সর্বশেষ যাকে গিলোটিনে চড়ানো হয়েছিল
১৯৩৯ সালের ১৭ জুনের সকাল। ভার্সাই নগরীর সেন্ট-পিয়েরে কারাগারের দরজার সামনে ভিড় বাড়ছে। একাধিক অপহরণ ও খুনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়া সিরিয়াল কিলার ইউজেন ওয়েইডম্যানের মৃত্যুদন্ড দেখতে এসেছেন সবাই।
মধ্যরাতের পরপরই উৎসুক মানুষেরা কারাগারের দরজায় ভিড় বাড়াতে শুরু করেন। কেনোনা মৃত্যুদণ্ড সাধারণত সূর্যোদয়ের আগেই কার্যকর করা হয়; সেইসঙ্গে প্রথম সারিতে দাঁড়াতে পারলে ঘটনাটি ভালোভাবে দেখা যাবে। স্থির অন্ধকার আকাশ জুড়ে সূর্যের প্রথম রশ্মি যখন ফুটেছিল, ততক্ষণে মানুষের ভিড় পৌছে গেছে ছ'শোর ওপরে।
ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "মোবাইল গার্ডদের সঙ্গে ক্যাটক্যাল ও ঠাট্টা-বিদ্রুপ করার পাশাপাশি মাঝেমধ্যে উল্লাস ও শিস বাজানোর শব্দও ভেসে আসছিল ভিড়ের ভেতর থেকে।"
ভোর ৪ টার একটু পরে ওয়েইডম্যানকে কারাগার থেকে বের করে আনা হলো; চোখ দুটো ছিল শক্তভাবে বাঁধা, কপালের ভাঁজ আর বিমর্ষতায় গালগুলো ডুবে গিয়েছিল তার। হাত দুটোও বাঁধা ছিল পিঠের সঙ্গে।
ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন লিখেছে, "তার পাতলা নীল শার্টটি বুকের ওপর থেকে কেটে ফেলা হয়েছিল এবং মেশিনটির গাঢ় পালিশ করা কাঠের বিপরীতে তার কাঁধ আশ্চর্যজনকভাবে সাদা দেখাচ্ছিল; কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে মেশিনটির ওপরে ধাক্কা দেওয়া হলো। "
এর দশ সেকেন্ড পরেই তিনি মারা যান।
যারা এই ঘটনা সরাসরি দেখছিলেন, তাদের মধ্যে একজন হলেন অভিনেতা ক্রিস্টোফার লি। তিনি পরে ড্রাকুলার ভূমিকায় অভিনয় করে স্বীকৃতি লাভ করেন। লি তখন ১৭ বছর বয়সী তরুণ। তিনি তার পরিবারের এক সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে সেখানে গিয়েছিলেন। তার আত্মজীবনীতে তিনি, 'চিৎকারের তীক্ষ্ণ শক্তি'র কথা বর্ণনা করেছেন, যা রাস্তায় ওয়েইডম্যানের সেই উপস্থিতিকে স্বাগত জানিয়েছিল।
লি জানান, তিনি ওয়েইডম্যানের মৃত্যুদণ্ড দেখার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারেননি। ১৯৯৮ সালের একটি তথ্যচিত্রে তিনি বলেছিলেন, "আমি মাথা ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম, কিন্তু আমি আর্তনাদ শুনেছি।"
ওয়েইডম্যানের শিরচ্ছেদ করা মাথা ও শরীরের বাকি অংশ মাটিতে পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু দর্শক স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ফুটপাতে ছড়িয়ে থাকা রক্তে নিজেদের রুমাল ও স্কার্ফ ভিজানোর জন্য লাশের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন।
গিলোটিনটি দ্রুত ভেঙে ফেলা হয়েছিল; পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা হয়েছিল ফুটপাত। এরইসঙ্গে জনতার ভিড়ও ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তারা মাত্র যা দেখেছিল, তা নিয়ে হয়তো কয়েকজনের মাঝে আলোচনা দীর্ঘ হয়েছিল। তবে, বেশিরভাগই ফিরে গিয়েছিলেন জীবনের সেই পুরনো গতিপথে।
প্যারিসের কারাগারের কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্লেস লুই-বার্থোর একটি অ্যাপার্টমেন্টে বসানো হয়েছিল ফিল্ম ক্যামেরা। সেখানে ধারণকৃত ওয়েইডম্যানের মৃত্যুদণ্ডের ছবি পরের দিন সকালে ফ্রান্সের প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। রক্তপাতের দৃশ্য ও বর্বর জনতার উচ্ছৃঙ্খল আচরণ জনসাধারণকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল তখন। এতে সরকারও বিব্রত হয়েছিল।
ফ্রান্সে প্রকাশ্যে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডগুলোর মধ্যে ওয়েইডম্যানের মৃত্যুদণ্ডের সময় জনতার উল্লাস ও উচ্ছৃঙ্খল আচরণ এক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করে তুলেছিল। ১৯০৯ সালে যখন উত্তরের বেথুন শহরে চার দস্যুর একটি কুখ্যাত দলকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, তখনও হাজার হাজার মানুষ সেই মৃত্যুদণ্ড দেখার জন্য জড়ো হয়েছিলেন। তারা এসেছিলেন পুরো ফ্রান্স থেকে; এমনকি বেলজিয়াম ও জার্মানি থেকেও এসেছিলেন অনেকে। পুলিশের বিশেষ অনুমতিতে রাতভর সরাইখানা খোলা রাখা হয়েছিল। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ও অবিরাম বৃষ্টি সত্ত্বেও, বেথুন শহরে তখন বয়ে যাচ্ছিল 'ছুটির হাওয়া'।
জল্লাদ গিলোটিন একত্রিত করার সঙ্গে সঙ্গে উৎসুক জনতা কারাগারের প্রবেশদ্বারের পাশের বাগানগুলোতে ভিড় করতে লাগলেন। আরও ভালভাবে দেখার জন্য অনেকে তো গাছের মাথায়ই উঠে বসেছিলেন। সেখানে ধূমপান, মদ্যপান আর গান বাজনা চলছিল অবিরাম। শত শত অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য ভিড়কে খুব কষ্টে আটকে রেখেছিলেন। ভিড়ের ভেতর থেকে ভেসে আসছিল 'প্রতিশোধ' এবং 'মৃত্যু!' বলে তীব্র চিৎকার। গিলোটিনের ব্লেড নামার সঙ্গে সঙ্গেই তারা মেতে উঠেছিলেন উল্লাসে। জনতার লাগামহীন আবেগ ও ভুল কৌতূহল জনসাধারণকে করেছিল কলঙ্কিত।
১৯৩৯ সালের মৃত্যুদণ্ডটি কার্যকর করার পর সরকার প্রকাশ্য মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করে দেয় দেশে। আর এর মধ্যেমেই ওয়েইডম্যান হয়ে থাকলেন ফ্রান্সের শেষ অপরাধী, যাকে প্রকাশ্যে গিলোটিনে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তবে সরকার প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ডের সহিংস প্রথা বাতিল করলেও, 'গিলোটিনিং' পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো কারাগারের চার দেওয়ালের আড়ালে।
১৯৮১ সালে মৃত্যুদণ্ড বাতিল না হওয়া পর্যন্ত, গিলোটিন ফ্রান্সে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার সরকারি পদ্ধতি হিসেবেই স্বীকৃত ছিল। ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭ সালে ফ্রান্সের বন্দরনগরী মার্সেইতে নির্যাতনকারী ও খুনী হামিদা জান্দোবিকে ব্লেডের নীচে রেখে কার্যকর করা হয়েছিল সর্বশেষ গিলোটিনিং। জান্দোবির মৃত্যুদণ্ডটিই ছিল গিলোটিন ব্যবহার করে সরকারের নির্দেশে কার্যকর করা শেষ মৃত্যুদণ্ড।
সূত্র: অ্যামিউজিং প্ল্যানেট