কীভাবে বুঝবেন, সময় হয়েছে ব্রেক-আপের?
রোমান্টিক কমেডিতে নিশ্চয়ই দেখেছেন, দুজন মানুষ কীভাবে হাজারো বাঁধার পাহাড় ডিঙিয়ে একসাথে থাকার পথ খুঁজে নিচ্ছে। নেপথ্যের কারণটা খুব সহজ: তারা একে অপরকে ভালোবাসে। কিন্তু পর্দার বাইরে বাস্তব জীবনে ব্যাপারটা এত বেশি সহজও কিন্তু নয়। একটি সম্পর্ককে চিরদিন টিকিয়ে রাখতে কেবল পারস্পরিক প্রেমই সবসময় যথেষ্ট নয়।
তবে হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে রোমান্টিক ভালোবাসার অনুভূতি এতটাই শক্তিশালী হয় যে, তার সুবাদে দুজন মানুষ সিদ্ধান্ত নিতে পারে সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে। তা সে সম্পর্ক যতটাই বিষাক্ত, অস্বাস্থ্যকর, অপরিপূর্ণ ও অসুখী হোক না কেন।
যেমন ধরুন, ২০১৫ সালে ফ্রন্টিয়ার্স ইন হিউম্যান নিউরোসায়েন্সে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, একজন ব্যক্তি যখন তার রোমান্টিক সঙ্গীর ছবির দিকে তাকায়, মন ভালো করা রাসায়নিক উপাদান ডোপামিনের নিঃসরণ ঘটে তাদের মস্তিষ্কে।
এই রাসায়নিকের প্রভাবে লোকের মনে যে অনুভূতির সৃষ্টি হয়, তার ফলে তারা একটি অসন্তোষজনক সম্পর্ক ছেড়ে বেরিয়ে আসার মতো যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্তকেও অগ্রাহ্য করতে পারে। কিন্তু এতে করে সাময়িকভাবে তারা সন্তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত থাকলেও, দীর্ঘমেয়াদে তাদেরকে নানা ধরনের ভোগান্তি ও বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। চিরকালীন অবসাদ নেমে আসে তাদের জীবনে।
তাই চলুন দেখা যাক, বিশেষজ্ঞদের মতে কোন ইঙ্গিতগুলো পেলে বুঝতে পারবেন, সময় হয়েছে একটি সম্পর্ক থেকে সসম্মানে বেরিয়ে আসার।
যখন আপনার চাহিদাগুলো পূরণ হবে না
ম্যাচমেকিং অ্যান্ড কোচিং সার্ভিস 'এলি সাইমন'-এর সিইও জুলি ওয়াডলি বলেন, প্রত্যেক মানুষেরই সম্পর্ক থেকে আলাদা আলাদা কিছু 'চাহিদা' থাকে। হতে পারে সেটি মানসিক ও আবেগিক চাহিদা, যেমন আপনি চান আপনার সঙ্গী আপনার সঙ্গে বেশি বেশি অবসর সময় কাটান। আবার হতে পারে সেটি বস্তুগত চাহিদা, যেমন অর্থ-সম্পদ ইত্যাদি।
যদি কোনো সম্পর্কে একজন সঙ্গী মনে করেন যে অন্যজন তার চাহিদাগুলো পূরণ করছে না বা করতে পারছে না, তাহলে সবার প্রথমে দুজনের মধ্যে খোলামেলা আলাপটাকেই জরুরি বলে মনে করেন ওয়াডলি। কিন্তু যদি দেখা যায় যে আলাপ-আলোচনার পরও পিছিয়ে পড়া সঙ্গী আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছে না তার সঙ্গীর চাহিদা মেটানোর, তাহলে তিক্ততা না বাড়িয়ে ওই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসাই উচিত ওয়াডলির মতে।
সঙ্গীর থেকে চাহিদা পূরণ না হওয়া সত্ত্বেও মানুষের একটি সম্পর্ক আঁকড়ে ধরে থাকতে চাওয়ার যে প্রবণতা, তার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো সিঙ্গেলদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক ধারণা। অনেকেই হীনম্মন্যতায় ভোগে যে, একটি সম্পর্ক যদি তারা টিকিয়ে রাখতে না পারে, ভবিষ্যতে হয়তো আর কোনো সম্পর্কেই সফল হবে না।
কিন্তু ওয়াডলির বিশ্বাস, এ ধরনের চিন্তাভাবনা একজন মানুষের মানসিক শান্তিকে শুধু ব্যাহতই করে, এবং কেড়ে নেয় তার জীবনের মূল্যবান সময়। "এরচেয়ে আপনারা বরং নিজের জন্য কিছুটা সময় নিয়ে চেষ্টা করে দেখতে পারেন, আপনার প্রত্যাশা পূরণের উপযোগী কারো সন্ধান পান কি না।"
যখন আপনি সেই চাহিদাগুলো পূরণে অন্যের দ্বারস্থ হন
মনে করুন, অফিসে আপনার প্রমোশন হয়েছে। কিংবা হুট করে একটি ফ্যামিলি এমার্জেন্সি চলে এসেছে। এরকম পরিস্থিতিতে সবার আগে আপনি কোন মানুষটিকে জানাবেন? কার সঙ্গে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত সুখ বা দুঃখ ভাগ করে নিতে চাইবেন? একটি পরিপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে, সেই ব্যক্তিটি নিশ্চিতভাবেই হবেন আপনার সঙ্গী।
ওয়াডলির মতে, কাজের জায়গায় কোনো বিশ্বস্ত সহকর্মী কিংবা জীবনসঙ্গীর পাশাপাশি অন্য কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু থাকা খারাপ না। কিন্তু সেই সহকর্মী বা বন্ধুটিকে যদি আপনি ক্রমাগত এমন জায়গায় বসাতে থাকেন, যেখানে থাকার কথা আপনার প্রকৃত সঙ্গীর, তাহলে বিষয়টি নিঃসন্দেহে কপালে ভাঁজ ফেলার মতো।
ওয়াডলি বলেন, "আপনার চিন্তা যদি এমন হয় যে, 'আমার প্রেমিক আছে, আবার একজন খুব ভালো ছেলে বন্ধুও রয়েছে। সেই ছেলে বন্ধুটি নিয়মিতই আমাকে মানসিকভাবে সাহস যোগায়। তাই প্রেমিকের বদলে আমি যেকোনো দরকারে ওই ছেলে বন্ধুটির দ্বারস্থই হতে পারি,' তাহলে নিঃসন্দেহে আপনার সম্পর্কে কোথাও একটা গড়বড় রয়েছে।"।
তাই যদি এমন হয় যে আপনাদের সম্পর্কে আপনি নিজে বা আপনার সঙ্গী, যেকোনো একজন অন্য কারো কাছ থেকে ক্রমাগত বিভিন্ন মানসিক ও শারীরিক সাহায্য নিয়ে চলেছেন, তাহলে সেটি একটি পরিষ্কার ইঙ্গিত যে এখন আপনাদের উচিত সম্পর্কটিকে থামিয়ে দেওয়া।
যখন আপনি আপনার সঙ্গীর কাছে আরও বেশি চাইতে ভয় পান
আপনার যা প্রয়োজন, তা যদি আপনি আপনার সম্পর্ক থেকে না পান, তাহলে সেটির বিষয়ে সঙ্গীর সঙ্গে খোলামেলাভাবে কথা বলাটা আপনার জন্য শুরুর দিকে খানিকটা অস্বস্তিকর হতেই পারে। কিন্তু ওয়াডলির মতে, দীর্ঘস্থায়ী ও স্বাস্থ্যকর সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিঃসঙ্কোচ যোগাযোগের কোনো বিকল্প নেই।
"অনেক মানুষই হয়তো এরকম ক্ষেত্রে ভাববে, 'এগুলো সরাসরি বলায় হয়তো মনে হবে আমি অনেক বেশি চাইছি, এবং আমি বাস্তববাদী নই," ওয়াডলি বলেন। তাই নিজের চাহিদাগুলোর কথা মুখ ফুটে বলার বদলে তারা নিজেদের অসন্তুষ্টি-অতৃপ্তিকে অবদমিত রাখে, সঙ্গীর 'বোঝা' হয়ে ওঠার ভয়ে সুখের ভান করে চলে।
"কিন্তু তারপর কোনো একসময় ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়," তিনি বলেন। তখন তিক্ততা, অসন্তোষ, রাগ-ক্রোধ পুঞ্জীভূত হয়ে বড় ধরনের ঝগড়ায় রূপ নেয়। এতে করে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সম্পর্ক। অথচ আগেই এসব ব্যাপার নিয়ে দুজনের খোলামেলা কথা হলে হয়তো কোনো বড় ঝামেলাই হতো না।
তাই নিজের সত্যিকারের অনুভূতিকে সঙ্গীর থেকে লুকিয়ে রাখার ফলে হয়তো একটি অপরিপূর্ণ সম্পর্ককে প্রলম্বিত করে ঠিকই, কিন্তু পুরোপুরি বাঁচাতে পারে না। ওয়াডলি বলেন, আপনি যদি নিজের সঙ্গীর সঙ্গে মন খুলে কথা বলার সাহসই সঞ্চয় করতে না পারেন, তাহলে তার সঙ্গে বিচ্ছেদই আপনার জন্য হতে পারে মঙ্গলজনক।
যখন আপনার পরিবার ও বন্ধুরা আপনাদের সম্পর্ককে সমর্থন করে না
নিউ ইয়র্ক-ভিত্তিক ডেটিং ও রিলেশনশিপ কোচ লিন্ডসে ক্রিসলারের মতে, আপনার পরিবারের বিশ্বস্ত সদস্য ও আপনার বন্ধুরা আপনার সম্পর্কের ব্যাপারে কী ভাবে, সেটাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
"যদি কেউই আপনার সম্পর্ককে সমর্থন না করে, তবে তা একটি বিপদসঙ্কেত," ক্রিসলার বলেন। তার মতে, আপনাকে যে মানুষগুলো ভালোবাসে, তাদের যদি মনে হয় ভালোবাসার সম্পর্কে আপনি সুখী নন, তাহলে তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়াটাই ভালো হবে।
আবার যদি বিষয়টা এমন দাঁড়ায় যে সম্পর্ক নিয়ে আপনার পরিবার ও বন্ধুদের চিন্তাকে আপনার অগ্রাহ্য করতে হচ্ছে, তাহলে এটিও একটি সঙ্কেত যে এখন আপনার জন্য এই সম্পর্কটা শেষ করে দেওয়াই মঙ্গল।
ক্রিসলার বলেন, "আপনি আপনার বন্ধুদের মিথ্যে বলছেন। আপনি নিজেকে মিথ্যে বলছেন। যখন আপনি আপনার কাছের মানুষদের চিন্তাগুলো শুনতে চান না বলে তাদের থেকে দূরে সরে যেতে চান, তখন সম্ভবত তারা ঠিকই বলছে — এই সম্পর্কটা আপনার জন্য কাজ করছে না।"
যখন আপনার মনে হয় আপনি আপনার সঙ্গীর সাথে থেকে যেতে বাধ্য
২০১৬ সালে কারেন্ট সাইকোলজির এক গবেষণায় দেখা যায়, একজন ব্যক্তি কোনো সম্পর্কে যত বেশি সময় ও শ্রম বিনিয়োগ করে, সে ওই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে তত বেশি মরিয়া থাকে। এটি অনেকটা অর্থ বিনিয়োগের প্রবণতা 'সাংক কস্ট ইফেক্ট'-এর মতো, যেখানে কোনো ব্যবসায়ী একটি ব্যবসায়ে অনেক টাকা, শ্রম ও সময় বিনিয়োগ করে ফেললে, বারবার ক্ষতির শিকার হওয়া সত্ত্বেও সেটি থেকে হাত গুটিয়ে নিতে চায় না।
ওয়াডলির মতে, "মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সময়ের সঙ্গে সাফল্যের খুব একটা সম্পর্ক নেই।" অর্থাৎ আপনি আপনার সঙ্গীর সাথে দীর্ঘদিন ধরে আবদ্ধ রয়েছেন বলেই যে আপনাদের সম্পর্কটা সুখের হয়ে যাবে, এমন কোনো কথা নেই।
তাই যদি স্রেফ দীর্ঘদিন একসঙ্গে রয়েছেন বলেই আপনার মনে হয় আপনি আপনার সঙ্গীকে ছেড়ে যেতে পারবেন না, তাহলে নির্ঘাত আপনাদের সম্পর্কে কোনো অপূর্ণতা রয়েই গেছে।
যখন আপনি আপনার সঙ্গীকে পছন্দ করেন না
অনেকের কাছেই কথাটি শুনে অদ্ভুত লাগতে পারে। কিন্তু ক্রিসলারের মতে, এমনটি হতেই পারে যে আপনি একজন ব্যক্তিকে ভালোবাসেন ঠিকই, কিন্তু তাকে পছন্দ করেন না। সেরকমই যদি হয়ে থাকে, তাহলে সাময়িকভাবে আপনি তার সঙ্গে মানিয়ে-গুছিয়ে চলতে পারলেও, অনেক চ্যালেঞ্জিং সময় আসবে যখন আপনার পক্ষে আর জোর করে তার প্রতি ভালোবাসা ধরে রাখা সম্ভব হবে না।
ঝগড়াঝাঁটি, মনোমালিন্য, বচসা কোন দম্পতির মধ্যে হয় না! সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর, ভালোবাসাময় সম্পর্কেও এগুলোর অস্তিত্ব দেখা যায়। কিন্তু ক্রিসলারের মতে, সেখানে মানুষগুলোর অবচেতন মনে এই চিন্তাগুলোও থাকে যে, "এই মানুষটি আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। যত যা কিছুই হোক, আমি এই মানুষটির সঙ্গেই সুখের সময় কাটাব।" কিন্তু যদি দুজন মানুষ একে-অপরকে পছন্দই না করে, তাদের পক্ষে জীবনের কঠিন সময়গুলো একসঙ্গে পার করা সম্ভব হয় না।
কিন্তু তারপরও, ভালোবাসার মানুষটির হাত ছেড়ে দিয়ে হুট করে চলে যাওয়া সম্ভব হয় না। এমনকি সম্পর্কটি যত তিক্তই হোক না কেন। এক্ষেত্রে ক্রিসলারের উপদেশ হলো মস্তিষ্কের যুক্তিনির্ভর অংশটির কথা শোনা। ভালোবাসার নেশাতেই সারাক্ষণ বুঁদ হয়ে থাকলে চলবে না!
যখন আপনার সঙ্গী আপনার উপর নির্যাতন চালায়
সঙ্গীর শত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনও মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছে, ভালোবাসা টিকিয়ে রাখছে, এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে ভূরিভূরি। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন একটি জরিপ চালায়। সেই জরিপে দেখা যায়, প্রতি চারজনে একজন নারী এবং প্রতি দশজনে একজন পুরুষ সঙ্গীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে এ হার যে আরও বেশি, সে কথা বলাই বাহুল্য।
এখন প্রশ্ন হলো, কেন নির্যাতক সঙ্গীর সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক চালিয়ে যায় অনেক নারী-পুরুষ? ২০১০ সালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথের এক গবেষণা অনুযায়ী, অর্ধেকের বেশি নারীই তাদের নির্যাতনকারী সঙ্গীকে মনে করে "অতিমাত্রায় নির্ভরযোগ্য"। এছাড়া প্রতি পাঁচজনে একজন নারী মনে করে, তাদের নির্যাতনকারী পুরুষ সঙ্গীদের মধ্যে দারুণ কিছু ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেমন হতে পারে তারা অনেক 'কেয়ারিং'।
অনেক নারী-পুরুষকে জোর করে, শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে বা অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার মাধ্যমে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে বাধ্য করা হয় ঠিকই, তবে গবেষণায় উঠে এসেছে যে নির্যাতনকারী সঙ্গীর ব্যাপারে এ জাতীয় ধারণার কারণেও অনেকেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে।
কিন্তু ক্রিসলারের মতে, একজন নির্যাতকের সঙ্গে কখনোই সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়া যাবে না। যখনই আপনি টের পাবেন যে আপনার সঙ্গী একজন নির্যাতক, তৎক্ষণাৎ তার সঙ্গে সম্পর্কে ইতি টানার রাস্তা খুঁজতে হবে আপনাকে। কেননা, "সবার আগে নিজেকে ভালোবাসা জরুরি।"
- সূত্র: টাইম