ভাড়া, কাছের স্টেশন, সময়—মেট্রোর দরকারি সব তথ্য পেতে ‘ঢাকা মেট্রোরেল’ অ্যাপ
২০২২ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে 'সময় বাঁচানো'র প্রতিজ্ঞা নিয়ে শুরু হয়েছে মেট্রোরেলের যাত্রা। নিত্যদিনের যানজট ঠেলে নগরবাসী যখন জেরবার হয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তাদের নাটোরের বনলতা সেনের মতো দুদণ্ড স্বস্তি দিয়েছে মেট্রোরেল। যে মতিঝিল থেকে উত্তরা যেতে আগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় কাটিয়ে দিতে হতো, মেট্রোর আগমনে তা দাঁড়ায় মোটে ৩৩ মিনিটে।
মেট্রোরেল নগরবাসীকে স্বস্তি দিলেও মেট্রো সংক্রান্ত নানান প্রশ্নের ঘুরপাক কিন্তু তাদের পিছু ছাড়েনি। এই যেমন 'মেট্রোরেল কখন ছাড়বে', 'উত্তরা দক্ষিণ থেকে আগারগাঁও-এর মেট্রোর ভাড়া কত' কিংবা 'র্যাপিড কার্ডে কত টাকা আছে, তা কীভাবে জানবো' ইত্যাদি। এই সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে, অর্থাৎ মেট্রোরেল সংক্রান্ত ধারণা দিতেই ২০২১ সালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চালু করা হয় 'মেট্রোরেল প্যাসেঞ্জার্স কমিউনিটি-ঢাকা' গ্রুপ। এই প্ল্যাটফর্মের নেপথ্যে ছিলেন মোহাম্মদ নাইম ইসলাম সোহাগ।
মেট্রোর একজন নিয়মিত যাত্রী হিসেবে তথ্যগত সহায়তার জন্যই তিনি চালু করেন গ্রুপটি। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কোনো গ্রুপ কি সবসময় শতভাগ সাহায্য করতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সোহাগ সিদ্ধান্ত নিলেন অ্যাপ তৈরি করার, যেই অ্যাপে মানুষ প্রবেশ করলেই মেট্রোরেল সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য পেয়ে যাবেন।
যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। কিন্তু অ্যাপ তৈরি তো চারটেখানিক কথা নয়, তার ওপর সোহাগ নিজে আইনের শিক্ষার্থী। আইনের মারপ্যাঁচ সোহাগের নখদর্পণে থাকলেও অ্যাপ তৈরি তার জন্য সহজ ছিলনা। তবে এ যাত্রায় সোহাগ একা ছিলেন না, তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন তারই বন্ধুমহল। অল্প খরচেই দেড় মাসের প্রচেষ্টায় চালু করেন অ্যাপ। অ্যাপের নাম হয় 'ঢাকা মেট্রোরেল'।
সোহাগ বলেন, "ঢাকা মেট্রোরেল অ্যাপ অনেকটা শখের বশেই করা। আমরা যারা মেট্রোরেলের নিয়মিত যাত্রী, তাদেরকে তথ্যগতভাবে সহায়তা করার জন্যই এই অ্যাপ চালু করেছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মেট্রোরেলের আরও অনেক গ্রুপ আছে, কিন্তু সেখান থেকে হয়তো সবসময় আমরা অথেনটিক তথ্য পাই না। এই অ্যাপের মাধ্যমে সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে। যেহেতু মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ 'ঢাকা মেট্রোরেল' শব্দটি কোথাও ব্যবহার করে না, তাই আমরা অ্যাপের নাম দিয়েছি 'ঢাকা মেট্রো রেল'।"
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ 'ঢাকা মেট্রোরেল' অ্যাপকে স্বাগত জানালেও এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন দেয়নি বলে জানান সোহাগ। তবে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন প্রাপ্তির জন্য তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
যুক্ত আছে যত ফিচার!
ঢাকা মেট্রো রেল অ্যাপে যুক্ত আছে ৮টিরও বেশি ফিচার। এরমধ্যে আছে ভাড়ার হিসাব, নিকটতম স্টেশন, কার্ড এবং ব্যালেন্স, ট্রেনের সময়সূচি, লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড, হটলাইন, এমআরটি পুলিশ, ট্যুরিস্ট গাইড, বাসরুট, অন্যান্য প্রশ্নোত্তরসহ আরও অনেক ফিচার। তবে এখন পর্যন্ত অ্যাপ দিয়ে র্যাপিড পাস বা এমআরটি পাস রিচার্জ করা, কার্ড রেজিস্ট্রেশন কিংবা লাইভ মেট্রো ট্রেনের সূচি দেখার ফিচার চালু হয়নি। গ্রাহকদের সুবিধার জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমোদন প্রাপ্তির পর সেগুলোও চালুর চেষ্টা করবে ঢাকা মেট্রোরেল অ্যাপ।
সোহাগ বলেন, "মেট্রো রেলের যত তথ্য আছে, যেমন— কখন চলে, ভাড়া কেমন, জরিমানা কত হবে— এগুলো আমরা অ্যাপে যুক্ত করেছি। তারপর চাকরির সার্কুলার, ফলাফল, মেট্রো রেলের ইতিহাস সামগ্রিক তথ্যগত যা কিছু আছে, সবই আমরা যুক্ত করেছি।"
"তাছাড়া মেট্রো যদি কোনো স্টেশনে নির্ধারিত সময়ের বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, এ সংক্রান্ত তথ্যও এই অ্যাপে পাওয়া যাবে," যোগ করেন সোহাগ।
ঢাকা মেট্রোরেল অ্যাপের প্রতিটি ফিচারের বিস্তারিত ব্যাখ্যা খুঁজতে গেলে সবার আগেই পাওয়া যাবে হটলাইন সেবা। বর্তমানে এমআরটি পুলিশের হটলাইন নাম্বার চালু আছে। জরুরি বা সাধারণ তথ্যের জন্য হটলাইন সেবা প্রদান করা হয়। যাত্রীরা যেকোনো জরুরি তথ্যের জন্য কন্ট্রোল রুমের (+৮৮০১৩২০২১৫৫৯৮) নম্বর এবং হটলাইন (+৮৮০১৩২০২১৫৫৯৯) নম্বরে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারবেন।
লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড মেট্রোরেলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফিচার। এটি মূলত মেট্রোরেলে ভ্রমণের সময় হারানো জিনিসপত্র খুঁজে পাওয়ার জন্য বিশেষ সেবা। অ্যাপের মাধ্যমে হারানো জিনিসের তথ্য যেমন জমা দেওয়া যাবে, তেমনি কোনো হারানো জিনিস পাওয়া গেলে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সেটি সংগ্রহ করা যাবে। এ সংক্রান্ত তথ্য থাকবে এই ফিচারে।
এছাড়াও আছে এমআরটি পুলিশ— যারা মূলত মেট্রোরেলে চলাচলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। এই অ্যাপের মাধ্যমে মেট্রোরেলে নিরাপত্তাজনিত কোনো সমস্যা হলে সরাসরি এমআরটি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে।
মেট্রোরেল ব্যবহারের সময় যাত্রীদের সাধারণ সমস্যা সমাধানের জন্য আছে প্রশ্নোত্তর ফিচার। এই ফিচারে সাধারণত জিজ্ঞাসিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়। যেমন— শুক্রবারে কয়টা থেকে মেট্রো চলে, বাচ্চাদের জন্য মেট্রোর ভাড়া কি ফ্রি, প্রথম এবং শেষ ট্রেন কয়টায় ইত্যাদি।
ভাড়া হিসাবকারী বা ফেয়ার ক্যালকুলেটর ফিচারটি মূলত যাত্রার দূরত্ব অনুযায়ী টিকিটের ভাড়া নির্ধারণের জন্য একটি বিশেষ টুল। এই ফিচারের মাধ্যমে যাত্রা শুরু এবং গন্তব্যের স্টেশন নির্বাচন করে ভাড়ার পরিমাণ জানা যাবে। যাত্রীদের বাজেট পরিকল্পনায় এই ফিচারের গুরুত্ব অনেক।
ঢাকা মেট্রোরেল অ্যাপের আরেকটি ফিচার হলো কার্ড ও ব্যালেন্স। মেট্রোরেল যাত্রীদের স্মার্ট কার্ড ব্যবহারের জন্য এই ফিচার। এর মাধ্যমে এমআরটি পাস এবং র্যাপিড পাস কার্ডের ব্যালেন্স দেখা যাবে। ব্যালেন্স শেষ হলে পুনরায় লোড করার প্রক্রিয়া জানা যাবে। প্রথমদিকে এই সেবা 'নিয়ার ফিল্ড কমিউনিকেশন' (এনএফসি) ভিত্তিক ফোনে শুরু হলেও বর্তমানে সাধারণ স্মার্ট ফোনে কার্ড ও ব্যালেন্স ফিচার চালু আছে। তাছাড়া, এনএফসি ভিত্তিক মোবাইল ফোনে 'ট্র্যাভেল হিস্ট্রি' বা ভ্রমণের বিস্তারিত বিবরণও পাওয়া যাবে।
এছাড়া, প্রতিদিনের মেট্রো রেলের সময়সূচি জানার জন্য আছে ট্রেন সময়সূচি ফিচার। এর মাধ্যমে প্রতিটি স্টেশনের ট্রেন কখন আসবে এবং কখন ছেড়ে যাবে তা জানা যাবে।
ঢাকা মেট্রো অ্যাপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ফিচার নিকটতম স্টেশন। এই ফিচারের মাধ্যমে ব্যবহারকারী বর্তমান অবস্থান থেকে নিকটতম মেট্রো স্টেশন খুঁজে বের করার সুবিধা পাবেন। জিপিএসের মাধ্যমে অবস্থান ট্র্যাক করে কাছের স্টেশনের ঠিকানা ও দূরত্ব জানতে পারবেন। যারা নতুন যাত্রী, তাদের চাহিদামতো স্টেশন খুঁজে পেতে এই ফিচার বেশি কার্যকরী।
রয়েছে যাত্রীদের আক্ষেপ
বর্তমানে ঢাকা মেট্রোরেল অ্যাপের সাথে যুক্ত আছেন ১১ জন। এরমধ্যে অ্যাপ ডেভেলপমেন্টের সাথে যুক্ত ২-৩ জন। অনলাইন এবং অফলাইন দুইভাবেই অ্যাপটি ব্যবহার করা যায়। তবে ইন্টারনেট থাকলে তুলনামূলক বেশি সুবিধা পাওয়া যায়। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই অ্যাপ ব্যবহার করার সুযোগ আছে। বর্তমানে অ্যাপটি অ্যান্ড্রয়েডভিত্তিক স্মার্টফোনে কাজ করে, তবে আইওএসভিত্তিক ফোনে চালু করার জন্যও কাজ করে যাচ্ছেন সোহাগ এবং তাদের দল। গুগল প্লেস্টোরে ঢুঁ মারলেই খুঁজে পাওয়া যাবে ঢাকা মেট্রোরেল অ্যাপ।
তবে ঢাকা মেট্রোরেল অ্যাপে রিচার্জ অপশন না থাকায় যাত্রীদের মধ্যে কিছু আক্ষেপ রয়েছে।
মেট্রোরেলের ফার্মগেট থেকে উত্তরা দক্ষিণ রুটের নিয়মিত যাত্রী ফারহানা বলেন, "অ্যাপের মাধ্যমে রিচার্জ করার সুযোগ থাকলে ভালো হতো। অধিকাংশ দিনই অফিসে যাওয়ার জন্য তাড়ায় থাকি। অ্যাপের মাধ্যমে কিংবা মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে রিচার্জের সুযোগ থাকলে ঘরে বসেই রিচার্জ করে ফেলতে পারতাম।"
আরেক যাত্রী ট্রেনের নীলা, ট্রেনের লাইভ লোকেশন নিয়ে অভিযোগ জানান। তিনি বলেন, "ঢাকা মেট্রোরেল অ্যাপে ট্রেনের লাইভ লোকেশন থাকলে ট্রেন ধরতে সুবিধা হতো। সময়টা ঠিকঠাক বুঝতে পারতাম আমরা।"
যাত্রীদের অভিযোগ আমলে নিয়ে সোহাগ বলেন, "কর্তৃপক্ষ আমাদের এখনও ট্রেন ট্র্যাকিং বা রিচার্জ অপশনের অনুমতি দেয়নি। আমরা অপশন রেখেছি, কিন্তু জায়গাটা ফাঁকা রয়েছে।"
সপ্তাহে ৭ দিনই মেট্রোরেল
মেট্রোরেল আইন-২০১৫ এর ওপর ভিত্তি করেই অ্যাপ নির্মাণ করা হয়েছে। সোহাগ বলেন, "অ্যাক্টে লেখা আছে মেট্রোরেলের কোনো টিকিট বা কার্ড কোনোভাবেই কোলন বা কপি করা যাবে না। সেক্ষেত্রে আমাদের অ্যাপ শুধু কার্ড রিড করতে পারবে। কেবল ব্যালেন্স দেখা যাবে।"
২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর উত্তরা উত্তর হতে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশে প্রথম ধাপে এবং পরের বছর ২০২৩ সালের ৪ নভেম্বর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অংশে দ্বিতীয় ধাপে মেট্রোরেলের বাণিজ্যিক চলাচল শুরু হয়। সপ্তাহে ৭ দিনই সেবা দিচ্ছে মেট্রোরেল। শনি থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা ১০ মিনিট থেকে রাত ৯টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত উত্তরা উত্তর হতে মতিঝিল রুটে এবং মতিঝিল থেকে উত্তরা উত্তর রুটে বাণিজ্যিকভাবে নিয়মিত চলছে মেট্রোরেল। আর ছুটির দিন শুক্রবারে বেলা ৩টা ৩০ মিনিট থেকে (উত্তরা উত্তর স্টেশন) রাত ৯টা ৪০ মিনিট (মতিঝিল স্টেশন) পর্যন্ত চলাচল করছে।
বিশ্বের ১৯৩টি দেশের মধ্যে ৬০তম দেশ হিসেবে মেট্রোরেল চালু হয়েছে বাংলাদেশে। বর্তমানে দৈনিক গড়ে প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার যাত্রী স্বল্প সময়ে মেট্রোরেলে যাতায়াতের সুবিধা ভোগ করছেন। এর ফলে ঢাকা মহানগরবাসীর জীবনযাত্রায় যোগ হয়েছে নতুন গতি ও মাত্রা।
এর পাশাপাশি এই রুটে যানবাহনের সংখ্যা কমার মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস পেতে শুরু করেছে। বায়ুদূষণ কমাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে মেট্রোরেল। যানবাহনের সংখ্যা কমার মাধ্যমে এই রুটে বছরে ২ লাখ ২ হাজার ৭৬২ টন কার্বন নিঃসরণ হ্রাস পাবে।
ঢাকা মেট্রোরেল অ্যাপের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে সোহাগ বলেন, "কর্তৃপক্ষ যদি অ্যাপের সঙ্গে যুক্ত হতে চায় বা আমাদের অ্যাপটি নিতে চায়, তাহলে আমাদের সাথে কাজ করতে পারবে। তথ্যগত সহায়তাই এখন অন্যতম লক্ষ্য।"