আপনি জানেন কি আপনার শরীরের গন্ধ থেকে অন্যরা কী তথ্য পায়?
আমাদের দেহ প্রতিনিয়ত নানা তথ্য বিকিরণ করে। এসব তথ্য বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে গন্ধের মাধ্যমে। তবে আমরা কীভাবে একেক রকমের গন্ধ শনাক্ত করি, তা এখনও রহস্য।
আমাদের শরীরের গন্ধ তিন স্তরবিশিষ্ট। প্রতিটি স্তরের উৎপত্তিই ত্বকে। সবার ওপরের স্তরের গন্ধের উৎস ডিওডরেন্ট ও গোসল । মাঝের স্তরের গন্ধের উৎপত্তি খাদ্যাভ্যাস ও পরিবেশের মতো সাংস্কৃতিক উপাদান থেকে। ওপরের দুই স্তর—অর্থাৎ ঘাম, লোশনের নিচ থেকে আসে মানুষের সর্বশেষ স্তরের গন্ধ।
সবার নিচের স্তরের গন্ধ অনন্য—একজনের শরীরের এই স্তরের গন্ধের সঙ্গে আরেকজনের গন্ধের কোনো মিল নেই। ঠিক বুড়ো আঙুলের ছাপের মতো। আর সর্বনিম্ন স্তরের এই গন্ধ আমাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেয়।
এই নিজস্ব গন্ধ সৃষ্টি তৈরি হয় মূলত 'মেজর হিস্টোকমপিট্যাবিলিটি কমপ্লেক্স' বা এমএইচসি থেকে। গন্ধ গবেষক র্যাচেল হার্জ তার 'দ্য সেন্ট অভ ডিজায়ার' বইয়ে লিখেছেন, এমএইচসি জিন অত্যন্ত পরিবর্তনশীল।
শরীরের সর্বনিম্ন স্তরের গন্ধ আমাদের ব্যক্তিত্ব ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতার দৃঢ়তা সম্পর্কে ধারণা দেয়। ৫০টি এমএইচসি জিনের গুচ্ছ আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধের জিনোটাইপ গঠন করে। এই ফেনোটাইপ আমাদের শরীরের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নিজস্ব গন্ধ হিসেবে নিঃসৃত হয়। প্রত্যেক বাবা-মার এমএইচসি জিন সন্তানের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গঠনে অবদান রাখে।
কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির গন্ধ আমাদেরকে আকৃষ্ট করার মূল কারণ হলো তাদের এমএইচসি জিন এবং ওই জিনগুলো যে প্রতিরোধক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে, তা আমাদের থেকে আলাদা।
গন্ধের ভিত্তিতে সঙ্গী নির্বাচন একটি জটিল বিষয়। প্রজননের জন্য গন্ধের মাধ্যমে সঙ্গী বাছাই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও সমকামিতার ক্ষেত্রেও শরীরের গন্ধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
একটি গবেষণায় একজন সমকামী পুরুষকে কয়েকটি টি-শার্টের গন্ধ শুঁকতে দেওয়া হয়। দেখা যায়, ওই সমকামী ব্যক্তি আরেক সমকামী ব্যক্তির টি-শার্টই বেশি পছন্দ করছে। সমকামী নারীর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা দেখা গেছে।
আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, ৯০ শতাংশের বেশি মা তাদের সদ্যোজাত সন্তানকে ঠিক ঠিক গন্ধ শুঁকে চিনে নিতে পারছেন।
অর্থাৎ জন্ম থেকেই শরীরের গন্ধ দিয়ে আমাদের চেনা যায়। অসংখ্য গবেষণায় নিশ্চিত করা হয়েছে, মা ও শিশুরা সর্বপ্রথম শরীরের গন্ধের মাধ্যমেই নিজেদের চিনে নেয়। একটি গবেষণায় সদ্যোজাত শিশুদের নাকের কাছে দুটো প্যাড ধরা হয়। একটি প্যাডে তাদের মায়ের স্তনের গন্ধ মেশানো থাকে, অন্যটিতে মায়ের স্তনের গন্ধ থাকে না। দেখা গেছে, বেশিরভাগ শিশুই মায়ের স্তনের গন্ধযুক্ত প্যাডের দিকে মুখ ফিরিয়েছে।
মায়েরা অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে তাদের নবজাত সন্তানের গন্ধ চিনে নেন। এক গবেষণায় সদ্য মা হওয়া নারীদের তিনটি শিশুদের আন্ডারশার্ট শুঁকে নিজেদের সন্তানকে শনাক্ত করে নিতে বলা হয়েছিল। ওই মায়েরা প্রসবের পর মাত্র ১০ মিনিট সন্তানের সঙ্গে কাটানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু দেখা যায়, ৯০ শতাংশ মা-ই আন্ডারশার্টের গন্ধ শুঁকে ঠিক ঠিক নিজের সন্তানকে চিনে নিতে পেরেছেন।
তবে বাবাদেরও হতাশ হওয়ার কিছু নেই। গন্ধ চেনায় বাবারাও কিন্তু পিছিয়ে নেই। এক গবেষণায় ১৫ জন মা ও ১২ জন বাবাকে ভ্রুণীয় তরলের বোতল দিয়ে নিজ নিজ সন্তানের তরলওয়ালা বোতল চিনে নিতে বলেন। ১২ জন মা এবং ১২ জন বাবার মধ্যে ১১ জনই নিজ নিজ সন্তানের বোতল চিনতে পারেন।
গন্ধ কীভাবে কাজ করে?
গন্ধের অণু আমাদের নাকের অলফ্যাক্টরি এপিথেলিয়ামে গিয়ে ধাক্কা দেয়। সেখানে অলফ্যাক্টরি নিউরন ওই গন্ধকে শনাক্ত করে এবং নিউরনের অভ্যন্তরের রিসেপ্টর প্রোটিন এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। এই যুগল কীভাবে কাজ করে, তা এখনও অজানা। ধারণা করা হয়, গন্ধের অণুর আকার-আকৃতিই ঠিক করে দেয় কোন রিসেপ্টরের সঙ্গে যুক্ত হবে। অনেকটা তালায় চাবি ঢোকার মতো বাপার।
তবে মানবদেহে মাত্র ৪০০ ধরনের রিসেপ্টর রয়েছে। অন্যদিকে গন্ধ রয়েছে অসংখ্য ধরনের। কাজেই গন্ধ কীভাবে কাজ করে, এ ব্যাপারে যে আরও অনেক কিছু জানার আছে তা নিশ্চিত।
যাহোক, রিসেপ্টরের সঙ্গে গন্ধের অণু যুক্ত হলে রিসেপ্টর অলফ্যাক্টরি বাল্বকে সংকেত দেয়। অলফ্যাক্টরি বাল্ব সেই সংকেত পাঠিয়ে দেয় মস্তিষ্কের কর্টেক্সের অলফ্যাক্টরি কেন্দ্রে।
আমাদের শরীরের সবচেয়ে অভ্যন্তরের স্তরের গন্ধ আমাদের ব্যক্তিত্ব ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা দেয়। এই গন্ধের ওঠানামা বলে দিতে পারে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ছি কি না। এক গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের শরীরে লিপোপলিস্যাকারাইড প্রবেশ করানো হয়। এই বিষ শরীরে ত্বরিত ও শক্তিশালী প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তোলে। আরেকদল মানুষের শরীরে প্রবেশ করানো হয় লবণপানি। চার ঘণ্টা পর গবেষকরা দুই দলের টি-শার্ট নিয়ে এসে বগলের অংশ কাটেন। তারপর আরেকদল অংশগ্রহণকারীকে বলেন টি-শার্টের ওই অংশের গন্ধ শুঁকে টি-শার্টের মালিকদের সুস্থতা সম্পর্কে বলতে। অংশগ্রহণকারীরা জানান, বিষ-মেশানো ঘামের গন্ধ বেশি তীব্র, দুর্গন্ধও বেশি এবং উৎকট।
গন্ধ থেকে রোগ নির্ণয় সম্ভব
একজন প্রশিক্ষিত ডাক্তার (বা কুকুর) গন্ধ শুঁকে ম্যালেরিয়া, পার্কিনসন্স ডিজিজ, মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস, মেলানোমা এবং স্তন ও ফুসফুসের ক্যান্সার নির্ণয় করতে পারে। ২০২০ সালের নভেম্বরে এক ফরাসি-লেবানিজ টিম ১৮টি কুকুরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে করোনা শনাক্ত করতে শেখায়। বিমানবন্দরে ট্রায়াল দেওয়ার সময় দেখা যায় কুকুরগুলো করোনা নেগেটিভের ফল শতভাগ ১০০ শতাংশ এবং করোনা পজিটিভের ফল ৯২ শতাংশ নিখুঁতভাবে দিতে পারছে।
শরীরের গন্ধের সাহায্যে রোগ নির্ণয় অবশ্য নতুন বিষয় নয়। প্রাক্-আধুনিক যুগেও চিকিৎসকরা জানতেন টাইফাস জ্বরের রোগীর শরীর থেকে সদ্য-সেঁকা পাউরুটির গন্ধ আসে, যক্ষ্মা রোগীর শরীর থেকে বাসি বিয়ার এবং প্লেগ রোগীর শরীর থেকে আসে অতিরিক্ত পাকা আপেলের গন্ধ।
শরীরের গন্ধের পরিবর্তন আমাদের আবেগের তথ্য ফাঁস করে দেয়। এক গবেষণায় গবেষকরা পুরুষ ও নারীদের শরীর থেকে বিরক্তি বা ভীতি-জাগানিয়া সিনেমা দেখার সময়কার ঘাম সংগ্রহ করেন। দেখা যায়, ভয় বা বিরক্তির সিনেমা দেখার পর তাদের শরীর থেকে দুর্গন্ধযুক্ত ঘাম বের হয়েছে।
আনন্দেরও কিন্তু ঘ্রাণ আছে। অর্থাৎ আনন্দের ঘ্রাণও পাই আমরা। আরেক গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের গবেষকরা আনন্দের সিনেমা (দ্য জাঙ্গল বুক) অথবা 'দ্য শাইনিং'য়ের ভীতিকর কিছু ক্লিপ দেখান। তারপর তাদের ঘাম সংগ্রহ করে আরেকদল স্বেচ্ছাসেবককে শুঁকতে দেন। আনন্দের ছবি দেখা অংশগ্রহণকারীদের ঘাম শুঁকে স্বেচ্ছাসেবকরা স্বতঃস্ফূর্ত হাসি দেন। আর ভীতিকর ছবি দেখা অংশগ্রহণকারীদের ঘাম শুঁকে আঁতকে ওঠেন। ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, প্রেমিক-প্রেমিকারা পরস্পরের গন্ধ অনেক বেশি নিখুঁতভাবে চিনতে পারেন।
করোনা মহামারির বিধিনিষেধের পর অনেকদিন বাদে আমরা আবার বন্ধু-বান্ধব ও প্রিয়জনদের জড়িয়ে ধরার সুযোগ পাচ্ছি। তাদের গায়ের গন্ধ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছি। মনে রাখবেন, আপনি শুধু প্রিয়জনকে জড়িয়েই ধরছেন না, তাদের সম্পর্কে প্রচুর তথ্যও টেনে নিচ্ছেন নিশ্বাসের সঙ্গে। তাদের মেজাজের কী অবস্থা, কী খেয়েছেন, তাদের স্বাস্থ্যের কী অবস্থা—সবই জেনে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন তাদের গায়ের গন্ধ শুঁকে।
কাজেই প্রিয়জনদের বেশি বেশি জড়িয়ে ধরুন এবং তাদের সম্পর্কে আরও বেশি বেশি জানার চেষ্টা করেন। ও হ্যাঁ, ভালো কথা, প্রিয়জনকে জড়িয়ে ধরার আরেকটা উপকারিতা কিন্তু আছে। মনোবিদরা বলেন, প্রিয়জনদের জড়িয়ে ধরার এক আশ্চর্য 'নিরাময় ক্ষমতা' আছে। তাই প্রিয়জনদের মনখারাপ থাকলে গভীর ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরুন তাদের—দেখবেন মনখারাপ কেটে গিয়ে সূর্যমুখীর মতো ঝলমলিয়ে হেসে উঠছেন তারা। সঙ্গে নির্মল ভালোলাগায় ছেয়ে যাচ্ছে আপনার মনও।
- সূত্র: দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল