কাবুল নয়, পুরান ঢাকার জাইতুনেই পেয়ে যাবেন অমৃতস্বাদের কাবুলি পোলাও!
সুপম ভাইয়ের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। আফগানিস্তানের ভূত-ভবিষ্যৎ অস্ত্রোপচার করলাম কিছুক্ষণ। আফগানিস্তানের খাবার প্রসঙ্গে একপর্যায়ে কাবুলি পোলাওয়ের কথা শুনি। খাবার হিসাবে পোলাও আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। এ ধরণের উচ্চ ক্যালরিযুক্ত বেশিরভাগ খাবারই পাঠানদের প্রিয় এবং মধ্য এশিয়ায় ভীষণ জনপ্রিয়। ইরান ও আফগানিস্তানের মতো অঞ্চলের শাসকদের হাত ধরে এসব খাবার উপমহাদেশে প্রবেশ করেছিল। তাই কাবুলি পোলাওয়ের নাম শুনেই মানসপটে বাদশাহী খাবারের একটা ছবি ভেসে উঠলো। তখনই সুপম ভাই জানালেন পুরান ঢাকার রাজকীয় এক কাবুলি পোলাওয়ের ঠিকানা। জাইতুন বিরিয়ানী হাউজ। ভালোমতো নাম-ধাম জেনে নিয়ে এক শুক্রবারে শাহী খাবারের স্বাদ নিতে চলে যাই এই বিরিয়ানী হাউজে।
সুপম ভাইয়ের পথনির্দেশনা অনুযায়ী লালবাগ থানার নবাবগঞ্জ বাজার দিয়ে একটু হেঁটে যেতেই জাইতুন বিরিয়ানি হাউজের দেখা মিলবে।
নবাবগঞ্জ বাজার জামে মসজিদ থেকে জুম্মার নামাজ শেষ করে বের হয়ে দেখি, এক দোকানের সামনে জনা পঞ্চাশেক মানুষ ভিড় করেছে। পুরান ঢাকার সংকীর্ণ রাস্তার কথা মোটামুটি সকলেই জানি। এরকম একটি রাস্তায় এত মানুষের ভিড় একইসাথে ভয় এবং কৌতূহলী করে তুলল। এগিয়ে যেতেই দেখা গেল, এটাই আমার সেই কাবুলি পোলাওয়ের ঘর, 'জাইতুন বিরিয়ানী হাউজ'! ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে নিশ্চিত হলাম যে, নাহ! কোনো গন্ডগোল হয়নি। রেস্তোরাঁর ভেতরে স্থান সংকুলান না হওয়াতেই বাইরে খেতে আসা মানুষজনের এই অপেক্ষা।
আমি বেশ খানিকটা সময় অপেক্ষার পর তিনজনের একটি দলের সাথে যোগ দিলাম। দ্রুত একটি ফাঁকা টেবিলে বসে গেলাম। টেবিলে রাখা মেন্যুকার্ড দেখা শেষ হতেই 'গরুর কাবুলি পোলাও' অর্ডার করেছি। গরুর কাবুলি পোলাওয়ের দাম ৩১০ টাকা। জাইতুন বিরিয়ানী হাউজে কাবুলি পোলাও ছাড়াও গরুর দম বিরিয়ানি (১৯০৳), গরুর কাচ্চি (২০০৳), বিফ-স্টিক চাপ পোলাও (২৫০৳), চিকেন টিকা কাবাব (২৫৳), চিকেন কোপ্তা (৩০৳) ইত্যাদি পাওয়া যায়। কেউ চাইলে আস্ত মুরগীসহ পোলাওয়ের ব্যবস্থাও আছে এখানে। তবে সেক্ষেত্রে অগ্রিম অর্ডার করে রাখতে হবে। এছাড়াও বোরহানী এবং ফিরনির পাশাপাশি পছন্দমতো হালকা পানীয়ের ব্যবস্থা তো থাকছেই।
খেতে কেমন এই কাবুলি পোলাও?
জাইতুনে খাবার রান্না করা হয় হোটেল থেকে একটু দূরেই, আলাদা রান্নাঘরে। এ কারণে গরম খাবার পাওয়া যায় প্রায় সবসময়ই। শেষ না হতেই নতুন হাঁড়ি চলে আসে। খাবারে ঘাটতি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই এ কারণে, প্রচুর ভিড় থাকলেও তাই অর্ডার দেয়ার সাথে সাথেই টেবিলে খাবার পৌঁছে যাচ্ছে। বাসমতি চালের তৈরী গরম পোলাও থেকে আসা ঘ্রাণ নাকে প্রবেশ করতেই রাজ্যের ক্ষুধা এসে পেটে ছুঁচোর কেত্তন শুরু করে দিল।
মোটামুটি বিস্ময় নিয়ে দেখলাম ধোয়া ওঠা প্লেটের অর্ধেক অঞ্চল দখল করে রেখেছে পোলাওয়ের সাথে থাকা গরুর মাংসের চাপ। পোলাওয়ের প্রথম লোকমা মুখে দিয়েছি। হালকা ভাজা গাজর কুচি, বাদাম আর বড় আকৃতির ছোলার মিশেলে যেন অপূর্ব এক স্বাদে মুখ ভরে গেল। দম দিয়ে (দীর্ঘক্ষণ ধরে আগুনের তাপে রান্না করা) গরুর মাংস নরম করা হয়েছে, ফলে কোনো রকম কসরৎ নেই মাংস ছিঁড়তে। হাত দিয়েও যেন যেন ভাঁজে ভাঁজে থাকা মাংস ছাড়িয়ে নেয়া যায়। আর যে পরিমাণ পোলাও দেয়া হয়েছে তা একজন ভোজনরসিকের জন্যও যথেষ্টই বলা যায়।
পোলাওয়ের সাথে খাওয়ার জন্য গরুর মাংসের ঝোল আলাদা বাটিতে দেয়া আছে। এটি কিছুটা ঝাঁঝালো স্বাদের। আফগানিস্তানের খাবারে বিশেষত কাবুলি পোলাওয়ে তুলনামূলক কাবুলি ছোলা, বিভিন্ন বাদাম ইত্যাদির অত্যধিক ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। অরিজিনাল কাবুলি পোলাওয়ে ঝাল কিংবা মশলার পরিমাণ একেবারেই কম থাকে। এছাড়া সেখানে রান্নায় তেলের পরিবর্তে ঘি ব্যবহার করা হয়। এদিক থেকে জাইতুনের কাবুলি পোলাওয়ে ঝাল এবং মশলার যথেষ্ট ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। বলাবাহুল্য, এই পাথর্ক্য বোধকরি এদেশের খাদ্যরসিকদের কথা বিবেচনা করেই।
জাইতুন বিরিয়ানী হাউজের স্বত্বাধিকারী মো. রাজিব হাসান রাজা বলেন, ''অরিজিনাল কাবুলি পোলাওয়ে ঝালের পরিমাণ কম থাকে। অন্তত, আমাদের দেশের রান্নার সাথে যদি তুলনা করা হয় তাহলে একথা একেবারেই সত্য। এখন আমরা যদি আমাদের রান্নাতে মশলার পরিমাণ কমিয়ে দিই তাহলে অধিকাংশ ব্যক্তিই খেতে পারবেন না। আমাদের দেশীয় এবং স্থানীয়দের রান্নায় খাবারে মশলা এবং ঝাল থাকা চাই। এই দিকগুলো সমন্বয় করে আমরা কাবুলি পোলাও রান্না করি।"
জাইতুনে যেভাবে কাবুলি পোলাও
জাইতুন বিরিয়ানী হাউজের প্রতিষ্ঠাতা মো. রাজিব হাসান রাজা। নবাবগঞ্জেই জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। কাজ করতেন কাঁটাবনের একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে, প্রায় ১৭ বছর। এরপর উচ্চাকাঙ্ক্ষার বশে পাড়ি জমান কাতারে। প্রবাস জীবন ভাল না লাগায় আবার দেশে ফিরে আসেন। স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে ঠিক করেন নিজ এলাকাতেই ব্যবসা শুরু করবেন।
এরপর ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে নবাবগঞ্জ বাজারে দোকান ভাড়া নিলেন। দোকানের নাম দিলেন 'জাইতুন বিরিয়ানী হাউজ'। শুরুর দিকে এখানে 'আস্ত মুরগী পোলাও' বেশ জনপ্রিয়তা পায়। এর পেছনের গল্পটা ছোট হলেও জাইতুনের জন্য তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। রাজার মতে, তখন রেস্তোরাঁ একেবারেই নতুন। তেমন কোনো নাম-ডাক হয়ে ওঠেনি। কেউ একজন আস্ত মুরগীর পোলাও খেয়ে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের একটি ফুডব্যাংক গ্রুপে শেয়ার করেন। সেই রিভিউয়ের পর কিছুদিনের মধ্যেই রেস্তোরাঁতে আস্ত মুরগী পোলাওয়ের চাহিদা বেড়ে যায়। এটি বাংলাদেশে করোনা মহামারি আসার আগের ঘটনা।
তারপর কাবুলি পোলাওয়ের শুরু কিভাবে? জানতে চাইলাম। কিছুক্ষণ মুচকি হেসে রাজা বলেন, ''আমি তখন কাতারে কাজ করি। আমার কর্মস্থলের পাশেই একটি আফগান রেস্তোরাঁ ছিল। সেখানকার মালিক থেকে কর্মচারী সবাই আফগানিস্তানের অধিবাসী। কাজ শেষে সহকর্মীদের সাথে প্রায়ই সেখানে খেতে যেতাম। ওখান থেকে এই খাবার রান্না বিষয়ক জ্ঞান। দেশে ফিরে ওই কথা মনে করেও রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করার আগ্রহ তৈরী হয়।"
"জাইতুনে প্রথম দিকে কাবুলি পোলাও ছিলো না। কিন্তু পরিকল্পনা মাথায় ছিল। প্রথমে বাজার চলতি দিয়েই যাত্রা। একদিন কাবুলি পোলাও নিয়ে আমার বাবুর্চিদের সাথে পরামর্শ করি। তাদের মধ্যে আগ্রহ দেখে কাবুলি পোলাওয়ের রেসিপি দেখাই। পরদিন তারা ওই রেসিপি অনুসরণ করে কাবুলি পোলাও রান্না করে খাওয়ায়। সত্যি বলতে কি সেদিনের কাবুলি পোলাও খেয়ে আমার কাতারের সেই রেস্তোরাঁর কথা মনে পড়ে যায়। একেবারে আসল স্বাদের কাবুলি পোলাও ছিল এটা।"
এভাবেই জাইতুন বিরিয়ানী হাউজে 'কাবুলি পোলাও'য়ের আগমন ঘটে। কিন্তু প্রথমবার পরিবেশনের পরেই যেন বিপত্তি বেঁধে গেল। রেস্তোরাঁর ফেসবুক পেইজে কেউ একজন নেতিবাচক মন্তব্য করে বসেন। মন্তব্যকারীর মতে, তিনি 'অথেনটিক কাবুলি পোলাও' খেয়েছেন, তাদেরটার মাংস বেশ ঝাঁঝালো স্বাদের হয়। জাইতুনে এসে তিনি সেটা পাননি।
এই অভিযোগ নিয়ে রাজা বিস্তর মাথা ঘামালেন। ''এরপর আমি বাবুর্চিদেরকে মাংসে মশলা কিছুটা কমিয়ে দেয়ার পরামর্শ দিই। এতে করে মাংসে কিছুটা 'র ফ্লেভার' বজায় থাকবে। পরিবেশিত খাবার যাতে সবার রুচির সাথে মিলতে পারে এজন্য আলাদা করে মশলাযুক্ত ঝোলের ব্যবস্থা থাকে'। এতে কাজ হল। এর ফলে যারা হালকা মশলাযুক্ত খাবার খেতে পছন্দ করেন তারাও কাবুলি পোলাওয়ের স্বাদ উপভোগ করতে পারছেন এখন", বললেন রাজা।
জাইতুন বিরিয়ানী হাউজে খেতে আসা বেশিরভাগ মানুষই কাবুলি পোলাওয়ের টানে ছুটে আসেন দূর-দূরান্ত থেকে। এমনই একদলের সাথে কথা হলো। একই টেবিলে বসেছিলাম আমরা। আমি ব্যতীত বাকি তিনজন এসেছেন নারায়ণগঞ্জ থেকে। উদ্দেশ্য কাবুলি পোলাও খাওয়া। শুধু শুক্রবারেই গরুর কাবুলি পোলাও পাওয়া যায় বলে তারা আজকেই এসেছেন। এই দলের একজন রফিক আহমেদ। পোলাও খেতে খেতেই জানালেন ইউটিউবের একটি রিভিউ দেখে তারা এখানে খাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আরেক দম্পতি খাসির কাবুলি পোলাও খাওয়া শেষ করে এর পরিমাণ সম্পর্কে বেশ ইতিবাচক মন্তব্য করলেন। রিফাত জামান বলেন, ''আমি পোলাও পছন্দ করি। অন্যান্য রেস্তোরাঁর সাথে তুলনা করলে এখানে দামের তুলনায় পোলাও পর্যাপ্ত পরিমাণে দেয়া হয়েছে। স্বাদ তো আছেই।"
তবে রেস্তোরাঁয় বসার জায়গার স্বল্পতা নিয়ে অভিযোগ করলেন বেশ কয়েকজন। দীর্ঘক্ষণ রেস্তোরাঁর বাইরে অপেক্ষা করতে হয় যা খানিকটা বিরক্তির বলে জানান রফিক আহমেদ। তবে রেস্তোরাঁ মালিক রাজা বলেন, ''এরকম ভিড় কেবল শুক্রবারেই হয়। অন্যান্য দিন ফাঁকাই থাকে।"
ব্যবসা শুরুর জন্য এখন পর্যন্ত কোনো ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করেননি রাজিব হাসান রাজা। ব্যক্তিগত সঞ্চয় এবং পরিবারের সদস্যদের আর্থিক সহায়তা মিলিয়ে প্রায় ৭ লক্ষ টাকা নিয়ে জাইতুনের পথ চলা শুরু হয়। বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠানে ৬ জন বাবুর্চিসহ মোট ১৩ জন ব্যক্তি কর্মরত আছেন। তাদের কেউ দৈনিক চুক্তিতে আর কেউ মাসিক চুক্তিতে কাজ করেন।
প্রতিদিনের আয়-ব্যয়ের হিসাব সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজা বলেন, ''প্রতিদিন গড়ে ৬ হাজার টাকার বাজার করতে হয়। তবে, শুক্রবারের হিসাব একটু আলাদা। শুধু শুক্রবারেই গরুর কাবুলি পোলাও বিক্রি করি। শুক্রবারে খাসি এবং গরুর কাবুলি পোলাওয়ের চাহিদা বেশি থাকে। ক্রেতাদের সামলাতে আমাদেরকে হিমশিম খেতে হয়। ফলে, শুক্রবারে আমাদের খরচ অন্যদিনের চেয়ে বেশিই হয়।"
মাসিক আয়ের বিষয়ে রাজা খাবারের মানের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, ''আমরা খাবারের মান এবং পরিমাণ নিয়ে আপোসহীন থাকতে চাই। আবার নতুন প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে আমাদেরকে ভোক্তাদের ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হয়। খাবার বিক্রি বাবদ আমাদের লাভ খুব সীমিত। প্রতি শুক্রবারে গড়ে ৪০ হাজার টাকার খাবার বিক্রি করা হয়।"
রাজিব হাসান রাজা দেশের সবার কাছে তার রেস্তোরাঁর কাবুলি পোলাও পৌঁছে দিতে চান। এজন্য তিনি প্রতিটি জেলায় জাইতুন বিরিয়ানী হাউজের কমপক্ষে একটি করে শাখা খুলতে আগ্রহী। শুরুতে ব্যবসা ক্রমশ উন্নতির দিকে এগোতেই করোনার প্রকোপ বেড়ে গিয়েছিল। গত বছর নিজেও আক্রান্ত হয়েছিলেন করোনা ভাইরাসে। মহামারির সময় ব্যবসায়িক ক্ষতির কথা স্বীকার করেন রাজা। তবে, করোনা মহামারিসহ অন্যান্য বাধা ডিঙিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।