৫০ টাকায় ভাসমান আবাসিক হোটেল!
আব্দুল মজিদ ভুঁইয়া, বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে। ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে মৌসুমী ফল বিক্রি করেন। দৈনিক আয়ের একটা অংশ তিনবেলা খাওয়া খরচেই শেষ হয়ে যায়। গ্রামে তার স্ত্রী দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে থাকেন। তাদেরকেও টাকা পাঠাতে হয়। ঢাকা শহরে থাকার জন্য খরচের কথা কমবেশি সকলেরই জানা আছে। ঢাকাবাসী মধ্যবিত্তদের প্রতিদিনের গল্পের আসরে বাসা ভাড়া নিয়ে উৎকণ্ঠার কথা প্রায়ই শোনা যায়। সেখানে, আব্দুল মজিদ ভূঁইয়ার মতো নিম্ন আয়ের মানুষেরা কোথায় থাকেন? কেমন তাদের জীবন ব্যবস্থা?
বাংলাদেশের কোথায় সবচেয়ে কম মূল্যে আবাসিক থাকা যায়? ঢাকায়? এ কথা শুনে যে কারোর কপাল-ই কুঁচকে যাবে। হ্যাঁ, ঢাকাতেই মাত্র ৫০ টাকায় আপনি হোটেল সুবিধায় থাকতে পারবেন। বলছি ঢাকার সদরঘাটের ভাসমান হোটেলের কথা। এই ভাসমান হোটেলগুলো আপনাকে কোনো তারকা হোটেলের সুবিধা দেবেনা। তবে, ব্যয়বহুল ঢাকা শহরে কম টাকায় আপনাকে থাকার ব্যবস্থা করে দেবে ঠিকই।
অবস্থান
সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের অদূরে মিটফোর্ড হাসপাতালের বিপরীতে ভাসমান হোটেলগুলোর অবস্থান। পূর্বের অবস্থান ছিল সদরঘাটের ওয়াইজঘাটে। বাবুবাজার ব্রিজের নিচের দিকে তাকালেই বাড়ি সাদৃশ্য পাঁচটি লঞ্চ দেখা যায়। লঞ্চগুলো পুরাতন এবং জীর্ণ। পাঁচটি লঞ্চের মাত্র দুটিতে নাম লেখা আছে। 'ফরিদপুর মুসলিম হোটেল' আর 'শরিয়তপুর মুসলিম হোটেল'। বাকীগুলোর নাম নেই। শরিয়তপুর মুসলিম হোটেলটি এখানকার সবচেয়ে পুরাতন লঞ্চ। আকারে বড় হোটেলটির নাম জানা গেল 'উমা উজালা'। দেখলে মনে হবে এটি অপেক্ষাকৃত নতুন। আসলে, এটি পুরাতন হোটেলগুলোর একটি। কিছুদিন হলো সংস্কার করা হয়েছে। পূর্বে এটিই একমাত্র হিন্দু হোটেল বলে পরিচিত ছিল। হোটেলগুলোর সারিতে একপ্রকার মৃতপ্রায় একটি হোটেল দেখা যাবে। নামহীন এই হোটেলের ভেতর প্রবেশ করে জানতে পারি এটির নাম ছিল 'বুড়িগঙ্গা'। লঞ্চগুলোর পাশে একেবারে ছোট আরেকটি টঙ সাদৃশ্য হোটেল দেখা যায়। দেখে মনে হবে এটিই বুঝি দুনিয়ার সবচাইতে ছোট আকৃতির ভাসমান হোটেল।
ফরিদপুর মুসলিম হোটেলের ভারপ্রাপ্ত ম্যানেজার মো. হাবিবুর রহমানের সাথে কথা বলে লঞ্চগুলো সম্পর্কে বেশ চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যায়। তিনি একইসাথে এই হোটেলে ভাড়া থাকেন এবং মূল মালিকের অনুপস্থিতিতে হয়ে যান ম্যানেজার। বেশ সারল্যতা নিয়ে ভাসমান হোটেল নিয়ে এর উপযোগীতার কথা বললেন। তার মতে, ফল ব্যবসায়ী মজিদ ভূঁইয়াসহ আরো অনেকের অস্থায়ী বাসস্থান সদরঘটের ভাসমান হোটেলগুলো। ফল ব্যবসায়ী ছাড়াও এখানে হকার, মজদুর, ট্রাক ড্রাইভার, বাসের হেলপার, সর্বোপরি নিম্ম আয়ের বহু মানুষ থাকেন। ইদানীং, মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের অনেক আত্নীয়রাও এখানে থাকতে আসেন। হাবিবুর রহমান এই ভাসমান হোটেলে আছেন বহুবছর। পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করলেন তিনি। পটুয়াখালীবাসী হাবিবুর রহমানের ঢাকায় কোনো আত্মীয়ের বাসা ছিল না। আরেক ব্যবসায়ী মারফত জানতে পারলেন সদরঘাটের ভাসমান হোটেলগুলো সম্পর্কে। এরপর কেটে গেছে বহুবছর। এখানেই নিয়মিত থাকেন এখন। ফরিদপুর মুসলিম হোটেলের বর্তমান মালিক মো. মোস্তফা। তার পূর্বপুরুষেরা ব্রিটিশ আমলেই সদরঘাটে ভাসমান হোটেল ব্যবসা শুরু করেন। বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, ১৯৭৫ সালে বিআইডব্লিউটিএ থেকে অনুমোদন নিয়েই এই হোটেল ব্যবসা চালু আছে। নিয়মিত পরিশোধ করেন ইজারার টাকাও।
হোটেল ভাড়া
ভাসমান এই হোটেলগুলো প্রায় প্রতিটিই দোতালা। উপর নিচে মিলিয়ে প্রতিটি হোটেলেই পঞ্চাশটি ছোট ছোট কক্ষ রয়েছে। তিন শ্রেণির কক্ষ সুবিধা বিশিষ্ট হোটেলের প্রথমটি ঢালাই বিছানা। এটি অনেকটা গণরুমের মতোই। কোনোরকম তোশক বা বিছানা বিহীন কাঠের পাটাতনের উপর করা হয় এই বিছানা। লঞ্চের একটি ঢালাই বিছানায় পাচজন মানুষ থাকতে পারেন। ঢালাই বিছানায় থাকতে হলে আপনার নিজের বিছানাপত্র নিয়ে থাকতে হবে। ঢালাই বিছানার মূল্য মাত্র ৫০ টাকা। অর্থাৎ মাত্র ৫০ টাকা থাকলেই আপনি সদরঘাটে এক রাত থাকতে পারবেন।
লঞ্চে সিংগেল কেবিনই বেশি। তবে রয়েছে ডাবল কেবিনও। এসব কবিনের আকার দৈর্ঘ্যে ৫ ফুট আর প্রস্থে মাত্র ৩ ফুট। ডাবল কেবিন প্রস্থে কিছুটা বড়। সিংগেল কেবিনের মূল্য ১০০ টাকা। আর ডাবল কেবিনে থাকতে হলে আপনাকে গুনতে হবে দৈনিক ১৫০ টাকা। কেবিনগুলোতে হোটেল কর্তৃপক্ষ থেকে বিছানার চাদর, বালিশ আর শীতকালে কম্বল দেয়া হয়।
অন্যান্য সুবিধা
হোটেলের নিরাপত্তা নিয়ে তেমন কোনো শঙ্কা দেখা গেল না বোর্ডারদের মধ্যে। হোটেলের নিয়মিত বোর্ডার নাজমুল বললেন, এখানে সবাই আমরা একরকম পরিচিত। তাছাড়া হোটেলে থাকার আগে সবার পরিচয়পত্র নিশ্চিত করেই এখানে থাকতে দেওয়া হয়। এজন্য, চুরি হবার ভয় নেই। আগে পাঁচটি হোটেলেই খাবারের ব্যবস্থা ছিল। তবে, তা প্রায় নব্বই দশকেরও আগের কথা। খাবার পানি, খাবার ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি প্রতিকূলে থাকায় এখন হোটেলগুলোতে শুধু থাকার ব্যবস্থা আছে। বোর্ডারগণ সদরঘাটের অন্যান্য খাবার হোটেলে নাস্তা সারেন। সরাসরি বিদ্যুৎ সুবিধাই আছে হোটেলগুলোতে। প্রতিটি হোটেলেরই আলাদা মিটার রয়েছে। সিংগেল বা ডাবল কেবিনগুলোতে সিলিং ফ্যান এবং মোবাইল চার্জের ব্যবস্থা করা রয়েছে। তবে, সুবিধাজনক পয়ঃব্যবস্থার জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই। সাধারণ লঞ্চের মতোই এসব হোটেলের পিছনদিকে ছোট একটি টয়লেটের ব্যবস্থা করা। বোর্ডারগণ সাধারণত নদীর পানিতেই গোসল করেন। লঞ্চে যাতায়াতের জন্য একটি লম্বা কাঠের পাটাতন আছে। লঞ্চগুলোতে কোনো ইঞ্জিন নেই। একঘাট থেকে অন্যত্র স্থানান্তরের প্রয়োজনে ইঞ্জিনচালিত ট্রলার ব্যবহার করা হয়। তবে, ঝড়-বৃষ্টিতে হোটেলগুলোকে তীরের সাথে শক্ত করে বেঁধে রাখাই যেন একমাত্র ভরসা।
ঢাকায় ভাসমান হোটেলের ইতিহাস বেশ পুরোনো। নদী বিধৌত ঢাকায় বহু নবাবেরা শাসন করেছেন। ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজ অফিসারগণ এসেছেন। তৎকালে আজকের মতো এতো হোটেল বা মেস ছিল না। মুঘল সেনাপতি সুবাদার ইসলাম খাঁ প্রথমবারের মতো ঢাকায় আসলেন। জানা যায়, তখন তাঁর থাকার জন্য তেমন কোনো বন্দোবস্ত ছিল না। তিনি থাকতেন তাঁর বিশাল এক বজরা নৌকাতে। তাঁর বজরার নামানুসারে সেই ঘাটের নামও হয়েছিল 'চাঁদনীঘাট'। ব্রিটিশ আমলেও অনেক অফিসারেরা ঢাকায় এসে এসব ভাসমান হোটেলে থাকতেন। মাঝে মধ্যে পরিবার নিয়ে রীতিমতো নৌকা বিলাস করতেন তারা। এসব ক্ষেত্রে স্থানীয় জমিদারদের বড় নৌকা ভাড়া করতে হতো। আজকের দিনে গাড়ি থাকাটা একরকম সামাজিক অবস্থার নির্দেশক। তৎকালে জমিদারগণও এসব নৌকার মালিকানাকে নিজেদের আভিজাত্যের প্রতীক হিসাবে দেখতেন। অবশ্য তখনকার বুড়িগঙ্গা আর আজকের বুড়িগঙ্গার মধ্যে বিস্তর ফারাক। এখন বুড়িগঙ্গার নাম শুনলেই আমরা নাক সিটকাই। তবে, তখনকার সময়ে সরকারি কর্মকর্তাগণ এখানে থাকতেন। থাকার জায়গা থাকলেও অনেকেই স্রেফ হাওয়া পরিবর্তনের জন্য এখানে আসতেন। অর্থাৎ, বুড়িগঙ্গার পানি বা আবহাওয়া দুই-ই স্বাস্থ্যকর ছিল।
বর্তমানে সারাদেশেই আধুনিক সুবিধার হোটেল নির্মিত হচ্ছে। আগে হোটেলগুলোর মূল উদ্দশ্য ছিল কোনো ক্লান্ত পথিকের রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করে দেয়া। এখন অবশ্য হোটেলগুলো নানা উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। সদরঘাটের ভাসমান হোটেলগুলো নিম্ম আয়ের মানুষদের থাকার ব্যবস্থা করে যেন পুরাতন উদ্দেশ্যই পূরণ করে যাচ্ছে।