২০০ বছর ধরে যে গ্রামে বেজে চলে বাঁশির সুর, পৌঁছে গেছে বিদেশেও
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/01/24/flute_village_5_0.jpeg)
বাঙালির সবচেয়ে আপন বাদ্যের নাম বাঁশি। বাঁশির মোহনীয় সুরে প্রাণ জুড়ায় না এমন মানুষ পাওয়া কঠিন। নজরুলের 'মধুর বাঁশরী' থেকে রাখালের ডাকাতিয়া বাঁশি—উচ্চ সংস্কৃতি থেকে লোক সংস্কৃতি, সর্বত্রই বাঁশির সুরের উপস্থিতি।
কুমিল্লার হোমনা উপজেলার মেঘনা নদীর তীরে শ্রীমদ্দি নামের একটি গ্রাম রয়েছে। এ গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা বাঁশি তৈরি। প্রায় চার প্রজন্ম ধরে তারা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। শ্রীমদ্দির কাঁচাপাকা পথ ধরে হাঁটতে গেলে ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসে বাঁশির মধুর সুর।
এই গ্রামের কারিগররা প্রায় ১৬ থেকে ২০ ধরনের বাঁশি তৈরি করতে পারেন। ক্লাসিকাল বাঁশি, আড় বাঁশি, মোহন বাঁশি, বীণ বাঁশি, ক্যালেনর বাঁশি, পাখি বাঁশি, নাগিন বাঁশি, বেলুন বাঁশি, মুখ বাঁশি, ফেন্সি বাঁশি, খানদানি বাঁশি—এর প্রতিটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ভরা।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/01/24/flute_village_7.jpeg)
দেশের প্রায় সব পেশাদার বংশীবাদক শ্রীমদ্দির তৈরি বাঁশি ব্যবহার করেন। দেশজুড়ে বাদ্যযন্ত্র বিক্রেতারা এখান থেকে বাঁশি সংগ্রহ করেন। বিশেষ করে পহেলা বৈশাখের সময় বাঁশির চাহিদা থাকে তুঙ্গে।
শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও শ্রীমদ্দির বাঁশি পৌঁছে যায়। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, আমেরিকা, ইতালি, কানাডাসহ প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটানেও নিয়মিত রপ্তানি করা হয় এসব বাঁশি।
শুরুর গল্প
প্রায় ২০০ বছর আগে শ্রীমদ্দি গ্রামের দুই বাসিন্দা কোকিল দাস বৈরাগী ও দীনবন্ধু তৎকালীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বাঁশি তৈরি শেখেন। দুজনেই ছিলেন দক্ষ বংশীবাদক। গ্রামে ফিরে তারা বাঁশ দিয়ে বাঁশি বানানো শুরু করেন।
নিজেদের তৈরি বাঁশি বাজানো এবং ফেরি করে বিক্রি করাই ছিল তাদের জীবিকা। ধীরে ধীরে তাদের হাত ধরে বাঁশি তৈরির এই শিল্প ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/very_big_1/public/images/2025/01/24/flute_village_1.jpeg)
দেশভাগের সময় কোকিল বৈরাগী ও দীনবন্ধু পরিবারসহ ভারতে চলে গেলেও শ্রীমদ্দিতে রেখে যান বাঁশি তৈরির এই অমূল্য শিল্প। সময়ের সঙ্গে নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যেও এই শিল্প এখনো টিকে আছে।
বর্তমানে গ্রামের ৩০-৪০টি পরিবার বাঁশি তৈরির কাজে নিয়োজিত। প্রবীণ কারিগর আবুল কাশেম বলেন, "স্বাধীনতার আগে বাঁশির চাহিদা অনেক বেশি ছিল। বাপ-দাদাদের দেখতাম দুই মাস খেটে বাকি সময়টা আরামে কাটাত। এখন সারা বছরই কষ্ট করতে হয়।"
বাঁশি তৈরির প্রক্রিয়া
বাঁশি তৈরির প্রধান উপকরণ মুলি বাঁশ, যা চট্টগ্রাম, মিরসরাই, সীতাকুণ্ড এবং রাঙামাটি থেকে সংগ্রহ করা হয়। বাঁশগুলো কেনার পর ভালো মানের বাঁশ আলাদা করে পরিষ্কার করা হয়। এরপর চাহিদামতো আকারে কাটা হয়। বাঁশ কাটার পর ধুয়ে রোদে শুকানো হয় কয়েকদিন।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/01/24/flute_village_2_0.jpeg)
একটি ছোট বাঁশি তৈরিতেও ১৩-১৪টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। পুরো প্রক্রিয়ায় প্রায় ২০-২২ জন লোকের পরিশ্রম লাগে। কেউ বাঁশ পরিষ্কার করেন, কেউ কাটেন, কেউ শুকানোর দায়িত্বে থাকেন। সবমিলিয়ে বাঁশি বানানো কোনো চাট্টিখানি কাজ নয়!
বাঁশ শুকানোর পর আড় বাঁশি, ক্লাসিকাল বাঁশি এবং অর্ডারের বিশেষ বাঁশির জন্য বাঁশকে একটি ঘরে রেখে কিউরিং করা হয়। কয়েক মাস থেকে বছরখানেক পর্যন্ত বাঁশ কিউরিং করা হয়। এতে বাঁশের মান বৃদ্ধি পায়। তবে কিছু বাঁশে ঘুণ ধরে গেলে সেগুলো বাতিল করা হয়। ভালো বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয় দামি পেশাদার বাঁশি।
তবে অন্যান্য সাধারণ বাঁশির জন্য এত দীর্ঘ কিউরিংয়ের প্রয়োজন হয় না। শুকানোর পরে বাঁশের ওপরের চামড়া ছেঁচে তুলে ফেলা হয়। যা আবার আড় বাঁশির ক্ষেত্রে করা হয় না। চামড়া তোলার পর কাদামাটি দিয়ে বাঁশের গায়ে বিভিন্ন নকশা করা হয়। কাদামাটি শুকানোর পর বাঁশিকে আগুনে ছেঁকা দেওয়া হয়। ফলে কাদামাটি ঝরে পড়ে যায়, আর বাঁশির গায়ে ফুটে ওঠে সুন্দর ও নান্দনিক নকশা।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/01/24/flute_village_6.jpeg)
এছাড়াও বাঁশির ভেতরে এক মাথায় কডি বসানো হয়। কডি বা কক তৈরি হয় মান্দাল কাঠ দিয়ে। এই কডির কারণে বাতাস এক পাশে আটকায়, আর ফুটোয় আঙুল চালিয়ে সুর তৈরি হয়।
বাঁশির শরীরে আকৃতিভেদে ছয় থেকে আটটি ছিদ্র থাকে। এই ছিদ্র করার জন্য এক মাথায় চোখা রডের শিক ব্যবহার করা হয়। শিককে আগুনে তাপ দিয়ে বাঁশির শরীরে ফুটো করা হয়। এই ফুটো করার আবার মাপ আছে। অনেকে স্কেল দিয়ে দাগ কেটে মাপ অনুযায়ী ফুটো করেন। তবে আবুল কাশেমের মতো দক্ষ কারিগরদের দাগ কাটা লাগে না। ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে বাঁশির কারিগরের কাজ করছেন তিনি। শিক গরম করে চোখের আন্দাজে নিমিষেই ফুটো করে ফেলেন বাঁশির শরীরে।
তবে এই আন্দাজের ফুটো সাধারণ বাঁশি, মেলায় বিক্রির বাঁশির জন্য। ক্লাসিকাল বাঁশি, আড় বাঁশি, অর্থাৎ পেশাদার বংশীবাদকদের বাঁশি ফুটো করা হয় যত্ন ও সাবধানতার সঙ্গে। হারমোনিয়াম বাজিয়ে, সুর মিলিয়ে বাঁশির স্কেল তৈরি করেন কাশেম মিয়া। কোনোটা এফ শার্প, কোনোটা সি মাইনর আবার কোনো ডি শার্প। পেশাদার বংশীবাদকদের চাহিদা অনুযায়ী সকল স্কেলের বাঁশিই তৈরি করা হয় শ্রীমদ্দি গ্রামে।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/01/24/flute_village_3.jpeg)
আবুল কাশেমের বাঁশি বাজিয়েছেন সবাই
আড় বাঁশি তৈরির পর এটি পেঁচানো হয় নানা রঙের বাহারি সুতো দিয়ে। লাল, হলুদ, সবুজ আর নীল রঙই বেশি ব্যবহার করা হয়। কেন এই সুতার ব্যবহার? আবুল কাশেম বলেন, "প্রথম কথা হলো দেখতে সুন্দর লাগে এভাবে সুতা পেঁচাইলে। তাছাড়াও সুতা দিয়ে বাঁধন দিলে বাঁশিটার গড়ন মজবুত হয়। হাত থেকে পড়লে ফাটে না। টিকে বেশি দিন। অনেকে কাস্টম অর্ডারে বলে দেয় কোন রঙের সুতা পেঁচাইতে হবে। আবার অনেকে স্কেল অনুযায়ী সুতা পেঁচানো বাঁশির অর্ডার দেয়।"
"কোনো বিখ্যাত শিল্পী কি আপনার থেকে বাঁশি বানিয়ে নিয়েছে কখনো?" এ প্রশ্নের জবাবে আবুল কাশেম মুখ টিপে গর্বের হাসি হেসে বললেন, "আপনি গত ৩০-৩৫ বছরে বাংলাদেশের সব সেরা বাঁশির শিল্পীর নাম বলতে থাকেন। আমার থেকে বাঁশি নেয় নাই এমন কারও নাম যদি শুনি, আমি আপনাকে থামাব।"
আবুল কাশেম আরও বলেন, "ওস্তাদ আজিজুল ইসলাম, ওস্তাদ শামসুল হক, ওস্তাদ ধীর আলী থেকে শুরু করে জালাল- সবার জন্যই আমি বাঁশি বানিয়েছি। বারী সিদ্দিকী ভাই আমার বাড়িতে এসে বাঁশি অর্ডার করে নিয়ে যাইতেন। বাংলাদেশের এমন কোনো পেশাদার বংশীবাদক নাই, যার জন্য আমি বাঁশি বানাই নাই। ওপরওয়ালা হাত দিছেন, আমি বানাইতেছি শুধু। যতদিন বেঁচে আছি, বানায়ে যাব।"
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/01/24/flute_village_4.jpeg)
বাঁশি যাচ্ছে সেই আন্দামানেও!
উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ বাঁশি। তাই পেশাদার বংশীবাদকদের কাছে একটি পরিচিত নাম মেঘনার তীরে অবস্থিত শ্রীমদ্দি গ্রাম। নতুন বাঁশি কেনা, পছন্দমতো বাঁশি বানানো কিংবা পুরোনো বাঁশি সারানোর জন্য এই গ্রামে ছুটে আসেন সঙ্গীতপ্রেমীরা।
শুধু সাধারণ বাঁশি নয়, আবুল কাশেম তৈরি করেন বীণও। দেশের নাটক-সিনেমার শুটিংয়ে তার হাতে তৈরি বীণ ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, সাপুড়েদের মধ্যেও তার তৈরি বীণ বেশ জনপ্রিয়।
শ্রীমদ্দি গ্রামের তৈরি বাঁশির চাহিদা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও পৌঁছে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাইরের কোনো অর্ডার নিয়ে কাজ করছেন কি না, এমন প্রশ্নে আবুল কাশেম এক টুকরো কাগজ দেখিয়ে বলেন, ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ থেকে কয়েকটি বাঁশির অর্ডার এসেছে। ছোট্ট এই গ্রাম থেকে তৈরি বাঁশি পৌঁছে যাচ্ছে এমন দূরবর্তী এলাকায়—এ যেন ভাবনারও অতীত!
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/01/24/flute_village_9.jpeg)
খরচাপাতি
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকাররা শ্রীমদ্দি গ্রামে এসে বাঁশি কিনে নিয়ে যান। মান, নকশা ও গুণাগুণভেদে বাঁশির দাম ভিন্ন হয়। পাঁচ টাকা থেকে পাঁচ-দশ হাজার টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হয় বাঁশি। এর মধ্যে আড় বাঁশির দামই বেশি। কারণ পেশাদার বংশীবাদক এবং শিক্ষার্থীরা মূলত এটি ব্যবহার করেন।
দৈর্ঘ্য, পুরুত্ব আর স্কেল—এই তিনটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে আড় বাঁশির দাম নির্ধারিত হয়। একটি সি শার্প স্কেলের মোটা আড় বাঁশি দেখিয়ে আবুল কাশেম তার দাম বলেন সাড়ে তিন হাজার টাকা। কেউ যদি পুরো পেশাদার বাঁশির সেট কিনতে চায়, যেখানে ১২ থেকে ১৫টি স্কেলের বাঁশি থাকবে, সেটের দাম পড়বে ৪৫ হাজার টাকা।
তবে বাঁশি তৈরির খরচ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। খরচ অনুযায়ী লাভের মুখ দেখছেন না কারিগররা। বাঁশের দাম ফি-বছর বাড়লেও একই হারে বাঁশির দাম বাড়ানো সম্ভব হয় না। অন্যান্য কাঁচামাল, যেমন কয়লা, খড়ি, কাঠ, রঙ, স্পিরিটের দামও বাড়ছে। শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিও একটি বাড়তি চাপ। কিন্তু সেই তুলনায় বাঁশি বানিয়ে তেমন লাভ আসে না বলে আফসোস করলেন আবুল কাশেম।
শ্রীমদ্দি আর বাঁশির ভবিষ্যৎ
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/very_big_1/public/images/2025/01/24/flute_village_8.jpeg)
চার পুরুষ ধরে বাঁশি বানানোর কাজ করছেন আবুল কাশেম। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ না পেলেও তিনি নিজের সন্তানদের এই পেশার কাজ শিখিয়েছেন। এখন তার ছেলেরাও তার সঙ্গে বাঁশি বানান।
তবে, তার ছেলে রশীদ মিয়ার কাছে সন্তানদের এই পেশায় আনতে চান কি না জানতে চাইলে জবাব দেন আবুল কাশেম নিজেই। তিনি মাথা নেড়ে বলেন, "না। আমি চাই না আমার নাতি-পুতি এই কাজে আসুক। যত দিন যাচ্ছে, আমাদের সম্মান কমছে। আয় রোজগারও কমছে। এখন তো নাকি কম্পিউটারে বাঁশির সুর বের করা যায়। বাঁশের বাঁশি আর লাগে না! এজন্যই দিন দিন আমাদের কদর কমে যাচ্ছে।"
সরকারি কোনো সহায়তা পাননি শ্রীমদ্দি গ্রামের বাঁশির কারিগররা। ক্ষুদ্র কুটির শিল্প হিসেবে তাদের রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি নেই। মাঝে মাঝে এনজিওগুলো কিছু সহায়তা দিলেও তা যথেষ্ট নয়।
এই গ্রামের ৩০-৪০টি পরিবার এখনো কষ্ট করে বাঁশি তৈরির ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। আগে গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরে বাঁশি বানানোর কাজ হতো। কিন্তু এখন অনেকেই এই পেশা ছেড়ে অন্যান্য কাজের দিকে ঝুঁকছেন।
আবুল কাশেমের মতে, বাজারে দোকান দিলে এই পেশার চেয়ে বেশি আয় করা সম্ভব। বাপ-দাদার শিখিয়ে দেওয়া কাজ বলে এখনো আবেগ ধরে রেখেছেন। তবে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সহায়তা না পেলে কতদিন আর এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে পারবেন, তা নিয়ে সন্দিহান এই গ্রামের কারিগররা।