যে বুনো শেকড়ের দাম ১৫ লাখ টাকা!
প্রায় হাজার বছর ধরে শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতা নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়ে আসছে জিনসেং। যৌন দুর্বলতা রোধেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় এই গাছের শেকড়। তবে জিনসেংয়ের একটি শেকড়ের জন্যই আপনাকে ১৭ হাজার ডলার পর্যন্ত গুণতে হতে পারে। যা প্রায় ১৪ লাখ ৬১ হাজার টাকার সমান।
বিশ্বের অন্যতম দামি একটি ঔষুধি এই জিনসেং। বুনো কিংবা ঝোপেঝাড়ে জন্মানো জিনসেংয়ের দাম সবচেয়ে বেশি।
সাধারণত এশিয়ান ও আমেরিকান দুই ধরনের জিনসেংয়ের প্রচলন দেখা যায়। দুধরনের জিনসেংয়েই জিনসেনোসাইডস নামের উপাদান রয়েছে যা শরীরের জন্য উপকারী।
এবার চলুন জিনসেংয়ের পাঁচটি বিজ্ঞানসম্মত উপকারিতার ব্যাপারে জেনে নেওয়া যাক।
সর্দি-কাশি, ফ্লুর যম জিনসেং
জিনসেং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। ফলে সর্দি-কাশি ও বিভিন্ন ফ্লুর বিরুদ্ধে লড়ার সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
পুষ্টিবিদ কেরি গ্যান্স বলেন, 'জিনসেংয়ের শেকড়ের নির্যাস সংক্রামক রোগ-বালাইয়ের বিরুদ্ধে বেশ কার্যকর।' তবে মানব বা পশুপাখির কোষে জিনসেংয়ের প্রভাব নিয়ে করা গবেষণা সমীক্ষাগুলোর অধিকাংশই করা হয়েছে ল্যাবরেটরিতে।'
২০২০ সালে ক্ষুদ্র পরিসরে মানুষের শরীরে জিনসেংয়ের প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালিত হয়। সেখানে দেখা যায়, যারা প্রতিদিন নিয়ম করে জিনসেংয়ের নির্যাসওয়ালা দুটো বড়ি খেয়েছে, তারা গতানুগতিক সর্দি-কাশির ক্যাপসুল খাওয়া মানুষদের চেয়ে ৫০ শতাংশ কম ঠাণ্ডাজ্বর বা ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছে।
আবার কেউ যদি ইতোমধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন তাদের শরীরেও জিনসেং সমানভাবে কাজ করবে। আগের গবেষণাতেই দেখা গিয়েছে- জিনসেং সেবনে অসুস্থতার সময়কাল গড়ে ১৪ দিন থেকে ৬ দিনে নেমে এনেছে।
শক্তিবর্ধক হিসেবে জিনসেংয়ের জুড়ি নেই
জিনসেংয়ের ভেতর জিনসেনোসাইডস থাকার কারণে এটি নিত্যদিনকার অবসাদ দূর করাড় পাশাপাশি শক্তিবর্ধক হিসেবেও সহায়ক। মূলত তিনভাবে এটি কাজ করে থাকে –
কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় রাখে। ফলে এটি অতিরিক্ত উত্তেজিত না হয়ে শরীরের শক্তির মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে।
শরীরের ক্ষত বা প্রদাহের বিরুদ্ধে কার্যকর থেকে ক্লান্তি দূর করতে ভূমিকা পালন করে।
কর্টিসেল নামক একটি স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে যেটি শরীরে ক্লান্তি আনার জন্য দায়ী।
২০১৮ সালের ১০টি গবেষণার একটি পর্যালোচনা অনুসারে, জিনসেং ক্লান্তি বা অবসাদ নিরাময় করে। তবে পর্যালোচনাকারী নিজেই বলছেন এ ব্যাপারে আরো গবেষণার প্রয়োজন।
মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়ায়
একজন পাচক ও রেজিস্ট্রার্ড ডায়েটিশিয়ানের অ্যাবি জেলম্যান বলেন, 'জিনসেংয়ের মস্তিষ্কের জন্য উপকারী কয়েকটি প্রভাব লক্ষ করা গিয়েছে, যেগুলো মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা হ্রাস এবং অ্যালঝেইমারের মতো স্মৃতিভ্রংশ রোগের বিরুদ্ধে কাজ করে।'
২০০৮ সালের এক গবেষণায় কয়েকজন অ্যালঝেইমার রোগীকে ১২ সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন সাড়ে চার গ্রাম করে জিনসেং পাউডার খাওয়ানো হয়। রোগীদের নিয়মিত অ্যালঝেইমারের লক্ষণের ব্যাপারে চেক-আপ করা হতো। দেখা যায়, যে রোগীরা অ্যালঝেইমারের গতানুগতিক পিল বা বড়ি সেবন করেছে তাদের চেয়ে জিনসেং পাউডার সেবনকারীদের অবস্থা তুলনামূলক ভালো।
জিনসেং সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের স্মৃতিগত উন্নতিতেও ভূমিকা রাখতে পারে। ২০১৫ সালে কয়েকজন সাবালক মানুষের ওপর এরকম একটি গবেষণা পরিচালনা করা হয়। কয়েকজন মধ্যবয়স্ক মানুষকে ২০০ মি.গ্রা করে জিনসেংয়ের নির্যাস সেবন করানো হয়। পরে তাদের স্বল্পমেয়াদী স্মৃতিশক্তিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। টেস্টে জিনসেং সেবনকারীরা ভালো স্কোর অর্জন করে।
আবার কয়েকটি গবেষণায় দেখা যায় জিনসেং মস্তিষ্কে বা স্মৃতিগত উন্নতিতে তেমন কোনো ভূমিকা রাখে না। ২০১৬ সালের এক গবেষণায় জানা যায়, কয়েকটি ক্ষেত্রে ৫০০ থেকে ১০০০ মি.গ্রা. জিনসেং নির্যাসও কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না।
গ্যান্স বলেন, 'মস্তিষ্কের উন্নতিতে জিনসেংয়ের প্রভাবের বিষয়টি সম্ভাবনাময় হলেও সুনিশ্চিত নয়। এখনও ১০০ শতাংশ নিশ্চিত হওয়া যায়নি।'
ইরেক্টাইল ডিসফাংশান নিরাময় করে
গ্যান্স জানান, 'সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায় জিনসেং ইরেক্টাইল ডিসফাংশানের চিকিৎসায় কার্যকর প্রভাব রাখতে পারে।'
এই কারণে জিনসেং যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধিতে, লৈঙ্গিক শিথিলতা ও দুর্বলতা দূরীকরণে সহায়ক হতে পারে।
২০১৮ সালের ২৪টি গবেষণার একটি পর্যালোচনা বলছে জিনসেংয়ের নির্যাস সেবনে ইরেক্টাইল ডিসফাংশানের লক্ষণগুলোর উপশম হয়।
জিনসেংয়ের ফলও ইরেক্টাইল ডিসফাংশান দূরীকরণে সাহায্য করে। ২০১৩ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায় ইরেক্টাইল ডিসফাংশানের কয়েকজন রোগী যারা ৮ সপ্তাহ প্রতিদিন ১৪০০ মি.গ্রা. করে জিনসেংয়ের ফলের নির্যাস গ্রহণ করেছে তাদের যৌন দুর্বলতার মাত্রা, বাজারের প্রচলিত ঔষধ সেবনকারীদের চেয়ে কম।
রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে
গ্যান্স এক সাম্প্রতিক গবেষণার উল্লেখ করে বলেন, গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে জিনসেংয়ের ভেতর জিনসেনোসাইডস নামক যে পদার্থ থাকে সেটি রক্তে সুগার লেভেলের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে।
জেলম্যান বলেন, 'জিনসেং রক্তের গ্লুকোজ পরিপাকে সহায়তা করে যার ফলে রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং টাইপ ২ ধরনের ডায়াবেটিসের নিরাময় হয়।'
আগেই বলা হয়েছে, জিনসেং ক্ষত বা প্রদাহের নিরাময়ে সাহায্য করে। বহুমূত্র রোগীর শরীরের ক্ষত বা ঘা শুকাতে অনেক দেরি হয়। ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগীদের জন্য জিনসেংয়ের এ বিষয়টি অনেক বড় একটি ব্যাপার।
২০১৯ সালের একটি গবেষণা বহুমূত্র রোগীদের জন্য আশার আলো নিয়ে এসেছে। গবেষণা অনুসারে, জিনসেং রক্তে সুগারের ভারসাম্য বজায় রাখতে ও ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা রক্ষায় দারুণ সহায়ক হতে পারে। এ দুটো বিষয় বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসায় সহায়ক হতে পারে।
শেষ কথা
কেউ জিনসেংয়ের ফল, শেকড়সহ যেকোনো অংশ সেবন করতে চাইলে তাকে আগে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। ডাক্তার তার শারীরিক অবস্থা, সংবেদনশীলতা, কী কী ঔষধ সেবন করছে ইত্যাদি বিষয় জানার পরে নিশ্চিত করবেন ব্যক্তি জিনসেং সেবন করতে পারবেন কিনা।
গ্যান্সও এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন। তার মতে, 'চিকিৎসা বা শারীরিক কোনো কারণে কেউ জিনসেং সেবন করার আগে রেজিস্ট্রার্ড ডায়াটিশিয়ান বা চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।'
পুরোপুরি প্রমাণিত না হলেও অনেক গবেষণাই বলছে জিনসেংয়ের রোগ প্রতিরোধ, প্রদাহের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারা, শক্তি বৃদ্ধির মতো নানা ধরনের উপকারী দিক রয়েছে।
সূত্র: ইনসাইডার