বিশ্ব মাতাবে টুইটারের ভারতীয় বিকল্প কু?
ভারতীয় মাইক্রোব্লগিং অ্যাপ কু কি টেক্কা দিতে পারবে এ খাতের বিশ্বসেরা টুইটারকে?
নিশ্চিতভাবেই সেই লক্ষ্যকে পাখির চোখ করেছে মুরগির ছানা কু, জানাচ্ছেন এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা মায়াঙ্ক বিদ্যাতকা। তাদের আশা, এ বছরের মধ্যেই ভারতে টুইটারের যে আড়াই কোটির শক্তিশালী ইউজার-বেজ রয়েছে, সেটিকে ছাপিয়ে যাবে কু।
অ্যাপটি ২০২১ সালের শেষ পর্যন্ত ভারতে ছুঁয়েছে ২ কোটি ডাউনলোডের মাইলফলক।
ভারতীয় টেক হাব ব্যাঙ্গালোরে কোম্পানির হেডকোয়ার্টারে বসে বিদ্যাতকা বলেন, "ইংরেজিসহ ১০টি ভাষায় বর্তমানে ব্যবহার করা যাচ্ছে অ্যাপটি। আমাদের লক্ষ্য এই বছরের মধ্যেই ভারতের ২২টি অফিশিয়াল ভাষাকেই কভার করা।"
কু-র পাদপ্রদীপের আলোর নিচে আসার উপলক্ষ্যটা ছিল বেশ ইন্টারেস্টিং। ভারতীয় সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মাইক্রোব্লগিং প্ল্যাটফর্ম টুইটারের যখন বিবাদ চলছিল, ঠিক সেই সময়টিতেই টুইটারের সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হয় কু।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার টুইটারকে বলেছিল কিছু তথাকথিত বিদ্বেষ ছড়ানো অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দিতে। প্রাথমিকভাবে প্ল্যাটফর্মটি তা করলেও, পরে আবার তারা ওই অ্যাকাউন্টগুলো ফিরিয়ে আনে। কারণ তাদের ভাষ্য ছিল, ওই অ্যাকাউন্টগুলো ব্লক করার মতো তেমন কোনো জোরালো যুক্তি তারা খুঁজে পায়নি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে টুইটারের সঙ্গে ভারত সরকারের বিরোধ। এমনকি ভারতে কর্মরত টুইটারের কর্মীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকিও দেওয়া হয়।
এর পাশাপাশি ভারতের নতুন ডিজিটাল নীতিমালা নিয়েও বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। অনেকেই ভারতে বসে ভার্চুয়াল মাধ্যমগুলোতে বাক স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার অপ্রতুলতার ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে পড়ে। হোয়াটসঅ্যাপ ভারত সরকারের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়, অভিযোগ করে যে নতুন নীতিমালার মাধ্যমে তাদেরকে বাধ্য করা হয় নিরাপত্তা সুরক্ষাগুলো লঙ্ঘন করতে।
টুইটারের প্রকাশ্য অবাধ্যতা এবং নতুন ডিজিটাল নীতিমালার সঙ্গে মানিয়ে চলার ব্যর্থতায় বিরক্ত হয়ে মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও আইনপ্রণ্রেতা টুইটার ছেড়ে কু-তে পাড়ি জমান। অবশ্য মোদি টুইটারেই থেকে যান। কোটি কোটি ফলোয়ার হারাতে চাননি তিনি।
২০২০ সালের গোড়ার দিকে লঞ্চ হওয়া এই অ্যাপটি মূলত ভারতের নন-ইংলিশ ব্যবহারকারীদের মধ্যেই জনপ্রিয়। এটি ২০২১ সালে পাড়ি জমায় নাইজেরিয়াতেও, যখন সে দেশে টুইটার নিষিদ্ধ করা হয়। কু এখন চায়, ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ১০ কোটি ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছে যেতে।
কু প্রতিষ্ঠায় বিদ্যাতকার সঙ্গে ছিলেন অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর ও উদ্যোক্তা অপরামেয়া রাধাকৃষ্ণা। অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর তাদের বলে, যারা কোনো প্রতিশ্রুতিশীল স্টার্ট-আপে অর্থ বিনিয়োগ করেন ওই স্টার্ট-আপের ব্যবসার আংশিক মালিকানার বিনিময়ে। এর আগে ২০১৫ সালে তার রাইড-শেয়ারিং বিজনেস ট্যাক্সিফরশিওরকে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে কিনে নেয় ভারতীয় কোম্পানি ওলা। এছাড়া বিদ্যাতকা ও রাধাকৃষ্ণা ভারতীয় ভাষার নলেজ-শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ভোকালও পরিচালনা করেন।
গত বছর থেকে ক্রমে কু-তে আকৃষ্ট হচ্ছেন ভারতীয় অনেক ক্রিকেটার ও বলিউড তারকারা। বর্তমানে এই অ্যাপের 'এমিনেন্ট অ্যাকাউন্ট'-এর সংখ্যা ৫,০০০। আশা করা হচ্ছে, এ বছরের মধ্যে সংখ্যাটি তিনগুণ হবে।
তবে ইতোমধ্যেই কু-র বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে সরকারী প্রোপাগান্ডায় সাহায্য করা, এবং মুসলিমবিরোধী হেইট-স্পিচের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার।
নানা ভাগে বিভক্ত ভারতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও একটি গুরুত্বপূর্ণ রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি'র সমর্থকদের বিরুদ্ধে অনেকদিন ধরেই অভিযোগ রয়েছে, যে-ই প্রধানমন্ত্রী মোদির সমালোচনা করে, তাকেই ট্রল করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওই সমর্থকরা।
কু-র গাইডলাইনে স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে, তারা কোনো ধরনের হেইট স্পিচ, বৈষম্য বা অফেন্সিভ কনটেন্টকে বরদাস্ত করা হয় না। কিন্তু প্রতি সেকেন্ডেই এখানে এত পরিমাণ নতুন নতুন 'কু' (টুইটারে যাকে বলে টুইট) জেনারেশন হয় যে, মডারেশনের কাজটি খুবই কঠিন। অবশ্য টুইটারসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মের অবস্থাও ভিন্ন কিছু নয়।
বিদ্যাতকা মনে করেন, এই সমস্যা সমাধানে মানুষ মডারেটরের চেয়েও বেশি কাজে লাগানো প্রয়োজন প্রযুক্তিকে। তাছাড়া ইউজার কমিউনিটিকেও এক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, যেন তারা টক্সিক মনে হওয়া পোস্টগুলোকে ফ্ল্যাগ করে দেয়।
বিদ্যাতকা স্বীকার করেন যে কু-তে "বিজেপির অনেক লোক" আছে। অবশ্য তিনি এ কথা মানতে নারাজ যে কু ডানপন্থী, অ্যান্টি-লিবারেল গোষ্ঠীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। তিনি আরও যোগ করেন যে কু-তে অন্য ১৯টি পার্টির নেতারাও আছেন। যেমন আছেন প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস পার্টির রাজ্য মুখ্যমন্ত্রীরাও।
"সব প্রযুক্তিরই কিছু আর্লি এডপ্টর থাকে (যারা প্রযুক্তিটিকে সবার আগে গ্রহণ করে)। কিন্তু শুরুতে কী হয়েছে, তা দিয়ে আপনি পুরো যাত্রাটিকে বিচার করতে পারবেন না," বিদ্যাতকা বলেন। "উদ্যোক্তা হিসেবে আমাদের এমন কিছু বানানোর কারণ নেই, যেটি কোনো জনগোষ্ঠীর নির্দিষ্ট একটি অংশই কেবল ব্যবহার করবে।"
ডিজিটাল বিশেষজ্ঞ নিখিল পাহওয়ার মতে, মোদি সরকারের কু-কে টুইটারের একটি স্বদেশী, জাতীয়তাবাদী বিকল্প হিসেবে প্রচার করার পেছনে যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। কারণ এর ফলে ভবিষ্যতে কখনও যদি টুইটারকে নিষিদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা মাথাচাড়া দেয়, তখন তাদের হাতে একটি তাৎক্ষণিক বিকল্প থাকবে।
পাহওয়ার মতে, চীনে আগে থেকেই রয়েছে 'স্পিটারনেট', যেখানে রাষ্ট্র কর্তৃক সাইবারস্পেসকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। একইভাবে, ভারতও বিগত কয়েক বছর ধরে ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব ও ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের করে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
"এ ধরনের প্রবণতার ফলে ভারতীয়-মালিকানাধীন প্ল্যাটফর্মগুলোর (যেমন কু) অগ্রযাত্রার পালে হাওয়া লাগবে," তিনি যোগ করেন।
ভবিষ্যতে ডেটা ও সিকিউরিটি পলিসির আওতায় গড়ে ওঠা বৈশ্বিক বড় প্রযুক্তিগুলোর ভারতে ডালপালা মেলার সম্ভাবনা ক্রমশ ফিকে হতে শুরু করবে বলেও ভবিষ্যদ্বাণী করেন পাহওয়া।
তার বিশ্বাস, কু-র সামনে ভালো সুযোগ রয়েছে সফলতা লাভের। তবে এক্ষেত্রে তাদেরকে কনটেন্ট মডারেশনজনিত সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে, এবং ব্যবহারকারীর জন্য একটি নিরাপদ স্পেসও তৈরি করতে হবে। টুইটারকে এখন পর্যন্ত নিরাপদ স্পেস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ঝক্কি পোহাতে হয়েছে।
তাছাড়া কু-কে একটি সমবেত প্রচেষ্টাও দেখাতে হবে যেন বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শের ব্যবহারকারীরাও এটির প্রতি আকৃষ্ট হয়। এখন পর্যন্ত লিবারেল বা অ্যান্টি-এস্টাবলিশমেন্টের পক্ষপাতী ব্যবহারকারীরাও হয়তো টুইটার ত্যাগ করতে আগ্রহী হবে না, অথবা দুই প্ল্যাটফর্মেই অ্যাকাউন্ট চালাবে।
কু অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করার জন্য একটি মোবাইল ফোন নাম্বারের মাধ্যমে অথেন্টিকেশনের প্রয়োজন হয়। এটিও পাহওয়ার মতে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা এতে করে কু তাদের কনটেন্ট আরও ভালোভাবে মডারেট করতে পারে ঠিকই, কিন্তু তার ফলে টুইটারে "আত্মগোপনের যে স্বস্তি" তারা পেয়ে থাকে, কু-তে সেটি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
তারপরও, ইংরেজির বাইরে অন্য ভাষাভাষীদের জন্য যে কু একটি স্বতন্ত্র প্রোডাক্ট তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছে, এ বিষয়টিই তাদেরকে অন্য অধিকাংশ প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে এগিয়ে রেখেছে।
গত কয়েক মাস ধরে কোম্পানিটি প্রচুর এক্সপেরিমেন্টও করেছে। যেমন তারা ব্যবহারকারীদের সুযোগ দিয়েছে একবারে, এক স্ক্রিনেই একাধিক ভাষায় 'কু' করার।
বিদ্যাতকার মতে, বিশেষত বলিউড অভিনেতারা এই ফিচারটির সবচেয়ে বেশি ফায়দা তুলছেন। সাধারণত তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের ভক্তদের সঙ্গে ইংরেজিতে যোগাযোগ করলেও, এখন একসঙ্গে একাধিক ভাষায় পোস্ট দিয়ে খুব সহজেই আরও বেশি অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছে যেতে পারছেন।
বর্তমানে ভারতে কু-র প্রতিযোগিতা শেয়ারচ্যাটের সঙ্গে। ইউজারবেজের দিক থেকে শেয়ারচ্যাট কু-র থেকে অনেকটাই এগিয়ে। ১৫টি ভারতীয় ভাষায় শেয়ারচ্যাটের বিশ্বব্যাপী মাসিক সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২৫ কোটি।
কিন্তু নাইজেরিয়ায় প্ল্যাটফর্মটির সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিদ্যাতকা পরিকল্পনা করছেন কু-কে ভারতের বাইরেও সেসব দেশে নিয়ে যাওয়ার, যেখানে ইংরেজি প্রধান আধিপত্যশীল ভাষা নয়।
"দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সম্ভাবনার ব্যাপারে আমরা খুবই রোমাঞ্চিত। কারণ এখানকার জনসংখ্যা বিশাল, অথচ বিদ্যমান প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহারের হার খুব বেশি নয়। এই হার বৃদ্ধিই এখন আমাদের লক্ষ্য," বিদ্যাতকা বলেন।
"বিশ্বে মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ ইংরেজিতে কথা বলে। বাকি ৮০ শতাংশ মানুষ ইংরেজিতে কথা বলে না। তাই গোটা বাজারটাই আমাদের সামনে খালি পড়ে আছে।"
- সূত্র: বিবিসি