চাপ মানেই বোখারী! আর সঙ্গে সকালের ঝোল পোলাও
"এই খাবার নিউ টাউনে কোনো নামিদামি রেস্টুরেন্টে খেলে দাম পড়ত ৩০০ টাকার উপরে, সেটা এখানে খাচ্ছি মাত্র ১৫০ টাকায়। শুধু আমি না, আমার মতো নিয়মিত কাস্টমার এখানে অনেক আছে। অল্প দামে এমন স্বাদের খাবার পুরান ঢাকা ছাড়া আর কোথায় পাওয়া যাবে?"
বোখারী রেস্তোরাঁয় বন্ধুবান্ধবের সাথে বাটার নান দিয়ে চিকেন ভেজিটেবল চাপ খেতে খেতে এভাবেই বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানজির আরাফাত।
আমি যখন বোখারীতে ঢুকি তখন ঘড়িতে বাজে রাত নয়টার ওপর। বোখারী বিরিয়ানী ও রেস্তোরাঁর ডাইনিং হলগুলো তখন একগাদা লোকে ঠাসা। চারজন ও আটজন বসার মতো যতগুলো টেবিল আছে সবগুলো টেবিল খরিদ্দারে পূর্ণ।
গ্লাস বয়েরা টেবিল মুছতে ব্যস্ত, মেসিয়ারেরা অর্ডার নিয়ে খাবার পরিবেশনে মত্ত, আর সবার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সুপারভাইজার কামালের। ক্যাশ কাউন্টারে দাম নিচ্ছিলেন ম্যানেজার সোহেল। সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে বোখারী রেস্তোরাঁর কর্ণধার মোঃ কবীর হোসেন।
পঞ্চাশোর্ধ্ব কবীর হোসেন জীবনের প্রথমদিকে হোটেল ব্যবসা বা বাবুর্চিগিরির কিছুই জানতেন না। ১৯৭৩ সালে তার বাবা মোঃ সোবহান মিয়া শ্রমিক ভিসায় সৌদি আরব গিয়ে কিছুদিনের মধ্যে একটি খাবারের দোকান চালু করেন। ১৯৮১ সালে ১৬ বছর বয়সে কবীর হোসেন অটো-মেকানিকের কাজ শিখে বাবার মতো সৌদি প্রবাসী হন।
প্রবাসে অটো-মেকানিকের কাজের পাশাপাশি কবীর বাবার কাছ থেকে বাবুর্চির কাজ শিখতে থাকেন। পার্টটাইম জবের সাথে তিনি বাবার খাবারের দোকানে নিয়মিত বসা শুরু করেন। কয়েকজন তুর্কি ও আফগান বাবুর্চি নিয়োগ দেওয়া হয় দোকানে। কবীর তাদের কাছ থেকে দেশীয় কাবাব, বিরিয়ানি, রেজালা ইত্যাদি বিভিন্ন খাবাবের রেসিপি শিখে নেন।
হাসিমুখে কবীর হোসেন বলেন, "আমাদের বংশে প্রথম হোটেল ব্যবসা শুরু করেছিলেন আমার দাদা। তার হোটেলের নাম ছিল 'মধু হোটেল'। ব্রিটিশ আমল থেকে আমরা কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা। তবুও আমাদের নাড়ি পোঁতা আছে বরিশালে, আমাদের আদিবাড়িতে।"
"বোখারী হোটেলটি প্রথম চালু করা হয় সৌদি আরবের রিয়াদের বদিয়াতে। সেখান থেকে আমরা বাংলাদেশে প্রথম দোকান খুলি বকশিবাজার আলিয়া মাদ্রাসার পাশে। সেখান থেকে মগবাজার, মগবাজার থেকে সায়েদাবাদ। সায়েদাবাদ থেকে নাজিরাবাজার। নাজিরাবাজারে দোকানের নাম দেওয়া হয় আমাদের সৌদি আরবের দোকান 'বোখারী'-র নাম অনুসারে।"
কথায় কথায় কবীর হোসেন প্রবাস ও দেশের অনেক স্মৃতিচারণ করেন। তার ৩২ বছর ৮ মাসের প্রবাস জীবনে তিনি যা শিখেছেন ও যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন সেগুলো তাকে দেশে হোটেল ব্যবসা করতে সরাসরি সাহায্য করেছে। দোকানের ম্যানেজমেন্ট, পেমেন্ট, সেকশনভিত্তিক আলাদা কমিটি করে সব সমস্যার সমাধানের মতো উদ্যোগগুলো তিনি তার প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে অর্জন করেছিলেন।
কবীর হোসেন বাংলাদেশে স্থায়ী হয়েছেন ছয় বছর ধরে। নাজিরাবাজারের আলাউদ্দিন রোডের দোকানটির বয়সও ছয় বছর। করোনার ভেতর বোখারী রেস্তোরাঁর পাশের হলরুমটি ভাড়া নিয়ে বিরিয়ানীর সেকশন খোলা হয়।
এ ব্যাপারে কবীর হোসেন বলেন, "করোনার মধ্যে বেচাকেনা কমে যাওয়ার কারণে পাশের দোকানটি ভাড়া নিয়ে বিরিয়ানী রান্না শুরু করি। বিরিয়ানীর আইটেমগুলো পার্সেল হিসেবে পাঠানো সহজ। তখন নিয়মিত পার্সেল পাঠানো হত বিভিন্ন জায়গায়। এমনিতে আমরা দোকান থেকে কোনো পার্সেল পাঠাই না। এখন বেচাকেনা কিছুটা স্বাভাবিক হওয়াতে পার্সেল পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছি।"
পার্সেল না পাঠানোর কারণ জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, "এমনিতে যে চাহিদা সেটাই মাঝেমাঝে কুলিয়ে উঠতে আমাদের কারিগরেরা হিমশিম খান। তার ওপর আবার পার্সেলের ঝামেলা ঘাড়ে নিলে এক্সট্রা চার্জ দিতে হবে, গুণাগুণ নষ্ট হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। যে খরচ পার্সেলে যাবে সেটা আমরা খাবারের মান উন্নয়নে ব্যয় করি।"
বোখারী রেস্তোরাঁয় সকাল-বিকালের নাস্তা, দুপুর ও রাতের খাবারের জন্য বাহারি পদের আয়োজন করা হয়। বুট, মুগ, পায়া, নেহারি, স্যুপ, মগজ, কলিজা, গ্রিল, চাপ, কাবাব ও বিরিয়ানীর হরেকরকম আইটেম পাওয়া যায়। একেক বেলায় বাবুর্চিরা একেকটি পদ রান্না করেন। গ্রাহকের চাহিদা অনুসারে সেগুলো পরিবেশিত করা হয়।
তবে যে পদটি বোখারী রেস্তোরাঁয় সবচেয়ে বেশি চলে সেটি হল চাপ ও নান। খরিদ্দারেরা মূলত বোখারীতে আসেন তিন রকমের নানরুটি দিয়ে চিকেন ভেজিটেবল তাওয়া চাপ খেতে। এটি বোখারী রেস্তোরাঁর 'সিগনেচার ডিশ'। এমনিতে ভাত, মাছ-মাংস, ডাল-ভাজি ইত্যাদি পদকে হোটেলের লোকজন বাংলা পদ নামে ডাকেন।
গ্রিল ও চিকেন ঝাল ফ্রাই আইটেমটিও বেশ জনপ্রিয়। গ্রিল ফুল, হাফ ও কোয়ার্টারে বিক্রি করা হয়। তিন রকমের নানরুটির মধ্যে স্বাদে কিছুটা ভিন্নতা দেখা যায়। পাতলা নান খুব সাধারণভাবে তাওয়ায় সেঁকা হয়। স্পেশাল নান দুটো পাতলা নানের সমান পুরু, তবে এর ভেতরে ঘি দেওয়া হয়। স্পেশাল নানের ওপর গলানো মাখনের আস্তরণ ও কিছু তিল ছিটিয়ে দিলেই হয়ে যায় বাটার নান।
একেক নানের একেক স্বাদ। চাপের এক টুকরো চিবোতে চিবোতে মেয়নিজ সসে বাটার নান ডুবিয়ে মুখে পুরে দিলে যেকোনো ভোজনরসিকের চোখ স্বাদের ঘোরে বন্ধ হতে বাধ্য। বোখারীতে বিভিন্ন রকম সালাদ ফ্রিতে দেওয়া হলেও মেয়নিজ সসের জন্য চার্জ কাটা হয়।
খেতে খেতে দু'জন প্রৌঢ় ভদ্রলোকের সাথে আলাপ হয়ে গেল। রহমতুল্লাহ খান ও রতন কুমার দে সহকর্মী। উভয়েই একটি সরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন। তারা বসেছিলেন আমার পাশের টেবিলে। গ্রিল অর্ডার করে বললেন, "আমরা দুই কলিগ প্রতি মাসেই পরিবার নিয়ে খেতে আসি এখানে। পুরান ঢাকার খাবারের একটা আলাদা গুণ আছে, ইতিহাস আছে। আমরা মনে করি চাপের জন্য এখানে বোখারী-ই সেরা।"
আরেক টেবিল দখল করেছিলেন হাফিজ-ইয়াসমিন দম্পতি ও তাদের দুই সন্তানেরা। মিস ইয়াসমিন বলেন, "আমি বাড়িতে বিভিন্ন রান্নাবান্নার এক্সপেরিমেন্ট করি। মেয়নিজ সস বানানোর ট্রাই করেছি কয়েকবার। বোখারীর মেয়নিজটা আমার অনেক ভালো লেগেছে।"
হাফিজ তার সাথে যোগ করে বলেন, "এখানকার মেয়নিজ দিয়েই অনায়াসে দুটো বাটার নান খাওয়া সম্ভব।"
বোখারীর নান আর গ্রিল আইটেম দুটো নাজিরাবাজারসহ নিউ টাউনের রেস্ট্রুরেন্টগুলোর চেয়ে স্পেশাল কেন, সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম বোখারীর মালিক কবীর হোসেনের দিকে।
নানের গায়ে ব্রাশ দিয়ে মাখন মাখাতে মাখাতে তিনি বললেন, "আমরা নান আইটেমটি তৈরি করি সৌদি আরবের তমিজ রুটির আদলে। সৌদিতে এক রুটি এক রিয়াল। এক রিয়ালে চার কেজি ময়দা পাওয়া যায় সেখানে। বাংলাদেশে এক রুটির দাম গড়ে ২০ থেকে ৩০ টাকা। এক কেজি ময়দার দাম ৬০ টাকা। এক রুটির টাকায় এখানে মোটামুটি হাফ কেজি ময়দা পাওয়া যায়। তবুও, আমরা রুটির মান ধরে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করি।"
তিনি আরো জানান, "বাংলাদেশে মাংসের দাম সৌদির তুলনায় বেশি। দাম কম হলেও মান নিয়ে আশঙ্কা থাকে। এসব কারণ থাকা সত্ত্বেও, আমাদের গ্রিল ওজনে অন্যদের চেয়ে ২০০ গ্রাম বেশি হয়। আমাদের সবজির আইটেমগুলোতে ভ্যারাইটি বেশি। রান্নার ও পরিবেশনের গুণ তো আছেই। এসব কারণে কাস্টমারেরা বোখারীতে আসেন।"
আরো কথা হয় ইডেন কলেজের দুইজন নারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তৃতীয় বর্ষের মুনতাহা বলেন, "নতুন ঢাকার খাবারের চেয়ে পুরান ঢাকাইয়া রেসিপিতে ঝাল বেশি দেওয়া হয়। আমি ঝাল খেতে পছন্দ করি তাই পুরান ঢাকার চাপ, গ্রিল আমার পছন্দের শীর্ষে।"
অপর শিক্ষার্থী তামান্না বলেন, "আমরা যখন আসি তখন দলবেঁধে আসি। স্টুডেন্ট বললে দাম কম রাখে আমাদের কাছে। আমাদের কাছে চাপ মানেই বোখারী, বোখারী মানেই চাপ।"
দোকানের জন্য সব বাজার-সদাই কবীর হোসেন নিজেই করেন। চাল-ডাল, আটা, মাছ-মাংসসহ সকল পাইকারি কেনাকাটা করা হয় মৌলভীবাজার পাইকারি মার্কেট থেকে। ডিলারকে ফোন দিলে খুব ভোরে বাজার পাঠিয়ে দেয়। কবীর হোসেনের সাথে একজন সুপারভাইজার এগুলো বুঝে নেন।
তিনি বলেন, "হোটেল ব্যবসা করতে হলে প্রথমে বাজার করা শিখতে হবে। বাজারের দ্বায়িত্ব অন্যজনের হাতে ছেড়ে কোনোদিন কোনো মালিক লাভ করতে পারবে না। আমি বাজার করার সময় দরদাম করে সবচেয়ে ভালোটা সবচেয়ে কমদামে কেনার চেষ্টা করি। আশেপাশের খুচরা বাজারের চেয়ে মৌলভীবাজার থেকে বাজার করলে শতকরা প্রায় ১০ টাকা সাশ্রয় করা যায়। সেই টাকাটা দিয়ে খাবারের মান আরো বাড়ানো সম্ভব।"
ভোর চারটা থেকে বাংলা সেকশনের রান্নাবান্না শুরু করে দেন শাহাদত বাবুর্চি। সকাল পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটায় দোকানের শাটার তোলা হয়। সারাদিন দোকানে চলে বিকিকিনি। দুপুর সাড়ে তিনটার পরে বাংলা খাবার-দাবার সরিয়ে নান, গ্রিল, চাপ ইত্যাদি আইটেমের পরিবেশনা চলে।
সন্ধ্যার পর থেকে পুরোদমে বেচাকেনা শুরু হয়ে যায়। কাস্টমারের ভিড় বাড়তে থাকে। দুপুরে হলরুমের অর্ধেক চেয়ার উল্টে রাখা হলেও সন্ধ্যার পর থেকে তিলধারণের জায়গা থাকে না।
বোখারীর বিরিয়ানীও দিনদিন বিখ্যাত হচ্ছে। বিরিয়ানী সেকশনের হেড বাবুর্চি সায়েম হোসেন গত আট বছর যোগানদার হিসেবে রান্না ও অন্যান্য সহায়তা করলেও হেড বাবুর্চি হয়েছেন আজ ছয়-সাত মাস হলো।
তিনি জানান, রান্নার দায়ভার পুরোটাই বাবুর্চির ওপর। ভালো হলে কাস্টমার প্রশংসা করবে, খারাপ হলে মন্দ কথা বলবে। হেড বাবুর্চির দায়ভার আরো বেশি। খাবার কিভাবে পরিবেশন করতে হবে, তেহারির সাথে সালাদে কোন কোন আইটেম দিতে হবে এসব বিষয়ও হেড বাবুর্চিকে ঠিক করে দিতে হয়।
বোখারীতে দুই শিফটে মোটামুটি ৩৫-৪০ জন লোক কাজ করে। প্রায় ১০টি সেকশনে ভাগ হয়ে এদের দ্বায়িত্ব বন্টিত থাকে। ছয়জন গ্লাসবয়ের কাজ কাস্টমার খেয়ে চলে গেলে টেবিল পরিষ্কার করা। ছয়জন বয় আছে যারা খাবারের অর্ডার নেয় ও খাবার পরিবেশন করে। একজন ম্যানেজার ও একজন সুপারভাইজার খাবার উৎপাদন ও পরিবেশনার সার্বিক দ্বায়িত্বে থাকে।
রুটি, পরোটা, গ্রিল, চাপ, বিরিয়ানী ও বাংলা খাবারদাবারের জন্য আলাদা আলাদা বাবুর্চি রাখা আছে। প্রত্যেক বাবুর্চির সাথে মোটামুটি দুইজন সহায়ক থাকে। এদের বলে সেকেন্ডম্যান ও থার্ডম্যান। রান্নাঘরে কোনো কর্মচারী আসলে প্রথমে তাকে থার্ডম্যান বা ফোর্থম্যান হিসেবে কাজ শেখা শুরু করতে হয়।
পেঁয়াজ, রসুনের খোসা ছাড়ানোর মাধ্যমে শিক্ষানবিশ কার্যক্রম শুরু হয়। ধীরে ধীরে থার্ডম্যান একদিন হেডবাবুর্চিতে পরিণত হন। বোখারীর বাবুর্চিরা জানান, যে সেকশনেই বাবুর্চিগিরি করেন না কেন রান্নার মৌলিক বিষয়গুলো আপনাকে জানতেই হবে। বাবুর্চি হওয়ার প্রথম শর্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। ডালের কুপি (বড় চামচ) মাছের ঝোলে যে বাবুর্চি মিশিয়ে ফেলবে তার দ্বারা বাবুর্চিগিরি করা সম্ভব না।
কোনো সেকশনের হেড বাবুর্চি অনুপস্থিত থাকলে সেকেন্ডম্যান তার ব্যাকআপ হিসেবে কাজ করেন। এক সেকশনের বাবুর্চি অন্য সেকশনের কুপি ধরতে পারবেন না। তবে শিকের বাবুর্চি অনেক সময় গ্রিলের সেকশনকে 'সাপোর্ট' দেন।
বোখারীতে নানরুটি তৈরির জন্য একটি খামি মেশিন আছে। সেখানকার বাবুর্চিরা জানান, খামি মেশিনে রুটি সেঁকলে রুটি তুলনামূলক নরম হয় এবং নোংরা হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
সারাবছর তিন রকম নান পাওয়া গেলেও রোযার মাসে আরো কয়েক রকম নান তৈরি করা হয়। দুধ নান, পনির নান, পুদিনা নানের পাশাপাশি দইবড়া ও হালিমের আয়োজন করা হয়। স্পেশাল ইফতারি আইটেমের সাথে এগুলো থাকে।
হোটেলের ম্যানেজার রেজাউল করিম বলেন, "স্পেশাল আইটেম মূলত রোযার দিনে হয়। তবে শুক্রবারে স্পেশাল ডিম পোলাও রান্না হয়। শুক্রবারে বা ছুটির দিনে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা আসে। ওদের জন্য আমরা সুলভ মূল্যে কিছু আইটেম তৈরি করি।"
বোখারী রেস্তোরাঁ দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা মোট ৬৪টি সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রত্যেক কাস্টমার ও কর্মচারীকে সর্বদা কমপক্ষে ৪টি সিসি ক্যামেরা অনুসরণ করে।
কাস্টমারেরা কর্মচারীদের যে টিপস বা বখশিস দেন সেগুলো নির্দিষ্ট অনুপাতে ভাগ-বাটোয়ারা হয়। তিনভাগের দুইভাগ পান মেসিয়ার, যিনি খাবার পরিবেশন করেন। একভাগ পান বয় বা গ্লাসবয়। এদের মধ্য থেকে কিছু টাকা দেওয়া হয় যিনি হাঁড়ি থেকে খাবার বেড়ে দেন তাকে। হোটেলে তাকে ডাকা হয় 'হান্ডিয়াল' নামে। টিপসের টাকা যেখানেই দেওয়া হোক না কেন সেগুলো এভাবেই বন্টিত হয়।
বোখারী সারাদিন চালু থাকলেও মূল বেচাকেনা শুরু হয় সন্ধ্যা বা রাত আটটার পর থেকে। চাপ, গ্রিল, নান বিকাল সাড়ে তিনটার পর থেকেই বিক্রি শুরু হয়। বোখারীর কাস্টমারদের সিংহভাগই শিক্ষার্থী। মূলত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাই এখানে বেশি খেতে আসে।
হোটেল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, রাত বারোটার পর থেকে গার্মেন্টস কর্মী বা আশেপাশের শ্রমিকেরা খেতে আসে। অনেক সময় তাদের খাবার অর্ডার হিসেবে আসে। রেঁধে কিংবা প্যাকেট করে সেগুলো পাঠিয়ে দিতে হয়। ভোর আর রাতের মধ্যভাগে বোখারীতে শ্রমিকেরা নিয়মিত একটা বড় অনুপাতের খাবার খায়।
বোখারীর মালিক কবীর হোসেন মানুষকে খাওয়ানোর কাজটিকে একপ্রকার ইবাদত হিসেবে গণ্য করেন। তার ভাষ্যে, নাজিরাবাজার এমন এক জায়গা যেখানে সমাজের সব স্তরের মানুষ সাধ্যমত উদরপূর্তি করে যেতে পারেন।
বোখারীর আরেকটি বিশেষ খাবার ঝোল পোলাও। ১৫ থেকে ২০ টাকায় সকালবেলা এই ঝোল পোলাও মেলে। পোলাওয়ের ভেতর খানিকটা রোস্টের ঝোল, আধখানা পেঁয়াজ, একটু সালাদ দিয়ে পরিবেশন করা হয় ঝোল পোলাও। নাজিরাবাজার থেকে কেউ খালি পেটে ফেরে না- এই আইটেম তার সাক্ষী।
জুতার দোকানের শ্রমিকেরা এই আইটেমের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। মূলত ওদের জন্য়ই বোখারীতে ঝোল পোলাওয়ের আয়োজন করা হয়।
বোখারীতে কর্মচারীদের বেতন পরিশোধের ব্যাপারে প্রোপাইটার কবীর হোসেন ব্যাপক সচেতন। তার দোকানে আট ঘণ্টার শিফটের পরে ওভারটাইম করার সুযোগও আছে। ১ ঘন্টা ওভারটাইমের বেতন সাধারণ কর্মঘণ্টার ১.৫ ঘণ্টার সমান। ওভারটাইমের টাকা সাথেসাথেই দেওয়ার নিয়ম রাখা হয়েছে।
এ ব্যাপারে তিনি জানান, হোটেল ব্যবসায় স্টাফদের মেইনটেন করতে পারা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ওদের মজুরি ঠিকঠাকভাবে দেওয়া না হলে ওরা কাজে আগ্রহ হারায়। সবচেয়ে ক্ষতি হয় মহাজনের।
সপ্তাহের বৃহস্পতি ও শুক্রবারে মাসের প্রথমদিকে বোখারীতে বিক্রি-বাট্টার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি হয়। প্রতিদিন প্রায় এক বস্তা আটার রুটি বানানো হয়। প্রতিদিন প্রায় কয়েকশ কেজির মুরগি আনানো হয়। গরুর আইটেমের জন্যও পরিমাণমত মাংস আনা হয়।
বিরিয়ানি সেকশনটি কবীর হোসেন অংশীদারে চালু করেছেন। তার ব্যবসায়িক অংশীদার সাইফুল হোসেন নিয়মিত বিরিয়ানীর ক্যাশ কাউন্টারে বসেন। তিনি বলেন, "এই হোটেলে ক্যাশ বা ম্যানেজমেন্ট যাদের সামলাতে হয় তাদের দ্বায়িত্ব খুঁটিনাটি বিষয়গুলোর দিকেও কড়া দৃষ্টি রাখা। কমাইন্ড পার্টনারশিপের মানে হলো আমি যেখানে থেমে যাবো কবীর ভাই আমাকে সাহায্য করবেন, কবীর ভাই যেখানে থেমে যাবেন, সেখানে আমি তাকে সাহায্য করব।"
বোখারী নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ব্যাপারে কবীর হোসেন জানান যে, "আপাতত এই মান বজায় রাখা বা মান উন্নত করাই আমাদের লক্ষ্য। সৌদিতে আমার ভায়েরা টুকটাক ব্যবসা চালাচ্ছেন। সেখানে আর যাওয়ার সুযোগ নেই আমার। সপরিবার দেশে থেকেই বোখারীকে আরো ভালো জায়গায় নিয়ে যেতে চাই আমরা।"
কথার শেষে নতুন যারা হোটেল ব্যবসায় নামতে চান তাদের উদ্দেশ্যে কবীর হোসেন বলেন, "মাঝারি বা নিম্ন আয়ের হোটেল ব্যবসায় নামতে গেলে বাজার-সদাই থেকে শুরু করে রান্নাবান্না, পরিবেশনা, কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারা ইত্যাদি গুণ মহাজনের ভেতর থাকতেই হবে। নিজের হোটেলের বাজার নিজে করতে না জানলে দেউলিয়া হওয়া ছাড়া উপায় নাই।"