কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মদিনকে ঘিরে শুরু হয় যে মধুমেলা; চলছে ১৩৫ বছর ধরে
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/02/img-20250131-wa0031.jpg)
'দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!'
বাংলা সাহিত্যে সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক, মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমাধিফলকে খোদাই করা রয়েছে এ চরণ কয়েক। বাঙালি কবি ও নাট্যকার, বাংলার নবজাগরণ সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব মাইকেল মধুসূদন দত্ত যত বিখ্যাত মানুষই হোন না কেন, যশোরের মানুষের কাছে তিনি বাড়ির ছেলে। দুইশ বছর পরেও যশোরের মানুষ চেষ্টা করে যাচ্ছেন প্রতি জানুয়ারিতে বাড়ির ছেলের জন্মদিনকে স্মরণীয় করে রাখার। আর তাই জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহজুড়ে যশোরের সাগরদাঁড়ি গ্রামে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ির প্রাঙ্গনে বসে মধুমেলা।
শুরুটা যেভাবে
সালটা ১৮৭৩ সাল। এ বছরের ২৯ জুন কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। তার বছর বিশেক পরের কথা। ১৮৯০ সালে কবির ভাইঝি কবি মানকুমারী বসু কবির স্মৃতিতে বাস্তুভিটা সাগরদাঁড়িতে আয়োজন করেন এক স্মরণসভার। এটি ছিল কবির বাস্তুভিটায় কবি স্মরণে প্রথম কোনো অনুষ্ঠান। এরপর আর সেটি থেমে থাকেনি। প্রতিবছরই কবির জন্মদিন উপলক্ষে কিছু না কিছুর আয়োজন চলতে থাকে।
এই আনুষ্ঠানিকতা আস্তে আস্তে বড় হতে শুরু করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সাল থেকে সাংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথমবারের মতোন আয়োজিত হয় মধুমেলা। এরপর থেকে প্রতি বছর কবিস্মরণে বসেছে মেলা। সাধারণত কবির জন্মদিনের দিন মেলা শুরু হয়। চলে সাত দিনব্যাপী।
তবে কখনো সখনো এক-দুদিন পরে কিংবা আগেও বসে যায় মধুমেলা। এবারেও কবির ২০১তম জন্মদিন উপলক্ষে মধুমেলা উদযাপিত হয় সমান জাঁকজমকে।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/02/img-20250131-wa0053.jpg)
'রেখো, মা, দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে'
বঙ্গভূমির প্রতি কবির এ মিনতি ব্যর্থ হয়ে যায়নি। প্রথমে ইংরেজিতে সাহিত্য চর্চা করলেও মাইকেল মধুসূদন দত্ত খ্যাতির শিখরে পৌঁছেছিলেন বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার মাধ্যমেই। শুধু তাই নয়, কবির মৃত্যুর এক শতাব্দী পেরোলেও মানুষ মনে রেখেছে এই কবিকে। তার প্রমাণ পেলাম কবির বাল্যকালের স্মৃতিবিজড়িত পৈতৃক ভিটা যশোরের সাগরদাঁড়ি গ্রামে গিয়ে।
কপোতাক্ষ নদের পাড়-ঘেঁষেই কবির বাড়ি। কপোতাক্ষ নদ থেকে শুরু করে মধুমঞ্চ পর্যন্ত অনেকটা জায়গা। হেঁটে গেলে প্রায় মিনিট সাতেক। এই বিশাল জায়গাজুড়ে বসেছে মেলা। দু'পাশজুড়ে স্টলের সারি। সবমিলিয়ে প্রায় ৪৫০ স্টল। পিঁপড়ের মতোন পিলপিল করে ঢুকছে মানুষ। লোকজনের ভিড়ে পা ফেলা দায়। কনকনে শীতের মধ্যেও মানুষের কমতি নেই। বাগেরহাট থেকে বাস ভাড়া করে এসেছেন এক দল লোক। কেউ এসেছেন ঢাকা থেকে, কেউ বা খুলনা। স্থানীয় মানুষের পাশাপাশি দূর-দূরান্তের মানুষ একেবারে কম নয়। প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষের সমাগম এই মধুমেলায়। শেষের দুইদিন সংখ্যাটা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। তাই জেলা প্রশাসন থেকে নেওয়া হয় বিশেষ নিরাপত্তা ও সিসিটিভির ব্যবস্থা।
কী খেতে চান? পাঁপড় ভাজা, শনপাপড়ি, বাদাম ভাজা, কিংবা জিভে গজা? ঝালমুড়ি, ভাজা চানাচুর, তেলেভাজা ফুচকা, চটপটির দোকান তো আছেই। বিশাল বিশাল গামলায় স্থানীয় বিখ্যাত মিষ্টির পসরাও দেখা গেল। বালিশ মিষ্টি, জামতলার রসগোল্লা, চমচম, আরও কত কী…!
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/02/img-20250131-wa0083.jpg)
তবে শুধুই কি খাবারের দোকান? না, একেবারেই তা নয়। জামাকাপড়, খেলনা, রেশমি চুড়ি থেকে শুরু করে নানান ধরনের মনিহারি সামগ্রীর দোকান। ঘর সাজানোর জন্য নানান শো পিস, কাঠের খোদাই করা নামের আদ্যাক্ষর, প্লাস্টিক ফুল, বেতের ঝুড়ি, ঝিলমিলি বেলুনও রয়েছে। সাময়িক বসা এ দোকানগুলোকে শীতকালীন ফুল গাঁদা দিয়ে গাঁথা মালায় সাজিয়ে তুলেছেন দোকানীর দল।
বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মধুমেলায় প্রতিবছর যোগ দেন এই দোকানীরা। তাদের জন্যে এই মেলা একটা বছরের অপেক্ষা। অনেক বিক্রিবাট্টা, কিছুটা লাভের মুখ দেখা, আর বহু মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ মেলে এ মেলার মাধ্যমে।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/02/img-20250131-wa0043.jpg)
বইয়ের স্টলে দেখা গেল কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন ও সাহিত্যকর্মের ওপর লেখা বিভিন্ন দুর্লভ বই। কবির বিভিন্ন কবিতার সরলার্থ, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আছে এমন বইও দেখা গেল এসব স্টলে।
এছাড়া, মধুমঞ্চে পৌঁছে জানা গেল এক বিশেষ আয়োজনের কথা। মেলা উদ্বোধনের দিন থেকে সপ্তাহজুড়ে মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা নাটক মঞ্চায়িত করে চলেছে একটি নাট্যদল। ২৪ জানুয়ারি 'শর্মিষ্ঠা' মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ আয়োজন। মধুমঞ্চের অডিটোরিয়ামে ২৫০ জন মানুষ বসবার ব্যবস্থা রয়েছে। দর্শক হিসেবে অপ্রতুলই বটে। কারণ প্রতিদিনই নাটক দেখতে জমে বহু মানুষের ভিড়।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/02/img-20250131-wa0036.jpg)
মধুমেলায় কী আছের থেকে যেন কী নেই– প্রশ্নটা বেশি প্রাসঙ্গিক। ছোটোবেলার সেই গ্রামীণ মেলা যেন এক ঝলকে উঁকি দিচ্ছিল চোখের সামনে। প্লাস্টিকের পিস্তল কিনে বছর চারেকের এক বাচ্চার প্রাণখোলা হাসি চোখ এড়ালো না। চারিদিকে একটা উৎসব উৎসব আমেজ। সন্ধ্যে নামতেই মেলার সাজো সাজো রবটা আরও বেশি চোখে পড়লো। চারপাশে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ আলোর ঝলকানি। গমগম করছে চারপাশ। কোথাও কোনো ক্লান্তির ছাপ নেই। যেন এই সবে শুরু।
স্টলগুলোর শেষে কিছুদূর এগোতে চোখ পড়লো নাগরদোলায়। নাগরদোলা আছে মানেই আছে কচিকাঁচার নাগরদোলায় চড়বার আবদার। নাগরদোলা চড়বার কাউন্টারে রীতিমত বাবা-মায়ের ধাক্কাধাক্কি। চরকির মতো করে ঘুরছে নাগরদোলার ছোটো ছোটো কামরাগুলো। নাগরদোলারই নতুন এক সংস্করণ হচ্ছে নৌকাদোলা। নৌকাভর্তি মানুষ তোলার পর অনেক জোরে জোরে নৌকাকে দোলা দেওয়া হয়। এসময় বাজানো হয় কোনো না কোনো ট্রেন্ডিং গান। নৌকাতে চড়বার জন্যেও উৎসাহী মানুষের অন্ত নেই।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/02/img-20250131-wa0056.jpg)
দি অলিম্পিক সার্কাসের একটি দল ঢাকার নবাবগঞ্জ থেকে এসেছে মেলায়। দূর থেকে চোখে পড়লো তাদের পোস্টার আর বিশাল তাবু। ছেলে-বুড়োর কৌতূহলী ভিড় তাবুর চারপাশ ঘিরে। সার্কাস দলের নানান কারসাজি দেখে তাবুর ভেতর থেকে হাততালি পড়বার শব্দ স্পষ্ট হলো। তবু বেশি এগোনোর সাহস পেলাম না। ভিড় ঠেলে সার্কাস দেখার সুযোগ পাচ্ছেন যে শুধু চরম ধৈর্যের পরীক্ষা দেওয়া মানুষেরা– সে ব্যাপারেও সন্দেহ রইল না।
প্রতিবছর মধুমেলায় আসে পুতুল নাচের একটি বিশেষ দল। আঙ্গুলের হেলানিতে নাচতে থাকে পুতুল। লাল ওড়না জড়ানো কনে, মনিপুরি সাজ। যে পুতুল নাচ মনে করিয়ে দেয়, ছোটোবেলার পুতুল খেলার সাথী কিংবা পুতুলের বিয়ের খাবারের মেন্যুর কথা। এবছর কোনো কারণে পুতুল নাচের এই দলটি আসেনি। কিন্তু তাদের খোঁজ করতে দেখা গেল অনেক দর্শনার্থীকে। তবে ঐতিহ্যবাহী যাত্রাপালার ব্যবস্থা কিন্তু এবারো আছে।
রথ তো দেখলেন, তা সেই সাথে কলাবেচা হলে সেই সুযোগ কী কেউ ছাড়তে চায়? একেবারেই না। এজন্যেই মেলা ঘোরার আগে কিংবা পরে মধুপল্লী ঘুরে দেখেই ফেরেন অধিকাংশ দর্শনার্থীর দল।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/02/img-20250131-wa0030.jpg)
কী আছে মধুপল্লীতে?
কবি মধুসূদন দত্তের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে সরকারি উদ্যোগে তাঁর পৈতৃক বাড়িটি সংরক্ষণ করা হয়েছে। নাম দেওয়া হয়েছে 'মধুপল্লী'। ১৯৬৫ সালে ২৬ অক্টোবর তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাড়িটি পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে। মধুপল্লীর সীমানার মধ্যে রয়েছে সাবেকি আমলের নকশায় তৈরি কবির পৈতৃক কাছারি বাড়ি, বসত বাড়ি, কবির কাকার বাড়ি, নাটমন্দির আর বাঁধানো পুকুরঘাট। পাশাপাশি কবির জন্মস্থানটিকে সুন্দর করে বাঁধিয়ে সেটিকে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
এছাড়া কবির ব্যবহৃত আসবাবপত্র, কলের গানসহ মধুসূদনবিষয়ক বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য দলিল, চিঠিপত্র, পাণ্ডুলিপি, হাতে আঁকা ছবি রাখা হয়েছে মধুপল্লীর মিউজিয়ামে। নামমাত্র প্রবেশ মূল্য দিয়ে আপনি ঢুকতে পারবেন মধুপল্লীতে।
মধুপল্লীর ঠিক বিপরীত দিকে রাস্তার ওপারে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠেছে কবি খসরু পারভেজের সংগ্রহশালা– মধুসূদন মিউজিয়াম। যেটির কোনো প্রবেশমূল্য নেই। এখানেও কবির দুর্লভ কিছু ছবি, বই আর অনুলিপি দলিল রাখা আছে।
'সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে!
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;'
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/02/img-20250131-wa0055.jpg)
সুদূর ফ্রান্সে বসে কবি মনে করতেন যেই কপোতাক্ষ নদের কথা, সেই নদখানা না দেখলে আপনার যাত্রাখানা খানিকটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বছর দশ-পনেরো আগে কপোতাক্ষ নদের জল শুকিয়ে যায়। কিন্তু পুনরায় খননের পর এখন সে স্বচ্ছসলিলা আদিরূপ ফেরত পেয়েছে। মধুমেলা ঘুরতে এলে কিছুদূর হেঁটে কপোতাক্ষ নদ দেখে আসতে পারেন। চাইলে নৌকা কিংবা স্পিডবোটে করে ঘুরতেও পারেন কপোতাক্ষে।
মধুমেলার সময়জুড়ে প্রায় ৫-৭ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়। কবির বাড়ির সামনের রাস্তাজুড়ে থাকা চা-কফির দোকানগুলোতেও বেশ ভালো কেনাবেচা হয়। পাশাপাশি আয় বাড়ে কপোতাক্ষ নদের মাঝিদের, যারা সারাবছর বলতে গেলে বেকার বসে থাকেন। কবির জন্মদিন উপলক্ষে এই মাঝিদের পরিবারে হয়তোবা দু-দশদিনে একটা ভালো মাছ ওঠে। কিন্তু সবটাই যেন আয় সম্পর্কিত নয়। তাদের মধ্যেও ঝলকে ওঠে মধুমেলার খুশির আমেজ।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/02/img-20250131-wa0058.jpg)
সারাবছর সাগরদাঁড়িজুড়ে কম বেশি দর্শনার্থী লেগেই থাকে। তবে সেটা জানুয়ারি মাসে সবথেকে বাড়ে। কবির জন্মমাস জুড়ে মধুপল্লী হয়ে ওঠে প্রাণোচ্ছ্বল। ভিড়ে মুখরিত হয়ে যায় কবির বাড়ির আঙ্গিনা। কবির আবক্ষ মূর্তিতে ঝুলতে দেখা যায় তাজা ফুলের মালা।
কবি সাগরদাঁড়িতে জন্ম নিলেও পড়াশোনা থেকে শুরু করে নানান কাজে থেকেছেন কলকাতাসহ বিভিন্ন জায়গায়। কিন্তু তাঁর অনেক কবিতায় সাগরদাঁড়ির প্রতি ভালোবাসা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। তেমনিভাবে সাগরদাঁড়ির মানুষও কবির স্মৃতিকে আগলাতে চান পরম মমতায়। তাদের আন্তরিকতার ছাপ ধরা পড়ে যায় সবকিছুতে। কিছু না বলেও তাঁরা যেন বুঝিয়ে দেন, মধুসূদন আমাদের ছেলে, আমাদের গর্ব।
ছবি: অনুস্কা ব্যানার্জী/দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড