ভালোবাসার মানুষের হাত ধরার অনুভুতি কেন এত শক্তিশালী?
মানুষ তার প্রিয়জনের হাত ধরতে চায় কেন? এর পেছনের কারণটা কী? জৈবিক না-কি মনস্তাত্ত্বিক?
মানুষ বিভিন্ন কারণে অন্যের হাত ধরে। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো– বন্ধন এবং সংযোগের আকাঙ্ক্ষা। হাত ধরাকে স্নেহ এবং ভালোবাসার একটি অভিব্যক্তি হিসেবে দেখা হয়। ভালোবাসার মানুষের হাত ধরা মানসিক বন্ধনকে দৃঢ় করতে এবং একে অপরের মধ্যে রোমান্টিক সম্পর্কের অনুভূতিকে আরও ঘনিষ্ঠ করতে সাহায্য করে। শারীরিক এই অঙ্গভঙ্গি ঘনিষ্ঠতা এবং সংহতির অনুভূতি প্রকাশ করে।
২০২১ সালের চলচ্চিত্র 'আই নো হোয়াট ইউ ডিড লাস্ট সামার'-এ দেখা যায়, একটি হরর সিনেমা দেখার সময় স্বামী স্ত্রীর হাত ধরে রাখায় ভৌতিক দৃশ্য দেখার সময় তিনি অনেকটা শান্ত ছিলেন।
একটি গবেষণায় দেখে গেছে, প্রিয় মানুষের হাত ধরলে, তা আপনার শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার ওপরও গভীর প্রভাব ফেলে। এটি আপনার উচ্চ রক্তচাপ ও ব্যথা হ্রাস এবং মানসিক অবসাদ, হতাশাকে দূর করতে সাহায্য করে।
সঙ্গীর হাতের স্পর্শ আমাদের মস্তিষ্কের কেন্দ্রীয় স্বায়ত্তশাসিত স্নায়ুতন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সকল উদ্ভূত মানসিক চাপ ও পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করে।
ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ার ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এবং ভার্জিনিয়া অ্যাফেক্টিভ নিউরোসায়েন্স ল্যাবরেটরির পরিচালক জেমস কোয়ান বলেন, 'আপনি যদি সত্যিই হাত ধরার বিষয়টি বোঝেন, তাহলে বুঝতে পারবেন মানুষ হওয়ার মর্মার্থ। হাত ধরে রাখা একে অপরের প্রতি আমাদের বহুবিধ ভূমিকা এবং আবেগ প্রকাশ করে।'
হাত ধরে রাখার প্রভাবের পরীক্ষা
কোয়ান ও তার দল হাত ধরার প্রভাব নিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। প্রথমে ১৬ জন বিবাহিত নারীকে এমআরআই মেশিনে রেখে সহনশীল মাত্রায় বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার ভয় দেওয়া হয়েছিল। মস্তিষ্কের স্ক্যানে দেখা গেছে, এই নারীরা যখন কোনো অপরিচিত ব্যক্তির হাত ধরেন, তখন তা তাদের ভয়কে কিছুটা হ্রাস করে। কিন্তু এর প্রভাবটা আরও প্রকট হয় যখন তারা তাদের স্বামীর হাত ধরেন।
হাত ধরার প্রভাবের ক্ষেত্রে সম্পর্কের গুণমান ও স্থিতিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরীক্ষায় স্বামীর হাত ধরে রাখা বিবাহিত নারীরা সর্বোচ্চ ফলাফল পেয়েছেন। পরবর্তী গবেষণায় দেখা গেছে যে, বন্ধু কিংবা প্রেমিক-প্রেমিকার হাত ধরাও ভয় ও মানসিক চাপকে হ্রাস করতে সাহায্য করেছে।
কোয়ানের গবেষণার ফলাফল থেকে জানা যায়, হাত ধরা আসলে মস্তিষ্কের চাপ মোকাবিলার কাজকে সহজ করতে সহায়তা করে। সুতরাং আপনি যখন কোনো কঠিন সময়ে প্রিয়জনের হাত ধরেন, তখন আপনার মনে হয় আপনি তাদের সাথে আপনার বোঝা, অনুভূতি ভাগ করে নিচ্ছেন।
মানুষ হাত ধরে কেন?
পরীক্ষার সময় কোয়ান এবং তার দল আশা করেছিলেন যে, প্রিয়জনের হাত ধরে রাখলে তা প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের ক্রিয়াকলাপ বাড়াবে। ভয় বা উদ্বেগের মতো আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করবে। কিন্তু পরীক্ষায় তারা উলটো ফল খুঁজে পান, কিছুটা অবাক হন তারা।
পরীক্ষায় দেখা যায়, প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের ক্রিয়াকলাপ ছাড়াই মস্তিষ্কের সংবেদনশীল অঞ্চলগুলোতে ক্রিয়াকলাপ হ্রাস পায়।
এর কারণ কী হতে পারে?
প্রথমে কোয়ান বুঝতে পারছিলেন না, পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীরা যখন হাত ধরেছিল তখন মস্তিষ্কের ঠিক কোন অংশের জন্য তাদের ভয় ও মানসিক চাপ হ্রাস পেয়েছিল। উনার কাছে ব্যাপারটা ভেন্ডিং মেশিন থেকে কোনো টাকা ছাড়াই খাবার বের হওয়ার মতো।
পরে যদিও কোয়ান একটি নতুন উপসংহারে পৌঁছেছিলেন। তা হলো– আমাদের মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবেই অন্য মানুষের সাথে মানসিক সংযুক্তি বোধ করার প্রত্যাশা করে। তাই কারো হাত ধরাটা মস্তিষ্কের কাছে ভিন্ন ও একটু বিশেষ ভাবে উপলব্ধি করাটা অস্বাভাবিক কিছু না।
হাত ধরা তখন একা থাকার এই অনুভূতি সহজ করতে এবং আমাদের মস্তিষ্ককে একা থাকার প্রয়োজনে অতিরিক্ত প্রচেষ্টা করতে উদ্ধুব্ধ করে।
কোয়ান বলেন, 'আমাদের মস্তিষ্ককে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় এবং একা থাকা এই চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি।' তিনি তার এই তত্ত্বের নাম দেন 'সোশ্যাল বেসলাইন থিওরি'।
কোয়ান ব্যাখ্যা করেন, আমাদের মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবেই অন্যের ওপর নির্ভর করে এবং অন্য মানুষের সাথে সম্পর্কে তৈরি করতে চায়। এই সংযোগ ছাড়া, জীবনের নানান সমস্যা তখন তার পক্ষে মোকাবিলা করা আরও কঠিন হয়ে যায়, তাকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে আরও বেশি চেষ্টা করা লাগে।
মানুষের হাতের বৈচিত্র্য
আমাদের জন্মের মুহূর্ত থেকে শুরু করে আমরা কীভাবে বিশ্বের সাথে যোগাযোগ করি তাতে আমাদের হাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এমনকি একটি নবজাতকও, যখন ভালো দেখতে বা রং প্রক্রিয়া করতে পারি না, তখন তার হাত চারপাশের বিভিন্ন বস্তু থেকে সংবেদনশীল তথ্য অন্বেষণ এবং সংগ্রহে ব্যস্ত থাকে।
আমাদের দেহের একটি ছোট অংশ হওয়া সত্ত্বেও, আমাদের দুটি হাত স্নায়ুর একটি বিশাল অংশকে ধারণ করে। হাতে থাকা স্নায়ু মস্তিষ্কের অনুভূতির সংকেত পাঠায় এবং আমরা তা উপলব্ধি করি। এই স্নায়ুগুলো আমাদের বিভিন্ন সংবেদনের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে সহায়তা করে, যেমন একটি গরম মাফিন কেকের উষ্ণতা, কুকুরছানার পশমের কোমলতা বা বৃষ্টির ফোঁটার শীতলতা।
একজন অন্ধ ব্যক্তি আঙুলের অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ব্রেইল পড়তে সক্ষম হন। শুধু এটি নয়, আমাদের হাতের তালু এবং আঙ্গুলের ডগায় থাকা মেইসনার কর্পাসকেলস নামক বিশেষ স্নায়ুগুলোর কারণে ১০ মিলিমিটার থেকেও কম আকারের বস্তুর স্পর্শ নির্ভুলতার সাথে উপলব্ধি করতে পারি আমরা।
এছাড়া, হাত থেকে কিছু পিছলে পড়ে যেতে চাইলেও আমাদের হাতের মুঠো দ্রুত তা ধরে ফেলে।
আঙুলের স্পর্শ কেবল তথ্য সংগ্রহের নয়, এটি যোগাযোগেরও একটি মাধ্যম।
২০০৯ সালের একটি গবেষণায় ১২৪ জোড়া ব্যক্তিকে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল– জোড়ার একজনকে চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল এবং দ্বিতীয়জনকে কেবল স্পর্শ ব্যবহার করে অন্যের কাছে আবেগ প্রকাশ করতে বলা হয়েছিল।
দ্বিতীয়জন অন্য ব্যক্তির কথা না শুনে বা না দেখেই কৃতজ্ঞতা, ঘৃণা, সুখ এবং ভয়ের মতো আবেগগুলো শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল।
এছাড়া, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা মুখ না দেখে কেবল হাতের দিকে তাকিয়ে অন্য ব্যক্তির আবেগ সঠিকভাবে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল।
করোনা মহামারির সময় যখন সংক্রামিত হওয়ার ভয়ে সবাই একে অপরের সাথে হাত মেলানো থেকে দূরে থাকছিল তখন সবাই-ই জানিয়েছিল হাত না মেলানোর কারণে তারা যোগাযোগে অপূর্ণতা অনুভব করেছিলেন।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন