পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব রাখে দৈনন্দিন যে ১০টি খাবার
পরিবেশের ওপর মানুষের অপরিমিত খাদ্যাভ্যাসের ভয়াবহ প্রভাব তো কম-বেশি সবারই জানা আছে। বিশ্বজুড়ে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে দায়ী আমাদের কৃষি; ফসল ফলানোর জন্য ব্যবহৃত কীটনাশক, সারের কারণেও দূষণ হয়, এর প্রভাব পড়ে সামগ্রিক বাস্তুসংস্থানে। পরিবেশগত ক্ষতির হিসাবে কিছু খাবারের প্রভাব অনেক বেশি। এরমধ্যে অনেকের পছন্দের কিছু খাবারও হয়তো আছে।
চিনি
চিনির মিষ্টতায় হয়তো এর পরিবেশগত প্রভাবের বিষয়টি ভুলেই বসেছি আমরা। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ডের (ডব্লিউডব্লিউএফ) প্রকাশিত একটি গবেষণা বলছে, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন ফসলগুলোর মধ্যে শুরুর দিকে আছে চিনি। চিনি উৎপাদনের জন্য বিরাট অঞ্চলজুড়ে চাষাবাদের জন্য ধ্বংস হয় জীববৈচিত্র্য। আঁখ আর সুগারবিট উৎপাদনে প্রচুর পরিমাণে পানি আর কীটনাশকের ব্যবহারে কারণে মাটিক্ষয় হয়। এটি এমন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে পাপুয়া নিউ গিনির বায়ো কার্বনের ৪০ শতাংশ নিঃশেষ হয়ে গেছে যা বায়ুমণ্ডলে ফিরে গিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড বলছে, এখনই চিনি প্রস্তুতের আরও টেকসই পদ্ধতি বেছে নেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। সেইসঙ্গে ডায়েবেটিস, স্থূলতার মতো জটিলতা মোকাবিলায় প্রয়োজন চিনির আসক্তি কমিয়ে আনা।
চকলেট
থিওব্রোমা কোকোয়া গাছের বীজ থেকে তৈরি হয় চকলেট। শুধু নিরক্ষীয় অঞ্চলের বনাঞ্চলে এই গাছটি জন্মায়। মাত্র ১০০গ্রাম চকলেট বানাতেই লাগে ২,৪০০ লিটার পানি। এরফলে কোকোয়ার বাণিজ্যিক চাষের কারণে প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানের ওপর প্রভাব পড়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, কোকোয়ার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দামও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। এরফলে অনেকেই নিজেদের আগের ফসল চাষাবাদ ছেড়ে ছোট পরিসরে কোকোয়া চাষের দিকে ঝুঁকছেন। সেইসঙ্গে ধ্বংস হচ্ছে নিরক্ষীয় অঞ্চলের বনাঞ্চল। এসব অঞ্চলে বন উজাড়ের কারণে নষ্ট হচ্ছে সেখানকার জীববৈচিত্র্য।
এখানেই শেষ নয়। চকলেট বাজারজাতকরণের আগে গাঁজন, গ্রাইন্ডিং-রোস্টিং, দুধ-ভেজিটেবল ফুয়াট-চিনি-সয়া লেসিথিন যোগ করা; এই পুরো প্রক্রিয়ায় চকলেট বানানোর পরিবেশগত প্রভাব বাড়তেই থাকে।
কফি
কফি উৎপাদনে পরিবেশগত প্রভাব অনেকটা চকলেটের মতোই। জীববৈচিত্র্যপূর্ণ বনাঞ্চলের ভেতরে গাছের চাষ হয়। সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে, কফি গাছ অন্য গাছের ছায়ার মধ্যে জন্মায়। কিন্তু বাণিজ্যিক চাষাবাদ এই উপায়ে সম্ভব হয় না, গাছের ছায়ায় নয় আলোতেই চাষ হয়। বাণিজ্যিক কফির চাষাবাদ হয় বন উজাড়ের মাধ্যমে, খরচ হয় প্রচুর পরিমাণে পানি-কীটনাশক, ক্ষয় হয় মাটি।
২০১৪ সালে বায়োসায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমানে কফি চাষাবাদ এযাবতকালের সবচেয়ে ক্ষতিকর অবস্থায় এসে পৌঁছেছে।
কারখানাজাত মাংস
পরিবেশের জন্য অন্যতম ক্ষতিকর একটি খাবার কারখানাজাত মাংস। এসব মাংসের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বন উজাড় হয়, গ্রিনহাউজ গ্যাস বিশেষ করে মিথেন নির্গমন বাড়তে থাকে। পরিবেশগত হিসাবে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় গরু আর ভেড়ার মাংস উৎপাদনে। গ্রাহকরা ছোট ছোট খামারগুলোর দিকে ঝুঁকলে এই ক্ষতি কমে আসবে। এসব খামারে প্রাণীগুলো মুক্ত পরিবেশে থাকে, চারণভূমিতে চড়তে পারে।
পাম ওয়েল
কারখানাজাত বেশিরভাগ মিষ্টি জাতীয় খাবারে পাম ওয়েল ব্যবহৃত হয়। খাবারের ইন্ডাস্ট্রিতে সয়াবিন তেলের ওপর বহুল ব্যবহৃত তেল এটি।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড বলছে, পাম ওয়েলের উৎপাদনের কারণে বড় পরিসরে বন উজাড় হচ্ছে, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া ও মালেশিয়ার প্রধান বনাঞ্চলগুলোতে।
বেশ কিছু সংখ্যক বিপন্ন প্রাণীর বাসস্থান ও বসবাসের পরিবেশ ধ্বংসের জন্য দায়ী কফি উৎপাদন। মাটিক্ষয়ের জন্যও দায়ী। মাটি, পানি ও বায়ু দূষণ তো হচ্ছেই। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন হচ্ছে কফি উৎপাদনের প্রক্রিয়ায়।
সয়াবিন
বিশ্বে প্রতি সয়াবিন উৎপাদন হয় ৩৩০ মিলিয়ন টন। ৩০ মিলিয়ন টন সয়াবিন তেল বানাতে খরচ হয় ১৫০মিলিয়ন টন সয়াবিন। বাকি সয়াবিন ব্যবহার হয় পশুর খাবার হিসেবে, বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরিতে।
বন উজাড় ছাড়াও সয়াবিন তেলের উৎপাদনের সময় হেক্সেন দ্রাবক ব্যবহার করা হয়, গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন ছাড়াও স্থানীয় পরিবেশের বিভিন্ন দূষণের জন্য দায়ী এটি। টফু ও অন্যান্য সয়া প্রোটিনের খাবার উৎপাদন প্রক্রিয়াও পরিবেশবান্ধব নয়।
মিনারেল ওয়াটার
বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য বোতলজাত মিনারেল ওয়াটারের চাহিদা সবখানেই তুঙ্গে। ফরাসীরাই প্রতি বছর ৫.৫ বিলিয়ন বোতল কেনে। প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে পানির বোতল বিক্রি হয় ৫০ বিলিয়ন। ১ লিটারের একটি বোতলের জন্যই খরচ হয় ৩ লিটার পানি। বিশ্বজুড়ে এসব বোতল বানাতে পোড়ানো হয় ১৭ মিলিয়ন ব্যারেল তেল।
খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস বলছে, বিশ্বে বিক্রি হওয়া ৮০ শতাংশ বোতলই রিসাইকেল করা হয় না। অসংখ্য বোতল প্রকৃতিতে আবর্জনা হিসেবে জমা হয়। যে সব স্থানে বিশুদ্ধ পানি সহজলভ্য সেখানে বোতলের পানি ব্যবহার না করা এটি কমিয়ে আনতে পারে অনেকাংশে।
স্যামন মাছ
স্যামন মাছ পেতে পানিতে যে কেমিক্যাল আর অয়ান্টিবায়োটিক দেওয়া হয় তা পানিতে ছড়িয়ে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ব্লুফিন টুনা
আমাদের পছন্দের অনেক মাছই এতো বেশি পরিমাণে ধরা হয়, এসবের ব্যবহার পরিমিত করে না আনলে এর প্রভাব পড়তে পারে সমগ্র খাদ্যশৃঙ্খল আর সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানে।
ধান ও কিছু খাদ্যশস্য
এক কেজি ধান উৎপাদনে লাগে ৩৪০০ লিটার পানি। ধানে খেত থেকে প্রতি বছর ১০০মিলিয়ন টন মিথেন নির্গত হয়। জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাদ্যশস্য উৎপাদনেও ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।
গমের আটা থেকে ১ কেজি রুটি বানাতে খরচ হয় ১৩০০ কেজি পানি। নাস্তা হিসাবে জনপ্রিয় সিরিয়ালে থাকে সিরিয়াল, চিনি, পামতেল, এমনকি চকলেট। অর্থাৎ, একটি খাবার বানাতেই অন্যতম ক্ষতিকর তালিকার অনেক কিছু ব্যবহার করা হয়।
কিছু ফল আর সবজিও!
কলা, আম আর পিচ- খেতে সুস্বাদু, স্বাস্থ্যকর তো বটেই। কিন্তু এসব ফলও বাণিজ্যিক উৎপাদনের দিকে গেলে পরিবেশগত ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়ায়। বানিজ্যকভাবে উৎপাদনের সময় ১ কেজি কলার জন্য ৮০০ লিটার, ১ কেজি আমের জন্য ১৬০০ লিটার আর ১ কেজি খেজুরের জন্য ৩০০ লিটার পানি লাগে। এ দিক দিয়ে আপেল, কমলা ও নাশপাতি জাতীয় ফলের পরিবেশগত প্রভাবটা কম। ভিন্ন পরিবেশ আর জলবায়ুতে ট্মেটো, লেটুস বা বাঁধাকপি উৎপাদন করলেও প্রচুর পানি খরচ হয়। যথাযথ পরিবেশে নিঋদষ্ট মৌসুমে জন্মানো সবজি খেলে কমে আসবে এ সমস্যা।
এই তালিকা দেখে হয়তো অনেকেরই মনে হতে পারে আমরা যা-ই খাই তা-ই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। সত্যি কথা হলো আমাদের খাদ্য উৎপাদনের প্রভাব পড়ে প্রকৃতিতে-পরিবেশে। প্রশ্ন হলো, এই প্রভাব টেকসই কিনা? রোজ রোজ কারখানাজাত মাংস খাবার দরকার আছে কিনা, বিশ্বের অন্য প্রান্তের আম খেতে হবে? আমের মৌসুম নেই এমন সময়ও আম খেতে হবে? পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে যে স্ব খাদ্য তৈরি হচ্ছে মানুষের জন্য, এসব নিয়ে চিন্তাশীল আর যত্নবান হতে হবে।
আমাদের খাদ্যাভ্যাসের কারণে পরিবেশ দূষণের জন্য বেশিরভাগ অংশেই দায়ী খাদ্য উৎপাদনের ইন্ডাস্ট্রিয়াল সংস্কৃতি। অর্থাৎ, আমাদের কৃষি প্রক্রিয়া আর মডেলের পরিবর্তন, অ্যাগ্রো-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কৃষি থেকে অ্যাগ্রো-ইকোলজিক্যাল কৃষির দিকে এগোনো, ছোট ছোট খামারের বিস্তারের মধ্যেই আছে এর সমাধান।