রাগী, জেদি, লড়াকু আসিল মোরগের জেতার লড়াই
মাঝারি একটি উঠানে একদল উৎসুক জনতা দাঁড়িয়ে আছে। উঠানে দাগ কাটা বৃত্তের মাঝে মুখোমুখি দুটি বিশাল আকৃতির মোরগ। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজনের ইশারা পেতেই পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো যুদ্ধংদেহী মোরগ দুটি। শুরু হলো তুমুল লড়াই। প্রায় দুই ফুট উচ্চতার মোরগটি তার মোটা দুটি পা দিয়ে প্রতিপক্ষ মোরগটিকে সজোরে আঘাত করছে। এসব মোরগের পায়ের পেছনের একটি নখ ভীষণ ধারালো আর সূচাল থাকে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে একটি মোরগ ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল, যেন লড়বার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ঐতিহ্যবাহী মোরগ লড়াইয়ের প্রচলিত দৃশ্য এটি।
আমাদের দেশে লড়াইয়ের জন্য প্রসিদ্ধ যেসব মোরগ, 'আসিল' তার মধ্যে অন্যতম। 'আসিল' শব্দের অর্থ আসল, খাঁটি ইত্যাদি। একে 'হাসলি', 'আচলি' ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়। মোরগ লড়াইয়ের সাথে আসিল মোরগের সম্পর্ক সেই প্রাচীনকাল থেকেই। আসিল মোরগ স্বভাবতই রাগী, জেদি, লড়াকু মনোভাবের হয়ে থাকে। অন্য জাতের মোরগের সাথে আসলি মোরগের পার্থক্য এখানেই। আমাদের দেশে ভারত থেকে এই মোরগ নিয়ে আসা হয়েছিল। জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের দেওয়ান বংশের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথম এই 'আসিল মোরগ' সরাইলে জনপ্রিয়তা পায়।
ভারত, আর্জেন্টিনা, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনসহ বিশ্বের অনেক দেশেই প্রচলিত আছে নিষ্ঠুর মোরগ লড়াই। একসময় গ্রামবাংলায় যত্রতত্র চোখে পড়ত মোরগ লড়াইয়ের আয়োজন। রাজধানী ঢাকাতেও এককালে হতো মোরগ লড়াই, এখনও হয়।
ঢাকার মধ্যে লালবাগ, মগবাজার, শনির আখড়াসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় অনেক আগে থেকেই ঐতিহ্যবাহী খেলাটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, বসিলায় 'বাংলাদেশ সৌখিন আসিল মোরগ উন্নয়ন সংস্থা' নামে একটি ক্লাব রয়েছে। বছরে কয়েকবার এই ক্লাব থেকেই 'মোরগ লড়াই'-এর আয়োজন করা হয়। ২৬ মার্চ, মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে মোরগ লড়াই অনুষ্ঠিত হয়। লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে 'বাংলাদেশ সৌখিন আসিল মোরগ উন্নয়ন সংস্থা' বনাম 'নিউ জালালাবাদ আসিল ক্লাব, সিলেট'।
আসিলের আসল লড়াই
দুই দলের মোরগের মধ্যে লড়াই দেখতে ভিড় জমিয়েছে স্থানীয়রা। খেলার মাঝে বিরতি থাকে ১০ মিনিট করে। লড়াইয়ের মাঠে একটি কোর্ট কাটা হয়েছে। কিছুটা ব্যাডমিন্টন কোর্টের মতো। মোরগ লড়াইয়ের কোর্ট দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ১২ ফুট হয়ে থাকে। কোর্টের দুইপাশে দুজন ব্যক্তি নিজেদের মোরগ হাতে দাঁড়িয়েছে। খেলার ফলাফল নির্ধারণের জন্য কোর্টের অদূরেই চার সদস্যের কমিটি আসন গ্রহণ করেছে। খেলার মধ্যে বিচারকার্যসহ যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার রাখে এই কমিটি।
লড়াই শুরু হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। প্রচলিত পদ্ধতিতেই লড়াই চলছে। লড়াইয়ের এক পর্যায়ে মোরগ দুটিকে বেশ আহত মনে হলো। তবুও প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছে। একেকবার সজোরে পা দিয়ে লাথি এবং একইসাথে ঠোঁট দিয়ে গলা চেপে ধরতে দেখা গেল। লড়াইটা এমনই। এসব যোদ্ধা মোরগের পায়ের পেছনের দিকের বড় নখকে 'কাটা' বলা হয়। তবে, খেলার নিয়ম অনুযায়ী এই নখ কিছুটা ছোট করে কেটে শক্ত কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে রাখা হয়। লড়াইয়ের মাঝের বিরতিতে মোরগের মাথা, গলা, ঘাড়ে ইত্যাদি জায়গা রক্তাক্ত হয়ে গেছে। এ পর্যায়ে মোরগটিকে আলতো করে চেপে ধরে একজন ব্যক্তিকে ঠোঁট দিয়ে ঐ স্থান চুষে দিতে দেখা গেল। বসিলা ক্লাবটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দ্বীন ইসলাম জানালেন মোরগটিকে বাঁচাতেই এমনটা করা হয়। লড়াইকালীন মোরগগুলো শক্তিশালী পা, আর ঠোঁট দিয়ে নানা জায়গায় আঘাত করে থাকে। এতে মোরগের শরীরের বিভিন্ন জায়গাতে বিশেষত, গলায় আর চোখের চারপাশে রক্ত বের হয় কিংবা জমাট বেঁধে যায়। আবার, বেশিক্ষণ এই জমাট রক্ত গলার মধ্যে থাকলে শ্বাসনালী বন্ধ হয়ে মোরগটির মৃত্যু হতে পারে। শরীরের এই অংশে ঠোঁট দিয়ে চুষলে ঐ রক্ত তাৎক্ষণিকভাবে মানুষটির মুখে চলে আসে। এর মাধ্যমে মোরগটিকে শারীরিকভাবে সুস্থ রাখা সম্ভব হয়। বর্তমান লড়াইয়ে কোনো মোরগের প্রাণহানির ঘটনার কথা জানা যায় না। তবে লড়াই যতক্ষণ স্থায়ী হবে, মোরগের আহত হবার সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে। আহত মোরগটিকে ঈষৎ উষ্ণ পানি দিয়ে শরীর মুছিয়ে দেয়া হয়, ক্ষেত্র বিশেষে মোরগটির শরীরে আলতো করে মালিশ করে দেয়া হয়। সঠিক যত্নের মাধ্যমে দ্রুতই মোরগটি সুস্থ হয়ে উঠে।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মোট সাতটি লড়াই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। উভয় দল কমপক্ষে নয়টি যোদ্ধা মোরগকে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত রাখে। সাতটি ম্যাচের জন্য সাতটি এবং লড়াইয়ের পূর্বে কোনো আহত মোরগের বদলী যোদ্ধা হিসাবে আরও দুটি মোরগ রাখা হয়। তবে, এদিন কোনো মোরগকে মারাত্মকভাবে আহত হতে হয়নি। জানতে পারি, জালালাবাদ ক্লাবটি চলতি মাসেই বেশ কিছু লড়াইতে অংশ নেয়। সেখানে ক্লাবটির বেশ কিছু মোরগ আহত হয়। সকাল নয়টা থেকে মাগরিবের আযান পর্যন্ত লড়াই চলে। এদিনের লড়াইয়ে 'বাংলাদেশ সৌখিন আসিল মোরগ উন্নয়ন সংস্থা'র একটি মোরগ শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে এবং ১-০ স্কোর করে জয় লাভ করে।
পরাজিত হওয়া জালালাবাদ ক্লাবের মোরগটি বেশ রক্তাক্ত হলে তা একসময় কোর্টের মধ্যে বসে পড়ে। মোরগটির মালিক জানান, "আমাদের মোরগটি যথেষ্ট সাহসিকতার সাথে লড়াই করেছে, তবে টানা কয়েকদিন লড়াই করাতে শেষদিকে এসে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তবে, খেলাতা শখের হওয়াতে আমরাও বেশ উপভোগ করেছি"। লড়াই দেখতে আসা জনাব আলী নিজেও শনির আখড়ার আসিল ক্লাবের সদস্য। তিনি বলেন," মোরগ লড়াই দেখা একটা নেশার মতো হয়ে গেছে। আমরা সকালে এসেছি এবং পুরো লড়াই দেখবো"।
পুরস্কার
মোরগ লড়াইয়ের ক্ষেত্রে পুরস্কার কি হতে পারে? এ সম্পর্কে দ্বীন ইসলাম বলেন, "ঐতিহ্যবাহী খেলা হিসাবে মোরগ লড়াই বেশ সমাদৃত। অন্যান্য প্রতিযোগীতার মতো এখানেও জয়-পরাজয় আছে। কিন্তু আমাদের এখানে পুরস্কার হিসাবে নামমাত্র একটা সম্মানী দেয়া হয়। আর্থিক মূল্য হিসাবে একে বিবেচনা করাটা উচিত হবে না। সাধারণত এক হাজার টাকা কিংবা গৃহস্থলীর তৈজসপত্র (গ্লাস, প্লেট ইত্যাদির সেট) পুরস্কার দেয়া হয়। তবে অংশগ্রহণকারী সকল পক্ষের জন্যই রয়েছে সান্ত্বনা পুরস্কার।"
খেলার নিয়ম
আয়োজক কমিটি থেকে জানা গেল, মোরগ লড়াইয়ে নিয়ম আছে বেশ কিছু, প্রায় ২৫-৩০ রকম। এসব নিয়ম একেক অঞ্চলে একেক রকম হতে পারে। তবে, জয়-পরাজয় নির্ধারনে কিছু অভিন্ন নিয়ম রয়েছে। যেমন, কোনো মোরগ যদি টানা ১ মিনিট মাটিতে বসে থাকে কিংবা প্রতিপক্ষ মোরগের আঘাতে নাস্তানাবুদ হয়ে দৌড়ে পালায়, তবে সে মোরগটি লড়াইয়ের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। সেক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। দীর্ঘক্ষণ এই লড়াই উপভোগ করেন দর্শকেরা। একেকটি লড়াই কমপক্ষে আধাঘণ্টা থেকে টানা কয়েক ঘন্টা স্থায়ী হতে পারে। অবশ্য, খেলার এই স্থায়িত্ব নির্ভর করে থাকে মোরগের প্রশিক্ষণ, মোরগটি কোন জাতের, এসবের উপর।
যোদ্ধা মোরগের প্রশিক্ষণ এবং খাবার
সৌখিন মোরগের খাবার এবং প্রশিক্ষণ—দুটোই হয় যত্নের সাথে। প্রতিটি মোরগের আলাদা করে যত্ন প্রয়োজন হয়। প্রশিক্ষণ চলে ক্লাবের মাঠেই। এজন্য মোরগটিকে দশ মিনিট থেকে শুরু করে টানা আধা ঘণ্টা পর্যন্ত লড়াই করানো হয়। এসময় অত্যান্ত সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করে মোরগটির শক্তিশালী এবং দূর্বল দিকগুলো চিহ্নিত করা যায়। প্রশিক্ষণকালীন মোরগগুলোকে স্বাভাবিক খাবারই খাওয়ানো হয়। পারাং জাতের ধান, ছোলা, বিভিন্ন বাদাম, গম, ভুট্টার গুড়া ইত্যাদি মোরগের নিয়মিত খাবার তালিকায় থাকে। কিন্তু লড়াইয়ের তিন মাস আগে থেকে মোরগের প্রতি বিশেষ যত্ন নিতে হয়। এসময় উচ্চ ক্যালরির আমিষ জাতীয় খাবার দেয়া হয়। তালিকায় থাকে ডিম, মাছ, মাংসের মতো খাদ্য। প্রশিক্ষণ এবং লড়াইয়ের সময় মোরগগুলোর শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য দশ মিনিট অন্তর পানি দিয়ে শরীর মুছে দেয়া হয়। কেউ কেউ তার মোরগের জন্য ট্রেডমিলও ব্যবহার করেন। এতে করে মোরগের লড়াই করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
শখের মোরগ
লড়াকু মোরগ আর সাধারণ মোরগে বিস্তর তফাত। লড়াকু মোরগ বাচ্চা অবস্থায় চেনার তেমন উপায় নেই। অনেকের মতে সরাইলের আসিল জাতের মোরগ লড়াকু প্রকৃতিরই হয়ে থাকে। কিন্তু ক্লাবের সদস্য মো. নাসের বিন জামালের মতে এমন ধারণা সত্য নয়। কেননা প্রশিক্ষণ চলাকালীন বোঝা যাবে কোনটি যোদ্ধা মোরগ। কেউ কেউ বাচ্চা মোরগ কিনে আনেন, এসব মোরগের দাম সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা হতে পারে।
তবে আকারে বড় মোরগের দাম মূলত নির্ধারিত হয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। অর্থাৎ, একটি মোরগ তার জীবদ্দশায় কতবার লড়াইতে অংশ নিয়েছে- তার উপর ভিত্তি করে মোরগটির মুল্য নির্ধারিত হয়। এক্ষেত্রে মোরগের দাম লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেলেও তা অবাক হবার কিছু নেই। কারণ কথায় আছে 'শখের তোলা আশি টাকা'।
বর্তমানে যারা মোরগ লড়াইয়ের সাথে যুক্ত তারা সকলেই শখের বশেই এই মোরগ পালন করেন। মো. নাসের বলেন, "দাম এবং মোরগের ওজনের প্রসঙ্গ আসলে অনেকেই মনঃক্ষুণ্ণ হন। সাধারণত, দাম নির্ধারিত হয় ওজনের উপর ভিত্তি করে, আর মোরগের মাংস খাওয়ার উদ্দেশ্যেই বিক্রি করা হয়। আমরা যেহেতু শখের বশে এই মোরগ পালন করি, এটি বিক্রি করার প্রশ্নই আসেনা। একেকটি মোরগ যত্ন সাপেক্ষে ৮-১০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। তবে, কোনো মোরগ আহত হয়ে গেলে আমরা সেগুলো নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দিই"। এই মোরগ পালনে বছরে মোটা অংকের টাকার প্রয়োজন হয়। সে তুলনায় কোনো প্রতিযোগীতায় বিজয়ী হলেও এই খরচের সিকিভাগও উঠে আসেনা। এজন্যই একে সৌখিন মোরগ বলা হয়।
ক্লাব হিসাবে 'বাংলাদেশ সৌখিন আসিল মোরগ উন্নয়ন সংস্থা'র যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৭ সালে। তবে তারও বহুকাল আগে থেকেই এই ক্লাবের পূর্ববর্তী সদস্যরা মোরগ লড়াইয়ের আয়োজন করতেন। ক্লাবটি আগে কারওয়ান বাজারে ছিল। স্থান সংকুলান না হওয়ায় ক্লাবটি বসিলাতে স্থানান্তর করা হয়। ক্লাবের বর্তমান ৩০ জন সদস্যের মোরগ আছে প্রায় ২০০টি। সদস্যদের সবাই-ই প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। শখের বশেই পালন করেন বিভিন্ন জাতের মোরগ। মোরগ লড়াই উপলক্ষ্যে রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে থাকা সদস্যর একত্রিত হন। এমনকি কেউ আসেন আমেরিকা, ইতালি এবং জাপান থেকে। সবাই-ই মোরগপ্রেমী। এদের মধ্যে কেউ তাদের পূর্বপুরুষদের অনুসরণ করে পালন করে আসছেন এই আসিল মোরগ। আমাদের দেশে গ্রামীণ লোকজ খেলা হিসাবে বিভিন্ন খেলার প্রচলন ছিল। কাবাডি, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগ লড়াই ইত্যাদি খেলাগুলো তখন গ্রাম-গঞ্জে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। সাধারণত চৈত্রের ফসল কাটার ক্লান্তি এবং নতুন ফসল ঘরে ওঠানোর আনন্দে এসব খেলাধুলা একটি ভিন্নমাত্রা যোগ করত। মুরুব্বিদের কাছে প্রায়ই যে হারানো ঐতিহ্যের ফিরিস্তি শোনা যায়, এই মোরগ লড়াই ছিল সেই ঐতিহ্যেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মো. নাসেরের মতো অন্যদের এসব শৌখিন মোরগ পালনকারীদের মাধ্যমে আমাদের ঐতিহ্যবাহী খেলাটি এখনো টিকে আছে সগৌরবে।