সরাইলের গ্রে হাউন্ড কুকুরের কথা জানি, ‘ফাইটার’ মোরগের কথা কি জানি?
গ্রে হাউন্ড কুকুরের মতোই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার ঐতিহ্যের আরেক অবিচ্ছেদ্য অংশ হাসলি বা আঁচিল মোরগ। মোগল শাসনামল থেকেই এই মোরগ লালন-পালন হচ্ছে সরাইলে। অত্যন্ত জেদী স্বভাবের হাসলি মোরগের পা এবং গলা অন্যসব মোরগ-মুরগির চেয়ে অনেক বেশি লম্বা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর উঁচু দেহের এই মোরগকে বলা হয়ে থাকে যুদ্ধবাজ মোরগ।
মূলত লড়াইয়ের জন্যই শৌখিনরা এ মোরগ লালন-পালন করেন। গত এক দশকে হাসলি মোরগের লড়াইকারী দলের সংখ্যাও হয়েছে দ্বিগুণ। তবে শৌখিনতার পাশাপাশি কেউ কেউ এখন এ মোরগ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেও পালন করছেন।
জনশ্রুতি আছে, ১৬ শতাব্দীতে ইরান থেকে সরাইল পরগনার জমিদার পরিবার সর্বপ্রথম সরাইলে হাসলি মোরগ নিয়ে আসেন। তখন থেকেই হাসলি মোরগের লড়াই চলে আসছে সরাইলে। স্থানীয়ভাবে এটিকে আঁচিল মোরগও বলা হয়। বিভিন্ন উৎসব-পার্বনে সরাইলসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিভিন্ন স্থানে মোরগ লড়াই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
দ্য লাইভস্টোক কনসারভেন্সি নামে প্রাণিসম্পদ বিষয়ক একটি ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, মোরগযুদ্ধের জন্য ভারত ও পাকিস্তানে এই মোরগের জাত উন্নত করা হয়েছে নানা সময়ে। আঁচিল মোরগের অত্যন্ত পেশিবহুল দৈহিক গঠনের কারণে মোরগটি সবসময় সোজা থাকতে পারে। ক্ষ্রিপ্ত গতিসম্পন্ন হওয়ার কারণে দেখতে অনেকটা হালকা মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এই মোরগের বেশ ওজন রয়েছে। আঁচিলের ঠোঁটগুলো ছোট এবং বাঁকানো কিন্তু অত্যন্ত শক্ত। চওড়া মাথার খুলির সঙ্গে রয়েছে একজোড়া ক্ষ্রিপ্ত চোখ।
বাংলাদেশে আঁচিল নামে পরিচিত এই মোরগের ইংরেজি নাম Aseel। আরবিতে এই নামের অর্থ 'শুদ্ধ'। হিন্দিতে এর অর্থ 'উচ্চ বংশ, উচ্চ বর্ণ, খাঁটি এবং আসল।
মূলত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়টাতে মোরগ লড়াই বেশি জমে উঠে। ঢাকা ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাসলি মোরগ (পালনকারী) দল এসে লড়াইয়ে অংশ নেয়। আবার সরাইলের মোরগগুলোরও ডাক পড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে আয়েজিত লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার জন্য।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রায় একশ পরিবার হাসলি মোরগ লালন-পালনে নিয়োজিত। এর মধ্যে সিংহভাগই সরাইল উপজেলার। এদের মধ্যে শৌখিন মোরগ পালনকারীর সংখ্যাই বেশি। আর ১৫-২০টি পরিবার আছে, যারা লড়াইয়ের পাশাপাশি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে হাসলি মোরগ পালন করছে। বছরে ৪-৫টি মোরগ বিক্রি করতে পারে একেকটি পরিবার। ঢাকা-সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসে মানুষ এসে সরাইল থেকে এ মোরগ কিনে নিয়ে যান।
একেকটি হাসলি মোরগ ৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হয়। মূলত মোরগের বয়স, শারীরিক অবস্থা, দেহের আকার এবং লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করা হয়।
যে মোরগ লড়াইয়ে যত অভিজ্ঞ, সেটির দামও তত বেশি। একটি হাসলি মোরগের উচ্চতা ২৮-৩২ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। দেড় বছর বয়স থেকে লড়াই শুরুর পর সর্বোচ্চ ৪ বছর বয়স পর্যন্ত লড়াইয়ের সক্ষমতা থাকে একটি হাসলি মোরগের। এরপর সেগুলো প্রজননের কাজে ব্যবহার করা হয়।
হাসলি মোরগের দৈনন্দিন খাবার তালিকায় থাকে ধান, গম ও ভুট্টাসহ অন্যান্য স্বাভাবিক খাবার। তবে লড়াইয়ের কয়েক মাস আগে থেকে কবুতরের মাংস, কাজু বাদাম, কাঠবাদাম, কিসমিস ও সিদ্ধ ডিমসহ বিভিন্ন পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হয় শক্তি সঞ্চয়ের জন্য।
ঐতিহ্যের ধারক হাসলি মোরগের লড়াইকারী দল সংখ্যা গত এক দশকে দ্বিগুণ হয়েছে। বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা জুড়ে ৮-১০টি মোরগ দল রয়েছে। এর মধ্যে সরাইল উপজেলায় আছে ৪টি দল। ৭-৮ জন মোরগ পালনকারী মিলে একটি দল গঠন করেন। একেকটি দলে ১০-১৫টি মোরগ থাকে, যেগুলো লড়াই করতে পারে। তবে খেলায় একটি দল থেকে শুধুমাত্র ৭টি করে মোরগ অংশ নেয়। একটি মোরগকে দুই ঘণ্টা ২০ মিনিট পর্যন্ত লড়াই করতে হয়।
সরাইল উপজেলার কালিকচ্ছ ইউনিয়নের বাসিন্দা মোহাম্মদ মাসুদ জানান, হাসলি মোরগ সরাইলের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে। এই মোরগের লড়াই দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজন সরাইলে আসেন। এটি এখন মানুষের বিনোদনের খোরাক।
বংশ পরম্পরায় হাসলি মোরগ পালন করছেন সরাইল উপজেলার কুট্টাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মন মিয়া। লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি বছরে ৪-৫টি মোরগ বিক্রি করতে পারেন তিনি।
মন মিয়া বলেন, "আমরা তিনপুরুষ ধরে মোরগ পালন করছি। আমার কাছে এখন লড়াই করতে পারে- এমন ৪টি মোরগ আছে। লড়াই করতে সক্ষম মোরগগুলোর কদর অনেক বেশি। তবে আমার বার্ধক্যজনিত কারণে গত বছর থেকে মোরগগুলোকে আর লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করাচ্ছি না"।
সরাইল উপজেলার মোগলটুলা গ্রামের মো. ইধন আলী জানান, তিনি গত ১৫ বছর ধরে হাসলি মোরগ-মুরগি পালন করছেন। মিতালী হাসলি মোরগ উন্নয়ন সংস্থা নামে একটি দলের হয়ে মাঝে-মধ্যে লড়াইয়ে অংশ নেয় তার মোরগ। এখন তিনি বিক্রির উদ্দেশ্যে লালন-পালন করছেন এই জাতের মোরগ। বছরে ৪-৫টি মোরগ বিক্রি করতে পারেন তিনি। একেকটি মোরগ ১০-১২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। তবে আগে আরও বেশি সংখ্যক মোরগ বিক্রি করতে পারতেন বলে জানালেন তিনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের নিউ সোনার বাংলা আঁচিল ক্লাবের সভাপতি ইব্রাহিম শাহ জানান, হাসলি বা আঁচিল মোরগ সরাইল তথা পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্য। আগে শুধু সরাইলে থাকলেও এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিভিন্ন স্থানে হাসলি মোরগ লালন-পালন হয়। তবে ঐতিহ্যবাহী প্রজাতিটি যেন হারিয়ে না যায় সেজন্য সরকারি পদক্ষেপ প্রয়োজন।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফুল হক মৃদুল বলেন, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আঁচিল মোরগের একটি প্রদর্শনী খামার করা হয়েছে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রদর্শন এবং খামারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য সেই খামারে ৬টি মোরগ সংগ্রহ করা হয়েছে। এই মোরগের বৈজ্ঞানিক নাম এবং কীভাবে এটি এদেশে এসেছে- এসব বিষয় সাধারণ মানুষ যেন জানতে পারে সেজন্য বিলবোর্ড বসানো হয়েছে।
সম্প্রতি প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে তিনজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সরাইলে এসেছিলেন। তারা আঁচিল মোরগ পালনকারীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। আঁচিল মোরগের জিনোম সিকোয়েন্স সংরক্ষণ করতে পারলে বাংলাদেশ এর মূল জাত হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি অর্জন করতে পারবে। আর এটা নিয়ে তারা কাজও করছেন। উপজেলা প্রশাসন তাদেরকে সহযোগিতা দিচ্ছে বলেও জানান ইউএনও।