পালসিট রেলওয়ে স্টেশন: এখানেই ক্যামেরাবন্দি করা হয় অপু-দুর্গার কালজয়ী সেই ট্রেন দেখার দৃশ্য
সত্যজিৎ রায়ের 'পথের পাঁচালী' যারা দেখেছেন, তাদের সবার মানসপটেই গেঁথে আছে একটি দৃশ্য। সাদাকালো পটভূমিকায় ধাতব রেলপথ সুদূরে মিলিয়ে গেছে। বাতাসে উড়ছে সাদা কাশফুল। তার মধ্য দিয়ে মোহাবিষ্ট অপু আর দুর্গা ছুটে বেড়াচ্ছে। দূরে শোনা যাচ্ছে ট্রেনের হুইসেল…। ঝমঝম শব্দে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে এগিয়ে আসছে ট্রেন...।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী ও তার পরের উপন্যাস অপরাজিতকে কেন্দ্র করে সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করেন 'পথের পাঁচালী', 'অপরাজিত' এবং 'অপুর সংসার'। বাংলা চলচ্চিত্রে এই তিনটি একত্রে 'অপু ট্রিলজি' হিসেবে পরিচিত।
'পথের পাঁচালী'র হাত ধরেই দক্ষিণ এশীয় চলচ্চিত্র প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক মনোযোগ টানতে সক্ষম হয়। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের তালিকায় জায়গা করে নেয় অপু-দুর্গা আর তাদের নিশ্চিন্দিপুরের গল্প।
অস্কারজয়ী হলিউড পরিচালক মার্টিন স্করসেজি একাধিক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন তার অন্যতম প্রিয় পরিচালকের নাম সত্যজিৎ রায়। সত্যজিতের 'অপু ট্রিলজি' দেখে যে ছবি তৈরির নানান খুঁটিনাটি বিষয় তিনি শিখেছেন, তা স্বীকার করতেও এতটুকুও কুণ্ঠাবোধ করেননি এই পরিচালক।
১৯৫৫ সালে মুক্তি পায় 'পথের পাঁচালী'। তবে অপু-দুর্গার আইকনিক দৃশ্যটি ধারণ করা হয়েছিল তারও তিন বছর আগে, ১৯৫২ সালের ২৬ অক্টোবর। সে মুহূর্তের যারা সাক্ষী হয়েছিলেন, তারা আজও দিনটির কথা অত্যন্ত গর্বভরে স্মরণ করে।
মুক্তি পেতেই অপু-দুর্গা-হরিহর-সর্বজয়া-ইন্দির ঠাকরুণ সেলুলয়েডের পর্দা থেকে যেন হয়ে ওঠেন আমাদের একান্ত। ভাইবোন অপু ও দুর্গার মধ্যে ভীষণ ভাব। দারিদ্র্যতা নিত্য সঙ্গী ছিল, তবু তারা স্বপ্ন দেখতো। ঝোপের আড়ালে-আবডালে কোথায় কী পাওয়া যায় সব জানা ছিল দুরন্ত দুর্গার। বনজঙ্গল খুঁজে সে সংগ্রহ করে আনত- আম, জাম, নারকেল, পাতালকোঁড়, ছাতু, মাকাল ফল, কামরাঙা। তার খেলনার বাক্স থাকত প্রকৃতির দানে পরিপূর্ণ- শুকনো নাটা ফল, খাপরার কুচিতে। দিদি দুর্গার হাত ধরেই প্রকৃতির সাথে পরিচয় হয় অপুর। দিদির মুখে শুনত কত গল্প!
অপু-দুর্গা এর আগে কখনও ট্রেন দেখেনি; ক্ষেতের পাশে গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে কুউউউউ ঝিকঝিক শব্দ তুলে কীভাবে ট্রেন চলে তাই নিয়ে দুই ভাইবোনের সে কী আগ্রহ! তাদের কথোপকথন চলে এভাবে-
অপু : দিদি তুই রেলগাড়ি দেখেছিস?
দুর্গা : হুম
অপু : তুই রেলের রাস্তা কোথায় জানিস?
দুর্গা : হুম
অপু : কোথায় রে ?
দুর্গা : ঐ তো সোনাডাঙার মাঠ তারপর ধানখেত তারপর রেলের রাস্তা।
অপু : একদিন যাবি?
এখনো যেন আমরা চোখ বুজলেই দেখতে পাই দুর্গা আর অপু- দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ে ছুটে চলেছে ট্রেন ধরার জন্য। ৬৯ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে অবস্থিত পালসিট স্টেশনের কাছে সে মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করা হয়েছিল। অথচ বিভূতিভূষণ এবং সত্যজিৎ রায়ের মত দুই দিকপালের সৃষ্টি এবং মাঝে পড়ে থাকা এই স্টেশনকে আজও স্মরণ করেন সেখানকার মানুষেরা।
শুধু তাই নয়, প্রতিবছর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিনে এই স্টেশনের কাছে গিয়ে উদযাপনে মেতে ওঠেন স্থানীয়রা। এখানে এসে স্মরণ করেন সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিনও। পালসিটে সেই কালজয়ী দৃশ্য ধারণের কাজ যারা কাছ থেকে দেখেছিলেন, তারা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মেলে ধরেন স্মৃতির ঝাঁপি; যেন ফিরে যান নিজেদের শৈশবে, অবিস্মরণীয় সেই দৃশ্যের কাছে।
হাওড়া থেকে ৯১.৬ কিলোমিটার দূরে, ভারতের রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের আওতাধীন এই পালসিট স্টেশন প্রথম থেকেই ছবির মত সুন্দর আর মনোরম ছিল। ২০২০ সালে স্টেশনটির সংস্কারকাজ সম্পন্ন হয়। ধীরে ধীরে বসার জায়গা, প্ল্যাটফর্ম শেড, ওয়েটিং রুম, ফুট ওভারব্রিজ, পানীয় জল ও নতুন প্ল্যাটফর্মসহ নানা পরিষেবা যুক্ত হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ স্টেশনে রূপ নেয় পালসিট।
এখন পালসিটে ট্রেনের সংখ্যা অনেক। আপ-ডাউন মিলিয়ে প্রতিদিন মোট ৫০টি লোকাল ট্রেনে যাত্রীদের ওঠানামা চলতেই থাকে।
স্টেশনের এই কোলাহল যেন চারপাশকে প্রাণবন্ত করে, প্রকৃতিতে উৎফুল্লতা এনে দেয়। তবে জায়গাটি সবচেয়ে বেশি সুন্দর হয়ে ওঠে পড়ন্ত বিকেলের সময়টুকুতে। সে সময় স্টেশনের বেঞ্চে বসে প্রকৃতির নির্মলতায় চাইলে একদম অলস একটি বিকেল কাটানো সম্ভব। নিষ্পাপ প্রকৃতিই আপনাকে তখন দেবে দু'হাত ভর্তি ভালোবাসা। শহুরে জীবনে কোথায় মেলে প্রকৃতির রঙবদলের এমন মুহূর্ত উপভোগের সুযোগ!
প্রতিবছরের মতো এবারও বিদায়বেলায় দুর্গাপূজা আরও সাথে করে নিয়ে গেছে শরৎ, শরতের আকাশ-মেঘরাজি আর বাতাসে দুলতে থাকা কাশফুল রাশি। হেমন্ত পেরিয়ে কুয়াশার চাদর জড়িয়ে ইতিমধ্যে মর্ত্যে নেমেছে হাড়কাঁপানো শীত।
প্রকৃতিতে মুগ্ধতা ছড়ানোর পালা শেষে পালসিটের কাশফুলগুলোও কিছু হয়েছে অদৃশ্য, আবার কয়েকটি পরিণত হয়েছে খড়ে। তবু যতোবার দুলতে থাকা ঝাঁকে ঝাঁকে নৃত্যরত কাশফুল মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, ততোবারই 'পথের পাঁচালী' প্রেমীরা বিহ্বল হয়ে উঠবেন।
- সূত্র- গেট বেঙ্গল, নিউজ এইটটিন