স্কুইড গেম, কে-ড্রামা ও কে-পপের পর, বিশ্বজুড়ে ঝড় তোলার অপেক্ষায় কোরিয়ান ওয়েবটুন
প্রযুক্তিজগৎ সম্পর্কে আপনার খুব ভালো ধারণা রয়েছে? তারপরও, বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ উপার্জন করা অ্যাপটির নাম আপনার না শোনার সম্ভাবনাই বেশি!
পিকোমা, একটি ডিজিটাল মাঙ্গা সাবস্ক্রিপশন সার্ভিস। ২০২১ সালে টিকটক ও ইউটিউবের পর তারাই ছিল সবচেয়ে বেশি লাভ করা নন-গেমিং অ্যাপ — এমনটিই জানাচ্ছে মার্কেট ইন্টেলিজেন্স কোম্পানি, সেন্সর টাওয়ার। তাদের হিসেব অনুযায়ী, সেরা তিনের তালিকায় জায়গা পায়নি অ্যামাজনের মতো মোবাইল কমার্স কিংবা অন্যান্য জনপ্রিয় ফুড ডেলিভারি অ্যাপও।
২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করে পিকোমা। আর গত অক্টোবরে, মাত্র ছয় বছরেরও কম সময়ের মধ্যে, অ্যাপটির ট্রানজেকশন বা ব্যবসায়িক লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। নিঃসন্দেহে এটি অসাধারণ এক অর্জন, কেননা এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী মাত্র ১৫টি নন-গেমিং অ্যাপই ১ বিলিয়ন ডলার ট্রানজেকশনের মাইলফলক স্পর্শ করতে পেরেছে।
পিকোমার এই সাফল্য আরও বেশি অভাবনীয়, কেননা তাদের সার্ভিস চালু রয়েছে কেবল জাপানেই। শুধু একটি দেশে কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমেই এত বেশি আয়, ভাবা যায়!
এবার শোনানো যাক আরও চমকপ্রদ তথ্যটি। জাপানে সার্ভিস চালু রয়েছে মানেই বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই মাঙ্গা অ্যাপটির জাতীয়তা যে জাপানি, তা কিন্তু নয়। অ্যাপটি দক্ষিণ কোরিয়ার, যারা সাম্প্রতিক অতীতে 'স্কুইড গেম', 'প্যারাসাইট' কিংবা কে-পপ ও কে-ড্রামার মাধ্যমে গোটা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছে।
পিকোমা অ্যাপের ডেভেলপার কাকাও পিকোমা, যেটি দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় মেসেজিং অ্যাপ কাকাও'র একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান।
জাপানের মাঙ্গা বাজার বিশ্বের মধ্যে বৃহত্তম হলেও, এভাবেই শিল্পটির ডিজিটাল রূপান্তরে নেতৃত্ব দিচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানিগুলো।
২০২১ সালে জাপানি ডিজিটাল মাঙ্গা বাজারের ৭০ শতাংশেরও বেশির মালিকানা ছিল কাকাও, নেভারসহ বিভিন্ন দক্ষিণ কোরিয়ান প্রযুক্তি কোম্পানির দখলে।
কাগজে ছাপা হওয়া মাঙ্গা কমিকস এখনও যথেষ্ট জনপ্রিয় ঠিকই, কিন্তু গেল বছর কাগুজে মাঙ্গার চেয়ে ডিজিটাল মাঙ্গাই বিক্রি হয়েছে বেশি। কোরিয়ান সরকারি সংস্থা কোরিয়া কালচারাল কনটেন্ট এজেন্সি ধারণা করছে, ২০২৫ সাল নাগাদ মাঙ্গা বাজারের ৮০ শতাংশই চলে যাবে ডিজিটাল সংস্করণের অধীনে।
কীভাবে সম্ভব হলো দক্ষিণ কোরিয়ার এমন ডিজিটাল বিপ্লব? তা বোঝার জন্য আমাদের ফিরে তাকাতে হবে নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে দেশটির নিজস্ব কমিক বুক ইন্ডাস্ট্রি ধসের দিকে।
১৯৯৭ সালে এশিয়ায় যে তীব্র অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়, তার সুবাদে প্রচুর মানুষ বেকার হয়ে পড়ে। ফলে তাদের হাতে আর টাকা থাকে না যে কমিক বুক কিনে পড়বে। এমন একটি পরিস্থিতিতেই দক্ষিণ কোরিয়ায় নিজদেশী কমিক বুকের বিক্রিতে ভাটা পড়ে। কিছু প্রকাশক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে জাপানি কমিকের সস্তা অনুকরণ করতে শুরু করেন। বাদবাকি যারা ছিলেন, তারা প্রকাশনা ব্যবসায় তালা ঝুলিয়ে দিয়ে কেটে পড়েন।
"একবার যখন আমাদের পতন হলো, আমরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম পালাবার পথ খুঁজতে," বলেন লি জে-সিক। তিনি এই ইন্ডাস্ট্রির দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ, এবং কোরিয়ান ওয়েবটুন প্রোডাকশন কোম্পানি সি অ্যান্ড সি রেভোলিউশনের প্রতিষ্ঠাতা।
১৯৯০-র দশকের শেষ দিকে দক্ষিণ কোরিয়ান কমিক বুকের বিক্রি তলানিতে গিয়ে ঠেকলেও, সেই সময়েই আবার তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে ইন্টারনেট। ডট-কম দুনিয়ার ক্রমাগত সাফল্যকে নিজেদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ বলে মনে করেন লি'র মতো কয়েকজন বিচক্ষণ ব্যক্তি। অবশ্য গোটা দেশই যখন অর্থনৈতিক মন্দায় বিপর্যস্ত, তখন একটি টলায়মান ইন্ডাস্ট্রির জন্য হুট করে মাথা তুলে দাঁড়ানো সম্ভব ছিল না। তাদেরকে ধৈর্য ধরতে হয়েছে। নিতে হয়েছে 'ধীরে-চলো' নীতি।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সুযোগটি দরজায় কড়া নাড়ে, যখন দাউমের মতো নবীন সার্চ ইঞ্জিনগুলো তাদের সাইটে ব্যবহারকারীদের নিয়মিত ভিজিট ধরে রাখার নিত্যনতুন উপায় খুঁজতে থাকে।
শূন্য দশকের গোড়ার দিক থেকেই, দক্ষিণ কোরিয়ান পোর্টালগুলো তাদের ওয়েবে ডিজিটাইজড কমিক বুক এবং অরিজিনাল কমিকস ফ্রিতে পড়বার সুযোগ দিতে শুরু করে।
সার্চ ইঞ্জিনগুলো এভাবে ওয়েবটুনের জন্য আত্মপ্রকাশের এক নতুন মঞ্চ তৈরি করে দেয়। গতানুগতিক কমিক বুক পাঠকের পাশাপাশি ইন্টারনেটের বদৌলতে নতুন অনেক পাঠকও ওয়েবটুনের দিকে ঝোঁকে, প্রেমে পড়ে যায় বিনোদনের এই বিশেষ মাধ্যমটির। আর সেই প্রেম এক নতুন মাত্রা পায় মোবাইল যুগের বিবর্তনের কল্যাণে।
এক পর্যায়ে যেহেতু অধিকাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীই কমিক পড়তে বা দেখতে শুরু করে তাদের স্মার্টফোনে, তাই নিজেদের চরিত্রে খানিকটা রদবদল ঘটায় ওয়েবটুনগুলো। স্ক্রিনজুড়ে একটি গোটা পাতা প্রদর্শনের পরিবর্তে, উপর-নিচে স্ক্রল করে পড়ার ব্যবস্থা করে তারা।
কোরিয়া ওয়েবটুন ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান সিও বুম-গাং বলেন, "স্ক্রলিং করে পড়ার এই পদ্ধতিটাই ব্যবহারকারীদের এক নতুন ধরনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। তারা এক ধরনের মুভমেন্টের অনুভূতি পায়। সেই মুভমেন্ট হতে পারে তাকিয়ে থাকার, কিংবা সময় বয়ে চলার।"
তিনি আরও বলেন, "যারা চলচ্চিত্রে কাজ করেন তারা বুঝতে পারবেন, এটি অনেকটা তাদের ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহৃত স্টোরিবোর্ডের মতোই ব্যাপার। যখন অডিয়েন্স ওয়েবটুন পড়ে, তারা সহজেই সেটিকে চলচ্চিত্র দেখার অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলাতে পারে।"
শূন্য দশকের শেষ ভাগ থেকেই দক্ষিণ কোরিয়ান চলচ্চিত্র ও টিভি ইন্ডাস্ট্রিতে দেখা যায় ওয়েবটুন অবলম্বনে নিজস্ব ঘরানার কনটেন্ট নির্মাণের প্রবণতা। বিশেষত ২০১৪ সালে অফিস ড্রামা 'মিসেং'-এর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার পর থেকেই কোরিয়ান বিনোদন জগতে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণার উৎসগুলোর একটি হয়ে ওঠে ওয়েবটুন।
এমনকি নেটফ্লিক্সের মতো আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মও খুবই আগ্রহী ওয়েবটুনের অ্যাডাপটেশন নির্মাণে।
'কিংডম', 'সুইট হোম' ও 'হেলবাউন্ড'-এর আন্তর্জাতিক সাফল্যের পর নেটফ্লিক্সের বর্তমান পরিকল্পনা হলো চলতি বছরেই পাঁচটি ওয়েবটুন-ভিত্তিক সিরিজ মুক্তি দেওয়ার।
ওয়েবটুন থেকে অনুপ্রাণিত টিভি সিরিজগুলোর এই বৈশ্বিক সাফল্য আবার বিদেশী বাজারে দক্ষিণ কোরিয়ান কমিকসের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতেও প্রভাব ফেলেছে। জাপানে স্ম্যাশ হিট হয় 'ইটাউন ক্লাস' টিভি সিরিজটি। একই নামের যে মাঙ্গা অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে এ সিরিজ, সেটি রয়েছে পিকোমা অ্যাপে। মূলত এই মাঙ্গাটির সাহায্যেই পিকোমা নেভারের ডেভেলপকৃত প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাপ লাইন মাঙ্গাকে পেছনে ফেলতে সক্ষম হয়।
বিগত বছরের তুলনায় ২০২০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ওয়েবটুন বাজারের প্রবৃদ্ধি ছিল ৬৪ শতাংশ। এ সময়ে তারা এক ট্রিলিয়ন ওনের (৮৪০ মিলিয়ন ডলার) মাইলফলককেও ছাপিয়ে যায়।
তবে এখানেই শেষ নয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় অন্যান্য সাংস্কৃতিক ইন্ডাস্ট্রির মতো, ওয়েবটুনও ক্রমাগত সাফল্যের সন্ধান করে চলেছে বিদেশের বাজারে।
সি অ্যান্ড সি রেভোলিউশনের প্রধান লি জানান, বর্তমানে তার কোম্পানির আয়ের ৬৫ শতাংশই আসে বিদেশী বাজার থেকে। সামগ্রিকভাবে যদিও ইন্ডাস্ট্রির বৈদেশিক আয়ের গড় ৩০ শতাংশ, তবে তা ক্রমেই বেড়ে চলেছে, এবং অদূর ভবিষ্যতেও সেই ধারার কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না বলেই বিশ্বাস কোরিয়া কালচারাল কনটেন্ট এজেন্সির।
প্রতিষ্ঠানটির আরেক হিসেব থেকে জানা যাচ্ছে, ২০২০ সালে বৈশ্বিক কমিক বাজারের মূল্যমান ছিল ১১ বিলিয়ন ডলার, যা প্রাক-মহামারি যুগের ফিল্ম বা মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির সিকিভাগ।
তবে ইন্ডাস্ট্রির ভেতরের কয়েকজনের দাবি, চিরাচরিত কমিক বাজার যা অর্জন করেছে, ওয়েবটুনের পক্ষে সম্ভব তারচেয়েও অনেক বেশি কিছু অর্জন।
"একটি অতি সাধারণ ভুল হলো ছাপা কমিকস আর ওয়েবটুনকে একই জিনিস ভাবা," সিও বলেন। "এ কথা সত্যি যে ওয়েবটুন এসেছে ছাপা কমিকস থেকেই। কিন্তু এখন আমরা ইন্ডাস্ট্রিতে যা দেখতে পাচ্ছি তা হলো, ওয়েবটুন ইন্ডাস্ট্রির চরিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন, এবং প্রিন্টেড কমিক ইন্ডাস্ট্রির থেকে তার উদ্দেশ্যও আলাদা।"
লি'র বিশ্বাস, ওয়েবটুনকে কেন্দ্র করে যে উন্মাদনা, তা সবে শুরু হয়েছে। সামনে এখনও বহুদূরের পথ পড়ে রয়েছে।
"আগেকার দিনে, আমরা ব্যস্ত থাকতাম অন্যান্য দেশের মনোযোগ আকর্ষণে। কিন্তু এখন তারা নিজেরাই আমাদের দিকে চেয়ে রয়েছে," তিনি বলেন।
"বাজারের বর্তমান যে হাল, তাতে এই চক্রের খুব শীঘ্রই শেষ হবে না।"
- সূত্র: আল জাজিরা