‘ভালোবাসার নারীকে পাশে না পেলে ছেড়ে দেব সব’—ক্ষমতা ছাড়ার আগে বলেছিলেন রাজা এডওয়ার্ড!
১৯৩৬ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে এক চরম সাংবিধানিক সংকট নেমে আসে রাজা অষ্টম এডওয়ার্ডের ক্ষমতা ত্যাগকে কেন্দ্র করে।
ঘটনার সূত্রপাত ঘটে, যখন এডওয়ার্ড ওয়্যালিস সিম্পসন নামের এক আমেরিকান নারীকে বিয়ে করতে চান। ওই আমেরিকান নারী বেশ সম্ভ্রান্ত হলেও, ইতঃপূর্বে একবার ডিভোর্স হয়েছিল তার। এবং রাজাকে বিয়ে করতে গেলে চলমান দ্বিতীয় বিয়ে থেকেও বেরিয়ে আসতে হতো তাকে। স্বভাবতই, রাজার পরিবারের কেউ মেনে নেয়নি এমন এক নারীকে তার বিয়ে করতে চাওয়ার মনস্কামনা।
এই বিয়ের বিরোধিতা করেছিল যুক্তরাজ্যের স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় সরকার থেকে শুরু করে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের সব রাজরাজড়ারাও। এই বিয়ে আটকানোর জন্য ধর্মীয়, আইনি ও রাজনৈতিক নানা বাধার অজুহাতও তোলা হয়। কারণ তখনকার দিনে কোনো ডিভোর্সি ব্যক্তি তার প্রাক্তন স্বামী বা স্ত্রীর জীবদ্দশায় চার্চে গিয়ে বিয়ে করতে পারত না। আর এডওয়ার্ড তো কোনভাবেই নয়, কেননা ব্রিটিশ রাজা হিসেবে তিনি ছিলেন চার্চ অব ইংল্যান্ডের আলঙ্কারিক প্রধান।
এই এতসব সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, এডওয়ার্ড একই সঙ্গে সিম্পসনকেও বিয়ে করবেন আবার ক্ষমতাও ধরে রাখবেন, তা হবে না। তাকে বেছে নিতে হবে যেকোনো একটি। শেষ পর্যন্ত এডওয়ার্ড প্রাধান্য দেন ভালোবাসাকেই। সিম্পসনের প্রতি প্রেমকে চূড়ান্ত পরিণতি দেওয়ার আশায় তিনি সিংহাসন ছাড়তেও দ্বিধা করেন না।
কীভাবে এডওয়ার্ড এই সিদ্ধান্ত পর্যন্ত পৌঁছান, তা জানা যায় যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্ট্যানলি বাল্ডউইনের বিবরণীতে। বাল্ডউইন জানান, ১৯৩৬ সালের ২০ অক্টোবর, মিসেস সিম্পসনের ডিভোর্সের শুনানির এক সপ্তাহ আগে, তিনি নিজেই তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর ১৬ নভেম্বর রাজা তাকে বলেন, "আমি মিসেস সিম্পসনকে বিয়ে করতে যাচ্ছি, এবং আমি চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছি।" ওই একই রাতেই রাজা কুইন মেরিকে, এবং পরে তার ভাইদেরও ব্যাপারটি অবগত করেন।
১৯৩৬ সালের ডিসেম্বরে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা ছাড়েন, এবং তার জায়গায় অধিষ্ঠিত হন তারই ভাই প্রিন্স অ্যালবার্ট (পরবর্তীতে ষষ্ঠ জর্জ)।
রাজক্ষমতা ছাড়ার পর এডওয়ার্ডকে দেওয়া হয় ডিউক অব উইন্ডসর খেতাব। ছয় মাস বাদেই তিনি সিম্পসনকে বিয়ে করে নেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ৩৫ বছর তারা একসঙ্গেই কাটান।
ক্ষমতা ছাড়ার আগে এক রেডিও বার্তায় এডওয়ার্ড তুলে ধরেন তার ক্ষমতা ত্যাগের নেপথ্যের কারণ। তিনি বলেন, "রাজা হিসেবে দায়িত্বের প্রচণ্ড বোঝা যেভাবে সামলানোর আশা আমি করেছিলাম, আমার ভালোবাসার নারীটির সাহায্য ও সমর্থন ছাড়া তা আমি করতে পারছি না।" এভাবেই, ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাওয়ার জন্য তিনি যে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতেও রাজি, কোনো রাখঢাক ছাড়াই প্রকাশ্যে তা বলে দেন এডওয়ার্ড।
এরপর সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে তার বিদায় ভাষণও দেন। সেখানে তিনি বলেন:
দীর্ঘদিন ধরে উদ্বেগের সঙ্গে চিন্তাভাবনার পর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সিংহাসন পরিত্যাগের। আমার বাবার মৃত্যুর পর আমি এই সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলাম। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, এবং এই সিদ্ধান্তেই আমি অনড় থাকব।
এই সিদ্ধান্তের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ঠিক কতটা, তা আমি বুঝতে পারছি। এখন আমার শুধু এটুকুই আশা থাকবে, আমার দেশের মানুষ যেন বুঝতে পারে কেন আমি এমন একটি সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।
এই মুহূর্তে আমি আমার ব্যক্তিগত অনুভূতিতে ঢুকব না। তবে আমি প্রার্থনা করব সবাই যেন মনে রাখে যে একজন রাজার কাঁধে চাপের বোঝা ঠিক কতটা ভারি হয়।
আমি এই চাপের বোঝা আর বয়ে বেড়াতে পারছি না। আমি যদি কাজ চালিয়ে যাই তবে তা দক্ষতার সঙ্গে বা নিজের সন্তুষ্টির মাত্রা অনুযায়ী করতে পারব না। কিন্তু আমি মনে করি, এই ঘোষণার মাধ্যমে আমি আমার জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বে অবহেলা করছি না।
আমি নিয়মমাফিক আজ সকালে আমার ক্ষমতা পরিত্যাগের আনুষ্ঠানিকতাগুলো সম্পন্ন করেছি। সে অংশটি নিম্নরূপ:-
আমি, গ্রেট ব্রিটেন, আয়ারল্যান্ড এবং সমুদ্রের ওপারের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যসমূহের রাজা এবং ভারতের সম্রাট অষ্টম এডওয়ার্ড, ঘোষণা দিচ্ছি যে আমি নিজের ও আমার বংশধরদের ক্ষমতার উত্তরাধিকার পরিত্যাগ করছি। আমি চাই, এটি যেন তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয়।
আজ, ১৯৩৬ সালের দশম দিনে, আমি এই নথিতে নিজের স্বাক্ষর দিচ্ছি। এখানে অন্যান্য সাক্ষীরাও উপস্থিত রয়েছেন, যাদের স্বাক্ষরও সংযুক্ত করা হচ্ছে।
(স্বাক্ষরকৃত) এডওয়ার্ড আর আই
আমার ক্ষমতা পরিত্যাগের এই ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন আমার তিন ভাই -- ডিউক অব ইয়র্ক, ডিউক অব গ্লুস্টার, এবং ডিউক অব কেন্ট।
সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য আমাকে যেসব অনুরোধ জানানো হয়েছে, আমি সেগুলোর জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে আমি সেসব অনুরোধের ব্যাপারে সময় নিয়ে ভেবে দেখেছি।
কিন্তু আমি আমার মনস্থির করে ফেলেছি। আর যদি দেরি করি, তাতে প্রিন্স অব ওয়েলস ও রাজা হিসেবে আমি যাদের জন্য কাজ করেছি, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু আমি মন থেকে চাই যেন ভবিষ্যতে তাদের জীবনে উত্তরোত্তর সুখ-সমৃদ্ধির আগমন ঘটে।
আমি এই আত্মবিশ্বাস ও আশাবাদের সঙ্গে তাদের থেকে বিদায় নিচ্ছি যে আমার নেওয়া সিদ্ধান্ত সিংহাসন ও সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা এবং আমার জনগণের সুখের জন্য মঙ্গলই বয়ে আনবে।
"আমার ক্ষমতায় আরোহণের পূর্বে ও পরে জনগণ যেভাবে আমাকে স্বাগত জানিয়েছে, সেজন্য আমি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। আমি জানি, তারা এভাবেই আমার উত্তরসূরীর জন্যও দুহাত বাড়িয়ে দেবে।
আমি এ ব্যাপারটি নিয়েই সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন যে আমার ক্ষমতা পরিত্যাগের আনুষ্ঠানিকতায় আর একদমই কালবিলম্ব করা উচিত হবে না, এবং প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থাই অতিসত্ত্বর গ্রহণ করা হবে আমার আইনত উত্তরসূরী, আমার ভাই, রয়্যাল হাইনেস দ্য ডিউক অব ইয়র্কের সিংহাসনে অধিষ্ঠানের জন্য।
এডওয়ার্ড আর আই
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান