ডিম আগে না মুরগি আগে? বিজ্ঞান কী বলে!
কী আজব প্রশ্ন! মুরগি ডিম পাড়ে। যার মানে, ডিম চাইলে আপনাকে অবশ্যই মুরগির ব্যবস্থা করতে হবে। আবার ডিম ছাড়া তো মুরগিও পৃথিবীতে আসতে পারবে না।
এই চিন্তা করেননি, এমন লোক হয়তো খোঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের অনেকের জীবনে শোনা প্রথম প্যারাডক্সই এটি। কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে অনেকেই একে ফালতু প্রশ্ন বলে উড়িয়ে দেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, শুধু আপনি-আমি না, এই প্যারাডক্স নিয়ে চিন্তা করতে করতে মাথা ঘোলা করেছেন অ্যারিস্টলসহ গ্রিক দার্শনিকরাও।
বুঝতেই পারছেন, ডিম আর মুরগির মধ্যে কার আগমন আগে, তা নিয়ে মানব সম্প্রদায় মাথা ঘামাচ্ছে হাজার বছর ধরে। তবে উত্তর কী পেয়েছেন কেউ?
সুসংবাদ হচ্ছে, হ্যাঁ বিজ্ঞানের বদৌলতে এখন এই প্রশ্নের জবাব পেতে পারি আমরা।
তবে জবাব দেওয়ার আগে প্রশ্নটি বুঝে নেই। এই প্রশ্নের দুই বা ততোধিক অর্থ দাঁড় করানো যায়। প্রথম অর্থ এমন হতে পারে- বস্তু হিসেবে ডিম আর মুরগির মধ্যে কার অস্তিত্ব আগে ছিল?
উত্তর হচ্ছে, ডিম। ডাইনোসরের ডিম এবং ভ্রূণের প্রাচীনতম জীবাশ্মগুলোর বয়স প্রায় ১৯ কোটি বছর। আর পাখি গোত্রের সবচেয়ে প্রাচীনতম রূপ, আর্কিওপ্টেরিক্স (এক ধরনের পাখির মতো ডাইনোসর)-এর জীবাশ্ম ১৫ কোটি বছরের পুরনো।
যার মানে, পৃথিবীতে কোনো পাখি আসার অনেক আগেই ডিম এসেছে।
দ্বিতীয় অর্থ হতে পারে এমন- মুরগি এবং মুরগির ডিম, এর মধ্যে কে আগে এসেছে?
এখানেও উত্তর একই, ডিম। বিবর্তনের ধারায় কোনো এক সময়, দুটি প্রায়-মুরগির মতো প্রাণী মিলে একটি ডিম তৈরি করে, যার জেনেটিক বিন্যাস কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে মুরগির মতো হয়ে যায়। সেই ডিম থেকে জন্ম নেয় পৃথিবীর প্রথম মুরগি।
প্রখ্যাত বিজ্ঞানী নিল ডিগ্রেস টাইসন এই তত্ত্বকে সমর্থন করেছেন। 'সাইন্স গাই' হিসেবে পরিচিত বিজ্ঞানী বিল নাইও একমত হয়েছেন এই তত্ত্বের সঙ্গে।
জেনেটিক পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রকৃতির কারণে ঠিক কখন এ ঘটনাটি ঘটেছিল, তা বের করা প্রায় অসম্ভব। তবে ধারণা করা হচ্ছে, প্রথম 'মুরগি'র ডিমের জন্ম দেওয়া প্রাণী দুটি ছিল লাল রঙের বনমোরগ। কেননা, বিজ্ঞানীরা বলছেন, আধুনিক মুরগি লাল রঙের বনমোরগেরই বিবর্তিত রূপ।
গ্যালাস গ্যালাস বা এই লাল বনমোরগের দেখা পাওয়া যায় দক্ষিণ-পশ্চিম চীন, থাইল্যান্ডের উত্তরাঞ্চল আর মায়ানমারে। আজ থেকে ১২ হাজার ৮০০ বছর আগে মূল প্রজাতি থেকে আলাদা হয়ে জন্ম নেয় আজকের গৃহপালিত মুরগি।
তাহলে বিজ্ঞান ও বিবর্তনবাদের কল্যাণে বহুবছর ধরে মাথায় ঘুরাফেরা করা প্রশ্নটির জবাব পেলেন। এখন আমরা সবাই সম্মত হতে পারি, ডিমই আগে।
তবে এখন আপনার জানতে ইচ্ছা করছে না অ্যারিস্টটল কী সমাধান দিয়েছিলেন এই ধাঁধার?
অ্যারিস্টটলও কোনো সুরাহা করতে পারেননি, স্বাভাবিকভাবেই। তিনি বলেছিলেন, "পাখিকুলের জন্ম দেওয়ার জন্য একটি প্রথম ডিম থাকতে পারে না। আবার এমন কোনো পাখিও থাকতে পারে না যে প্রথম ডিমের জন্ম দিয়েছিল, কেননা পাখি ডিম থেকেই আসে।"
ডিম-মুরগির এই ধাঁধা গ্রিক দার্শনিকদের সৃষ্টির রহস্য নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছিল। দার্শনিক প্লুটার্ক বলেছিলেন, পৃথিবীর সূচনা কীভাবে হয়েছে, আদৌ কোনো সূচনা ছিল কি না; ঘুরেফিরে এই ভারী প্রশ্নটিতেই নিয়ে যাচ্ছে এই ধাঁধা।
খ্রিস্টান বুদ্ধিজীবীরাও কম যাননি। তবে তাদের চিন্তার ক্ষেত্র ছিল সীমিত। বাইবেলের অধ্যায় 'জেনেসিস'-এর উপর ভিত্তি করে তারা বলতেন, মুরগি আগে এসেছে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত প্রাকৃতিক ইতিহাসবিদরাও ধরে নিতেন মুরগি আগে এসেছে (অথবা কেউই আগে আসেনি)।
গ্রেগর জোহান মেন্ডেল জেনেটিক্স ও চার্লস ডারউইন বিবর্তনবাদ আবিষ্কার করার আগ পর্যন্ত এই খাতে মন্তব্য করার তেমন কোনো সুযোগ ছিল না বিজ্ঞানীদের।
আজকে বিজ্ঞান এই ধাঁধার জবাব দিতে পারলেও প্রশ্নটি কিন্তু এখনও ঘুরে-ফিরে আছে সাধারণ মানুষ ও দার্শনিকদের মুখে মুখে। কারণ, সাধারণ মানুষের জন্য হাজার বছরের পুরনো এই প্রশ্নটি একটি হাসির খোরাক। আর দার্শনিকদের জন্য চিন্তার খোরাক।
(আচ্ছা, এই প্রশ্নের আরেকটি অর্থ হতে পারে- 'ডিম' ও 'মুরগি' এই দুই শব্দের মধ্যে কার আগমন আগে? কয়েকবছর আগে অক্সফোর্ড ডিকশনারি কর্তৃপক্ষ এর উত্তর বের করার চেষ্টা করেছিল। না, তারা উত্তর খুঁজে পাননি।)