দিল্লির লালকেল্লার মালিকানা দাবি করে আদালতে এক ‘মোগল সম্রাজ্ঞী’
কলকাতার উপকণ্ঠে হুগলির তীরে ফোরশোর রোড বস্তিতে গিয়ে 'মোগল সম্রাজ্ঞীর' কথা জিজ্ঞেস করলে ছোট ছোট বাচ্চাও বাড়িটি দেখিয়ে দিবে। কিন্তু মোগল সাম্রাজ্যের 'স্বীকৃত এই রানির' বাড়ি এসে তার দুরবস্থা দেখলে সম্ভবত ভেঙে যাবে মন।
নাতির সঙ্গে বস্তির দুই ঘর নিয়ে থাকেন ৬৮ বছর বয়সী সুলতানা বেগম। ঘরগুলো বস্তির অন্যান্য বাড়ির মতোই জীর্ণ। এই বয়সেও একা হাতে সব কাজ করেন সুলতানা। শুধু নামে নয়, মোগল সালতানাতের উত্তরাধিকারী হিসেবে স্বীকৃত মির্জা মোহাম্মদ বেদার বখতের স্ত্রী হিসেবে সত্যিকার অর্থেই তিনি যেন একজন সম্রাজ্ঞী।
সম্প্রতি দিল্লির মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের বাসস্থান রেডফোর্ট বা লালকেল্লার মালিকানার চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পিটিশন দায়ের করেন সুলতানা। পিটিশনে বলা হয়, দিল্লির সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের উত্তরসূরী হিসেবে বর্তমানে সুলতানা বেগম এই কেল্লার প্রকৃত স্বত্বাধিকারী এবং ভারত সরকার বেআইনিভাবে তার সম্পত্তি দখল করে রেখেছে।
সুলতানার পিটিশন খারিজ করে দিয়েছেন দিল্লি হাইকোর্ট। ১৫০ বছর অপেক্ষার পর কেন পিটিশন দায়ের হলো- এই প্রশ্নের 'যৌক্তিক ব্যাখ্যা' দিতে না পারায় গত ২০ ডিসেম্বর বিচারক রেখা পাল্লির বেঞ্চ এই রায় দেন।
তবে পিটিশন খারিজ হলেও তার উত্তরাধিকারের দাবি আসলেই বৈধ কি না, এ বিষয়ে কোনো রুল জারি করেননি আদালত। সুলতানাও তার অধিকার বুঝে নিতে আদেশের বিরুদ্ধে আদালতের উচ্চ বেঞ্চে আপিল আবেদনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
স্বীকৃতি থাকলেও নেই মর্যাদা
১৯৬০ সালে জওহরলাল নেহেরু প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বেদার বখতকে মোগল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের বংশধর হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ভারত সরকার। বেদার বখতের জন্য রাজনৈতিক ভাতা বরাদ্দ করা হয়।
সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ ও রানি জিনাত মহলের সন্তান মির্জা জাওয়ান বখত। তিনি ছিলেন সম্রাটের ১৫তম পুত্র। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সময় জাওয়ান বখতকে রক্ষা করেন তার মা জিনাত। জাওয়ান বখতের দ্বিতীয় সন্তান জামশেদ বখত। ধারণা করা হয় সেই জামশেদ বখতের সন্তানই বেদার বখত।
১৯৬৫ সালের ১৫ আগস্ট সুলতানার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন মুহাম্মদ বেদার বখত। ১৯৮০ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর সুলতানা বেগমের জন্যও রাজনৈতিক ভাতা বরাদ্দ করে তৎকালীন সরকার।
২০১০ সালে সুলতানা বেগমের রাজনৈতিক ভাতা মাসিক ৪০০ রুপি থেকে বাড়িয়ে ৬০০০ রুপি করা হয়।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে এএফপিকে সুলতানা বলেন, 'যে সম্রাট কিনা তাজমহল বানিয়েছেন তার বংশধররা এখন চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ছে এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?'
সুলতানার দাবি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মোগলদের সঙ্গে যে অন্যায় করেছিল তারই প্রতিকার চান তিনি।
লালকেল্লার ইতিহাস
সম্রাট শাহজাহান ১৬৩৮ সালে রেডফোর্ট বা লালকেল্লার নির্মাণকাজ শুরু করেন। ১৮৪৮ সালে শেষ হয় দুর্গের কাজ। লালকেল্লায় বসবাসকারী সর্বশেষ মোগল সম্রাট ছিলেন দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর।
১৮৩৭ সালে বাহাদুর শাহের রাজ্যাভিষেকের সময়ই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসায়ীদের আধিপত্যে মোগল সাম্রাজ্য ছিল ক্ষয়িষ্ণু।
এর দুই দশক পরই সংগঠিত হয় সিপাহি বিদ্রোহ। বর্তমানে এই বিদ্রোহকে ইতিহাসে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলা হয়ে থাকে। বিদ্রোহী সৈন্যরা বৃদ্ধ সম্রাটকে তাদের নতুন নেতৃত্ব হিসেবে ঘোষণা দেন।
তবে সম্রাট বাহাদুর শাহ যুদ্ধ-বিগ্রহের চেয়ে কবিতা লিখতেই বেশি ভালোবাসতেন। তিনি জানতেন বিশৃঙ্খল এই বিদ্রোহ দ্রুত ফুরিয়ে যাবে।
একমাসের ভেতর ব্রিটিশ সৈন্যরা দিল্লি ঘেরাও করে এবং কঠোরভাবে বিদ্রোহ দমন করে। রাজপরিবার আত্মসমর্পন করলেও বাহাদুর শাহের ১০ ছেলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
বৃদ্ধ সম্রাটকে গরুর গাড়িতে করে বার্মায় পাঠানো হয়। সেখানেই পাঁচ বছর অতিবাহিত করার পর নিঃস্ব অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন সম্রাট বাহাদুর শাহ।
এরপর লালকেল্লার কর্তৃত্ব সরাসরি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে যায়। কেল্লাকে ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। ভারতের স্বাধীনতার পর ২০০৩ সাল পর্যন্ত লালকেল্লা ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল।
সরকারের বিরুদ্ধে অবৈধ দখলের অভিযোগ
বিদ্রোহের পরের কয়েক বছরে লালকেল্লার বেশ কিছু ভবন ভেঙে ফেলা হয়। ২০ শতকের শুরুতে ঔপনিবেশিক সরকার ভবন মেরামতের নির্দেশ দেয়। তখন থেকেই লালকেল্লা ভারতে ব্রিটিশ শাসন বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীকে রূপান্তরিত হয়।
১৯৪৭ সালের আগস্টে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু স্বাধীনতার প্রথম দিন উপলক্ষে দুর্গের প্রধান ফটকে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এরপর থেকে প্রতিবছর ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রীরা লালকেল্লায় পতাকা উত্তোলনের পর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন।
লালকেল্লার মালিকানা চ্যালেঞ্জ করে প্রায় দেড়শ বছর পর পিটিশন দায়ের করেন সুলতানা বেগম। বেশ কয়টি সংগঠন এ সময় তার পাশে দাঁড়ায়।
সুলতানার দাবি ভারত সরকার অবৈধভাবে এই সম্পত্তি দখল করে রেখেছে। তবে হাইকোর্ট তার এই আবেদনকে 'সময় অপচয়' বলে অভিহিত করেছেন।
লালকেল্লার দাবি নাকচ আদালতের
পিটিশনে বলা হয়, বর্তমানে সুলতানা পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ায় এক বস্তি এলাকায় অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করেন। সুলতানা বেগম নিরক্ষর। ১৮৫৭ সালে কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া ছাড়াই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের পারিবারিক সম্পত্তি জোর করে দখলে নেয়।
তবে ১৫০ বছর পরে পিটিশন দায়ের করার কোনো 'যৌক্তিক ব্যাখ্যা' সুলতানা বেগমের নেই বলে মন্তব্য করেন হাইকোর্টের বিচারক রেখা পাল্লির বেঞ্চ।
বিচারক পাল্লি প্রশ্ন করেন, সুলতানা বেগম কিংবা বাহাদুর শাহ জাফরের অন্যান্য উত্তরসূরীরা কেন এতদিনেও এই প্রশ্ন তুলেনি। তিনি আরও বলেন, বাহাদুর শাহ জাফরের নির্বাসনের বিষয়টি সকলেই জানে।
'সেসময় কেন কিছু দায়ের করা হয়নি? যদি তার পূর্বসূরীরা এই কাজ না করে, তাহলে কি তিনি (সুলতানা) এখন এটা করতে পারেন," প্রশ্ন রাখেন আদালত।
সুলতানার আইনজীবী অ্যাডভোকেট বিবেক মোর যুক্তি দেখান সুলতানা নিরক্ষর হওয়ায় পিটিশন দায়েরে বিলম্বের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেন আদালত।
পিটিশন খারিজ হলেও আইনজীবী বিবেক মোর বলেছেন এই মামলা চলবে। দিল্লি হাইকোর্টের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে সুলতানা বেগম আদালতের উচ্চ বেঞ্চের সামনে আবেদন করবেন বলে এএফপিকে জানান তার আইনজীবী।
সুলতানা বেগম কী বলছেন
মাত্র ১৪ বছর বয়সে নিজের চেয়ে ৩২ বছরের বড় মির্জা মোহাম্মদ বেদার বখতের সঙ্গে বিয়ে হয় সুলতানার। বেদার দখত পেশায় একজন ভবিষ্যদ্বক্তা ছিলেন। বিধবা হওয়ার আগে থেকেই সুলতানা বেগমের জীবনযাত্রা ছিল অনিশ্চিত। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি বস্তিতে এসে থাকতে বাধ্য হন।
দারিদ্র্য, ভয় এবং অভাব অনটনই তার স্বামীকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দেয় বলে জানান সুলতানা।
এএফপিকে সাক্ষাৎকারে সুলতানা বেগম বলেন, 'আমি আশা করি সরকার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে। যার জিনিস, তাকেই সেটা ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।'
সুলতানা বেগম এখন তার এক নাতির সঙ্গে বস্তিতে থাকেন। প্রতিবেশিদের সঙ্গে রান্নাঘর ভাগাভাগি করে রান্না করেন তিনি। রাস্তায় উন্মুক্ত ট্যাপের পানি থেকে থালাবাসন ও কাপড় ধোয়ার কাজ করেন সুলতানা।
বেশ কয়েক বছর আগে তিনি ঘরের কাছেই একটি ছোট চায়ের দোকান চালাতেন। কিন্তু রাস্তা প্রশস্ত করতে সেই দোকান ভেঙে দেওয়া হয়। এখন ছয় হাজার টাকার ভাতাতেই পার হয় তার দিন।
তবে তিনি এখনও আশা করেন যে রাজ উত্তরাধিকারী হিসেবে একদিন তিনি যথাযথ সুযোগসুবিধা ও স্বীকৃতি পাবেন।
'আজ হোক, কাল হোক কিংবা ১০ বছর পরে, আমার ন্যায্য পাওনা আমি পাব। খোদার ইচ্ছা থাকলে ন্যায়বিচার হবে বলে আমি নিশ্চিত,' বলেন মোগল সালতানাতের এই বিস্মৃত 'সম্রাজ্ঞী'।
- সূত্র: এএফপি, দ্য হিন্দু ও টাইমস অব ইন্ডিয়া