বাকল্যান্ড বাঁধের উল্টোপথেই উল্টিনগঞ্জ: উল্টিনসাহেবের কাঠের ময়দান
তৈমূর খান অপু বলেন, বিকে দাস রোড ঢাকার প্রথম পাকা রাস্তা। ১৯২৭ সালে ব্যবসায়ী বসন্ত কুমার দাসের নামে হয় সড়কটির নামকরণ। অপু রাস্তাটির ৪২ নম্বর বাড়ির মালিক। বাংলাবাজার পার হয়ে পশ্চিম দিক থেকে ঢুকলে রাস্তার মাথায় ফরাসীদের লালকুঠি, তারপর সার সার পেঁয়াজ, হলুদ, মরিচের আড়ত। কিছু পরে রুপলাল হাউজ; তারপর শ্যামবাজার ধরে আরো পূর্বদিকে রাস্তাটি যাওয়ার মুখেই শুরু হয় মোহিনী মোহন দাস রোড। তারপরই পুঁথিঘর-মুক্তধারার আগের বাড়ি, আরো এগিয়ে সুদৃশ্য বড় বাড়ি, উল্টোদিকে বিবি-কা-রওজা। তারপর অপুদের বাড়ি আর ঠিক উল্টোদিক থেকেই শুরু ফরাশগঞ্জের উল্টিনগঞ্জ।
ফরাশগঞ্জের নাম আদিতে ছিল ফ্রেন্সগঞ্জ। সেখানে ফরাসিরা বসবাস করত । জায়গার দখল নিতে তাদের মারামারিও করতে হয়েছে। সেটা ১৭৫০ সালে। ফরাসিরা ইংরেজদের একটি কারখানার ওপর হামলা চালিয়ে দখল করে নেয়। ইংরেজরাও কি ছাড়ে? শেষে নায়েব নাজেম জাসারাত খানের হস্তক্ষেপে একটা বোঝাপড়া হয়। পরে ফরাসীরা এখানে কাঁচা হলুদ, আদা, রসুন আর মরিচের পাইকারি আড়ত গড়ে তোলে। সেই থেকে ফ্রেন্সগঞ্জ হয়ে ফরাশগঞ্জ। অপু জানালেন, উল্টিন বলে এক সাহেব বান্দরবনে কর্মরত ছিলেন। তিনি সেখান থেকে কাঠ এনে এ বাজার চালু করেছিলেন। তাই নাম উল্টিনগঞ্জ।
উল্টিনগঞ্জের কথা কিছু:
সিকি মাইল হতে পারে লেনটির দৈর্ঘ – উল্টিনগঞ্জ লেন। অপুদের বাড়ির উল্টোদিক থেকে একদম বুড়িগঙ্গা অবধি। নব্বই সাল পর্যন্ত নৌপথেই কাঠ আসত। বেশি আসত বান্দরবান, রাঙামাটি আর খাগড়াছড়ি মানে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে। সেগুন, গর্জন. গামারি ইত্যাদি আসত বেশি-এগুলোর চলতি নাম সুকাঠ। আর বরিশাল থেকে আম, জাম ইত্যাদি যেসব কাঠ আসে সেগুলোকে লোকে বলে আকাঠ। আবুল হোসেন মিয়া উল্টিনগঞ্জের নাইট গার্ড। বাহাত্তর বছর বয়স তার, এর মধ্যে প্রায় ৫০ বছর যাচ্ছে উল্টিনগঞ্জে। তিনিও একসময় নৌকা বাইতেন। বললেন, উবারি নৌকা বাইতাম। হাজার বারোশো মণী নৌকা, বাদাম তুলে নৌকা চালাতাম, মাঝে গুন টানত জনা দশেক লোক। আমি হাল ধরতাম। বারোশি মণীর নৌকার ছই তো উঁচুই হবে, এখনকার দেড় তলা হবে, তার ওপরে বসে নাও বাইতাম। তারপর উল্টিনগঞ্জ এসে প্রথম প্রথম গাছ নামানোর কাজ করতাম নৌকা থেকে। এভাবে অনেকদিন গেল, তারপর লেবারদের হিসাব রাখার কাজ করছি। বছর কয় হলো টিম্বার মালিক সমিতির নাইট গার্ডের কাজ নিছি।'
শেরে বাংলা ফজলুল হকের বাড়ির কাছেই মানে চাখারে আবুল হোসেনের বাড়ি। এক মেয়ে আর এক ছেলে তাঁর। ছেলেটা অল্পদিন হয় কাজে লেগেছে। রোজগার তেমন বেশি নয়। রাত কাটান চিটাগাং উড টিম্বারের গুদামে।
উল্টিনগঞ্জের পুরোনো কাঠের আড়তগুলোর একটা চিটাগং উড টিম্বার। এছাড়া লাকসাম টিম্বার, ফরাশগঞ্জ কাষ্ঠ বিতান, শর্ষিনা স মিল ইত্যাদিও পুরোনো। কত বছরের পুরোনো এ বাজার? জানতে চেয়েছিলাম উল্টিনগঞ্জ কাঠ ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক গাজী অসীম ইমামের কাছে। তিনি দোহার কাঠ ঘরের স্বত্বাধিকারী। বলছিলেন, 'একশ বছরের বেশি হবে বাজারের বয়স। বাজারে ২৮টি স মিল আছে। ৪৭০ জন তালিকাভুক্ত ব্যবসায়ী আছেন। বাজারে লেবারের সংখ্যা হবে হাজার মতো।'
কাঠের কথা কিছু:
প্রাচীনকাল থেকেই বসতবাড়ির খুঁটি, কড়ি, বরগা, চৌকাঠ, দরজা, জানালা, দেয়াল এমনকি মেঝেও কাঠ দিয়ে তৈরি হয়ে আসছে। এখনো রড, সিমেন্ট, পাথর ইত্যাদির সঙ্গে কাঠের ব্যবহার দেখা যায়। তবে পরিমাণে অনেক কম। তবে আসবাবপত্রে লোহা, স্টিল, পারটেক্স, রাবার বা প্লাস্টিকের সঙ্গে কাঠ এখনো ভালোভাবেই পাল্লা দিচ্ছে বলা যায়। আসবাবপত্রের জন্য মূলত মেহগনি, কড়ই, চম্বল, সেগুন বেশি ব্যবহৃত হয়। দরজার চৌকাঠ তৈরি হয় মূলত মেহগনি, শিলকড়ই, জাম বা গজারি কাঠ দিয়ে। দরজার পাল্লা তৈরিতে ব্যবহৃত হয় বেশি শাল, সেগুন আর গামারি। জানালার ফ্রেম শাল দিয়েই ভালো হয়। উল্লেখ্য ঘুন ধরে না লোহা কাঠ আর নিম কাঠে।
তখন বড় বৈশাখী মেলা হতো:
অসীম সাহেবদের বাড়ি দোহারে। তাঁর বাবা গাজী আলী ইমাম কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্সের ছাত্র ছিলেন। স্বাধীন ভারতে তিনি বামপন্থী ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। স্লোগান দিতেন- ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়। ছিলেন বিখ্যাত বামপন্থী নেতা অসীম রায়, গোলাম রসুলদের বন্ধু। জ্যোতি বসুর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল। তৎকালীন ভারত সরকারে কোপানলে পড়লে বন্ধুরাই তাকে ঠেলেঠুলে বাড়ি মানে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়। ১৯৫৫ সালে ফরাশগঞ্জে তিনি তেলের ব্যবসা শুরু করেন। একইসঙ্গে উল্টিনগঞ্জে কাঠের কাজও করতেন।
অসীম সাহেব মনে করতে পারেন, ষাটের দশকের শেষ দিকে তিনি পড়তেন আগা খানী স্কুলে (লালকুঠির কাছেই ছিল স্কুলটি)। টাই পরে স্কুলে যেতেন। সে আমলে শত টাকা বেতন ছিল। পাক আর্মি দেখলে চেঁচিয়ে বলতেন- জয় বাংলা। বলছিলেন, ওই সময় শবে বরাত ছিল একটা উৎসবের রাত। দশ টাকা দামের বাজিও পুড়িয়েছি। বৈশাখী মেলা ছিল বড় মেলা। ধুপখোলার মাঠে বড় মেলা হতো। আমার বোনের নাম বাবা রেখেছিলেন বৈশাখী। বাবা বই পড়তে খুব ভালোবাসতেন। রাজনীতির বই-ই বেশি পড়তেন। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে কলকাতায় যেতেন মাঝে মধ্যে। আমরাও দু-একবার গেছি তাঁর সঙ্গে, কফি হাউজে চা-সিঙ্গারা খেয়েছি।'
অসীম সাহেব কাঠের ব্যবসায় এসেছেন নব্বইয়ের গোড়ায়। বলছিলেন, নৌপথে যেমন রেলে চড়েও আসত কাঠ। এখন প্রায় ৯০ ভাগ গাছই আসে ট্রাকে চড়ে। নব্বইয়ের দশক থেকেই আসলে টেকনাফ থেকে কাঠ আসা শুরু হয়। মায়ানমারের গাছ। সীমান্তে সরকারের দপ্তরগুলো পার হয়েই চড়ে বসে ট্রাকে, আসে উল্টিনগঞ্জ। সে বদৌলতে গর্জন কাঠের এখন বড় বাজার উল্টিনগঞ্জ। তবে এখনো সেগুনেরই আধিপত্য বেশি। তবে আগের প্রাচীন সেগুন এখন কম। বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে সেগুন। ১৫-২০ বছরের মাথায় বিক্রির জন্য প্রস্তুত হয়ে যাচ্ছে।'
আবুল হোসেন চিটাগং উডের আড়তে সেগুন দেখিয়ে বলছিলেন, 'এই যে গাঢ় অংশটা হলো সার আর বাকিটা বার। যদি কোনো ফার্নিচারের সবটা সার দিয়ে বানান তবে তা দুই-তিন প্রজন্ম চলে যাবে। যদি বার মিশিয়ে তৈরি করেন তবে বেশিদিন আয়ু আশা করতে পারবেন না।'
চাঁছা সেগুন গাছ গোল হয় আর শিলকড়ই বা গর্জন হয় পাটামতো বর্গাকার। ভারী একটা গর্জন বইতে ৭-৮ জন লোকও লাগে। ষাট বছর বয়সী আব্দুল হালিম খান মানিকগঞ্জের মানুষ। একই নামে মানিকগঞ্জে একজন বিখ্যাত বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। হালিম খান তাঁকে ভালো করেই চেনেন। মনে করতে পারেন, 'পদ্মায় ভেসে আসা পাক আর্মির অনেককে ক্যাপ্টেনসাব (ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরী) বন্দি করে ক্যাম্পে নিয়ে রেখেছিলেন। দেশ স্বাধীন হলে তাদের পিছমোড়া করে ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।'
আব্দুল হালিমের বাড়ি হরিরামপুরে। পদ্মা তাঁদের বাড়ি ভেঙ্গেছে চার-পাঁচবার। খুব ছোট্টবেলায় একবার ধানী জমিতে হলুদ হরিষা দেখে এসেছিলেন বাবার সঙ্গে। দিনকয় পরেই তা নদীর গর্ভে চলে যায়। তাঁরা তিন ভাই। বাবা পরে আর ভাঙন সইতে না পেরে রাজবাড়ির দিকে একটা বাড়ি বানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, কিছু না থাকলে এখানে এসে ওঠবা। এখনো প্রতি অগ্রহায়ণ পৌষ মাসে আশা করে থাকেন চর জাগবে। আবার বাড়ি বাঁধবেন কিন্তু কোনোবারই আশানুরুপ কোনো ঘটনা ঘটে না। আব্দুল হালিম খান গত সপ্তাহে (জানুয়ারির প্রথমদিকে) সপ্তা পেয়েছেন মানে ছয়দিনে ২৬০০ টাকা। দিনে সাড়ে চারশো টাকা প্রায়।
জানতে চাইলাম, এ দিয়ে চলেন কিভাবে?
আব্দুল হালিম: আসলে সব সপ্তাহে এক রকম রোজগার হয় না। কোনো কোনো সপ্তাহে পাঁচ হাজার টাকাও সপ্তা পাই। তবে আগের মতো আর নাই উল্টিনগঞ্জে। ওইপারে বাসা নিছি। দুইটা মেয়ে বিয়ে দিছি। ছেলেটাকে কম্পিউটার শিখাইছি। আধা সরকারি একটা চাকরি পাইছে। তবু কুলাইতে পারি না। ছোট্ট মেয়েটা স্কুলে পড়ে।
দুপুরে কি খেলেন?
ডিমের ঝোল আর ভাত। আজকে বাড়ি থেকে ভাত আনতে পারি নাই। হোটেলে খাইছি। রাতে যদি গাছ না আসে তবে ৯টায় সময় নদী পার হয়া যাই। আর যদি গাছ আসে তবে রাত তিনটা-চারটাও বাজে। আবুল হোসেন ভাইয়ের ওখানে কিছু জামা কাপড় রাখা আছে। একবারে গোসল দিয়া ধোয়া কাপড় পরে বাড়ি যাই।
আপনাদের টয়লেটের ব্যবস্থা কি?
সমিতির বিল্ডিংয়ে টয়লেট আছে। মোবারক টিম্বারের ওপরে টয়লেট আছে। চিটাগাং উডেও টয়লেট আছে।
উল্টিনগঞ্জে মন্দা:
'আঘাত আসছিল অনেকদিন ধরেই। প্লাস্টিক, রাবার, পারটেক্সের হামলা তো অনেকদিন ধরেই চলছে। শেষ আঘাতটা হানল করোনা। এখন তো বাজারে দুইশ ব্যবসায়ী খুজে পাবেন কি-না সন্দেহ। লোকে চকচকে জিনিষ পছন্দ করে, টেকসই চিন্তা এখন আর মানুষের নেই। আমার দাদা যে আলমিরা তৈরি করে গেছেন সেটা তো এখনো আমার ঘরে আছে। কিন্তু এখনকার মানুষ এইটা পাঁচ বছর তো ওইটা তিন বছর। মানুষ তো এক বাড়িতে থাকতেও পারছে না বেশিদিন। তাহলে শক্তপোক্ত ভারী জিনিষ বইবে কেন? তাছাড়া বাড্ডা, মিরপুরে কাঠের আড়ত হয়েছে, তাই উল্টিনগঞ্জে দুর্দিন। যদিও এখনো এটা সবচেয়ে বড় পাইকারি কাঠের বাজার। তারপর নদীটাও মরতেছে। আগে নৌপথে বান্দরবান থেকে গাছ আসতে তিন চারদিন তো লাগতই কিন্তু তাতে তেমন অসুবিধা ছিল না। লোকে ধীরেসুস্থে গাছ নিত। কাঠ কাটিয়ে নিত সুবিধামতো। এখনো পাইকারি আড়ত বেশি তবে অনেককেই ঝুকতে হচ্ছে খুচরা বেচাকেনায়। আমি জানি না আমরা সামনে দুর্দিন কাটিয়ে উঠতে পারব কি-না।' বলছিলেন গাজী অসীম ইমাম।
উল্টিনগঞ্জের অহংকার হাতিল:
উল্টিনগঞ্জের পুরোনো প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি এইচএ টিম্বার। ষাটের দশকে এর যাত্রা শুরু। চিটাগাং টিক, জারুল, টিক চাম্বল, চাপালিশ, শিল কড়ই, বিদেশি বার্মাটিক, রেড ওক আর বিচসহ বিভিন্ন জাতের কাঠ বিক্রি করে এ প্রতিষ্ঠান। তারা মিয়ানমার, জার্মানি, কানাডা এবং আফ্রিকা থেকে কাঠ আমদানি করে। উল্টিনগঞ্জে তাদের দুটি যন্ত্রচালিত করাতকল আছে। সবমিলিয়ে মাসে গড়ে ৫-৬ হাজার ঘনফুট (সিএফটি) কাঠ বিক্রি করে এ প্রতিষ্ঠান। তবে এক দশক আগেও এর চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ কাঠ বিক্রি করত তারা। রেলপথ ও নৌপথ বন্ধ হওয়ায় খরচও বেড়েছে। এখন আবার দেশি কাঠের চেয়ে আমদানি করা কাঠই বিক্রি হয় বেশি। শুল্কহার কমানোও তাই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। উল্লেখ্য হাতিল গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান এটি। হাতিল প্রথম দরজা বানিয়ে খুচরা মার্কেটে আসে। সেই '৮৯ সালে শুধু দরজা বানানোর কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না। তারা বাড্ডায় হাতিল ডোর নামে একটি বিক্রয়কেন্দ্র চালু করে। ১৯৯০ সালে গেন্ডারিয়ায় একটি ময়দার কারখানা ভাড়া নিয়ে দরজা বানানো শুরু করে। চাহিদা বাড়তে থাকলে মিরপুরের কাজীপাড়ায় আরেকটি বিক্রয়কেন্দ্র চালু করে। অল্পকাল পরেই সেগুন কাঠের খাট, ডাইনিং টেবিল , চেয়ার বানাতে শুরু করে। ১৯৯৩ সালে কুড়িয়ে ৫০০০ বর্গফুট জায়গার একটি ফ্যাক্টরি ভাড়া নিয়ে আসবাবপত্র বানাতে শুরু করে। ২০০০ সালে হাতিল একটি আসবাবপত্রের জগতে জনপ্রিয় ও সম্ভ্রান্ত নাম হয়ে ওঠে।
সাধারণ সব মানুষ:
উল্টিনগঞ্জে তিনটি চায়ের দোকান, একটি সেলুন, একটি মোবাইল রিচার্জের দোকান আছে। নদীর ধারে মানে বাকল্যান্ড বাঁধে হোটেল আছে তিন-চারটি। নদীর পাড়েই আছে খেয়াঘাট। সারাক্ষণ নদী পারাপার হয় নৌকায়। লেবার বা শ্রমিকদের বেশিরভাগ ওপারে মানে কেরানীগঞ্জে থাকে। সেখানে থাকা-খাওয়া সস্তা হয়। লেবাররা প্রতি ঘনফুট কাঠ গুদামে নিতে পান ১২টাকা, মাপজোক করতে ২ টাকা আর করাতকলে কাটতে পান ১০ টাকা। একেকজন শ্রমিক মাসে গড়ে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় করতে পারেন। ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা ৭০০ থেকে আটশ ঘটফুট কাঠ বিক্রি করতে পারেন। এখানে বেশি বিক্রি হয় চাম্বল, সেগুন ও বার্মাটিক। এ গঞ্জে সকাল ৮টায় কাজ শুরু হয়। একটি খোলা ডিপ টিউবওয়েল আছে যেখানে লেবাররা গোসলও করেন। একটা বড় জামে মসজিদ আছে। সকাল থেকে সারাদিন অ্যালোভেরার শরবত বিক্রি হয়। বাত ব্যাথার হাতের তাগা বা পায়ের বালা বিক্রি করেন এমন বিক্রেতা আছেন কয়েকজন। বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের সেন্টু ঢালী প্রায় ত্রিশ বছর ধরে শ্রমিকের কাজ করছেন গঞ্জে। তিনিও নদী ভাঙা মানুষ। বললেন, 'ভারী কাজ করি আমরা। সারাদিন ধরেই চলে গাছ নামানো বা গাছ তোলার কাজ। আমরা গায়ের পায়ের ব্যথায় ভুগি। বালাগুলি অনেক কাজে দেয়।'
গঞ্জের এক চায়ের দোকানদার আব্দুর রহিম। তারও দুই যুগ হয়ে গেছে এখানে। তিনি বনরুটি, পান আর র চা বিক্রি করেন। বেমক্কা প্রশ্ন করলাম, ৫০০ কাপ বিক্রি করতে পারেন দিনে?
আব্দুর রহিম: তাহলে তো ভাই বাড়ি থাকত দুইটা। সারাদিনে ২০০ কাপ চালাতে পারি মাত্র। দিনে ৫০০ টাকা ইনকাম করতে ঘাম ছুটে যায়। শ্রমিকরা সপ্তা পায় বৃহস্পতিবার। এর আগে খাতা খোলা আছে, সব সেখানে লিখে রাখতে হয়।
এইভাবেই চলবে তাহলে ভাই?
আব্দুর রহিম: আর তো কোনো রাস্তা চেনা নাই। দিনে দিনে গঞ্জের অবস্থা খারাপ হইতেছে, সামনে কী আছে কপালে জানি না।
উল্টিনগঞ্জের ব্যবসা এখন:
'২০০০ সালের হিসাব যদি ধরি সব গাছ মিলিয়ে ধরুন সেগুন, শিলকড়ই, গামারী, চাপালিশ ইত্যাদি মিলিয়ে প্রায় ৪০০০ কিবি বা সিএফটি কাঠ বিক্রি হতো। গড়ে যদি ১২০০ টাকা করেও সিএফটি গোনেন তবে দাম দাঁড়ায় ৪৮ লাখ টাকা। তখন আকাঠ মানে আম কাঠই বিক্রি হতো ৫০০ সিএফটি দিনে। আর এখন সবমিলিয়ে ১০০০ সিএফটি সারাদিনে বিক্রি করাই বিরাট কষ্টের ব্যাপার হয়ে গেছে। এর মধ্যে ধরেন সেগুন ২৫০ সিএফটি আর শিলকড়ই ও গামারি বিক্রি হয়। কিছু বিক্রি হয় মেহগনী আর চাপালিশ। সেগুনের সিএফটি আপনি ২৭০০ টাকা ধরে হিসাব করুন। আর সবগুলো মিলিয়ে যদি গড়ে ১৫০০ টাকা সিএফটি ধরেন তবে মোট লেনদেনের পরিমাণ এখন দিনে ১৫ লক্ষ টাকা। আমার মনে হয় এটাও বাড়িয়ে বলা হলো। ধরা যায় ১০ লক্ষ টাকার লেনদেন এখন হয় দিনে উল্টিনগঞ্জে।' বলছিলেন গাজী অসীম ইমাম।
উল্টিনগঞ্জের আরো:
ষোল নম্বর উল্টিনগঞ্জে আছে হারুন অ্যান্ড সন্স টিম্বার। তারা মে মাসের ৪ তারিখে ফেসবুকে লিখেছে, 'যাদের ইন্টেরিয়র ডিজাইন কোম্পানি আছে তাদের জন্য গর্জন কাঠ অনেক কম দামে দিতে পারব।' তাদের ফেসবুক পেইজে একজন জিজ্ঞেস করছে, আপনারা ঢাকার বাইরে থেকে গাছ কেনেন? আমাদের বিক্রির জন্য গাছ ছিল..
আরেকজন জানতে চাইছিলেন, গামারি কাঠ পাকা সাইজ কতো ভাই? আরেকজন জানতে চেয়েছেন, বার্মাটিক সাইজ কাঠের দাম কত?
শর্ষিনা স মিলের একজন জানালেন, আপনি যদি বাছাল গাছ ( বেছে বেছে নিলে) নেন তাহলে দামে একরকম আর যদি লটের সবগুলো নেন তাহলে দাম আরেক রকম। সেগুনেরই দাম কয়েকপদের হয়। এগুলোর নাম যেমন ওভার থ্রি, ওভার ফোর ইত্যাদি। যে গাছের ডায়া মানে প্রস্থ যত বেশি তার দাম ততবেশি। ওভার ফোর মানে ৪ কিবি বা ৪ সিএফটি ডায়া। এটা ৪৫০০ টাকা সিএফটি। আবার ১ সিএফটি ডায়া ২২০০ টাকায়ও পেতে পারেন।
বিকাল শেষ প্রায়। বুড়িগঙ্গার জলে শীতের সূর্যের ম্লান আভা। ঢেউয়ে কিছু আভা ছড়িয়ে পড়ছে দূরে দূরে। নৌকাঘাটে ব্যস্ততা। উল্টিনগঞ্জ কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছে বিকালবেলায় এসে। অনেকে মাগরিবের নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছে। চা দোকানী আব্দুর রহিম শেষে বললেন, 'খারাপ লাগে না এখানে। সবাই এখানে আমরা সবারে চিনি। দুই চার টাকা মার যায় কিন্তু গায়ে লাগে না। বাড়ি থেকে মাঝে মধ্যে ঘুরে আসি। অন্যরাও যায় । আসার সময় পিঠা পুলি নিয়ে আসে। সবাই মিলেঝুলে খাই। ব্যবসা কিছু খারাপ হয়েছে কিন্তু আমাদের মোহাব্বত কমে নাই। আছি ভালোই।'