ভোলা বস্তি: ঢাকার জন্য মেঘনার উপহার!
তখনো এরশাদ গড়ি আঁকড়ে আছেন, নব্বই সালের প্রায় শেষ। মিরপুরের পল্লবী এক্সটেনশনে অল্প দু-চারটি ছাড়া ছাড়া বাড়ি উঠেছে। কারিতাসের সামনে দিয়ে যাওয়া পথটি ইটবিছানো ও সরু। যেখানে ঢাল শুরু হলো, তার পশ্চিম দিকে বিরাট ঝিল সেই দুয়ারি পাড়া পর্যন্ত। কোনো বসতি নেই, সরকারের খাস জমি।
মেঘনার তাণ্ডবে ঘর ও জমি হারানো কামাল হাওলাদার, রব মুন্সি, জাফর দেওয়ান ঘুরতে ঘুরতে এসে ঝিলের ওপর ঘর বাঁধলেন। ছোট্ট এক কোঠার ঘর। বাঁশের খুটি দিয়ে মাচা বানিয়ে তৈরি হলো সে ঘর। কাউকে বলতে হয়নি, নিতে হয়নি অনুমতিও।
কামাল হাওলাদারের ভাই বারেক হাওলাদার বললেন, "তখনও এ জায়গাতে প্রভাবশালীদের চোখ পড়েনি, ঝিল বলেই বুঝি তারা অবহেলা করেছে। আমরা ঘর তুলে থাকতে শুরু করলাম। আমাদের পাঁচ ভাইয়ের সবাই এখানে ঘর তুললেন।"
নদী ভাঙা মানুষের দল
যে আট-দশ ঘরবসতি জায়গাটিতে তৈরি হলো, তাদের সবাই নদী ভাঙা। ভোলা সদরের ইলিশা ইউনিয়নে ছিল তাদের বাড়ি। মেঘনার পূবপাড়ে ইলিশার অবস্থান। ইলিশা থেকে আরও কিছুদূর দক্ষিণে গিয়ে মেঘনা সমুদ্রে পড়েছে।
মেঘনা এখানে প্রায়ই ফুঁসে ওঠে, পাড় ভাঙে। বছর বছর বিল ভাঙতে ভাঙতে ইলিশা গিয়ে বারেক হাওলাদারের বাড়ির ধারে পৌঁছায়। বারেকরা আশা করতে থাকেন, এবার বুঝি থামবে! কিন্তু পরের বছরই বারেকদের জমি ও বাড়ি গিলে খায় মেঘনা। উপায় না পেয়ে বারেকের বড় ভাই কামাল হাওলাদার ছোট তিন ভাইকে নিয়ে ঢাকায় আসেন। রাজমিস্ত্রী, যোগালি, মুটের কাজ করে দিন চালাতে থাকেন।
পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট বারেক। বারো বছর বয়সে ঢাকায় ভাইদের কাছে এসে ওঠেন। তখন তারা মিরপুর-১২ নম্বরে এক টিনশেড মেসে থাকতেন। আরো বছর কয় পরে উঠে আসেন ভোলা বস্তিতে, যদিও নামটি তখনও হয়নি।
বারেক ঢাকায় আসার পর মেঝ ভাইয়ের সহযোগিতায় একটি পান-বিড়ির দোকান দেন। সে দোকানটি নানান জায়গা ঘুরে এখন পল্লবী মেট্রো স্টেশনের গোড়ায়। দিনে ৫০০-৫৫০ লোকের সঙ্গে লেনদেন করেন বারেক। সিগারেট, পানের সঙ্গে ফ্লাক্সে করে চাও বিক্রি করেন।
বললেন, "ত্রিশ বছর ধরে চায়ের দোকান করতেছি। রোডের এমাথা থেকে ওমাথা, নানান জায়গায় দোকান বসাতে হয়েছে, যখন যে পেরেছে ধাক্কা দিয়ে সরিয়েছে, উদ্বাস্তু মানুষ, কিছুই বলতে পারি না। শেষে করোনার আগে আগে যখন বস্তি ভেঙে দিল, তখন ঘরও হারালাম।"
নাম হলো ভোলা বস্তি
ছিয়ানব্বই-সাতানব্বই সালে ভোলা বস্তি জমে ওঠে, জায়গা কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। সাড়ে তিন বিঘা জমিতে প্রায় এক হাজার পরিবারের বসতি। আশি ভাগ লোক ছিল ভোলার, মুখে মুখে নাম হয়ে গেল ভোলা বস্তি।
একটি মসজিদও গড়ে উঠেছিল, পরিচিত ছিল ভোলাইয়া মসজিদ নামে। কোথায় ইলিশা আর কোথায় ঢাকার পল্লবী এক্সটেনসন! মানুষগুলো একই, জায়গা বদলেছে আর বদলেছে পরিচয়। আগে ঠিকানা ছিল এখন ভিটাছাড়া।
কাল্লু রাঢ়ী (৬৫) সাতানব্বই সালে ঢাকায় আসেন। তার বাবার মামাতো ভাই এখানে ছিলেন আগে থেকে। মেঘনা ঘর ভেঙে নিলে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলেন। ৭টি ছোট ছোট সন্তান তার। সম্পর্কের ওই চাচার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন।
চাচা বললেন, "ঢাকায় চলে আসো, কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।"
কাল্লু রাঢ়ী ৭ সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় চলে এলেন। সম্বল বলতে গোটা কয় বালিশ ও কাঁথা এবং আড়াইশ টাকা। চাচা দয়া করে নিজের ঘরে থাকতে দিয়েছিলেন। প্রথম পাঁচ-সাতদিন কোনো কাজই পাননি। একদিন ইস্টার্ন হাউজিংয়ের ভিতরে দেখলেন লোকে ইট ভাঙছে। কিছুক্ষণ বসে থেকে কাজ দেখলেন, তারপর সুযোগ পেয়ে একজনকে শুধালেন, "এখানে কাজ পাওয়া যাবে?"
লোকটি তাকে ছাতা মাথায় দিয়ে চেয়ারে বসে থাকা ম্যানেজারের কাছে নিয়ে গেলেন। ম্যানেজার বললেন, "কাজ তো আছে, পারবা তো?"
কাল্লু মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। ম্যানেজার বললেন, "গ্যাসে পোড়া ইট একশ ভাঙলে ৪০ টাকা, আর লাকড়ি পোড়া ইট ভাঙলে পাবে ৩০ টাকা। রাজি থাকলে বলো নাম লিখে নেই।"
ইট ভাঙেন কাল্লু
কাল্লুর রাজি না হয়ে আর উপায় কী। অতোগুলো মানুষ তার পথ চেয়ে বসে থাকে! কাল্লু রাঢ়ী ইটভা ঙার কাজ নেন। ধুলা-বালি আর ইটের গুড়ায় চারপাশ ছেয়ে যায়, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়; কিন্তু কাল্লুকে কাজ চালিয়ে যেতেই হবে।
এরমধ্যে চাচার ঘরে থাকা আর সম্ভব হচ্ছিল না। কাল্লুকে বস্তির ভিতর একটি ঘর তুলতে হবে। তার জন্য বাড়তি আরও কিছু টাকা লাগবে। বড় দুই ছেলে দিনমজুরের কাজে যোগ দিলেন। এক সময় হাতে টাকা জমলে তারাও ঝিলের ওপর খুঁটি গেড়ে মাচা বানালেন এবং বাঁশ-বেড়ার ঘর তুললেন। এখনো কাল্লু ভোলা বস্তিতেই থাকেন। বস্তিটি নেই, কিন্তু নালার ধারে যে রাস্তাটি দুয়ারি পাড়ায় গিয়ে উঠবে তার ওপর ৬০-৭০ পরিবার দাঁত কামড়ে পড়ে আছে, কাল্লুর পরিবার সেগুলোরই একটি।
তার ছেলেমেয়েদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেরা নিজেদের মতো আলাদা সংসার পেতেছেন। বড় মেয়েটি কাল্লুর সঙ্গেই থাকেন। ছেলেরা তাকে খাওয়ার খরচ দিতে পারেন না, তবে কাল্লু কিছু ভাড়া পান। যেটুকু জায়গা তার দখলে আছে, সেটুকুতে তিনটি ঘর তুলে দুটি ভাড়া দিয়েছেন। তার নাতি-নাতনীরা স্কুল ড্রেস পরে স্কুলে যায়, এতে তিনি খুব সুখ অনুভব করেন। নিজে তো স্কুল যাননি, ছেলেদেরও পড়াতে পারেননি, এখন নাতি-নাতনীদের দেখে চোখ জুড়ান।
তার বড় ছেলে জসিমউদ্দিন রূপনগরে ৮,০০০ টাকা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন। প্রতি সন্ধ্যায় শামসুদ্দিন ছোট ছেলেকে নিয়ে আসেন দাদাকে দেখাতে।
কাল্লু অনেকদিন হলো কাজ করতে পারেন না, তার শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা। ডাক্তারের দেওয়া ওষুধও কিনতে পারেন না ঠিকমতো। তবে তার আক্ষেপ কম; বেঁচে যে আছেন, তার জন্যই শোকরিয়া।
ইলিশা এক দুঃখের নাম
ইলিশা এখন দুই ভাগ হয়ে গেছে— পূর্ব ও পশ্চিম ইলিশা। শুধু পূর্ব ইলিশাতেই ভোটার ৭০ হাজার। নাদুন মিয়ার হাট দুই ইলিশার মাঝখানে। ভোলার বিখ্যাত এই হাট বসিয়েছিলেন জমিদার নাদুন মিয়া, তার নামটি এখনও রয়ে গেছে, কিন্তু হাট আর নেই।
পশ্চিম ইলিশায় বারেকদের বাড়ি, তারপর নাদুন মিয়ার হাট, তারপর ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, তারপর গোডাউন, তারপর স্বাস্থ্য ক্লিনিক, তারপর পূর্ব ইলিশায় ইউনুস মুন্সির (৬৮) বাড়ি। বারেকদের বাড়ি থেকে দূরত্ব দুই কিলোমিটার হবে। কিন্তু তবু টিকল না, মেঘনার সহ্য হলো না, বছর তিন-চারের ব্যবধানে গিলে নিল।
লম্বালম্বি প্রায় ১২ কিলোমিটার ভেঙেছে মেঘনা, প্রস্থে আরও কয়েকগুণ। ঘটনাটা গেল সাড়ে তিন দশকে সম্পন্ন করেছে মেঘনা। তাতে কত কত মানুষ ভিটাছাড়া হয়েছে! হাজার হাজার মানুষ ছড়িয়ে পড়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, রাজশাহী বা সিলেটে। যে যেখানে একটু জায়গা পেয়েছে, সেখানেই মাথা গুজে নিয়েছে।
ইউনুসদের মুন্সি বাড়িতে ৩৫ ঘরবসতি ছিল। সবাই একই বংশের। মেঘনা ভেঙে নেওয়ার পর সবাই এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে। আগে যেখানে প্রতিদিন দেখা-সাক্ষাৎ হতো, এখন বছরেও একবার খবর পাওয়া যায় না।
ইউনুস মুন্সি চাষাবাদের সব জানতেন— ধান, মিষ্টি আলু, বেগুন, কুমড়া আবাদ করতেন। উত্তরাধিকার সূত্রে চার বিঘা জমি পেয়েছিলেন, আরো কিছু বর্গা নিতেন। সাংবাৎসরিক খোরাকির জন্য তার বাজারে যাওয়া লাগত না। বাজার থেকে কেবল তেল আর লবণ কিনতেন। টাকার কোনো চিন্তা তাকে তখন করতে হয়নি। গোয়ালে গরু ছিল, পুকুরে মাছ ধরতেন, পকেটে টাকা আছে কি নেই— তা ভাবতে হতো না। দুই মেয়ে এক ছেলে তার।
বিলে জোছনা নামতো
বাড়ির ধারের বিস্তীর্ণ বিলটির কথা খুব মনে পড়ে ইউনুসের। পূর্ণিমা রাতে জোছনায় ভেসে যেত চরাচর। গাঁয়ের ছেলেরা দুধ জ্বাল দিয়ে খেজুর গুড়ের পায়েশ বানিয়ে খেত। বয়স্করাও গল্প করত গভীর রাত পর্যন্ত। মৃদুমন্দ হিম বাতাস বইত, স্বর্গীয় এক পরিবেশ তৈরি হতো সেখানে।
আজ এর সবই স্মৃতি। ইউনুস স্মৃতির তাড়নায় বছরে দু-একবার ইলিশায় যান, তবে বেশিদিন থাকতে পারেন না। সব হারানোর বেদনায় তিনি কাতর হয়ে পড়েন।
ইউনুস ঢাকায় এসেছেন ২০১৬ সালে। ভোলা বস্তিতে উঠেছিলেন এক আত্মীয়ের ঘরে। বেশিদিন অবশ্য থাকার সুযোগ পাননি। ২০১৯ সালে বস্তি ভেঙে দেওয়া হয়। বলা হয়ে থাকে, স্থানীয় সংসদ সদস্যের এতে ইন্ধন ছিল। বস্তি ভেঙে দিলে মানুষগুলো রাস্তায় এসে ওঠে, কেউ কেউ রাস্তাতেই থাকে দু-তিন মাস। তাদের তখন অবর্ণনীয় কষ্ট হয় পানির, গোসলের, খাওয়ার, রান্নার ও ঘুমানোর। ঘরহারা মানুষ আবার ঘর হারিয়ে কাঁদতেও ভুলে যান।
নতুন প্রজন্মের যারা
বস্তিটা যেখানে ছিল, তার কাছেই মোহাম্মদ রনির ভাঙারির দোকান। তার বয়স বাইশ। তার বন্ধু সুমন, আলমাস, হৃদয় সন্ধ্যা হলে কাজ সেরে এসে গল্প করেন। তারা নতুন প্রজন্মের ভোলাইয়া। জন্ম তাদের ঢাকাতেই। ইলিশার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আলগা। তাদের খালা বা মামা ইলিশায় থাকে। দু-একবার গেছেন, কিন্তু কোনো সুখস্মৃতি তৈরি করতে পারেনি। ঢাকার বাতাসে ধুলা-বালি, শব্দের খুব যন্ত্রণা তবু ঢাকা ছেড়ে থাকতে পারেন না।
অন্যদিকে, স্থায়ী কোনো ঠিকানা না থাকার কষ্টও তাদের পীড়িত করে। তাদের কেউ ড্রাইভার, কেউ সেলসম্যান। মাসে একবার তারা কাচ্চি বিরিয়ানী খেতে ভালোবাসেন। প্রতি শীতে সব বন্ধু চাঁদা দিয়ে বারবিকিউ পার্টি করেন, লাউড স্পিকারে গান শোনেন— এটুকুই আনন্দ; এই আনন্দকে সঙ্গী করেই বছরের বাকি সময় কাটান তারা।
বস্তির গৃহিনীরা রিপু, সেলাই, জরি লাগানোর কাজ করে করে কিছু উপরি উপার্জন করেন। তারাই মূলত সংসার দেখেশুনে রাখেন, পুরোনো জামা-কাপড়ের বদলে ঘরের জন্য প্রয়োজনীয় হাড়ি-পাতিল সংগ্রহ করেন, লেস ফিতাওয়ালাদের কাছ থেকে মেয়েদের জন্য ফিতা-চুড়ি কেনেন। বস্তির জীবন এখনো অনেকটা আদিম।
ইউনুস মুন্সিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "আবার কি ইলিশায় ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ আছে?"
তিনি বললেন, "না, কোনো সুযোগ নেই।"
"মেঘনার ভাঙন যদিও এখন থেমেছে, কিন্তু জমি-জিরাত ফিরে পাওয়ার আশা নেই। এখন যা রোজগার হয়, তার কিছুই সঞ্চয় হয় না। তাই আবার ফিরে গিয়ে নতুন করে শুরু করা সম্ভব হবে না। এভাবে ধুকে ধুকে যেমন পার হচ্ছে, তেমনই যাবে আমাদের জীবন। উদ্বাস্তুর জীবন, ভেসে ভেসে চলায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কষ্ট মেনে নিতে শিখেছি," যোগ করেন ইউনুস।
ছবি: সালেহ শফিক/দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড