বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্ট্রিমিং সার্ভিস হয়েও কেন ভারতকে নিয়ে হতাশ নেটফ্লিক্স
২০১৮ সালে দিল্লির এক ব্যবসায়িক সম্মেলনে নেটফ্লিক্স সিইও রিড হেস্টিংস বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, তাদের পরবর্তী ১০ কোটি গ্রাহক আসবে ভারত থেকে।
কিন্তু চার বছর পর, ২০২২ সালে এসে এখন আর হ্যাস্টিংসকে এতো আশাবাদী শুনাচ্ছে না। গত সপ্তাহে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে এক বৈঠকে ভারতে এই স্ট্রিমিং প্লাটফর্মটির ব্যর্থতা নিয়ে হা-হুতাশ করেন তিনি।
"সবকটি বাজারেই আমরা দারুণ সাফল্য পাচ্ছি। কিন্তু ভারতে তেমন সুবিধা করতে পারছি না। ব্যাপারটা হতাশাজনক। তবে এখানেও সামনের দিকে ঝুঁকছি আমরা," বলেন নেটফ্লিক্স সিইও।
মিডিয়া পার্টনার্স এশিয়ার মতে, ভারতে স্ট্রিমিং সার্ভিসগুলোর বাজার প্রায় ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের। এবং এসব সার্ভিসের প্রায় ১০ কোটি গ্রাহক রয়েছেন এই অঞ্চলে।
প্রথম স্ট্রিমিং প্লাটফর্ম হিসেবে ভারতে ছয় বছর আগে আত্মপ্রকাশ করলেও নেটফ্লিক্স কখনোই ঠিক সুবিধা করতে পারেনি এখানে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্ট্রিমিং প্লাটফর্ম হয়েও ভারতে নেটফ্লিক্সের গ্রাহকসংখ্যা মাত্র ৫৫ লাখ। যেখানে ডিজনি প্লাস হটস্টারের গ্রাহকসংখ্যা চার কোটি ৬০ লাখ এবং অ্যামাজন প্রাইমের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় দুই কোটি।
গ্যাংস্টার থ্রিলার 'স্যাক্রেড গেমস'-এর মাধ্যমে ২০১৮ সালে ভারতে এক ধরনের চাঞ্চল্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল নেটফ্লিক্স। ভারতের শীর্ষস্থানীয় দুই পরিচালক ও বলিউডের শীর্ষ কয়েকজন তারকার সম্মেলন হওয়া এই সিরিজ দর্শক-সমালোচক সবারই মন জয় করেছিল।
নেটফ্লিক্সের প্রথম অরিজিনাল ভারতীয় সিরিজের এমন সাফল্যের পর দ্য ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিন লিখেছিল, "এই সিরিজ প্রমাণ করেছে যে হিন্দি চলচ্চিত্রের গতানুগতিক প্রতিভা, হলিউডের মূল্যবোধ এবং সিলিকন ভ্যালির প্রাচুর্যের সমন্বয় করা সম্ভব এবং এর একটি ভবিষ্যৎ রয়েছে।"
দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, সেই ভবিষ্যতের দেখা আর পায়নি নেটফ্লিক্স।
ভারতে বিনোদনের বাজার অনেক বিশাল ও বিস্তৃত। এখানে ২০ কোটিরও বেশি পরিবারে একটি করে টিভি সেট রয়েছে। এবং এসব টিভির পিছনে মাসে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকার মতো খরচ করে থাকে প্রতিটি পরিবার (স্যাটেলাইট খরচ বাবদ)। এখানে বিনোদনের সবচেয়ে জনপ্রিয় তিনটি মাধ্যম হচ্ছে সিনেমা, খেলাধুলা এবং সংবাদ।
সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করে বানানো টিভি শোগুলোরও ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে ভারতে। গতবছর একজন স্টক মার্কেট কালোবাজারিকে নিয়ে বানানো সনিলিভের সিরিজ 'স্ক্যাম ১৯৯২' বেশ সোরগোল তুলেছিল।
এছাড়া সহিংসতা ও অশ্লীলতায় পূর্ণ ডার্ক থ্রিলারগুলোরও আলাদা জনপ্রিয়তা রয়েছে। কেননা, টিভিতে পরিবারের সঙ্গে এ ধরনের শো দেখতে পারেন না সাধারণ ভারতীয়রা।
ভারতে নতুন গ্রাহক আকৃষ্ট করতে অনেক চেষ্টা করেছে নেটফ্লিক্স। সাবস্ক্রিপশন ফি ৬০ শতাংশ কমিয়ে ভারতীয়দের জন্য মাসিক ১৪৯ রুপির একটি সার্ভিসও এনেছে তারা।
এছাড়া ৪০ কোটি মার্কিন ডলারের চেয়েও বেশি অর্থ ব্যয় করে অর্ধ শতাধিক সিনেমা নির্মাণ করেছে নেটফ্লিক্স। এরমধ্যে হিন্দি ভাষার সিনেমা ও শোয়ের সংখ্যা ৩০টিরও বেশি।
এদের মধ্যে প্রত্যাশা অনুযায়ী সাড়া পেয়েছে খুব কম শো ও সিনেমাই। গত বছর স্ট্রিমিং প্লাটফর্মে সর্বাধিক দেখা ১৫টি হিন্দি ভাষার শোয়ের মধ্যে মাত্র একটি ছিল নেটফ্লিক্সের (কোটা ফ্যাক্টরি)।
বিশিষ্ট চলচ্চিত্র সমালোচক এবং কলামিস্ট শুভ্রা গুপ্তা বলেন, "ভারতে নেটফ্লিক্সকে এখনও একটি উচ্চবিত্ত জায়গা হিসেবে দেখেন অনেকে, যার পরিষেবা খরচ অনেক বেশি এবং এখানে শুধু বিদেশী জিনিস দেখানো হয়।"
নেটফ্লিক্সের প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে ডিজনি প্লাসের মূল আকর্ষণ তাদের খেলাধুলার প্রোগ্রামগুলো। আইপিএলসহ ভারতের বড় বড় প্রায় সব টুর্নামেন্টের সত্ত্বই ডিজনির হাতে।
এমনিতেও ভারত বিশ্বের বৃহত্তম ক্রিকেট বাজার। এই সুবিশাল বাজারেরই সুবিধা নিচ্ছে ডিজনি।
এদিকে অ্যামাজন প্রাইমের ব্যবসায়িক মডেল বেশ বিস্তৃত। তারা মোট ১০টি ভারতীয় ভাষায় সিনেমা ও টিভি শো নির্মাণ করে। প্রাইমের অ্যাকশন-ড্রামা, ফ্যামিলি ম্যান গত বছরের সবচেয়ে জনপ্রিয় হিন্দি স্ট্রিমিং শো। গ্রাম্য গ্যাংদের নিয়ে সিরিজ, 'মির্জাপুর'-ও দেশব্যাপী ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
নিজস্ব কনটেন্টের বাইরেও প্রাইমের লাইব্রেরি বেশ সমৃদ্ধ। অরম্যাক্স মিডিয়ার সিইও শৈলেশ কাপুর জানান, ভারতের সমস্ত ব্লকবাস্টার সিনেমার ৪০ শতাংশের মালিকানাই কিনে নিয়েছে প্রাইম। চলতি বছরের শুরুতে হওয়া ভারত-নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট সিরিজও সরাসরি সম্প্রচার করেছে প্রাইম।
এই পরিষেবার সদস্যপদের কিছু বাড়তি সুবিধাও আছে। যেমন, প্রাইমে অ্যাকাউন্ট থাকলে অ্যামাজনে কেনাকাটাতে কিছু বাড়তি ছাড় দেওয়া হয়। এছাড়া আরও আটটি ছোট স্ট্রিমিং পরিষেবার সব কন্টেন্ট দেখারও সুযোগ রয়েছে প্রাইমে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা বিশ্বে যে মডেল ব্যবহার করেছে নেটফ্লিক্স, এখানেও তা ব্যবহার করেই কোটি কোটি ডলার খরচ করেছে মার্কিন কোম্পানিটি। সিনেমা ও সিরিজের জন্য তারা বলিউডের শীর্ষস্থানীয় স্টুডিও এবং প্রযোজকদের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এসব চুক্তি বড় বড় শিরোনামের জন্ম দিয়েছে। এর বাইরে তেমন কিছুই দেয়নি।
বিবিসিকে একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, "এসব প্রযোজকদের কারোরই স্ট্রিমিং শো করার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। যে কারণে তাদের বেশিরভাগ কাজই ফ্লপ খেয়েছে।"
মিডিয়া পার্টনারস এশিয়ার সহ-সভাপতি মিহির শাহ বলেন, "নেটফ্লিক্সের উচিত আরও আঞ্চলিক কন্টেন্ট বানানো। সাথে সাথে কন্টেন্টের নতুনত্বও বজায় রাখতে হবে তাদের।"
নেটফ্লিক্স ইন্ডিয়া অবশ্য বলছে, তারা তাদের এতদিনের কাজ নিয়ে বেশ গর্বিত। কোম্পানিটির একজন মুখপাত্র বলেন, "আমরা সবচেয়ে উৎকৃষ্ট গল্পগুলো দিয়েই আমাদের গ্রাহকদের বিনোদন দেওয়ার চেষ্টা করি। ড্রামা থেকে কমেডি, থ্রিলার থেকে রোমান্স, ফিকশন থেকে নন-ফিকশন; সব ধরনের গল্পই বলার চেষ্টা করি আমরা।"
ভারতের স্ট্রিমিং বাজার ২০২৬ সালের মধ্যে দ্বিগুণ হবে। নতুন গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে হলে নেটফ্লিক্সে তাই স্থানীয় কন্টেন্টের উপর মনোযোগ দিতেই হবে।
তবে এই কাজও সহজ হবে না। ইতোমধ্যে ৭৫টিরও বেশি স্ট্রিমিং সার্ভিস রয়েছে ভারতে। এদের মধ্যে নিজেদের স্বাক্ষর রাখতে পেরেছে হাতেগোনা কয়েকটি সার্ভিস। এখন পর্যন্ত ভারতে ২২৫টি স্ট্রিমিং শো নির্মিত হয়েছে, এর মধ্যে মাত্র ১৫ থেকে ২০টি ব্যবসাসফল হয়েছে।
শৈলেশ কাপুর বলেন, "সবাই বিশাল পরিমাণে সিনেমা-সিরিজ বানাচ্ছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। সবই ঠিক আছে। তবে আপনাকে মনে রাখতে হবে, বিনোদনের বাজার হিসেবে ভারত বেশ জটিল।"
সূত্র: বিবিসি।