দক্ষিণ কোরিয়ার অভিশংসিত প্রেসিডেন্টকে গ্রেপ্তার করা এত কঠিন হচ্ছে কেন?
১০০ জনের বেশি পুলিশ সদস্য এবং তাদের কাছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সত্ত্বেও দক্ষিণ কোরিয়ার অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওলকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। খবর বিবিসির।
তার বাড়ির সামনে ছয় ঘণ্টার অচলাবস্থা চললেও, পুলিশ তাকে গ্রেপ্তারে ব্যর্থ হয়েছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ইউনের নিরাপত্তা দল তাদের পথ রুখে দেয়। তারা মানবপ্রাচীর তৈরি করে এবং গাড়ি দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেয়।
গত এক মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতিতে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে। প্রেসিডেন্ট ইউন সামরিক আইন জারি করেছিলেন। কিন্তু সেটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এরপর তার বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে অভিশংসন প্রস্তাব পাস হয়। পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হলেও, তিনি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাজির হননি। এই সপ্তাহে তার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
এই ডানপন্থি নেতার এখনো অনেক সমর্থক রয়েছে। শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) সকালে তার বাড়ির সামনে গ্রেপ্তার ঠেকাতে হাজারো মানুষ জড়ো হয়েছিল।
প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা দল
অভিশংসনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হারালেও ইউন সুক ইওল এখনো রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা দলের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রাখেন। শুক্রবার তার গ্রেপ্তার আটকে দেওয়ার পেছনে এই নিরাপত্তা দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সিউলের হানকুক ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক মেসন রিচি বলেন, "প্রেসিডেনশিয়াল সিকিউরিটি সার্ভিস [প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা দল] হয়ত ইউনের প্রতি আনুগত্যের কারণে এমনটি করেছে, অথবা তাদের আইনি ও সাংবিধানিক ভূমিকা নিয়ে ভুল ধারণা থেকে এটি ঘটেছে।"
ইউন অভিশংসিত হওয়ার পর নিরাপত্তা দল পিএসএসের নির্দেশ নেওয়া উচিত ছিল ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট চোই সাং-মকের কাছ থেকে।
তবে সহযোগী অধ্যাপক মেসন রিচি বলেন, "পিএসএস হয়ত চোই-এর কাছ থেকে পিছু হটার নির্দেশ পায়নি, অথবা তারা সেই নির্দেশ মানতে অস্বীকার করেছে।"
কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ইউনের প্রতি "নিঃশর্ত আনুগত্য" দেখিয়েছে, প্রেসিডেন্টের পদটির প্রতি নয়। তারা মনে করিয়ে দেন, পিএসএসের প্রধান পার্ক জং-জুন গত সেপ্টেম্বর ইউনের নিয়োগ দেওয়া একজন।
যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক আইনজীবী ও কোরিয়া বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টোফার জুমিন লি বলেন, "সম্ভবত ইউন ইচ্ছাকৃতভাবে পিএসএসে কট্টরপন্থী অনুগত ব্যক্তিদের বসিয়েছিলেন এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে।"
এদিকে পার্কের পূর্বসূরি ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী কিম ইয়ং-হিউনের বিরুদ্ধে ইউনকে সামরিক আইন জারির পরামর্শ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তিনি বর্তমানে ইউনের বিরুদ্ধে অপরাধ তদন্তের অংশ হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক রয়েছেন।
উত্তেজনা বাড়ার ঝুঁকি
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আইনজীবী ক্রিস্টোফার জুমিন লি বলছেন, উত্তেজনা এড়ানোর "সবচেয়ে সহজ" সমাধান হলো ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট চোই সাং-মকের পিএসএসকে পিছু হটার নির্দেশ দেওয়া।
তিনি আরও বলেন, "যদি চোই তা করতে অস্বীকৃতি জানান, তাহলে এটি জাতীয় সংসদের কাছে তার নিজের অভিশংসনের কারণ হতে পারে।"
প্রধানমন্ত্রী হান ডাক-সুকে অভিশংসনের পর চোই [যিনি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন] ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন।
এই রাজনৈতিক অচলাবস্থা দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতিতে চরম মেরুকরণেরই প্রতিফলন। ইউনের সামরিক আইন জারির পক্ষে থাকা এবং বিপক্ষে থাকা পক্ষগুলো স্পষ্টভাবে বিভক্ত।
সেন্টার ফর এ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির সিনিয়র ফেলো ডুয়েয়ন কিম বলেন, দক্ষিণ কোরিয়ার বেশিরভাগ মানুষ একমত যে ৩ ডিসেম্বর ইউনের সামরিক আইন জারি ভুল ছিল এবং তাকে এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। তবে কীভাবে জবাবদিহি করানো উচিত, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, "প্রক্রিয়া, পদ্ধতি এবং এর আইনি ভিত্তি নিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মতবিরোধ রয়েছে। এটি বর্তমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আরও বাড়াচ্ছে।"
এই অনিশ্চয়তা শুক্রবার ইউনের সরকারি বাসভবনে দেখা দেওয়া উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মতো ঘটনাগুলোর জন্ম দিচ্ছে। তার সমর্থকরা সেখানে দিনের পর দিন ক্যাম্প করেছে। উত্তেজিত বক্তব্য এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।
সহযোগী অধ্যাপক মেসন রিচি বলেন, আইন প্রয়োগকারী বাহিনী আরও সদস্য নিয়ে ফিরে আসতে পারে এবং বলপ্রয়োগ করতে পারে। তবে তা হবে "অত্যন্ত বিপজ্জনক।"
পিএসএস সদস্যরা ভারী অস্ত্রে সজ্জিত। তাই পুলিশ সংঘর্ষ এড়াতে চাইছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আইনজীবী ক্রিস্টোফার জুমিন লি প্রশ্ন তোলেন, "যদি পুলিশ পিএসএস সদস্যদের গ্রেপ্তারের পরোয়ানা নিয়ে আসে, আর পিএসএস তা অমান্য করে অস্ত্র উঁচিয়ে ধরে, তখন কী হবে?"
পুলিশ জানিয়েছে, পিএসএস পরিচালক এবং তার ডেপুটির বিরুদ্ধে বাধা দেওয়ার অভিযোগে তদন্ত চলছে। তাদের বিরুদ্ধে নতুন অভিযোগ এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আসতে পারে।
ইউনের সামরিক আইন জারির ফলে দুর্নীতি তদন্ত অফিস (সিআইও) চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। মাত্র চার বছর আগে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট পার্ক গিউন-হাইয়ের দুর্নীতি কেলেঙ্কারির পর জনরোষের জবাবে এটি গঠিত হয়।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টরা এর আগে জেলে গেছেন। তবে ইউনই প্রথম, যিনি পদ ছাড়ার আগেই গ্রেপ্তারের মুখোমুখি হচ্ছেন।
তদন্তকারীদের হাতে ইউনকে গ্রেপ্তার করার জন্য ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় আছে। এর মধ্যেই পরোয়ানার মেয়াদ শেষ হবে।
সপ্তাহের শেষে আবারও তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালানো হতে পারে। তবে সমর্থকদের ভিড় বাড়লে তা আরও কঠিন হতে পারে। নতুন পরোয়ানা নিয়ে আবারও গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হতে পারে।
দক্ষিণ কোরিয়া যে এখন অজানা এক পথে এগোচ্ছে, তা স্পষ্ট। অনিশ্চয়তা হয়ত আরও দীর্ঘায়িত হবে।