সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশ ভ্রমণে এত ভোগান্তি কেন?
সময়টা ২০১৯ এর জুলাই। আটলান্টিক মহাসাগরের একটি ছোট দ্বীপ দেশ কেপ ভার্দের বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন লাইনে অপেক্ষা করছিলেন মালিহা ফাইরুজ।
সারিতে থাকা লোকদের পাসপোর্ট চেক করতে আসা দুজন ইমিগ্রেশন অফিসার তখন কোনো কারণ ছাড়াই দুজন লাইবেরিয়ান পুরুষ এবং বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী ফাইরুজকে লাইন থেকে সরে যেতে বলে। 'নিরাপত্তা প্রোটোকলের' খাতিরে তাদেরকে সরে যেতে বলা হয়েছে বলে জানায় ঐ দুজন অফিসার।
কেপ ভার্দে ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত ডকুমেন্ট, ভিসা, বিমানবন্দর ট্যাক্স (অনলাইনে পরিশোধিত), দুটি ভিন্ন হোটেলে রিজার্ভেশন এবং দেশের বাইরে একটি ফ্লাইট টিকেট দেখানোর পরেও ফাইরুজকে ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হয়নি। এমনকি তিনি ইমিগ্রেশন অফিসারকে তার গোল গ্লোবাল সিয়েরা লিওনের কাজের আইডিও দেখিয়েছিলেন।
ফাইরুজ জানান, সেই অফিসার তার কথা শুনতে কোনো আগ্রহ দেখাননি। কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পর আটক তিনজনকে বলা হয়, তাদেরকে সেনেগালে ফেরত পাঠানো হবে।
এতে যে কেবল ফাইরুজের ভ্রমণ পরিকল্পনা ব্যহত হবে তা নয়, এতে করে একটি একক প্রবেশ ভিসা নিয়ে সেনেগালে আটকা পড়বেন তিনি। "এটি আমার সমস্যা নয়, এটি আপনার সমস্যা এবং যে এয়ারলাইন আপনাকে এখানে এনেছে তার সমস্যা এটি," বলা হয় তাকে। ফাইরুজ তাকে ইউরোপ পাঠানোর আবেদন করছিলেন।
তবে তিনি একা নন। এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে যেখানে বাংলাদেশি যাত্রীরা বিমানবন্দরে একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন। তাদের কাছে থাকা 'দুর্বল' পাসপোর্টের কারণে সকল প্রয়োজনীয় এবং বৈধ কাগজপত্র হাতে থাকা সত্ত্বেও হয়রানির কবলে পড়তে হয় তাদেরকে। বেশিরভাগ সময়ই 'নিরাপত্তা প্রোটোকল' হিসেবে চিহ্নিত করা হয় একে।
সাধারণত কয়টি দেশে ভিসা ছাড়া প্রবেশ করা যাবে তার ভিত্তিতে একটি পাসপোর্টের ক্ষমতা নির্ধারিত হয়। বার্ষিক হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্স ২০২১ অনুযায়ী, বাংলাদেশি পাসপোর্ট এ তালিকায় রয়েছে ১০৮তম স্থানে। ৪০টি দেশে ভিসা-মুক্ত ভ্রমণ করতে পারবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ধারীরা। তবে, কেপ ভার্দে দ্বীপপুঞ্জ পরিদর্শন করতে বাংলাদেশি পাসপোর্টের আগমন ভিসা প্রয়োজন; যা ফাইরুজ অনলাইনে অগ্রিম পরিশোধ করেছেন।
ফাইরুজকে সেদিন একটি হোল্ডিং সেলে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে তিনি ১৭ ঘন্টা কাটান। তার সাথে সেই সেলে আটক সকলেই ছিলেন আলাদা বর্ণের মানুষ।
"আমার ব্রিটিশ বন্ধুরা কিছু সময় পরেই কেপ ভার্দে ভ্রমণ করে। ইমিগ্রেশনের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় তারা কোনো ধরনের হয়রানি বা ঝামেলার সম্মুখীন হয়নি," বলেন ফাইরুজ।
পেশায় একজন সাহায্য কর্মী ফাইরুজ সম্প্রতি ক্যারিবিয়ান সফর শেষ করেছেন। বাংলাদেশি পাসপোর্টে এ পর্যন্ত ৯৩টি দেশ ভ্রমণ করেছেন তিনি। তার পুরো ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় তিনি ইমিগ্রেশন সেল, ২০১৬ সালে হলি আর্টিসান হামলার পরে ম্যাকাডোনিয়ায় নির্বাসন, শারীরিক এবং বিস্ফোরক পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছেন। ফাইরুজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সার্বিয়া ব্যতীত সমগ্র বলকান অঞ্চল এবং মালদ্বীপে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে কোনো হেনস্তার শিকার হননি তিনি।
"ভ্রমণ একটি বিশেষাধিকার খেলা," বলেন ফাইরুজ।
২০১৯-এ হোল্ডিং সেল থেকে তাকে বের করতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে ফাইরুজের মা কে। তিনি নিজে জাতিসংঘে কর্মরত হওয়ায় কেপ ভার্দের কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন তিনি। "যাদের আমার মতো একই সংস্থানগুলোতে অ্যাক্সেস নেই তাদের কী হবে?" প্রশ্ন রাখেন ফাইরুজ।
স্বাভাবিক সন্দেহভাজন?
হয়রানির শিকার বাংলাদেশিরা আরও লক্ষ্য করেন, যখন তাদেরকে লাইন থেকে আলাদা করা হয় তখন লাইনের সামনে পেছনে দাঁড়ানো অন্যান্যদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখা যায়নি।
বাংলাদেশি ঐশীন ঘুরনী, চার জন ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় বন্ধুকে নিয়ে যুক্তরাজ্য থেকে গ্রিসে যাচ্ছিলেন। ইমিগ্রেশন অতিক্রমের সময় একমাত্র তাকেই ভ্রমণের উদ্দেশ্য এবং সময়কাল জিজ্ঞেস করা হয়। "এটি একটি মাইক্রো অ্যাগ্রেশনের মতো," বলছিলেন তিনি।
কিছু লোক হয়তো বুঝতেও পারে না যে তাদেরকে কিছু অতিরিক্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে। ঘুরনী বলছিলেন, "ইমিগ্রেশন অফিসারদের কথা বলার ধরণে যে বিরক্তি আছে তা আপনি শুরু থেকেই বুঝতে পারবেন।"
একই কথা বলেন ফাইরুজও। তিনি বলেন, "অনেক বিমানবন্দরেই আমার সাথে এমনটি হয়েছে। তাদের কথার ধরণ দেখে মনে হয় যেন তারা বলছে, 'এখানে আসার বা ভ্রমণ করার সাহস কি করে হয়?'"
ঢাকার প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ঘুরনী এ পর্যন্ত ১৩টি দেশ ভ্রমণ করেছেন। শুধু বিদেশি বিমানবন্দর নয়, এমনকি বাংলাদেশি ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারাও তাকে ছাড় দেন না। "আমার একক ভ্রমণে আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল আমার স্বামী বা প্রেমিক আছে কিনা। আমি বাজি ধরে বলতে পারি যে তারা অন্য কোনো দেশের একজন নারী ভ্রমণকারীকে একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার সাহস করবে না।"
এছাড়া, বিশ্বের কিছু অংশে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশি পাসপোর্ট পুরোপুরি জানেন না। "আমার পাসপোর্টকে তারা একটি জাল পাসপোর্ট হিসেবেই বিবেচনা করে," বলেন তাসনিম ফেরদৌস। বর্তমানে কানাডার উইনিপেগে আর্কিটেকচারে মাস্টার্স করছেন তিনি।
"লাওস বিমানবন্দরে আমাকে প্রায় দুই ঘণ্টা আটকে রাখা হয়েছিল, কারণ তারা ভেবেছিল আমি সেখানে অবৈধভাবে গিয়েছি," বলেন তিনি। ভ্রমণকারীদেরকে তাদের পাসপোর্টের ভিত্তিতে স্টেরিওটাইপ এবং জাতিগত প্রোফাইলিংয়ের শিকার হওয়া উচিত নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ভালোবাসুন প্রতিবেশীকে
ইউরোপ ছাড়াও প্রতিবেশী ভারত ভ্রমণ করা অনেক বাংলাদেশি হয়রানির শিকার হয়েছেন। "আমি যখন ভারতে ছিলাম তখন একবার আমার ভ্রমণ ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। বহির্গমন পারমিটের জন্য আবেদন করার নিয়ম থাকলেও সেটি আমার জন্য খুবই উদ্বেগজনক সময় ছিল। আমি সেই দেশে আটকে যেতে চাইনি। শুধু ভিসা নিয়েই দেশে না ফেরার বিষয়টি বিস্ময়কর ছিল আমার কাছে। দুটি দেশ একে অপরের ঠিক পাশাপাশি," ঈশা রহমান।
অস্থায়ী পারমিটের জন্য আবেদন করতে একটি ইমিগ্রেশন অফিসে তিনি একই কারণে আটকে থাকা আরও বাংলাদেশি দেখতে পান। "আমার একজন মধ্যবয়সী লোকের কথা মনে আছে যিনি তার কাগজপত্র ভালোভাবে বুঝতে পারছিলেন না। আমি তাকে রাতে থাকার জন্য মসজিদে আশ্রয় নিতে বলেছিলাম।"
'পাসপোর্ট র্যাঙ্কিং' কীভাবে তৈরি হয়?
১৬ বছর আগে হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স নামক একটি ব্রিটিশ ফার্ম বার্ষিক হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্স তৈরি করে। ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন (আইএটিএ) থেকে তথ্য নিয়ে তালিকা প্রকাশ করে তারা। ১৯৯টি পাসপোর্ট এবং ২২৭টি ভ্রমণ গন্তব্যের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিষ্ঠানটি।
হেনলির গ্রুপ হেড অব পাবলিক রিলেশনস সারাহ নিকলিন একটি ইমেইলে বলেন, "আমরা রাজনৈতিক বক্তা নই, বরং বিনিয়োগ অভিবাসন উপদেষ্টা বিশেষজ্ঞ।"
তিনি বলেন, "পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ রয়েছে যাদের কূটনৈতিক সম্পর্কে নষ্ট হওয়ার কারণে নির্দিষ্ট দেশের নাগরিকদের তাদের সীমান্তে প্রবেশ বা তাদের নিজস্ব নাগরিকদেরকে অন্য দেশের সীমানায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।"
"কোনো দেশের সরকার পর্যটনের উপর যে ধরণের গুরুত্ব দেয়, সেটির মাধ্যমে ভিসা-নীতির সিদ্ধান্ত পরিবর্তীত হয়। মধ্যপ্রাচ্যে কাতার, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলো তাদের দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক কৌশলের অংশ হিসাবে পর্যটনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ফলে দেশগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ ভিসা নীতিতে অন্যান্য দেশের তুলনায় শিথিল নিয়ম-নীতি রাখবে," বলেন নিকলিন।
ট্যুরিজম ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টিডিএবি) উপদেষ্টা জামিউল আহমেদ বলেন, "আমাদের পর্যটন শিল্পের অবস্থা শোচনীয়।" টিডিএবি-তে ২০ বছর ধরে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করা আহমেদের মতে, পর্যটন শিল্পের ব্যবস্থাপনা এবং অবকাঠামোগত উন্নতির প্রয়োজন। কিন্তু এ বিষয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো কারণও নেই।
নিকলিন তার ইমেইলে আরও বলেন, "এ পর্যন্ত সূচকে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের। ২০১১ সালে যেখানে ৬৭ স্কোর নিয়ে দেশটির পাসপোর্ট ছিল ৬৫ নম্বরে। বর্তমানে ১৭৪ স্কোর নিয়ে তাদের পাসপোর্ট আছে ১৬ নম্বরে।"
হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্সে ২০০৬ সালে বাংলাদেশের র্যাঙ্কিং ছিল ৬৮। ২০২১ এ তা নেমে এসেছে ১০৮ নম্বরে।
স্বাভাবিকভাবেই বিদেশে পড়াশোনার জন্য জাতীয়তা নির্বিশেষে স্টাডি পারমিট বা ভিসা প্রয়োজন। তবে এটা অনুমান করা যেতে পারে যে, উত্তর আমেরিকান, অস্ট্রেলিয়ান বা ইউরোপীয়দের জন্য সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র ততটা জটিল নয় যতটা বাংলাদেশী পাসপোর্টধারীদের জন্য। "আমাকে আমার মাস্টার্স প্রোগ্রাম এবং বৃত্তির জন্য পুনরায় আবেদন করতে হয়েছিল," বলছিলেন ঈষা রহমান। বর্তমানে স্থাপত্যবিদ্যায় মাস্টার্সের জন্য নিউইয়র্কে অবস্থান করছেন তিনি।
এছাড়া, বাংলাদেশে অন্যান্য সকল দেশের দূতাবাসও নেই। ফলে, হাঙ্গেরিতে পড়তে যেতে চাইলে একজন বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীকে হাঙ্গেরির ছাত্র ভিসার জন্য আবেদন করতে সরাসরি ভারতে যেতে হবে।
এর বাইরেও, বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী যাত্রীদের মধ্যে বেশিরভাগ সময় দুর্ভোগের সম্মুখীন হন অভিবাসী শ্রমিকেরা। "তারা আমাদের সাথে অসম্মানের সাথে কথা বলে," বলেন দুবাইতে বসবাসরত রবিউল হাসান। দুবাইয়ে তিনি একজন ক্যাব ড্রাইভার হিসাবে কাজ করেন। "দুবাই থেকে ফিরে আসার সময় আমাকে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এমনকি ঢাকা বিমানবন্দরে একাধিকবার তল্লাশিও করা হয় আমাকে। এখন আমি অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি," বলেন হাসান।
বিদেশি পাসপোর্টে কি ভ্রমণ সহজ?
দ্বৈত নাগরিকত্ব ধারক সাদিন খান বলেন, "বিদেশি পাসপোর্টে ভ্রমণ অনেক সহজ। এতে ইমিগ্রেশন অফিসাররা কম প্রশ্ন করেন, এবং সহজেই প্রকৃয়াটি সম্পন্ন হয়।" পেশায় তিনি ফোর্ডের একজন প্রকৌশলী। তার পাসপোর্ট নাম আহমেদ খানের কারণে নাইন ইলেভেনের পরে বেশ কিছুটা সমস্যায় পড়েছিলেন তিনি।
বর্তমানে তিনি ভ্রমণের সময় কানাডিয়ান পাসপোর্ট ব্যবহার করেন। "এই পাসপোর্ট ব্যবহার করে আমি সহজেই সিঙ্গাপুরে আমার অসুস্থ বাবার কাছে যেতে পেরেছিলাম। বাংলাদশের পাসপোর্ট হলে আমাকে ভিসার জন্য অপেক্ষা করতে হতো।"
ঐশীন ঘূর্ণী বলেন, "আমি মনে করি এটি ত্বকের রঙ, জাতি এবং পাসপোর্ট ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। অবশ্যই বিদেশি পাসপোর্টের মাধ্যমে ভ্রমণ সহজ।"
"আমার গায়ের রঙ যত গাঢ় হবে, সাধারণভাবে ভ্রমণ করা ততই কঠিন হবে," বলেন ফাইরুজ।
- মূল ফিচার: The troubles of travelling with Bangladeshi passport
- ভাষান্তর: সাদিয়া আফরিন শায়লা