কামাল বিরিয়ানি কা কামাল!
মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের বিরিয়ানির খ্যাতি সারা দেশজুড়ে। বোবার বিরিয়ানি, মামার বিরিয়ানি, শাহিদের বিরিয়ানি, কামাল বিরিয়ানির নাম বিরিয়ানি প্রেমিকদের মুখে মুখে।
মোহাম্মদপুর কলেজগেট থেকে গজনবী রোড ধরে একটু এগিয়ে জেনেভা ক্যাম্পে ঢুকে সিপিজিয়ারসি রোডের একদম মাঝামাঝিতে এক সিরিয়ালে বিরিয়ানির দোকানগুলো পড়ে। যাওয়ার সময় মামা বিরিয়ানি, বোবার বিরিয়ানির দোকান পার হয়ে 'কামাল বিরিয়ানী হাউজে' যেতে হয়।
সকাল সকাল কামাল বিরিয়ানিতে গেলে বিরিয়ানি না খেয়েই চলে আসতে হবে। বেচাকেনা শুরু হয় দুপুর বারোটা থেকে। রাত একটা-দুইটা পর্যন্ত দোকান খোলা থাকে। সারাদিন দোকানে বেচাকেনা চলে।
দু'টো হলরুম নিয়ে খুব ছিমছাম পরিবেশে কামাল বিরিয়ানির দোকান। একটি হলরুমে ক্যাশ কাউন্টার। খুব সম্প্রতি কামাল বিরিয়ানির প্রতিষ্ঠাতা কামাল হোসেনের প্রণোদনায় বড় হলরুমের পাশে একটি পানের দোকান চালু করেছে আমিন নামের একজন।
কামাল হোসেন নিজেও পান খান। পান চিবোতে চিবোতে দোকান সামলে-সুমলে হলরুমে বসিয়ে কথা বলা শুরু করলেন আমার সাথে। তার কথা শুধু বিরিয়ানির দোকান বা খাবারে সীমাবদ্ধ থাকেনি।
জেনেভা ক্যাম্পের দুঃসহ স্মৃতির কথাও শোনালেন আমাকে। ষাট ছুঁইছুঁই কামাল হোসেন আজও সেই দিনগুলো ভুলতে পারেননি।
কামাল বিরিয়ানিতে আজ কয়েকশ মানুষ খাবার খান, অনলাইন ফুড ডেলিভারি কোম্পানিগুলো প্রতিদিন কয়েকশ প্যাকেট খাবার অর্ডার করে কামাল বিরিয়ানিতে। অনেক চরাই-উৎরাই পার করে কামাল হোসেন আজকের এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছেন। খ্যাতির শীর্ষে এসে দাঁড়ালেও কথায় কথায় তিনি সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করেন।
কামাল হোসেন বিরিয়ানি বেচা শুরু করেছিলেন ১৯৮৪ সাল থেকে। এর আগে ৮ বছর হোটেলে কাজ করেন। কামাল হোসেনের শৈশব খুব সুখকর ছিল না। ঢাকার নবাবপুরে জন্ম নিলেও নিয়তি তাকে খুব অল্পবয়সে নিয়ে আসে জেনেভা ক্যাম্পের অন্ধকারময় গলিতে।
মাত্র ৯ বছর বয়সে পিতৃহারা হন তিনি। কামাল হোসেনের ভাষ্যে, "পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবা মারা গেল আমার। আমার মা মানুষের বাসায় কাজ করে। আমাদের ভাই-বোনদের পেট চালাতে আমি কিতাব ছুঁড়ে ফেলে হোটেলে কাজ করা শুরু করি। সারাদিন কাজের পরে আমার হোটেল মালিক যে ঝুটা খাবার আমায় দিত গভীর রাতে আমি সেগুলা বাড়িতে নিয়ে এসে আমার মা আর বোনের মুখে তুলে দিতাম।"
"এই জেনেভা ক্যাম্প কী যে একটা জায়গা ছিল, আজকের ছেলেপেলে সেগুলো ভাবতেও পারবে না। ছোট্ট একটা ঘরের ভেতর মা, জওয়ান বোন, বউ, ভাই-বেরাদর নিয়ে থাকতে হতো।"
কামাল হোসেন বিরিয়ানি রান্না শেখেন তার দুলাভাইয়ের কাছ থেকে। রাত তিনটায় উঠে তার তালিম শুরু হত। দুলাভাই রান্না করে দিলে কামাল ২ টাকা প্লেট দরে সেগুলো ক্যাম্পের কসাই, মাছবিক্রেতা, দোকানদানদের কাছে বিক্রি করতেন।
বিরিয়ানির রেসিপি ভালোভাবে শেখার পরে কামাল হোসেন খাসির কাচ্চি উদ্ভাবন করেন। সেসময় কাচ্চি বলতে সবাই গরুর কাচ্চি বুঝত। কামাল প্রথম জেনেভা ক্যাম্প ও তার আশেপাশে খাসির কাচ্চির নতুন রেসিপি উদ্ভাবন করে বিক্রি করা শুরু করেন। ছোট ভাই, কামাল হোসেনের ভাষায় 'ধরম ভাই' ছোটুকে নিয়ে শুরু করলেন 'ছোটুর বিরিয়ানি'।
ছোটুর বিরিয়ানির মাধ্যমে কামাল হোসেনের বিরিয়ানি ও বাবুর্চিগিরি খ্যাতি লাভ করা শুরু করল। সে দিনগুলোতে কামাল হোসেনের বিরিয়ানির সিংহভাগ ক্রেতা ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে গিয়ে কামাল হোসেন প্রতিদিন প্রায় কয়েকশ প্লেট বিরিয়ানি বেচতেন।
তিনি বলেন, "তখনকার দিনে জেনেভা ক্যাম্প এক আলাদা দুনিয়া ছিল। এরশাদ হটাও আন্দোলনে গিয়ে আমি আমার বিরিয়ানির খরিদ্দারদের জেনেভা ক্যাম্পে এসে বিরিয়ানি খাওয়ার কথা বলতাম। অনেক বলার পরে তারা এক এক করে আসা শুরু করেন।"
এ সময় হঠাৎ ছোটুর সাথে কামাল হোসেনের বনিবনা না হওয়ায় তিনি আলাদা হয়ে ১৯৯০ সালে নিজের বিরিয়ানির দোকান চালু করেন। এইসময় বোবার বিরিয়ানির বোবা ও তার ভাই শাকিল কামাল হোসেনের দোকানে কাজ করতে আসে। তিনি তাদের ধীরে ধীরে বিরিয়ানি রাঁধা শেখান।
'৯০ এর দশকটি কামাল বিরিয়ানির উত্থান-পতনের দশক। পার্শ্ববর্তী দোকানগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে কামাল বিরিয়ানি জেনেভা ক্যাম্পে সেরার তালিকায় একদম শীর্ষে চলে আসে। ব্যবসার কৌশল হিসেবে তিনি খরিদ্দারদের জর্দা, বোরহানি ফ্রি দেওয়া শুরু করেন।
এভাবে ধীরে ধীরে খ্যাতির শীর্ষে চলে আসে কামাল বিরিয়ানি। বর্তমান তথ্য ও প্রযুক্তির যুগে দোকানের বর্তমান প্রোপাইটার ও কামাল হোসেনের বড় ছেলে আরাফাত হোসেন অনলাইন ব্যবসা ও বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে খুব সচেতন। তিনি কয়েকজন ম্যানেজারকে সাথে নিয়ে সরাসরি হোটেলের ক্যাশ ও ম্যানেজমেন্ট সামলান।
তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কামাল বিরিয়ানি সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে ও বিভিন্ন ফুড ব্লগিং কোম্পানির সাহায্যে বিখ্যাত হয় ২০১৬ সালে। তখন দোকানের স্টাফ ছিল ৭-৮ জন। খ্যাতি বাড়ার সাথে সাথে বিক্রিও বাড়ে। বর্তমানে দোকানের স্টাফ ৩০ জনের বেশি।
কামাল বিরিয়ানিতে সবচেয়ে যে আইটেমটি বেশি বিক্রি হয় সেটি হল 'স্পেশাল গরুর কাচ্চি'। প্রতি প্লেট ১২০ টাকা। শিক্ষার্থী বা নিম্ন আয়ের মানুষদের পছন্দের শীর্ষে গরুর স্পেশাল কাচ্চি। স্বাদে ও গন্ধে খাবারটির জুড়ি নেই। এক প্লেট কাচ্চিতে ৪-৫ পিস মাংস, দুই পিস আলু ও সালাদ দেওয়া হয়।
বারোটার দিকে দোকান খোলার পরপরই কাচ্চি খেতে এসেছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থী সাইদুল ইসলাম আনিস ও করবী। আনিস গত আট বছর ধরে কামাল বিরিয়ানিতে কাচ্চি খেতে আসেন। করবীর তার মুখে প্রশংসা শুনে প্রথমবার কামাল বিরিয়ানিতে আসা।
আনিস জানান যে, তিনি স্কুলে পড়ার সময় থেকে কামাল বিরিয়ানির ভক্ত। জেনেভা ক্যাম্পের ভেতরে হওয়ায় দোকানটির অত নাম শোনা যায় না। তার বন্ধু-বান্ধবদের অনেকেই তার কথা শুনেই কামালে বিরিয়ানি খেতে এসেছেন। তিনি মনে করেন যে, কামাল বিরিয়ানি স্বাদে অনন্য হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ কামাল হোসেনের স্পেশাল রেসিপি।
করবী বলেন, "কামালে প্রথমবার এসে বিরিয়ানি খেয়ে ভালো লেগেছে। দশে আট-নয় দেওয়া যায়। কিন্তু দোকানের পরিবেশ ও স্বাস্থ্যকর দিক নিয়ে মালিকের আরো সচেতন হওয়া উচিত।"
কামাল বিরিয়ানির কাস্টমার হলরুম এখন দুইটি। দুই হলরুমে মোটামুটি ৩০ জন কাস্টমার একসাথে বসে খাবার খেতে পারবেন। প্লাস্টিকের চেয়ার-টেবিলে খাওয়ার ব্যবস্থা।
অন্যান্য আইটেমের মধ্যে রয়েছে ভিআইপি কাচ্চি, খাসির কাচ্চি, চাপ পোলাও, মোরগ পোলাও। কাচ্চি আর পোলাওয়েরই বেশ কয়েকটি আইটেম। ভিআইপি কাচ্চি প্রতি প্লেট ২০০ টাকা। দামে বেশি হলেও স্বাদে অনন্য।
সালমান ও খোরশেদ দুই বন্ধু। তারা উভয়ই একটি বেসরকারি স্কুলে বেয়ারার চাকরি করেন। তারা ভিআইপি কাচ্চি অর্ডার দিয়ে আমার সাথে কথা বলতে বলতে জানান, "আমাদের এখানে খেতে আসার প্রধান কারণ আইটেমগুলোর দাম কম। এখানে এক প্লেট ভযানপি কাচ্চিতে যা পাবো সেটা ক্যাম্পের বাইরে পেতে চাইলে ২০০ টাকায় সম্ভবই না।"
কামাল বিরিয়ানিতে কাচ্চি, পোলাওয়ের সাথে ফিরনি, বোরহানি, টিকা পাওয়া যায়। ফুল বোরহানি ১০০ টাকা, হাফ ৫০ টাকা। টিকা প্রতি পিস ২০ টাকা। ফিরনি ও বোরহানি কামাল হোসেনের বড় ছেলের স্ত্রী ঘরোয়াভাবে তৈরি করেন। ঘরে তৈরি করা হয় বলে কঠোরভাবে এর মান নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।
কামাল বিরিয়ানিতে যারা খাবার খেতে আসেন তাদের অধিকাংশই স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মোহাম্মদপুর ও তার আশেপাশের এলাকা থেকে নিয়মিত অনেকে সপরিবার কামাল বিরিয়ানিতে খেতে আসেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সাজিয়া ও তার বন্ধু নাবিলা কামাল বিরিয়ানির বিখ্যাত ভিআইপি কাচ্চি খেতে এসেছিলেন। তারা কামাল হোসেন ও তার বিরিয়ানির প্রশংসা করে বলেন, "বনানীতে বাসা আমাদের। ফেসবুকে কামাল বিরিয়ানির নামডাক শুনে খেতে এসেছি। এর আগে এখানকার বিরিয়ানি বাসায় বসে খেয়েছি। দোকানে বসে এই প্রথম খাচ্ছি। খেয়ে ভালো লেগেছে।"
কামাল হোসেন দোকানের প্রতিষ্ঠাতা ও হেড বাবুর্চি হলেও আরো ৪ জন কাচ্চির কারিগর সারাদিন চুলায় রান্না করছেন। চারজনের সহায়ক আরো ৪ জন। তারা কাজ শিখছেন।
গ্লাস বয়, মেসিয়ার, পার্সেল ম্যান, ক্যাশিয়ার, সহায়ক, মশলা পেষার লোক সব মিলিয়ে দোকানের বর্তমান স্টাফ সংখ্যা প্রায় ৩৫ জন। ২০১৬ সালের পর থেকেই দোকানে স্টাফের সংখ্যা বাড়াতে হয়েছে।
কামাল বিরিয়ানিতে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ ডেগ কাচ্চি রান্না করা হয়। প্রতি ডেগের হিসাব একদম ধরাবাঁধা। কামাল হোসেন বলেন, "এক ডেগ কাচ্চিতে মোটামুটি ১৫০ প্লেট কাচ্চি থাকে। বেশি থাকে, হিসাবের সময় ১৫০ ধরি আমরা। প্রতি প্লেট ১২০ টাকা হিসাবে এক ডেগচি থেকে ১৮০০০ টাকা আয় হয় আমাদের।"
"এখানে চুরি করার কোনো সুযোগ নেই। ডেগচি ফাঁকা হয়ে যাওয়ার অর্থ আমার ক্যাশ বাক্সে ১৮,০০০ টাকা থাকতেই হবে। কাস্টমার খাওয়ার সময় কম-বেশি করতে পারে, স্টাফের সেই উপায় নাই।"
বিরিয়ানির চারজন বাবুর্চিরা হলেন– কাল্লু বাবুর্চি, মোহাম্মদ আলী বাবুর্চি, বাদল বাবুর্চি, শাইখ বাবুর্চি। এরা শিফটে কাজ করেন। সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে থাকেন কামাল হোসেন নিজে। বাবুর্চিখানায় কথা বলে জানা যায়, এক ডেগ কাচ্চি-বিরিয়ানিতে ২০ কেজি চাল, ২০ কেজি মাংস থাকে। অন্যান্য মালমসলা মিলিয়ে মোটামুটি ১৫,০০০ টাকা খরচ হয় ডেগপ্রতি।
এক ডেগ বিরিয়ানি রেঁধে দোকানে নিয়ে আসতে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। এক ডেগ শেষ হওয়ার পরপরই আরেক ডেগ নিয়ে এসে বসানো হয়। সারাদিন বাবুর্চিখানায় রান্না চলে।
কামাল বিরিয়ানিতে দৈনিকের বাজার দৈনিক করা হয়। প্রতিদিন প্রায় ৭ মণ চাল ও ৭ মণ মাংস চুলায় চাপানো হয়। তাজমহল রোডের মুন্না কসাইয়ের দোকান থেকে মাংস আনা হয়। দুটো গরু প্রতিদিন কামাল বিরিয়ানির জন্য সেখানে জবাই করা হয়। মাংসের দর কেজিপ্রতি ৬৫০ টাকা। মুন্না কসাই পারিবারিক সম্পর্কে কামাল হোসেনের বেয়াই হন।
ছুটির দিনগুলোতে বিক্রি তুলনামূলক বেশি হলেও অন্যান্য দিনে মোটামুটি ১০-১২ ডেগচি বিরিয়ানি বিক্রি হয়। ছুটির দিনে ১৫ ডেগচির বেশি বিক্রি হয়। দোকানের কর্মী রাজা জানান, "ঝড় হোক, বৃষ্টি হোক কামাল বিরিয়ানি থেকে প্রতিদিন ১০ ডেগ খাবার বিক্রি হবেই।"
ফুড পান্ডা, হাংরি নাকি-র মতো ফুড ডেলিভারি কোম্পানিগুলো প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ ডেগ খাবার নিয়ে যায়। তাদের এজেন্টরা সকাল থেকেই অর্ডার অনুযায়ী ভিড় করে। মাস শেষে বিল পে করা হয়। একেকটা বিল ছয়-সাত লাখ টাকার হয়ে থাকে। কামাল হোসেনের ছেলে আরাফাত হোসেন এগুলো তত্ত্বাবধায়ন করেন।
দোকানের সামনে কাস্টমারদের ভিড়ে ফুড পান্ডা, হাংরি নাকি-র ডেলিভারি বয়রা এসে দাঁড়ায়। তাদের গায়ের টি-শার্ট দেখে সহজেই তাদের চিনতে পারা যায়। কামাল বিরিয়ানির নিজস্ব কোনো পার্সেল সিস্টেম নেই।
খাবারের স্বাদ ও মান নিয়ে ফুডপান্ডার একজন পার্সেলবয় জানায়, "মোহাম্মদপুর ও তার আশেপাশে ফুডপান্ডায় বিরিয়ানি অর্ডার দিয়ে যারা খান তাদের অনেকেই জানে না কামাল বিরিয়ানি থেকে তাদের খাবার সরবরাহ করা হয়। কাস্টমারের রিভিউ ভালো। লকডাউনের মাঝে অর্ডার বেড়েছিল। এখনও ভালোই চলছে।"
খাবারের স্বাদের কথা ওঠায় আবার বাবুর্চিখানায় ফিরতে হচ্ছে। বাবুর্চিখানার কর্মীদের কাছ থেকে মজার কিছু তথ্য জানা গিয়েছে। যেমনঃ মশলা ব্লেন্ডারে না কুটে শিলপাটায় কোটা হয়। ব্লেন্ডারে মশলা কুটলে স্বাদ খানিকটা নষ্ট হয়। বিরিয়ানি জ্বাল দেওয়া হয় খড়ি দিয়ে। গ্যাসে দিলে হুট করে জ্বাল শুরু হয়। ফলে মাংস ও মশলাপাতি কাঁচা থাকে। খড়ির জ্বাল গ্যাসের তুলনায় ধীরগতিতে হওয়ায় মাংস তুলনামূলক বেশি সিদ্ধ হয়।
কামাল বিরিয়ানি থেকে যেকোনো অনুষ্ঠানে রান্নার অর্ডার নেওয়া হয়। রান্না করতে গেলে কামাল হোসেন কয়লা নিয়ে যান সাথে করে। মজুরি ধরা হয় যতজন খাবে তার সংখ্যার ওপর। যেকোনো খাবার রান্না করলে একইভাবে হিসাব করা হয়। মাথাপিছু ৪০ টাকা করে চার্জ ধরা হয়। যাতায়াত, থাকা-খাওয়ার খরচ বাদে এটা ধরা হয়।
কিছুদিন আগেই কামাল হোসেন নরসিংদীতে একটি অনুষ্ঠানে রান্না করতে গিয়েছিলেন। সেখানে ৪০০০ লোকের খাবার রেঁধে তিনি ব্যাপক সুনাম কুড়িয়েছিলেন। তার টিমের কাজ ছিল শুধু রেঁধে দেওয়া। পরিবেশন করা ডেকোরেশন কোম্পানির কাজ।
কামাল বিরিয়ানিতে শুক্রবারে বেশি ভিড় থাকে। অন্যান্য দিনে দুপুর বারোটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত একনাগাড়ে বেচাকেনা হয়। বিকালের পরে বেচাকেনার গতি কিছুটা কমে আসে। আবার রাত আটটার পর থেকে বেচাকেনা তুমূলভাবে শুরু হয়। রাত বারোটা-একটা পর্যন্ত একভাবে বিক্রি হয়।
কামাল হোসেন দোকানের ব্যাপারে কয়েকটি সুখকর স্মৃতিচারণ করেন। সম্প্রতি এফডিসিতে হওয়া শিল্পী সমিতির নির্বাচনে তার দোকান থেকে খাবার সরবরাহ করা হয়েছিল। ইলিয়াস কাঞ্চন ও মিশা সওদাগর তার বিরিয়ানি খেয়ে প্রশংসা করেছিলেন; সে কথা আমাকে সানন্দে জানান।
একবার কাকতালীয়ভাবে 'ঢাকা লেডিস ক্লাব'-য়ে তার দোকান থেকে খাবার পাঠানো হয়। সেখানেও একইভাবে প্রশংসা লাভ করে কামাল বিরিয়ানি। কামাল বিরিয়ানি থেকে দেশের বাইরেও খাবার পাঠানো হয়েছে। একবার ঢাকার এক নামকরা প্রবাসী কামাল বিরিয়ানি থেকে ফ্রিজিং করে ইংল্যান্ডে বিরিয়ানি নিয়ে গিয়েছিল। তার সুবাদে সেখানেও কামাল বিরিয়ানির সুনাম ফোটে।
হোটেল কর্তৃপক্ষ থেকে শোনা গিয়েছে কামাল বিরিয়ানির সুনাম দেশ ছাপিয়ে ভারত, পাকিস্তান, আয়ারল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু কামাল বিরিয়ানি নয়, কামাল হোসেনের নামও বিখ্যাত হয়েছে। দেশগুলো থেকে কামাল হোসেনের কাছে বিরিয়ানি প্রেমিকদের টেলিফোন আসে।
কামাল বিরিয়ানি নিয়ে কামাল হোসেনের ভবিষ্যত পরিকল্পনা খুব উচ্চাভিলাষী ধরনের নয়। তিনি কামাল বিরিয়ানির শাখা খুলতে চান না। তার ভয় শাখা খুললে বা নামের স্বত্ব বিক্রি করলে কামাল বিরিয়ানির কোয়ালিটি নষ্ট হবে। তিনি প্রায়ই এ ধরনের আবেদন নাকচ করে দেন।
তার ভাষায়, "আমি এ দোকানের মালিক না; মালিক খোদাতায়ালা। আমি এর সামান্য মহতাজ। বুড়া বয়সে বেশি কিছু চাওয়ার নাই। আমি কষ্ট করে যা শিখছি সেই শিক্ষাটা আমার সন্তানদের দিয়া যাইতে চাই। আমার পরে কামাল বিরিয়ানির মান তারা ধরে রাখবে।"