টিকটকও চার্লি চ্যাপলিনের!
চার্লি চ্যাপলিন নামটি শুনলেই হাস্যকর মূকাভিনয় করা এক অভিনেতার কথা মনে পরে। চার্লির নাম না জানলেও তার ব্যবহৃত টুপি, বেত, গোঁফ দেখেই বেশিরভাগ মানুষ চিনে ফেলে ইতিহাস-বিখ্যাত এই অভিনেতাকে। বিশ শতকে চার্লির অনেক চলচ্চিত্রই ছিল ব্যাপক ব্যবসা সফল। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে বিখ্যাত এই অভিনেতাকে পাদপ্রদীপের কেন্দ্র থেকে সরে যেতে হয়। শুধু তাই নয়, তাকে আমেরিকা থেকে আজীবনের জন্য বিতারিত পর্যন্ত করা হয়েছিল।
চার্লি চ্যাপলিনের অভিনয় জীবন আমেরিকার বুকেই শুরু হয়। তখন আমেরিকাসহ সারাবিশ্বেই তার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। তারপরও কেন এই অসামান্য অভিনেতাকে মার্কিন সরকার বর্জন করেছিল ? কেনই চার্লিকে স্বেচ্ছা-নির্বাসন নিতে হয়েছিল 'লেক জেনেভা' দ্বীপে?
আসলে সেজন্য দায়ী বিংশ শতকের রাজনৈতিক অস্থিরতা। বিশ্বজুড়ে বাড়ছিল পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ছায়া। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় ক্ষমতা দখল করেই ফেলে বলশেভিক সমাজতন্ত্রীরা। এই বিপ্লবকে পশ্চিমা দুনিয়া সরাসরি হুমকি হিসেবেই নেয়। সেই সময়ে অনেকে ধারণা করে কমিউনিস্টদের প্রতি চ্যাপলিনের ছিল নীরব সমর্থন।
চ্যাপলিন ১৯২১ সালে তার জন্মভূমি লন্ডনে সফর করলে সেখানেও রাজনৈতিক বিষয়ে তার অবস্থান জানতে চাওয়া হয়। সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করে 'আপনি কি একজন বলশেভিক'। লেনিন সম্পর্কে তার মতামত, ভাবনা এইসবও জানতে চাওয়া হয়। চ্যাপলিন বলশেভিক মতবাদে বিশ্বাসী কিনা- ছুঁড়ে দেওয়া হয় এমন প্রশ্নও।
সেবারই শেষ নয়; ১৯৫২ সালে চার্লিকে আবার এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু এবার আরও চাপের মুখে পড়তে হয় তাকে। কমিউনিস্টদের হয়ে আমেরিকায় প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। তার আগে ১৯৪০ সালে আমেরিকা যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়নি— তখন চ্যাপলিন 'দ্য গ্রেট ডিকটেটর' সিনেমায় কাজ করেন। যেখানে হিটলার চরিত্রকে ব্যাঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপন করা হয়। তখন আমেরিকার বুকে অনেকেই ছিলেন হিটলারের মতাদর্শে বিশ্বাসী। তারা চার্লিকে সমাজতন্ত্রের ঝান্ডাবাহক হিসেবেই শত্রু জ্ঞান করলেন।
চ্যাপলিনের ওপর এ সন্দেহের তীর কখনোই উবে যায়নি। ২০২২ সালে যদি এই ঘটনা ঘটতো তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায় চ্যাপলিনকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার ব্যাপক ঝড় বয়ে যেত। হয়তো তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও অনেক কাঁদা ছোড়াছুঁড়ি চলতো; যেমনটা এখন বিখ্যাতদের নিয়ে করতে দেখা যায়।
টিকটক ব্যবহারকারীদের এখন ভিডিওতে নানান মূকাভঙ্গি ও অঙ্গভঙ্গি করতে দেখা যায়- এই ধারার প্রচলন অনেকটাই চার্লি চ্যাপলিনের হাত ধরেই এসেছে। তিনি ক্যামেরার সামনে এমনকি ক্যামেরা না থাকলেও মঞ্চে দর্শকদের দিকে চোখমুখের ভঙ্গি দিয়ে কৌতুকাভিনয় করতেন। ব্যক্তিগত জীবনে অনেক দুঃখ থাকলেও তিনি সবাইকে তার মূকাভিনয় দিয়ে হাসাতেন।
চ্যাপলিনের অভিনয় এখনো অগণিত দর্শকের হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে। এই ইতিহাসখ্যাত অভিনেতা তার কাজের মধ্য দিয়ে আমাদের মাঝে আজীবন বেঁচে থাকবেন। কিন্তু তার জনপ্রিয়তা এখন আগের থেকে যেন অনেকটা মলিন হওয়ার পথে; তাহলে কি আমরা তাকে দিন দিন হারিয়ে ফেলছি? আমরা কী সাম্যবাদের প্রতি তার সমর্থনকেও ভুলে যাব? আর সেখান থেকে বিশ্বের শিল্পী সমাজের শিক্ষণীয়ই বা কী হতে পারে?
- সূত্র: ফিন্যান্সিয়াল টাইমস