সহকর্মীর সঙ্গে প্রেমের আগে যে বিষয়গুলো ভেবে দেখবেন
'দ্য অফিস'-এর জিম ও প্যাম, কিংবা 'ব্রুকলিন নাইন নাইন'-এর জেইক ও অ্যামি — জনপ্রিয় সিটকমগুলোতে বারবারই ঘুরেফিরে এসেছে অফিস রোমান্সের কাহিনি।
পর্দায় এই জুটিগুলোকে রোমান্স করতে দেখে দর্শকের হৃদয়ে এরকম রোমান্সের ইচ্ছা জেগে ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এমনকি অনেকের ক্ষেত্রে বাস্তবিকভাবেই এই ইচ্ছা সত্যি হয়ে যায়। কোনো এক সহকর্মীর সঙ্গেই হয়তো হয়ে যায় মনের মিলন।
এরকমই এক ভাগ্যবান ব্যক্তি বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি ডিরেক্টর রফিক আহমেদ। তিনি কাজ করছেন তার স্ত্রীর সঙ্গেই।
"আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে পরিচিত হয়েছি তিনি ব্যাংকে যোগ দেওয়ার আগেই। তবে এখন আমরা একসঙ্গে কাজ করি। আমি কী ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি তা বুঝতে পারে এমন কারো উপর নির্ভর করতে পারা সত্যিই দারুণ একটা ব্যাপার," রফিক বলেন।
অবশ্য তিনি এ কথাও বলেন যে, অফিস-রোমান্স অনেকটা দুধারি তলোয়ারের মতো। স্বাভাবিকভাবেই, একজন সহকর্মীর সঙ্গে প্রেম করার সুবিধা অসংখ্য। কিন্তু ব্যক্তিগত ও পেশাগত দিক দিয়ে কিছু ঝুঁকিও রয়েই যায়।
তাহলে অফিস-রোমান্সের সুবিধাগুলো কী কী? এর নেতিবাচক দিকই বা কোনগুলো? আর কীভাবে আপনি সামলাতে পারেন সেসব ঝামেলা? চলুন, এই লেখায় একে একে খুঁজি সকল প্রশ্নের উত্তর।
সহকর্মীর সঙ্গে প্রেমের সুবিধা
সত্যি বলতে, সুবিধা রয়েছে প্রচুর।
যখন কেউ প্রেমে পড়ে, বিশেষত শুরুর দিককার 'হানিমুন' ফেজটা, তখন সে যেন তার ভালোবাসার মানুষটিকে চোখে হারায়। সারাটাক্ষণ, প্রতিটা মুহূর্তই সে চায় তাকে দেখতে।
এমনকি যখন কেউ সম্পর্কের একটা স্থিতিশীল পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখনও চিরাচরিত ও একঘেয়ে কর্মক্ষেত্রে সঙ্গীর উপস্থিতি এনে দিতে পারে শান্তির সুবাতাস।
দিনটা খারাপ যাচ্ছে? চাইলেই একসাথে লাঞ্চ করতে করতে খানিকের আলাপে মন হালকা করে চাপমুক্ত হওয়া যেতে পারে। এ ব্যাপারে একমত রফিকও।
"যখনই আমি অফিসে সমস্যার সম্মুখীন হই, আমি সেগুলো নিয়ে আমার স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করি। সবকিছু আমার জন্য অনেক সহজ হয়ে যায় তখন," তিনি বলেন।
আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, সহকর্মীর সঙ্গে প্রেম হওয়ার মানে দু'জনের আগ্রহ, মূল্যবোধ ও জীবন নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষা সম্ভবত একই রকম।
অনেক নতুন সম্পর্কেরই অঙ্কুরেই বিনাশ ঘটে কেবল জীবনের প্রাধান্য বিষয়ক মতপার্থক্যের কারণে। সেক্ষেত্রে সহকর্মীর সঙ্গে প্রেম ভালো বোঝাপড়ার ভিত গড়ে দিতে পারে।
"বিয়ে হলো এক ধরনের সংস্কৃতির মেলবন্ধন। দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের ক্ষেত্রে মূল্যবোধই সবকিছু। মূল্যবোধে মিল না থাকলে সম্পর্ক টেকানো অনেক মুশকিল হয়ে পড়ে। সঙ্গীর সঙ্গে কাজ এক্ষেত্রে আপনাকে অনেক সাহায্য করবে," বলেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের নির্বাহী সম্পাদক শাহরিয়ার খান।
শাহরিয়ার যখন দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন, তখনই দেখা হয় তার স্ত্রীর সঙ্গে। অল্প সময়ের মধ্যেই তারা বন্ধু হয়ে যান, এবং শেষমেশ প্রেমে জড়ান। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে একসঙ্গেই রয়েছেন তারা।
তাছাড়া, একই সংস্থায় কাজ করার ফলে যানজট ঠেলে কাজে আসার বিরক্তিটাও অনেকটাই প্রশমিত হয়, কেননা দম্পতিরা অনেকসময় একসাথেই যাতায়াত করতে পারেন।
যেহেতু অফিসগুলোতে সাধারণত একই ধরনের কর্মঘণ্টা থাকে, তাই তারা ঘন ঘন ডেটে যাওয়ার কিংবা গেট টুগেদারের সুযোগও পেয়ে যান সহজেই।
কিন্তু সহকর্মীর সঙ্গে প্রেম মানেই জীবনের 'হ্যাপি এন্ডিং' নয়। বরং এর মাধ্যমে এক মহাবিপদও ডেকে আনতে পারেন আপনি। হুট করেই আপনি নিজেকে আবিষ্কার করতে পারেন প্রতি পদে পদে এক বুবি-ট্র্যাপে আটকা পড়ে থাকতে। একটি ভুল পদক্ষেপ মানেই হয় আপনার ক্যারিয়ারে অবনমন, অথবা সম্পর্কে চিড়।
কানাঘুঁষা, হিংসা ও বিতর্ক
আপনি এক সহকর্মীর সঙ্গে প্রেম করবেন মানেই যে বাকি সব সহকর্মীর সঙ্গেই আপনার মধুর সম্পর্ক হবে, তেমন ভাববেন না যেন। আপনার অনেক সহকর্মীকেই দেখতে পাবেন আপনাদের সম্পর্ক নিয়ে অহেতুক কানাঘুষা করতে। এমনকি কেউ চাইলে এইচআরের কাছে গিয়ে আপনাদের নামে অভিযোগও ঠুকে দিতে পারে।
শাহরিয়ারের জীবনেও এমন একটি অভিজ্ঞতা রয়েছে। "যখন অফিসের সিনিয়ররা আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে জানতে পারলেন, তারা বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি। কয়েকজন তো সম্পাদকের কাছেই অভিযোগ জানান।"
যখন বস তাকে ডাকেন, শাহরিয়ার তার সম্পর্কের ব্যাপারে অকপট থাকেন, সোজাসাপটা জবাব দেন। বাকিদেরও এক্ষেত্রে একই কাজ করার পরামর্শ দেন তিনি।
"সহকর্মীর সঙ্গে প্রেম করা কোনো ভুল কিছু নয়। এটা নিয়ে কোনো হইচইয়েরও মানে হয় না," তিনি যোগ করেন।
কীভাবে সংবাদটি জানাবেন সবাইকে?
অনেক প্রেমিক যুগলই তাদের সম্পর্কের ব্যাপারটি অফিসে কাউকে জানাবেন কি না- এ বিষয়ে মনস্থির করতে গিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। আর যদি জানানও, সেটি কীভাবে জানাবেন, বা এ ব্যাপারে অফিসের কোনো নির্দিষ্ট প্রটোকল রয়েছে কি না- তা নিয়ে শঙ্কিত থাকেন অনেকে।
একটি আদর্শ পৃথিবীতে, আপনি কার সঙ্গে প্রেম করছেন না করছেন সে কথা তো কাউকে জানানোরই প্রয়োজন নেই। অনেক ক্ষেত্রেই আপনি আপনার নিজের জীবনেও এ নীতি অনুসরণ করতে পারেন, এবং নির্ভয়ে নিজের দৈনন্দিন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারেন।
"আমার সহজ উপদেশ হবে, নিজের মতো থাকুন এবং আশা করুন সবকিছু ভালোই হবে," বলেন সাংবাদিক কামরুন নাহার চাঁদনী। সহকর্মী মাসুম বিল্লাহকে বিয়ে করেছেন তিনি।
কিন্তু এমন অনেক সময়ও আসবে যখন কেবল নিজের মতো থাকাই যথেষ্ট হবে না। অফিস-রোমান্স অনেকসময় যৌন হেনস্থা, স্বার্থের সংঘাত জাতীয় পরিস্থিতিতেও পৌঁছে যায়, যা কাজের পরিবেশকে ব্যাহত করে।
এইচআরদের ভূমিকার কথা জানতে চাইলে শাহরিয়ার খান বলেন, "যতক্ষণ পর্যন্ত আপনারা একটি পেশাদার আবহ বজায় রাখছেন, আমার মনে হয় না এইচআরদের অফিস-রোমান্স নিয়ে আপত্তি জানানোর কোনো যুক্তি আছে।"
তবে অনেক সংস্থার এইচআর বিভাগ থেকেই বলে দেওয়া হয়, কর্মীরা যদি নিজেদের মধ্যে রোমান্টিক সম্পর্কে জড়ায় সেটি যেন আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু কখন আর কীভাবে সেটি করবেন আপনি?
এক্ষেত্রে প্রথম কাজ হবে তাড়াহুড়ো না করে ধীরেসুস্থে এগোনো এবং বোঝার চেষ্টা করা যে আপনি আসলেই প্রেমে পড়েছেন কি না। সম্পর্কের ব্যাপারে আপনি কতটুকু সিরিয়াস, সেটিও ভাবতে হবে আপনাকে। যদি নিজেই দোটানায় থাকেন, তবে প্রেমের খবরটা রাষ্ট্র করা অনর্থক।
সবসময়ই ভালো হয় যদি আপনি আর আপনার সঙ্গী একসাথে বসেই চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেন আপনাদের প্রেমের ব্যাপারটি অন্যান্য সহকর্মী ও এইচআরকে জানাবেন কি না।
এমনও হতে পারে যে, প্রথমেই এইচআরের দোরগোড়ায় না গিয়ে খুব কাছের কারো কাছে খবরটি ফাঁস করতে চান আপনি।
আরও একটি ব্যাপার মাথায় রাখবেন যে, আপনাদের সম্পর্ক যদি কোনোদিন ভেঙেও যায়, সেটি যেন আপনাদের ক্যারিয়ার বা পেশাদার জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে।
আর এ কথা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না যে প্রকাশ্যে নিজেদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ যেন কখনোই সীমা না ছাড়ায়। হাজার হোক, এটি যে আপনার অফিস!
একই দলে কাজ করবেন না
সঙ্গীর সঙ্গে একই দলে কাজ করতে পারাটা হয়তো স্বপ্নের মতো মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হতে পারে একদমই ভিন্ন।
প্রথমত, একই দলে কাজ করার ফলে বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষভাবে কাজ বণ্টন ও মূল্যায়ন করা কঠিন হতে পারে, বিশেষত আপনাদের মধ্যে একজন যদি তত্ত্বাবধায়কের পদে থাকেন।
এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে স্বার্থের সংঘাতও মাথাচাড়া দিতে পড়ে, যা কর্মক্ষেত্রের পেশাদার পটভূমিতে বিশৃঙ্খলার জন্ম দেবে। এমনকি আপনি স্বচ্ছ ও বস্তুনিষ্ঠ থাকলেও আপনার অন্য সহকর্মীরা আপনাকে স্বজনপ্রীতির অপবাদ দিতে পারে।
এদিকে আপনি যদি নিজের আবেগ-অনুভূতির থেকে যুক্তি-বুদ্ধিকে আলাদা করতে না পারেন, তাহলে আপনার সঙ্গীর সঙ্গেও ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থেকে যায়।
"যদি আমি বস হই, তবে আমি হয়তো এমন কিছু বলে বসব যা আমার স্ত্রীর ভালো লাগবে না, সে সেটিকে সিরিয়াসলি নিয়ে নেবে। এ ধরনের ঘটনা দিনশেষে সম্পর্ককেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে," শাহরিয়ার বলেন।
তাছাড়া পরস্পরকে সারাক্ষণ দেখতে থাকাও সম্পর্কের জন্য হানিকর হতে পারে বলে যোগ করেন শাহরিয়ার। তার মতে, আপনার মনে হতে পারে এই সম্পর্কটাই আপনার যাবতীয় সময় ও শক্তিকে শুষে নিচ্ছে।
আর এই সবকিছুর উপরে, দুজনের একই সময়ে কাজ থেকে বের হওয়াও হয়তো ক্রমশ দুরূহ হয়ে পড়বে। তখন হয়তো লম্বা কোনো ছুটিতে যাওয়া বাদে আপনাদের আর একসঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগই হবে না।
"আপনার ছুটির প্রয়োজন, আপনি কোথাও গিয়ে ঘুরে আসতে চান- স্বাভাবিকভাবেই আপনি চাইবেন আপনার স্বামী বা স্ত্রীকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে। কিন্তু একই অফিসে? দুজন কর্মীর একই সময়ে ছুটি নেওয়া অনেক বড় একটি ব্যাপার," মাসুম বিল্লাহ বলেন।
ঘরে ফিরেও কাজের কথা?
সবশেষে, সকল দম্পতিই চায় কাজ ও ব্যক্তিগত জীবনকে না মেলাতে। এতে অনেক ধরনের সমস্যার উদ্রেক ঘটতে পারে। হয়তো আপনার সঙ্গী আপনার সঙ্গে যথাযথ তাল মেলাতে ও আপনার মনঃপুত প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারবে না, অথবা আপনিই ভুল বোঝাবুঝির শিকার হবেন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এইসব তিক্ততার পাহাড় জমে যাবে, যার ফলে এক পর্যায়ে দাম্পত্য সম্পর্কেও টানাপোড়েন দেখা দেবে।
আবার এমন অনেক দম্পতিও আছেন যারা হয়তো বাড়িতে ফিরে কাজের আলাপচারিতাকে উপভোগই করবে, এমনকি সহকর্মীদের নিয়ে গসিপও করবে। ব্যাপারটি তো আপনারা বনাম বাকি বিশ্ব, তাই না?
তবে যা-ই হোক, একই দলে না হলেও একই সংস্থায়ও যদি কোনো দম্পতি কাজ করে, তাহলেও কাজের সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনকে আলাদা করা তাদের জন্য দুষ্কর হয়ে পড়বে।
শাহরিয়ার বিশ্বাস করেন, সম্পর্কে ব্যক্তিগত পরিসর বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত যখন দম্পতিরা একই জায়গায় কাজ করেন।
তিনি বলেন, "অনিবার্যভাবেই, একসঙ্গে কাজ করা দম্পতিরা পেশাদার ও ব্যক্তিগত জীবনকে মিশিয়ে ফেলবে। তবে একটি সফল বৈবাহিক সম্পর্কে জরুরি বিষয় হলো নিজেদের জন্য সময় বের করা এবং নিজেদের ভালোবাসার কাজগুলো করা।"