প্রশ্নের জবাবে কোম্পানির একজন মুখপাত্র বলেন, "বিদ্যমান বিষয়টির গোপনীয়তার কারণে, আমরা এবিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।"
ভ্যাট আদায়ে ফাঁকফোকর?
২০২২-২৩ অর্থবছরের ভ্যাট এড়ানো সংক্রান্ত এনবিআরের অপর একটি নোটিশের কপিও টিবিএস দেখেছে। এতে বলা হয়, তামাকপণ্যের ভ্যাট সাধারণত খুচরা বিক্রয় পর্যায়ে নয়, উৎপাদনস্থল হতে সরবরাহকালে আদায় করা হয়ে থাকে।
"সেক্ষেত্রে আইনি বিধান অনুযায়ী, সিগারেট উৎপাদন কারখানা হলে প্রতিটি অপসারণই সরবরাহ হিসেবে গণ্য হবে, এবং প্রতিটি সরবরাহের বিপরীতে একটি চালানপত্র ইস্যু করতে হবে," বলা হয় এতে।
অবশ্য, যেহেতু সিগারেটের সরবরাহকালে ওই সময়ের প্রযোজ্য ভ্যাট পরিশোধ হয়েছে, সে হিসেবে পরবর্তীতে বর্ধিত দামে বিক্রির সময় এর ওপর বাড়তি শুল্ক বা ভ্যাট প্রযোজ্য হবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
তবে এর ব্যাখ্যাও আছে এনবিআরের এলটিইউ ভ্যাট বিভাগের ওই নোটিশে। এতে বলা হয়, সিগারেট উৎপাদনের কারখানা হতে প্রতিটি অপসারনই সরবরাহ হিসেবে বিবেচিত হলেও - নির্ধারিত মূল্যের অতিরিক্ত (দামে) বিক্রয় করার সুযোগ নেই। যেহেতু বাড়তি মূল্যে বিক্রি করা হয়েছে, এজন্য বর্ধিত মূল্যের উপর বর্ধিত ট্যাক্স হবে। অবশ্য বর্ধিত সম্পূরক শুল্ক প্রযোজ্য হবে না বলে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এনবিআরের ভ্যাট পলিসি'র সেকেন্ড সেক্রেটারি ব্যারিস্টার মো. বদরুজ্জামান মুনশি টিবিএসকে বলেন, "এ বিষয়ে আমরা আইনি ব্যাখ্যা আমরা এলটিইউ-ভ্যাটকে জানিয়েছি, যার ভিত্তিতে বাড়তি ভ্যাট পরিশোধের দাবি জানিয়ে ডিমান্ড লেটার ইস্যু করা হয়েছে।"
এ বিষয়ে তিনি আর বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি।
তবে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, "টোব্যাকো কোম্পানিগুলো যদি ঘোষিত সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) অনুযায়ী পণ্য বিক্রি করত, তাহলে সমস্যা ছিল না। কিন্তু, বিএটি এবং জেটিআই এমআরপি'র চেয়ে বেশি মূল্যে বিক্রি করেছে। বাড়তি যে মূল্যে বিক্রি করেছে, ওই মূ্ল্যের উপর আইন অনুযায়ী তারা ভ্যাট পরিশোধ করবে।"