আলু পুরি, ডাল পুরির চেয়েও সেরা টিপু সুলতানের টাকি পুরি
পুরান ঢাকার টিপু সুলতান রোডের 'খাঁন হোটেল' যখন খুঁজে পাই, ঘড়িতে তখন চারটা বাজে। দোকানের বাইরে একজন দেদারসে পুরি বেলছে, আরেকজন ভেজে সেগুলো পাতে সাজিয়ে রাখছে। চুলাগুলোও খালি নেই। ফুটন্ত তেলে পরপর ভেজে তোলা হচ্ছে পেঁয়াজু, চিকেন চাপ, বেগুনি।
শুধুই কি ঝাল ঝাল মুখরোচক আইটেম! সাজিয়ে রাখা খাবারের মধ্যে চোখ কেড়ে নেবে মনভোলানো জিলাপিও।
৬০ বছর আগে মোহাম্মদ ঈসমাইল খাঁনের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় 'খাঁন হোটেল'। তার ছেলে মো. বিল্লাল হোসেন জানান, বাবার পর তিনিই ৪০ বছর ধরে সামলাচ্ছেন এই হোটেল। আগে কেবল ডাল পুরি, আলু পুরি, পেঁয়াজু, আলুর চপ বিক্রি হতো খাঁন হোটেলে। বিল্লাল হোসেন দোকানের হাল ধরার পর আইটেমে এলো ভিন্নতা।
তিনি গ্রাহকদের পরিচিত করালেন টাকি মাছের পুরির সঙ্গে। এই ভিন্নরকম পুরির সম্পর্কে জানতে চাইলে বিল্লাল হোসেন বলেন, বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে নয়, নিজে খাওয়ার জন্যই একদিন হুট করে বাড়িতে টাকি পুরি তৈরি করেন। টাকি পুরির স্বাদে মুগ্ধ হয়ে তখনই ভাবেন, দোকানে বিক্রি করলে কেমন হয়!
এভাবেই শুরু টাকি পুরির যাত্রা। কিন্তু বিক্রি শুরু হতেই এমন অভূতপূর্ব সাড়া পাবেন তা হয়তো নিজেও ভাবেননি বিল্লাল হোসেন। তিনি জানান, 'প্রথম দিন থেকেই টাকি পুরি গ্রাহকদের মন জয় করে নিয়েছে। এখন তো দূর-দূরান্ত থেকেও মানুষ ছুটে আসছে এই টাকি পুরির স্বাদ নিতে।'
তবে শীতে টাকি মাছ সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় বলে এই সময় পুরিতে মাছের পুরের পরিমাণও থাকে বেশি। শীতকালে নতুন কাঁচামরিচ, ধনে পাতা, কাঁচা পেঁয়াজ ইত্যাদির সংমিশ্রণে পুরির স্বাদ বেড়ে যায় বহুগুণ। এমনটাই বললেন বিল্লাল সাহেব।
পুরির জন্য মাছের পুর তৈরি হয়ে আসে বিল্লাল হোসেনের বাড়ি থেকেই। কাঁটা বাছার মতো সবচেয়ে কঠিন কাজটি করে থাকেন তার স্ত্রী। এত বছর যাবত তার স্ত্রী-ই অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে কাজটি করে আসছেন। বলতে গিয়ে বেশ গর্বের একটি হাসিই যেন ফুটে উঠলো বিল্লাল হোসেনের মুখে।
জানতে ইচ্ছে হল যেই টাকি পুরি খেতে এতদূর থেকে মানুষ আসছে, সেই টাকি পুরির গোপন রেসিপি। বিল্লাল হোসেন কোনো লুকোছুপি না করে গল্পের ছলেই রেসিপি দিয়ে দিলেন।
প্রথমে মাছগুলোকে সেদ্ধ করা হয়, তারপর ভাজা। এরপর কাঁটা আলাদা করে মাছের কিমা বা পুর বানানো হয়। সেই কিমা হোটেলে এনে মরিচ, আলু, ধনেপাতা, পেঁয়াজ প্রভৃতি মিলিয়ে গোল গোল মুচমচে পুরিতে রূপ দেওয়া হয়।
তবে টাকি পুরির খোঁজ করতে গিয়ে এখানে পেয়ে গেলাম অন্য আরেক পুরির সন্ধান। মুরগির পুর ভরে এই পুরি তৈরি করা হয়। বিল্লাল হোসেন জানালেন, মুরগির পুরি খেতে গ্রাহকদের ভিড় দেখা যায় মূলত রমজান মাসে।
যদিও টাকি পুরির সন্ধানেই সেখানে যাওয়া, কিন্তু গরম গরম পেঁয়াজু, চিকেন চাপ, বেগুনি দেখে মনে হবে টাকি পুরির মত এখানকার অন্য সব খাবারও বোধহয় ভিন্নধর্মী। যেভাবে চুলোগুলোতে ক্রমাগত ভাজাপোড়া চলছে তাতে সামান্য পিঁয়াজু, বেগুনির মতো আইটেমগুলোও আপনার জিভে জল এনে দেবে একথা হলফ করেই বলা যায়।
তাছাড়া পুরির সঙ্গে দেওয়া হয় মজার এক চাটনি। শর্ষেবাটা, কাঁচা মরিচ, ধনেপাতা আর টক দই দিয়ে বানানো চাটনি টাকি মাছের পুরির সঙ্গে মাখিয়ে খেতে হয়। বেশ যে লাগে, তা বোঝা গেল রেস্তোরাঁয় খেতে আসা মানুষজনের তৃপ্ত মুখ দেখে।
খাঁন হোটেলে দিনে প্রায় ২,৫০০ পুরি তৈরী হয় বলে জানালেন বিল্লাল হোসেন। টাকিপুরি, ডালপুরি, আলুপুরি আর চিকেন পুরি- এই চার ধরনের পুরি মিলবে। চিকেন আর টাকি পুরি বানাতে, দিনে ৪ কেজি করে মুরগি ও ৮ কেজির মতো টাকিমাছ দরকার হয়।
এত আয়োজন আর ভিন্নতা থাকলেও দাম কিন্তু আপনার হাতের নাগালেই। দারুণ মজার এ টাকিপুরির স্বাদ নিতে পারবেন মাত্র ১০ টাকাতেই। দাম অনুযায়ী যদি পুরির আকারের কথা বলতে হয়, তবে গ্রাহক হিসেবে যে আপনি ঠকবেন না একেবারেই তাও নিশ্চিত করে বলা যায়!
বিল্লাল হোসেনের সাথে কথা বলে জানা গেল, তার হোটেলের সব খাবারের দামই একেবারে হাতের নাগালে। পেঁয়াজু, ডাল পুরি, আলুর চপ, বেগুনি সবই পাঁচ টাকা করে। এছাড়াও এখানে চিকেন চাপ বিক্রি হয় ৮০ টাকায়। বিল্লাল হোসেনের দাবি, এতো কম দামে এমন সুস্বাদু চিকেন চাপ আর কোথাও মিলবেনা।
তিনি জানান, ব্যবসার মধ্য দিয়ে তিনি মানুষকে সেবা দিতে চান। এটি তার ব্যবসার প্রধান নীতিও বটে।
তার মতে, মানুষকে ঠকিয়ে কেউ প্রকৃত আনন্দ লাভ করতে পারে না।
"এই পুরি ১০ টাকার পরিবর্তে আমি যদি ১৫ টাকায় বিক্রি করি, তাহলেও কিন্তু বিক্রি হবে। কিন্তু সেটিকে তো আর ব্যবসা বলা যায় না। এখন আমার লাভ খুব সীমিত। কিন্তু যে পরিমাণ বিক্রি হয়, তাতে আমি ঠিক পুষিয়ে নেই," যোগ করেন বিল্লাল হোসেন।
স্থানীয় একজন ফল বিক্রেতার সঙ্গে আলাপ হলে তিনি বলেন, "এই হোটেল বেশ পুরোনো। হোটেলের আন্তরিকতা, খাবারের মান এবং দামে সাশ্রয়ী হওয়ায় অনেক ভিড় হয় এখানে।"
তবে মালিক বিল্লাল হোসেন পুরান ঢাকার স্থানীয় কেউ নন, তার বাড়ি চাঁদপুরে। ঢাকার বাইরে থেকে এসেও তিনি যেভাবে স্থানীয়দের ভালবাসা আর সম্মান পেয়েছেন, সেসবের পেছনে তার নিজের সততা এবং মানুষের সঙ্গে তার ভদ্র ব্যবহার ভূমিকা রেখেছে বলেই তিনি বিশ্বাস করেন।
খাঁন হোটেলের দুটি অংশ। একটিতে পাওয়া যায় পুরি আর ভাজাপোড়ার আইটেমসমূহ। অপরটি শুধু বসে খাওয়ার জায়গা। তাই এই হোটেলে এসে যদি বসে খেতে যান তবে আপনাকে একটু সামনে এগিয়ে দোকানের সামনে অংশে বসতে হবে।
সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে খাঁন হোটেল। তবে টাকি পুরি খেতে চাইলে যেতে হবে বিকেল ৪টা-৫টার দিকে। রাত ৮টার মধ্যে সব পুরির বিকিকিনি সম্পন্ন।
চাইলে এই হোটেল থেকে সকালের নাস্তাও করতে পারেন। নাস্তার আইটেমের মধ্যে রয়েছে চিকেন স্যুপ, মুরগির গিলা-কলিজা, মুরগি দিয়ে মুগডাল ভাজা, বুটের ডাল, হালুয়া ও বুন্দিয়া।
রয়েছে দুপুরে খাবারের আয়োজনও। ভাতের সাথে ১২ পদের ভর্তা, ৮ পদের মাছ, ৫ পদের সবজি আর ৪ পদের মাংস। চার ধরনের মাংসের কথা শুনে খানিকটা ভ্রু কুঁচকে উঠল। জানা গেল, গরু, মুরগি, খাসির পাশাপাশি হোটেলটিতে কোয়েল পাখির মাংসও মেলে।
আলু পুরি, ডাল পুরি, কিমা পুরি তো কম-বেশি সবাই খেয়েছে। ভিন্নধর্মী এই টাকি মাছের পুরি খেতে চাইলে সোজা চলে যান খাঁন হোটেলে। হোটেলের ঠিকানা- ১৫/১৪, টিপু সুলতান রোড, ওয়ারী, ঢাকা-১১০০।