মহাশূন্য থেকে পাঠানো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চাঞ্চল্যকর ছবি
দিন কয়েক আগেই মহাশূন্যে সবচেয়ে বড় টেলিস্কোপ পাঠিয়েছে নাসা। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপটি সৃষ্টির অসীমের সন্ধানে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে এমনটাই আশা বিজ্ঞানীদের।
তবে এই সুযোগে আগের প্রজন্মের টেলিস্কোপ সম্পর্কেও আলোচনা দরকার। তাদের অবদান জানলে বোঝা যাবে জেমস ওয়েবের বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে বিজ্ঞানীদের উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনার কারণ।
মহাজাগতিক অনুসন্ধানে যেমন পৃথিবীতে স্থাপিত টেলিস্কোপ ব্যবহার করা হয়, তেমনি প্রচলন আছে স্পেস বা মহাকাশে স্থাপিত টেলিস্কোপের। কারণ দ্বিতীয় পদ্ধতিতে আরও স্বচ্ছ ও বাধামুক্তভাবে ছবি তোলা যায়।
শুধু ছবি তুলেই অবশ্য বিজ্ঞানীদের কাজ শেষ হয় না। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ থাকে সেগুলো দৃশ্যায়নে। তাই অনেক সময় জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের ছবিগুলো টেলিস্কোপ সংগৃহীত তথ্যসূত্রের আলোকে চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে চিত্রায়িত করা হয়। মানুষের চোখে মহাশূন্যের আলো-আধারির খেলা কীভাবে তুলে ধরা যায়, তা চিত্রায়নে শৈল্পিক অনুভূতির আশ্রয় নেন মহাকাশ সংস্থার নিয়োগকৃত শিল্পীরা। এভাবেই অনেক সময় তৈরি হয় দূর কোনো ছায়াপথ, নীহারিকা বা গ্রহের ছবি।
সেই ৭০ এর দশকের শেষ থেকেই মহাশূন্যের দৃশ্যধারণে অগ্রগতি হয়েছে বিজ্ঞানের। গুটিকয়েক ছবির মাধ্যমে অসাধারণ সব আবিষ্কারের পুরো ইতিহাসও তুলে ধরা সহজ নয়। এজন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ অথচ খুব একটা বহুল প্রচারিত নয়- এমন কিছু ছবি তুলে ধরে মার্কিন গণমাধ্যম দ্য কনভারসেশন।
সেখানে ব্যক্তিগত পছন্দানুসারে নির্বাচিত পাঁচটি ছবি ব্যাখ্যা করেছেন ব্রিটিশ জ্যোতিঃপদার্থবিদ ক্যারোল অ্যান হ্যাসওয়েল।
১. বৃহস্পতির মেরু:
এই ছবিটি তুলেছে নাসার জুনো মিশন। এখনও সেই কৃত্রিম উপগ্রহ ঘুরছে গ্রহরাজ বৃহস্পতির কক্ষপথে। ২০১৭ সালে বৃহস্পতির মেঘমালার ১৮ হাজার ৯০৬ কিলোমিটার দূর থেকে এ ছবি তোলে মহাশূন্য যানটি।
এতে গ্রহটির উত্তর গোলার্ধের মেঘরাশি দেখা যায়। এটাই ছিল মানুষের দেখা প্রথম বৃহস্পতির উত্তর মেরুর ছবি। তাই এটি ইতিহাসও সৃষ্টি করে।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উপরিভাগ থেকে ঘূর্ণিঝড়ের মেঘমালাকে যেমন দেখায়, ঠিক তেমনই ঘূর্ণায়মান এক মেঘপ্রবাহ তুলে ধরেছে চিত্রটি। বিভিন্ন উচ্চতায় ভাসমান গ্যাসীয় মেঘরাশিতে বিদ্যুৎ ঝলকের মিশ্র প্রভাবও উঠে এসেছে। উপরের স্তরের মেঘ এখানে নিচের সারির উপর গভীর ছায়ার স্তর ফেলে এক আশ্চর্য মুগ্ধতার জন্ম দিয়েছে।
ক্যারোল বলেন, শৈল্পিক সৌন্দর্য এবং বিস্ময় সৃষ্টির জন্যই ছবিটিকে বাছাই করেছি। গ্রহটির নিরক্ষবৃত্তের যে চিত্র আমরা আগে দেখেছি- তার সঙ্গে উত্তর মেরুর কাছের অংশের দৃশ্য ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। মানবজাতির চিরচেনা এক গ্রহের ওপর নতুন আলোকপাত করেছে জুনো মিশন।
ঈগল নীহারিকা:
মানুষের দৃষ্টি ক্ষমতার বাইরেও রয়েছে আলোর অনেক রঙ। এই রঙগুলো ধারণে সংবেদনশীল টেলিস্কোপ তৈরি করে অনেক চমকপ্রদ তথ্য জানা সম্ভব হয় মহাকাশ বিজ্ঞানীদের। আমরা রঙধনুর যে বাহারি ছটা দেখি, বিজ্ঞানের ভাষায় তা বিদ্যুৎচুম্বকীয় ছটার রঙভাণ্ডারের ক্ষুদ্রতর এক অংশ।
যেমন আমাদের পরিচিত লাল রঙের চেয়েও লাল হলো- ইনফ্রারেড। চোখে দেখা আলোর চেয়ে এটি কম শক্তি ধারণ করে। আমাদের তৈরি ইনফ্রারেড ক্যামেরায় কোনো বস্তুকে উত্তপ্ত হতে বা উত্তাপ হারিয়ে শীতল হতে দেখা যায়। তবে মহাশূন্যে স্থাপিত এমন শক্তিশালী ক্যামেরা মহাজাগতিক ধুলোর স্তর ভেদ করে বহু আলোকবর্ষ দূরের তাপ নিঃসরণকারী বস্তুকে দেখতে পারে।
জেমস ওয়েব উৎক্ষেপণের আগপর্যন্ত সবচেয়ে বড় মহাকাশ টেলিস্কোপ ছিল ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সির হারশেল স্পেস অবজার্ভেটরি। ২০১৬ সালে হারশেল ঈগল নীহারিকার (নেবুলা) এ ছবি তোলে। নীহারিকাটির সাংকেতিক বৈজ্ঞানিক নাম এম-১৬।
নীহারিকা আসলে বিশাল পরিধি জুড়ে মহাজাগতিক গ্যাসীয় মেঘ। ঈগল নেবুলা পৃথিবী থেকে ৬ হাজার ৫০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবে এ দূরত্ব তেমন বড় কিছুই নয়। এই নীহারিকা অনেক নক্ষত্রের জন্ম দিয়েছে।
এর মধ্যভাগে ফোকাস করে একটি বিখ্যাত ছবি তুলেছে হারশেল স্পেস অবজার্ভেটরি, যার নাম দেওয়া হয়েছে 'পিলারস অব ক্রিয়েশন' বা 'সৃষ্টির স্তম্ভ'।
চিত্রটি দেখলে মনে হয় কেউ যেন বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনী সামান্য বাঁয়ে ঝুঁকিয়ে উপরদিকে নির্দেশ করছে। স্তম্ভগুলি আবার গ্যাসীয় অণুর এক বিশাল গহ্বরের দিকে উঠে গেছে। নীহারিকার বুকে জন্ম নেওয়া নতুন তারাগুলোর তাপপ্রবাহের বাতাসে ঝঞ্ঝামুখর থাকে সেই ফাঁকা স্থানটি।
ছায়াপথের কেন্দ্র:
আমাদের ছায়াপথটির নাম আকাশগঙ্গা । তারই কেন্দ্রের ছবি এটি। ইনফ্রারেড রশ্মি শনাক্তকারী ক্যামেরা এবং নাসার দুটি টেলিস্কোপ হাবল ও স্পিটজার এর তথ্যানুসারে ছবিটি তৈরি করা হয়েছে।
ছবির ডানপাশের নিচ দিকে যে উজ্জ্বল সাদা অংশ দেখা যাচ্ছে, সেটাই আকাশগঙ্গা ছায়াপথের একবারে কেন্দ্রস্থল। এখানে রয়েছে 'স্যাগিটারিয়াস এ' নামের বিশাল এক কৃষ্ণগহ্বর । আরও আছে আজ থেকে ১০ হাজার বছর আগে বিশাল এক তারা (সুপারনোভা) বিস্ফোরণের ধ্বংসাবশেষ ও একগুচ্ছ অন্যান্য নক্ষত্র।
অ্যাবেল- ৩৭০:
কৃষ্ণবস্তুর অদৃশ্য এক তারের জালে বাঁধা আমাদের মহাবিশ্ব। এর মধ্যে সবচেয়ে নাটকীয় সুন্দর ও দৃশ্যমান বস্তুসমষ্টি হলো ছায়াপথগুলোর গুচ্ছ। অদৃশ্য তারগুলোর পরস্পরছেদ অংশে যা দেখা যায়।
আইনস্টাইনের সূত্র অনুসারে, ভর মহাশূন্যকেও পরিবর্তন করে। তার সত্যতা আমরা খুব কাছের ছায়াপথগুচ্ছের দিকে তাকালেই বুঝতে পারব।
২০১৭ সালে অ্যাবেল-৩৭০ নামক ছায়াপথগুচ্ছের এমনই এক চাঞ্চল্যকর ছবি তোলে হাবল টেলিস্কোপ। ছবিতে ভরের অদৃশ্য বাঁধনে এতে মহাশূন্যের ওই অংশকে পেঁচিয়ে যেতে দেখা গিয়েছে।
অ্যাবেল-৩৭০ ছায়াপথেগুচ্ছ আছে শত শত ছায়াপথ। পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব পাঁচশ কোটি আলোকবর্ষ। এমনকি আলোর বক্ররেখাও হাবলের তোলা ছবিতে এত স্পষ্ট ছিল যে বিজ্ঞানীরা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন।
তারা চাক্ষুষ দেখলেন, কীভাবে অনেক বস্তুর গুচ্ছভারে মহাজাগতিক সময় ও আলোর বিকৃতি ঘটেছে। ফলে এক ধরনের প্রাকৃতিক আতসকাঁচ হয়ে উঠেছে মহাশূন্যের ওই স্থান, যা বহুদূরের ছায়াপথকেও দেখার সুবিধা করে দিচ্ছে।
ভরে বেঁকে যাওয়া মহাজাগতিক অবস্থা অপটিক্যাল লেন্সের মতো কাজ করায় একে বলা হয় গ্রাভিটেশনাল লেন্সিং।
হাবল আল্ট্রা ডিপ ফিল্ড:
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা একবার মহাশূন্যের অন্ধকার এক অংশের প্রতি হাবল টেলিস্কোপের লেন্স কিছুদিনের জন্য তাক করার সিদ্ধান্ত নেন। এতে অন্ধকারের বুক চিড়ে মহাবিশ্বের দূরতম কোনো অংশের সন্ধান মিলবে, এমন লক্ষ্যই ছিল তাদের। হাবল তাদের নিরাশ করেনি।
এরপর যে চিত্র মিলেছে তাকে তারা বলছেন 'হাবল আলট্রা ডিপ ফিল্ড'। এতে উঠে আসে প্রায় ১০ হাজারের কাছাকাছি মহাজাগতিক বস্তু। বেশিরভাগই ছিল অনেক দূরের ছায়াপথ।
মহাবিশ্বের বয়স যখন মাত্র ৫০ কোটি বছর তখন থেকে আরও অসীমের পানে ছুটে চলেছে ছায়াপথগুলি। তাদের নিঃসরিত আলো ১৩শ কোটি বছর ধরে মহাশূন্য পাড়ি দিচ্ছে।
অর্থাৎ, সৃষ্টির অন্যতম প্রাচীন ও মানুষের শনাক্ত সবচেয়ে দূরবর্তী মহাজাগতিক এসব বস্তু। ছবিতে অতি-প্রাচীন কিছু নক্ষত্রের আলো দেখা যাচ্ছে, যাদের প্রতিবেশী অন্য তারারা অনেক আগেই লুপ্ত হয়েছে।
আলোর মাধ্যমে এত বিপুল পরিমাণ তথ্য পাওয়ার কারণেই বিজ্ঞানীরা আমাদের মহাবিশ্বের ইতিহাস সম্পর্কে অনেক শূন্যস্থান পূরণ করতে পারেন। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ সর্বাধুনিক ইনফ্রারেড প্রযুক্তি সম্বলিত, যা আগামী প্রজন্মের মহাকাশ বিজ্ঞানীদের গবেষণায় রাখবে অমূল্য অবদান। জন্ম দেবে আমাদের ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে নতুন প্রশ্ন ও অনুসন্ধানের।
- সূত্র: স্ক্রোল ডটইন