শেক্সপিয়ারকে কেন ঘৃণা করতেন লিও তলস্তয়?
বিখ্যাত ইংরেজ নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের সাহিত্যিকর্মে মুগ্ধ, এমন ভক্তের অভাব নেই। কিন্তু, তার সৃষ্টিগুলোর প্রতি সবার কিন্তু নেই একচেটিয়া মোহ। বিভিন্ন সময়ে একইরকম খ্যাতিমান বিভিন্ন লেখক সর্বকালের সেরা নাট্যকার হিসেবে শেক্সপিয়ারের রাজত্বের বিরোধিতা করেছেন।
তিন বছর ধরে থিয়েটার নাটকের সমালোচক থাকার সময় জর্জ বার্নার্ড শ শেক্সপিয়ারের সাহিত্যে 'দর্শনের শূন্যতা' সম্পর্কে অন্যদের সচেতন করাকে দায়িত্ব বলে মনে করেছেন। ইংরেজি সাহিত্যের আরেক পণ্ডিত জে. আর. আর. টোকিন তো ১৬ শতকের এই ইংরেজ কবি ও নাট্যকারের সৃষ্টির প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষিত না হওয়ার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। কথা প্রসঙ্গে শেক্সপিয়ারের কথা উঠলেই উত্তেজিত, ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতেন ভলতেয়ার।
তবে বিশ্বসাহিত্যের বিখ্যাতজনদের মধ্যে সম্ভবত কেউই লিও তলস্তয়ের মতো শেক্সপিয়ার বিদ্বেষী ছিলেন না। সর্বকালের সেরা লেখকদের অন্যতম এই রুশ সাহিত্যিক শেক্সপিয়ারের কাজগুলোর মান নিয়ে বেশ জোর গলাতেই অভিযোগ করে গেছেন।
তলস্তয় বনাম শেক্সপিয়ার
বিশ্ব সাহিত্যের রাজকোষে 'ওয়ার অ্যান্ড পিস' উপন্যাসটি লিখে এক অমূল্য মুক্তো যোগ করেন অভিজাত এক রুশ পরিবারে জন্ম নেওয়া তলস্তয়। তিনি ছোট থেকেই অনেক রকম বিদেশি সাহিত্যকর্মের সংস্পর্শে আসেন। তখনই তিনি পড়েন শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট ও ম্যাকবেথ।
তার বন্ধু ও পরিবারের অন্যরা শেক্সপিয়ারের এসব নাট্যসাহিত্যকে উচ্চমার্গের মনে করলেও, তলস্তয়ের কাছে সেগুলো মোটেও ভালো লাগেনি। সবার সাথে পছন্দের এই অমিল তাকে শেক্সপিয়ারের প্রতি আরও ক্ষুদ্ধ করে তোলে। তার কাছে কোনোদিনই মনে হয়নি বিখ্যাত ইংরেজ লেখকের কোনো কাজ 'মাস্টারপিস' তকমার যোগ্য। তিনি বলেছেন, শেক্সপিয়ারের কৌতুকগুলো একেবারেই 'আবেদনহীন- নিরস'। আর শেক্সপিয়ারের শ্লেষমূলক পরিহাসকে তলস্তয় মনে করেছেন নিতান্ত 'জোলো' ধরনের। হেনরি-ফাইভ নাটকের মাতাল ফলস্টাফ চরিত্রটির মাধ্যমে শেক্সপিয়ার যেসব বাক্য লিখেছেন, একমাত্র সেগুলোর ব্যাপারেই কিছুটা উদার প্রশংসা করেছেন তলস্তয় ।
অন্যদিকে বিখ্যাত দুই লেখক ইভান তুর্গনেভ ও আফানাসি ফেটের গুণমুগ্ধ ছিলেন তলস্তয়। সাহিত্য বিবেচনায় তাদের সম্মানও করতেন। তাদের কাছেই প্রশ্ন রাখেন, ইংরেজ এই নাট্যকবি কি সত্যিই এত বিখ্যাত হওয়ার যোগ্য? কিন্তু, সঠিক বিশ্লেষণ দিতে ব্যর্থ হন দুজনেই, বরং তাদের যুক্তি ছিল হেঁয়ালি ও অস্পষ্টতায় ভরা।
তিনি আরও লক্ষ্য করলেন, সাহিত্যকর্মের চুলচেরা বিশ্লেষণের চাইতে তার প্রিয় লেখকদ্বয় কাল্পনিক বিশ্বাসের মধ্যে দিয়ে শেক্সপিয়ারের গুণগান করেছেন।
তলস্তয় তখন ভাবলেন, বুড়ো বয়সে হয়তো শেক্সপিয়ার তার ভালো লাগবে। কিন্তু, ৭৫ বছর বয়সেও তাকে সেই অনুভূতি যখন স্পর্শও করলো না, তখন কাগজেকলমে 'শেক্সপিয়ারীয় অসারত্ব' নিয়ে সমাচলোচনা লেখার সিদ্ধান্ত নিলেন।
১৯০৬ সালে লেখা ওই সাহিত্য সমালোচনা পক্ষপাতিতা ও ত্রুটির ঊর্ধ্বে না হলেও এটি শেক্সপিয়ারের কালজয়ী মূর্তির ওপর প্রচণ্ড আঘাত হয়ে ওঠে। তার সৃষ্টিকর্ম চর্চাকারী বিভিন্ন শিল্প সংস্থার প্রতি যা ছিল কড়া চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার শামিল।
প্রথমেই নাট্যলেখক হিসেবে শেক্সপিয়ারের যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন স্তলস্তয়। তিনি বলেন, বাইবেলে বর্ণিত কাহিনির মতোই শেক্সপিয়ারের চরিত্রদের রক্তারক্তি, খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ার নজির বেশি। গল্পে রহস্য, রোমাঞ্চ যোগ করতে চরিত্রগুলোর আত্মপরিচয় বদলানোর কৌশল দর্শকদের কাছে চরিত্রগুলোকে দুর্বোধ্য করে তোলে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
অনেক সময় চরিত্রগুলো তাদের নিজস্ব আচরণ বহির্ভূত কাজ করে। প্লটের চাহিদামাফিক এ পরিবর্তনে চরিত্রটির কাছ থেকে যে প্রত্যাশা করা হয় তাও পূরণ হয় না।
সেই সময়কার রুশ লেখকরা চরিত্রের ধারাবাহিকতায় জোর দিতেন, স্তলস্তয়ও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। নিজের সৃষ্টি প্রতিটি চরিত্রের বয়স, লিঙ্গ ও আর্থ-সামাজিক শ্রেণি ভেদে নিজস্ব সত্তায় তুলে ধরাতেই ছিল তার সাবলীল দক্ষতা।
উদাহরণস্বরূপ, তার গল্পের রাজকন্যারা ছিল নম্রভাষী, ভাষাজ্ঞানে সমৃদ্ধ। অন্যদিকে মাতাল চাষিদের মুখে অকথ্য গালি ও শাপশাপান্ত দেখা যায়।
কাব্যরীতির এ ধারায় শেক্সপিয়ার লিখলেও তলস্তয়ের মতে "তার গল্পে এক চরিত্র থেকে যে কথা প্রত্যাশা করা হয়, সেটা শোনা যায় অন্য কারো মুখে। ফলে শুধু বাক্য শুনে এটা কোন চরিত্রের সংলাপ তা বোঝার উপায় নেই।"
শেক্সপিয়ারকে অনেকেই সমর্থন করে, কিন্তু কেন?
শেক্সপিয়ারের সৃষ্টির সমর্থনে অন্যদের অতি-উৎসাহী আচরণই স্তলস্তয়কে তার সমালোচক করে তুলেছিল। তিনি অন্ধ-ভক্তির এই বাড়াবাড়িতে বিস্মিতও হয়েছেন।
তিনি বলেন, "শেক্সপিয়ার কেন মহান তার ভক্তদের কাছে বহুবার তার ব্যাখ্যা চেয়েছি। কিন্তু তাদের প্রায় সকলের আচরণ ও অভিব্যক্তি ছিল একই রকম। সমর্থনের নেশায় বুঁদ থেকে তারা যৌক্তিক এক বিন্দু সমালোচনাও মেনে নিতে পারে না। তারা আগের বিশ্বাসেই স্থির থাকতে চায়।"
নিজ সমালোচনা পত্রের দ্বিতীয়ার্ধে স্তলস্তয় শেক্সপিয়ারবাদ কেন এক ধর্ম বিশ্বাসের মতো প্রবল ও গোঁড়া তা ব্যাখ্যা করেছেন।
১৬ শতকে লেখা শেক্সপিয়ারের সাহিত্যকর্মকে উচ্চমার্গের তুলে ধরার জন্য তিনি বিখ্যাত জার্মান কবি জোহান উলফগ্যাং ভন গথের সমালোচনা করেন। স্তলস্তয়ের মতে, গথ অশ্লীল ধরনের নিম্নশ্রেণির বিনোদনের উপকরণকে শৈল্পিক ও সূক্ষ্ম সাহিত্যকর্ম হিসেবে প্রচার করেছেন। কথাটির সত্যতাও রয়েছে, শেক্সপিয়ারের যুগে তার সৃষ্টিগুলো সমাজের খেটে খাওয়া মানুষেরই বিনোদনের উপাদান ছিল।
তলস্তয়কে দেওয়া অরওয়েলের জবাব
স্তলস্তয় জন্মগ্রহণের কয়েক শতক আগেই পৃথিবীকে বিদায় জানিয়েছিলেন শেক্সপিয়ার। তাই তার পক্ষে এসব স্মালোচনার জবাব দেওয়া কোনো উপায় তো ছিল না। কিন্তু, স্বদেশী গুরুজনের এই দুর্নাম মোচনে এগিয়ে এলেন আরেক যুগান্তকারী ব্রিটিশ লেখক, উপন্যাসিক জর্জ অরওয়েল। তিনি গীতিকবি মহাশয়ের পক্ষ নিয়ে লিখলেন স্তলস্তয়ের সমালোচনার জবাব। কেন সবারই শেক্সপিয়ার পড়া উচিত, সেই যুক্তিও দেন তিনি।
কিন্তু, সেই পরামর্শ দেওয়ার আগে স্তলস্তয়ের ত্রুটিগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখান অরওয়েল। তার প্রথম যুক্তি, একজন শিল্পীর ভালো বা মন্দ নির্ধারণ করাটাই একটা মস্ত ভুল। কারণ শিল্প কেবল অনবদ্য ও স্বতন্ত্র হতে পারে, এক যুগের অবহেলিত সৃষ্টি খ্যাতি পায় অন্য আরেক সময়ে।
তাছাড়া, তলস্তুয়ের শিল্পদর্শন ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি জার্মান 'রোমান্টিসজম'কে মেনে নিতে পারেননি। এই দর্শনে বিশ্বাসী অন্য লেখক, কবিদের প্রতিও তার কোনো মোহ ছিল না। প্রথম পাঠেই তিনি তাদের সৃষ্টিকে সব সময় রদ্দি হিসেবে গণ্য করতেন। তাদের শেক্সপিয়ার বন্দনাও তলস্তয়ের কাছে মানসম্পন্ন মনে হয়নি।
১৯৪৭ সালে প্রকাশিত 'লিয়ার, স্তলস্তয় অ্যান্ড দ্য ফুল' শিরোনামের ওই নিবন্ধে সর্বোপরি অরওয়েল লেখেন, "কালজয়ী হতে পারাটাই সাহিত্যের জন্য সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। এটাই বেশিরভাগ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।"
সাহিত্যের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ দিয়ে শেক্সপিয়ারকে বিচার করে স্তলস্তয় মস্ত ভুল করেছেন বলে মন্তব্য করেন অরওয়েল। সাহিত্য মানেই মানবজাতির জন্য মহান কিছু সৃষ্টির চেষ্টা থাকতেই হবে, এমন ধ্যানধারণাকে তিনি ভ্রান্ত বলেছেন।
শেক্সপিয়ার প্রকৃতপক্ষে একজন কবি হলেও, তাকে একজন লেখক, উপন্যাসিকের দৃষ্টিতে দেখেছেন তলস্তয়। অথচ বেশিরভাগ মানুষ গল্পের চেয়ে শেক্সপিয়ারের চরিত্রগুলোর চমৎকার সংলাপেই বেশি আকৃষ্ট হন।
জুলিয়াস সিজার, জেন্টেলমেন অব ভেরোনা নাটকে সংলাপ বিনিময়ের অপূর্ব উদাহরণ রয়েছে। রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েটেও রয়েছে তার জ্বলন্ত উদাহরণ। অথচ তলস্তয় এদিকটি একেবারেই এড়িয়ে গেছেন বলে উল্লেখ করেন অরওয়েল।
হাসিখুশি খোকা আর গোমড়ামুখো বুড়ো
অরওয়েল উপসংহারে, এসে শেক্সপিয়ারকে এক হাশিখুশি বালক হিসেবে কল্পনা করেছেন। গৎবাঁধা মহানুভবতার দর্শন যাকে সীমাবদ্ধ করেনি। যা যখন মনে চায়, শিশুর মতো তাকেই নাটকে রূপ দিয়েছেন।
অন্যদিকে, তলস্তয় হলেন বয়সের ভারে ন্যুজ ঘরকুণো এক বুড়ো। শিশু শেক্সপিয়ারের দুরন্তপনা দেখে যে রাগে গজগজ করতে করতে বলছে, "খোকা অযথা লাফঝাঁফ না করে, আমার মতো চুপটি করে বোসো।"
শুনতে হাস্যকর হলেও যারা তলস্তয়ের জীবনী পড়েছেন তারা একটু লক্ষ্য করলেই তার 'সিরিয়াস' মনোভাব ও সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছেটি বুঝতে পারবেন।
অরওয়েলের মতে, শেক্সপিয়ারের চরিত্রগুলো পরিচিত ভঙ্গিমায় সংলাপ বললেও, তার লেখা প্রতিটি নাটকই ছিল আগেরটির চেয়ে স্বতন্ত্র।
জার্মান বংশদ্ভুত ব্রিটিশ দার্শনিক ইসাইহ বার্লিন তার 'দ্য ফক্স অ্যান্ড হেজহগ' নিবন্ধেও বলেছেন একই কথা। তিনি এক ঘরানা থেকে আরেক ঘরানায় বিচরণকে শেক্সপিয়ারের কৌতূহলী বালকের মতো চাঞ্চল্য বলেছেন। আর অন্যদিকে এক দৃষ্টিকোণ থেকে কল্পনার বাইরের এক স্থায়ী দুনিয়াবি দৃষ্টিভঙ্গির জ্যেষ্ঠই বলেছেন স্তলস্তয়কে।
সূত্র: দ্য বিগ থিংক